Monday, December 5, 2016

নিকানো উঠোনে ঝরে রোদ


(বিধিসম্মত সতর্কীকরণঃ এই গল্পের সমস্ত ঘটনা কাল্পনিক, মনগড়া, আজগুবি এটসেটেরা। আসলে বাংলা মিডিয়ামের ছেলেরা আদৌ আমার মতন ল্যাদাভ্যারুস না, বরং অনেক স্মার্ট হয় ! কাউকে কাউকে দেখে, সত্যি বলছি, একচুলও বোঝা যায় না ! ঠিক তেমনি এটা যদিও তর্কের খাতিরে মেনেও নিই যে সব ট্যাঁশই ইংলিশ মিডিয়াম, আপনাকে-আমাকে আর মদন-মামাকে মানতেই হবে যে সব ইংলিশ মিডিয়াম-ই ট্যাঁশ নয়!)

আর না মোটেও লজ্জা-টজ্জা পাই না, বরং বিশ্বাস করি বাংলাভাষা আমার উত্তরাধিকার, অস্বস্তিকর জন্মদাগ নয় - তবে আলিমুদ্দিনও একদিনে 'জাঙ্গিয়া পড়েনি, আর কথাঞ্জলিও রাতারাতি লেখা হয়নি ! বাইরে যখন বৃষ্টি ছিলো, তখন অনেক পাতা এদিক ওদিক গাছ-গাছালি, কূট-কচালি, বাপের খ্যাদানি আর প্রেমের প্যাঁদানিতে ভরিয়েছিলাম আমরা ! জলে ভিজে, উইয়ে ধরে সব নষ্ট হয়ে যাওয়ার আগে দেখি যদি একটুও উদ্ধার করা যায় - এই শীতের মিঠেকড়া রোদ্দুরে আচারের বয়ামের পাশে অমনি কয়েকটা পাতা ! যেরকম পেলাম তেমনি রেখে দিলাম পাশাপাশি, কেমন?)



তেরোশত নদী শুধায় আমাকে, কোথা থেকে তুমি এলে ?
আমি তো এসেছি চর্যাপদের অক্ষরগুলো থেকে ...

তো সেটা কত সাল আমার মনে নেই, এটা মনে আছে যে কৃষ্ণমাচারি শ্রীকান্ত তখন ওপেন করতেন আর ক্যামন নাক-ফাক কুঁচকে এদিক-উদিক চার-ছয় হাঁকাতেন। এইসময়েই একদিন আমার বাবা এসে থার্ড আম্পায়ারের মতন আউট ঘোষণা করে জিজ্ঞেস করলেন, "সারাদিন যে হাঁ করে টিভি গিলছো, কি হবে বড় হয়ে?" আমিও সপাটে স্টেপ আউট করে বললাম, "ওই যে শ্রীকান্ত"! বাবা গম্ভীর গলায় বললেন, 'ম্যান অব দ্য ম্যাচের ইন্টারভিউটা দেখেছো? কির'ম সুন্দর ইংরেজি বলছে? পারবে?' আমি বিপদ বুঝে বললাম, 'ঠিকাছে, তা'লে কপিল দেব' ... বাবা কিয়ৎকাল রণে ভঙ্গ দিলেন বটে, কিন্তু আমি বুঝলাম সত্যি ঘোর বিপদ ... নিশীথস্যার বেত হাতে যে বঙ্গভঙ্গ আন্দোলন শুরু করেছেন, এ জীবনে তা বোধকরি আর ঘোচার নয় !

এখানে একটা কথা বলে রাখা দরকার, আমার বাবা নেহাৎ দিনে রেলে চাকরি আর রাতে ব্রাইয়োনিয়া-বেলাডোনা করে ইহজীবন কাটিয়ে দিলেন বটে, আসলে কিন্তু ওনার মধ্যে হাল্কা করে একটা ত্রিকালজ্ঞ ব্যাপার ছিলো, অন্ততঃ আমাকে নিয়ে - যখন যা ভয় পেতেন, মাস খানেকের মধ্যে 'ফলিবেই ফলিবে' !

