শ্রোডিংগারের বেড়ালের গল্প

 


শ্রোডিংগারের বেড়ালের গল্প জানেন তো? যে যুগপৎ জীবিত এবং মৃত? খুব বিখ্যাত থট-এক্সপেরিমেন্ট। একটা বাক্সে একটা (বেচারি) বেড়াল বন্দী, বেড়ালের সাথেই বাক্সের ভেতর একটি বিষভর্তি কাচের পাত্র, একটি তেজস্ক্রিয় পদার্থ, আর একটি গাইগার কাউন্টার। গাইগার কাউন্টার তেজস্ক্রিয় কণার বিকিরণ ডিটেক্ট করলেই ঐ কাচের পাত্র ভাঙবে, আর ভাঙলেই বেড়াল বেচারি ডেড, আর নৈলে নয়। কিন্তু বাক্স বন্ধ থাকা অবস্থায় আপনি বেড়াল-ও দেখতে পাচ্ছেন না, তেজস্ক্রিয় কণাও না। তার উপরে আরও মুশকিল - কোয়ান্টাম মেকানিক্স বলে একটি কণা এক-ই সাথে একাধিক স্টেটে থাকতে পারে, ডিকেইড এবং নন-ডিকেইড। আর যেহেতু বেড়ালের ভাগ্যও ঐ কণার সাথেই ওতপ্রোতভাবেই জড়িত, যতক্ষণ না বাক্স খুলছেন, বেড়াল এক-ই সাথে জীবিত এবং মৃত।

আন্দোলনের ফলে রাজ্যের সরকারি স্বাস্থ্য ব্যবস্থাও ঐ শ্রোডিংগার'স ক্যাটের মত। জীবিত এবং মৃত। একদিকে জুনিয়র ডাক্তার-রা বলেছেন সমস্ত পরিষেবাই অক্ষুণ্ণ, সিনিয়র ডাক্তার-রা রাতজেগে ডিউটি দিচ্ছেন ইত্যাদি প্রভৃতি। কেউ দিচ্ছেন না এমন নয়, সত্যিই কেউ না কেউ কোথাও না কোথাও লড়ে যাচ্ছেন। তবে সে কতটুকু? ইতোমধ্যে খবর বেরোচ্ছে ২৭ দিনে সাড়ে ছ'হাজার সার্জারি বাতিল। সাড়ে ছয় হাজার! আর খবর বেরোচ্ছে বেসরকারি হাসপাতালের ব্যাবসা বেড়েছে ৪০%। ভুয়ো? হবেও বা।

একজন প্রত্যক্ষদর্শীর অভিজ্ঞতা পড়লাম এইমাত্র, ভুয়ো নয় বলেই মনে হয়। একজন কাঠের মিস্ত্রীর স্ত্রী সংক্রমণ নিয়ে চিকিৎসা পাচ্ছেন না সরকারি হাসপাতালে, দিশেহারা হয়ে ঘুরছেন শহরের রাস্তায়, শেষে ডাক্তার না, অ্যাম্বুলেন্স চালকের বদান্যতায় ভর্তি এক জায়গায়। তাতেও শেষরক্ষা নেই। সেই উপায়হীন মানুষটি মারা যাচ্ছেন যে বেসরকারি হাসপাতালে তারা ২৪ ঘন্টা কাটার আগে ছুতোর পেশার স্বামীকে বিল ধরিয়ে দিচ্ছে ২৪,০০০ টাকার। অনুরোধ-উপরোধে ৫০০-১০০০ টাকার ডিসকাউন্ট। বিল অনাদায়ে 'বডি' বাজেয়াপ্ত, শেষমেশ পুলিশের হস্তক্ষেপ। সদ্গতি সিনেমার অন্তিম দৃশ্য মনে পড়ে যায়। তবে এই বেলায় কারুর কান্নার আওয়াজে কারুর ঘুম ভাঙবে এই আশঙ্কা কম।
কিন্তু নাঃ, এইসব ভয়ানক গল্প বললে আপনি চটিচাটা, তিনুর দালাল। অনলাইন বিপ্লবী মব আপনার মুণ্ডু চাইবে, গণধোলাইয়ের গ্যারান্টি-সহ। অতএব, আমরাও এইসব বলছি না। বলছি না তাইই না, ভাবতেও ভয় পাচ্ছি। প্রাণপণে সেন্সর করছি নিজেদের। কারণ, গণআন্দোলন চলছে। শুরু হয়ে গেছে রাতের কার্নিভ্যাল। কিছু পতঙ্গ মরবে না?

আসলে কি, দোষ তো মৃতপ্রায় পতঙ্গমানুষদের, দোষ উপায়হীন মানুষদের। এই কি একটা সময় অসুস্থ হওয়ার? যাও বা হলেন, দরকার ছিল চিকিৎসার আশা করার? দরকার ছিল মফস্বলের একটাই যে বড়ো রাস্তা সেই দিয়েই হাসপাতালে ছোটার? ছিচ্ছিক্কার! মাইরি আপনাদের ধিক্কার জানানোর ভাষা নেই।

তাই, এই বছর পুজোর কেনাকাটা, হাস্যোজ্জ্বল সেলফির মতই ক্রিটিক্যাল ইলনেস মুলতুবি রাখলে ভালো। না পারলেও চুপচাপ এইসব অপকর্ম বাড়িতে সেরে ফেলা উচিত। বিপ্লব দীর্ঘজীবী ও মেইনস্ট্রিম হোক, পারেসাবা বাসারকারে হোক, আর গরীব মানুষ হ্রস্বজীবী ও কোল্যাটারাল।

আশার কথা, কমরেড মীনাক্ষী মুখার্জী ঘোষণা করেছেন অবস্থান মঞ্চেই বিকল্প স্বাস্থ্য কেন্দ্র চালু হবে কাল (৬ সেপ্টেঃ) থেকে। অভয়া ক্লিনিক তো আগেই চালু। তবে, এরা যে কেন আবার কষ্ট করে এসব করছেন জানি না! স্বাস্থ্যব্যবস্থার পরিষেবা তো অক্ষুণ্ণ আছে। অক্ষুণ্ণ-ই যদি হবে তাহলে আর বিকল্প কেন? আর বিকল্প-ই যদি লাগে, তবে কী ক্ষুণ্ণ হচ্ছে আর কোথায়? এই যদি সেই বেড়াল হবে, তবে মাংস কই? আর এই যদি সেই মাংস হবে, তবে বেড়াল কই?

আসলে বেড়ালটি তো শ্রোডিংগারের। সে জীবিত না মৃত জানতে গেলে ঐ বাক্সটা খুলতে হবে। থট এক্সপেরিমেন্টের বিলাসিতা ছেড়ে দাঁড়াতে হবে সেই শোচনীয় পরিণামের মুখোমুখি। মেনে নিতে হবে ‘এখানে জীবন মানেই মৃত্যুযন্ত্রণা গিলে ফেলা’। সে সাহস আমাদের আর অবশিষ্ট নেই। আমার অন্ততঃ নেই।

সৈকত মিস্ত্রীর পোস্ট (প্রত্যক্ষদর্শীর অভিজ্ঞতা):
https://www.facebook.com/100003961093591/posts/3108673009274705/

Comments

Popular posts from this blog

কামাই

যে ভাষায় আমের নাম ...