এবারেও তার ব্যত্যয় হলো না ! নিশীথদা একগাদা ট্রান্সলেশান দিলেন পরীক্ষায়, আর আমিও তো বাংলার বাঘ ! কোসচেন দিলো, 'আমি রোজ ভাত খাই', আমি ভেবে দেখলাম eat বললে তো খাই মনেই হয়, কিন্তু এই যে আমি রোজ রোজ শুধুই ভাত-ই খাই, রোজ ম্যাগি নয়, রোজ বিরিয়ানি নয়, যেন অনন্তকাল ধরে সিসিফাসের পাথর তোলার মতন প্রতিবাদ না করে শুধুই ভাত-ই খেয়ে যাচ্ছি, সেটা কি শুধু eat বললে মেটে? নাঃ ! দীর্ঘশ্বাস ফেলে লিখে দিলাম 'I eats rice'!


খাতা বেরুলো যেদিন, দেখি ভদ্রলোক সবার উপরে আমারটা নিয়ে এসেছেন, ক্লাসে পড়ে শোনাবেন বলে ... পাক্কা পনেরো মিনিট নিশীথদা আর সেকশান-ডি হ্যাহ্যা করে হাসলো, আমিও মনে মনে বেশ পুলক অনুভব করলাম, কিন্তু বাড়ি ফিরে দেখি আবহাওয়া থমথমে, বাবার হাতে একটা লাল বই, রেন অ্যান্ড মার্টিন, আর চেয়ারে একজন পুরুষ্টু গোঁফওয়ালা নতুন মাস্টারমশাই !


মাস্টারমশাইয়ের জেদ ছিলো সাংঘাতিক, আমাকে তিনি দেখলেন যেন অমল দত্ত দেখছেন রেলিগেশানের মুখে মোহনবাগান ! কি-ই না করতেন, মাঝে মাঝে ইংরেজি কাগজ ঠুসে বলতেন পড়ে যাও একপাতা, আমিও নিকুচি করেছে বলে প্যারা-ফ্যারা উড়িয়ে কংগ্রেস-ডায়ানা-হাওয়ালা-আজহার সব একসাথে পড়ে যেতাম! মাঝে মাঝে পাশে তাকিয়ে দেখতাম দিদি হাসি চাপতে ইতিহাসের বইতে মুখ লুকোচ্ছে আর বাবার ভ্রূ শুয়োঁপোকা থেকে শুয়োঁপোকা-তর হচ্ছে ক্রমশঃ ...

রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ চলেছিলো বহুদিন, এবং কবে কি করে যে সেই মাস্টারমশাই শেষমেশ রণে ভঙ্গ দিয়ে পালালেন তা আর মনে নেই এক্কেবারেই, তবে শাপে বর হলো সত্যি - যাঁকে পেলাম, তাঁকে ইংরেজির টিচার বলা মানে রবীন্দ্রনাথকে ট্রাফিক পুলিশ বলা ! তিনি দেখলেন একে দিয়ে গ্রামার-ট্রামার হবে না, এর পাস্ট অতিশয় ইনডেফিনিট, ফিউচার ততোধিক টেন্স ! হাতে ধরিয়ে দিলেন দুটি বই, অস্কার ওয়াইল্ডের পিকচার অব ডোরিয়ান গ্রে আর টি এস ইলিয়টের কবিতাগুচ্ছ! ইংরেজি একফোঁটা বলতে বা দু-কলম লিখতে না পারলেও যে দিব্যি পড়ে মুগ্ধ হওয়া যায় ... সেটা সেই জানলাম !

বছর দেখতে দেখতে ঘুরে যায়, নরেন্দ্রপুরে ঢুকে দেখলাম, সব বই ইংরেজি হয়ে গেছে - ভয়ানক চাপ ! শুধু কেকুলের সাপ বুঝলে চলবে না, সে সাপ ছোটে না কি হাঁটে না, অন্ততঃ বাংলায় চাটে না ... একবার কেমিস্ট্রির ল্যাবে কি কান্ড, ঢুকে দেখি সারি সারি শিশিবোতল - গায়ে বড় বড় করে লেখা INFLAMMABLE ! এদিকে তো রেন অ্য্যান্ড মার্টিন গাঁতিয়েছি, in মানেই নঞর্থক ! এই যেমন ধরুন -

  • Incapable - আমার মতন অপদার্থ,
  • Inaudible - মিনমিনিয়ে কতা কয়, কেউ শুনতে পায় না,
  • Incurable - যা সারে না, শাহ্রুখখানের তোতলামো, আর আমার ক্যাবলামো,
  • Invisible - যা দেখা যায় না, গাঙ্গুলীর কভার ড্রাইভ !
  • Infallible - যা একবার উঠলে আর পড়ে না (এটার উপমা আর দিলাম না) ...

তো আমিও মনের আনন্দে ঠাউরে নিয়েছি, ইনফ্লেমেবল নিশ্চয়ই হিন্দু আত্মার মতন অদাহ্য - অক্লেদ্য কিছু একটা হবে, আমিও এটাসেটামিক্স করবো বলে দুটো বোতল হাতে নিয়ে পিছন ফিরেছি - দেখি দীনবন্ধু স্যার ভয়ার্ত দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে আছেন আমার দিকে !

এইবেলাই বুঝলাম, জানেন, যে জীবনে এমন কিছু পড়াই ভালো, যেখানে খুব বেশি ইঞ্জিরি না মাড়িয়ে পাতার পর গ্রীক লেটার আর চাউমিন সিম্বল দিয়ে ভরিয়ে দিলেও দিব্যি চলে যাবে ... টুক করে স্ট্যাটে চলে এলাম ... আই-এস-আই-তে বছর পাঁচেক আমার ইংরেজি ওই পিসি-র অমর কবিতার মতন,

"তোমার নাম? হ্যালো হাই / বাবার নাম? সি ইউ বাই!"

তখন বাংলা শুধুই রন্ধ্রে নয়, রক্তেও ! এক রোববার GRE দিয়েই ছুটতে ছুটতে আমি আর পানু চলে গেলাম খালাসিটোলায় ! হাফ ওপেন স্কাই ছাদের তলায় স্কুলবেঞ্চ পাতা, একদিকে বাংলা বিক্রি হচ্ছে ঢেলে, একদিকে মাছভাজা-আলুকাবলি, আর খালি বোতল ফেরৎ দিলে তিন টাকা সাতাত্তর পয়সা !

সে অন্ধকারে মাটির ভাঁড়ে প্রেম-অপ্রেম যেন গলে জল হয়ে এলো ! এক চুমুক দিয়েই দেখলাম বিকেলের আকাশে সবকটা মুখ মিলেমিশে একাকার হয়ে গেলো - হঠাৎ পানু বললে, ভেবে দ্যাখ জেডি, কমল্কুমার ক্লাসের ফাঁকে এসে এক পাত্তর ঢেলে গলা ভিজিয়ে নিচ্ছেন এককোণে, বা হয়তো তুষার রায় সদ্য লেখা কবিতাটা শোনাচ্ছেন শক্তি-সুনীলদের ! ফেরার সময় মনে আছে, ট্যাক্সিকাকুকে কিছুতেই মনে করে বলতে পারছি না কোথায় নামতে চাই, পানু অনেক কষ্টে বললো, নর্থ ক্যালকাটা !

জীবনটা চলে যাচ্ছিলো, দিব্যি চলেই যেতো, পাঁচ বছর যে আসলে ইনফিনিটি নয় সেটা কেউ বললেও বিশ্বাস করতাম না  - কিন্তু তাও, কলকাতা থেকে মুম্বাই, মুম্বাই থেকে আবার পালাতে পালাতে অর্ধেক পৃথিবী দূরে, দিন-রাতের অন্যদিকটায় !

'পড়ে রইলো যে, পড়েই থাকতো ... সে লেখা তুলবে বলে, 
কবি ডুবে মরে, কবি ভেসে যায় অলকানন্দা জলে ...'

বলেছিলাম এখন লজ্জা পাই না, তখন কিন্তু খুব হতো ... খু-উ-ব, বলে আর শেষ হওয়ার নয় সে গপ্পো -- একদিন সাবওয়ের কাউন্টারে দাঁড়িয়ে বলেই যাচ্ছি বাবা দুটো পেয়াঁজ আর লঙ্কা দে, ব্যাটা হাঁ করে তাকিয়ে আছে যেন অর্জুন বিশ্বরূপ দর্শন করছে ... আরেকদিন আবার হলে ঢুকে সবাইকে জিজ্ঞেস করছি ভাই লিফটটা কোনদিকে, তারা এমন ভাব করছে যেন আপনি শ্যালদা স্টেশানে পক্ষীরাজ ঘোড়া খুঁজতে বেরিয়েছেন ... অনেক কষ্টে একদিন ঘন্টা দেড়েক ধস্তাধস্তি করে এক ব্যাটাকে বানান করে বোঝালাম যে আমার জীবন ইন্টারনেট ছাড়া অচল, সে পরেরদিন দরজায় প্যাকেট রেখে পালিয়ে গেলো, উপরে নাম লেখা 'Jyoeis Daha' ..

তারপর তো কত-কত-দিন গড়িয়ে গেছে, দিকে দিগন্তরে বক্তিমে দিয়েছি, ছাত্রদের বুঝিয়েছি কোরিলেশান আসলে কজেশান নয়, কিন্তু ভেতরে ভেতরে একটা দুরুদুরু যায়নি পুরোপুরি - সেই প্রথমবার যখন আইনক্সে অ্যানাকোন্ডা দেখতে ঢুকে বুঝেছিলাম হলের সিনেমায় শালারা সাবটাইটেল দেয় না, আর নিতান্ত বাধ্য হয়েই শুধু লোপেজ দিদিকে দেখেই ফিরে এসেছিলাম - সেরকম অনেকটা ! এখনও আগে পুরো বাক্যটা মনে ভেবে নিই, তারপর ভাবি নিশীথস্যার ক্যালাবে, তারপর ট্রান্সলেট করি,  একটু হি-শি-হ্যাজ-হ্যাভ দেখে টেখে নিয়ে বলি - ভুল্টুলও কমে, লোকেও নির্ঘাৎ একটা গ্রাম্ভারি গেছোদাদা টাইপের কিছু একটা ভেবে নেয় !!

তবে হারাতে হারাতেও, ভেসে যেতে যেতেও, শ্যাওলা-খড়কুটো ধরে কি করে যেন একটু সেই খালাসিটোলার সন্ধ্যেটা রয়ে গেছে গ্লাসের তলায় লেগে ! অঙ্ক-টঙ্ক যেদিন নামে না, বা যেদিন খুব ইচ্ছে করে দাঁড়ে বসে ডানা ঝাপটাতে, সেদিন খাতা খুলে একটা বাতি জ্বালিয়ে বসি ... এক বন্ধুর দেওয়া ফাউন্টেন পেনটা যত্ন করে পরিষ্কার করে কালি ভরে একটু লিখি একটা সাদা পাতায় ... হয়তো একটা প্রিয় শব্দ, একটা আদরের নাম ... একটা চেনা কবিতা মাথায় আসে, গুনগুন করে,

' তবু সে এখনও মুখ 
দেখে চমকায়
এখনও সে মাটি পেলে 
প্রতিমা বানায়'

আস্তে আস্তে জটগুলো ছেড়ে যায় তখন ! এই বন্ধ পড়ার ঘরের ঘুলঘুলি আর আনাচ কানাচ দিয়ে কি করে যেন ক্যাট-ব্যাট-ডগ-ফিশ পেরিয়ে ঢুকে পড়ে একরাশ বাংলা ভাষা ! পরম মমতায় আমার হাতের আঙ্গুল ছুঁয়ে থাকে সে ... আমি আবার স্বপ্ন দেখি !

Saturday, November 19, 2016

তেজেনবাবুর গল্প


                                                                    <১>


তেজেনবাবুর মনমেজাজটা একদম-ই ভালো নেই আজ, এই শীতের সকালে গিন্নির তাড়া খেয়ে যাও বা বাজারে গেলেন, দু-একপিস রোগা ফুলকপির বাচ্চা আর জলডোবা পটল ছাড়া কিছুই পেলেন না, মাছের বাজারে ঢুকে মনে হলো সেদিন বেশী দূরে নেই যে মানুষ ব্যাগভর্তি পয়সা নিয়ে বেরুবে আর পকেটে ভরে বাজার নিয়ে বাড়ি ফিরবে, সামনের মাসে আবার বাবার বাৎসরিক, ভেবেই পেটটা একটু বকমবকম করে উঠলো যেন ! পৌনে একঘন্টা অকারণ দর-দাম করে একজোড়া বিষণ্ণ মাগুরমাছ আর পেয়াঁজকলি নিয়ে বাড়ির চৌকাঠ ডিঙ্গোতেই টের পেলেন টুবাই-টিকলু আবার পড়াশোনা থামিয়ে টিভিটা চালিয়েছে, আর পাশের বাড়ির অবিনাশবাবুও এই সক্কালবেলাই দাঁত মেজে দাদু-গেঞ্জি পরে চলে এসেছেন - চা খেয়ে, টেলিগ্রাফ পড়ে তারপর কালকের ম্যাচ আর কেন্দ্রীয় সরকারের বঞ্চনার বেত্তান্ত নিয়ে ঝাড়া একটি ঘন্টা এখন বরবাদ ... নাঃ, সকালগুলো বড্ড বিরক্তিকর লাগে আজকাল ...

গতকাল আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে একটা একটা করে ঝুলপি থেকে পাকা চুল কুচকুচ করে কাটছিলেন তেজেনবাবু, হঠাৎ খেয়াল করলেন আয়নার লোকটার দিকে - মনে হলো যেন ভুরু কুঁচকে থাকতে থাকতে কপালের মাঝখানটায় অল্প ভাঁজ-ই পড়ে গেছে, আর যাওয়ার নয় ... আয়না দিয়ে বসার ঘরের দেওয়ালে ঝোলা বাবার সেপিয়া-কালারের ছবিটাও ভালো করে ঠাহর করে দেখে নিলেন একবার। হ্যাঁ, সেই অব্যর্থ কূঞ্চন, কপালের মাঝখান বরাবর যেনো ইন্ডিয়ানা আর গন্ডোয়ানাল্যান্ডের ঠোকাঠুকি লেগে একটা আস্ত হিমালয় উঠছে, ঠিক তলায় এক জোড়া চোখ, ভিসুভিয়াসের থেকেও ভয়ঙ্কর... চোখগুলোর দিকে চেয়ে এই এগারো মাস পরেও বুকটা অল্প কেঁপে গেলো তেজেন্দ্রনারায়ণ বাবুর ... আবার কাঁচি-ঝুলপি তে মন দিলেন আবার।


টুবাইটা ঘর থেকে উঁকি মারলো একবার, খবরের কাগজটা নেওয়ার লোভে, আজকেই সিনেমার পাতাটা দেয় - বাবার থমথমে মুখ দেখেই আবার সুড়সুড় করে লেজ গুটিয়ে ঘরে ঢুকে গেলো। মাঝে মাঝে নিজের ছেলেদের দেখলে নিজের-ই অল্প আফশোস হয় আজকাল, চেয়েছিলেন কড়া ডিসিপ্লিনে ছেলেদুটো মানুষের মত মানুষ হবে, অঙ্ক করবে তো রামানুজন, ব্যাট হাতে মাঠে নামবে তো সেওয়াগ ... হলো তো ঘোড়ার ডিম, এ দুটোয় অঙ্ক করে সেওয়াগ আর ব্যাট করে যেন চোখ বুজে ত্রৈরাশিক কষছে। মাঝখান থেকে বাবার সাথে বন্ধুত্বটা হলো না কোনোদিন-ই ... এক-একদিন অফিস থেকে বেরুতে বেরুতে মনে হয় যাই বাড়ি ফিরে গল্প-গাছা করি, তারপর সেই সার্কুলার রেলের ভিড় আর মেট্রোর সামনে হনুমানের ল্যাজের মতো লম্বা লাইন পেরোতে পেরোতে কোথায় যে ইচ্ছেটা উবে যায় ...

অফিসের নেতাইবাবু রোজ-ই আসেন টিফিন-টাইমে, রেলে কাজ করেও ভদ্রলোক সাইড বিজনেস চালিয়ে যাচ্ছেন এই বয়সেও। সেই অ্যামওয়ের পিরামিড স্কিম, কে যে কার মাথায় ইঁট চাপাচ্ছে কেউ জানে না  - কেউ ডাকেও না তাকে, তাও এসে এই চেয়ার, ওই চেয়ার ঘুরে নিজেই খানিক বকবক করে যান রোজ ... আজও তেজেনবাবু চেয়ারটায় দোল খেতে খেতে ঝুলপিটায় হাত বোলাচ্ছিলেন লাঞ্চের পর, হঠাৎ দিগন্তে বত্রিশ পাটি ঝকঝক করে উঠলো দেখে বুঝলেন নেতাইবাবু ... ধপ করে চেয়ারটার নিজেকে ফেলে দিয়ে নেতাই বললেন,

" বুইলেন না মহায়, আপনার নামটাই কালপ্রিট ! তেজেন্দ্রনারায়ণ ! শুনলেই কেমন একটা ইয়ে হয় না?"
"আপনার তো কিছুই হয় বলে বোধ হচ্ছে না"
"আহা, আমি তো সাতঘাটের জল খাওয়া মানুষ, কিন্তু এই যে ডেঁপো বাচ্চারা, সারাক্ষণ তাস পিটছে, একবার আপনি করিডরটায় হেঁটে দেখুন গে, ওমনি আড্ডা থামিয়ে টকাটক এক্সেল খুলে বসবে"
"ভয় পায়, পেতেই পারে"
"ভয় না ভায়া, টেরর টেরর, লিফটে ওঠা-নামার সময় কাউকে দেখেছো কোনোদিন? দ্যাখোনি! তুমি ভায়া লিফটের দিকে হেঁটে গেলে আনকোরা জুনিয়র-রাও সাততলা সিঁড়ি বেয়ে নামে, জানো?"
"ধুর! যত্তসব ... ওরা চেনেই না আমাকে"
"সে আর চিনতে কি লাগে, তুমিই ভেবে বলো দিকি যার নাম তেজেন্দ্রনারায়ণ - সে লোকটা কোনোদিন তুড়ি মেরে শিস দিয়ে গান গেয়ে উঠবে, বা খুব আড্ডা মারবে রকে বসে?"

তেজেনবাবুর মনটা বড়োই খারাপ হয়ে গেলো - সবাই ভয় পায়, সব্বাই? কয়লাঘাটের রেলের অফিসের পাশেই মিলেনিয়াম পার্ক, জানলা দিয়ে অনেকক্ষণ সেইদিকেই তাকিয়ে থাকলেন - বাচ্চা-বাচ্চা ছেলেমেয়েরা স্কুল কেটে হাত ধরে ঘরে বেড়াচ্ছে, কি মজা ওদের ! তেজেন-ও কি ওইরকম-ই ছিলেন এককালে?

ছোটো ছেলে তিনি, চার ভাইবোনের মধ্যে - মা একটু বেশীই স্নেহ করতেন, আর বাবা পুষিয়ে দিতেন পিঠে কঞ্চির বাড়ি মেরে ... আর ভাইবোনগুলো বেশ প্রতিভাবান - বড়-দা ডাক্তার, মেজ-দাও দারুণ অঙ্ক কষতেন, এখন বাইরে, আর বড়দি-ও সেকালের ডাবল এম-এ, চাট্টিখানি কথা নয়, একটা নাকি ক্যাসেটও ছিলো, তিনি যদিও পৃথিবীর মায়া কাটিয়েছেন বাবার-ও আগেই - বাবা বলতেন "মেন্ডেলিয়ান জেনেটিকস, পেডিগ্রি, পেডিগ্রি, সবটাই পেডিগ্রি" ... তিনি ছিলেনও এক মহাপুরুষ - ছেলেবেলায় ফুটবল খেলেছেন তো এক্কেবারে ফার্স্ট ডিভিশান, পাহাড় চড়েছেন তো বেস ক্যাম্প, আবার নাকি নিজের লেখা বই-ও ছিলো একটা ... ছেলে হিসেবে তেজেন এক্কেবারেই ডাহা ফেল! গোদের ওপর বিষফোঁড়া - বাৎসরিকে বাবার উপর দুচার লাইন বলার জোয়াল-টাও তার কাঁধে ফেলে বড়দা গেছেন, মেজদার কাছে বেড়াতে ...

তেজেন-এর সত্যি বলতে পড়াশুনোয় একটুও মন ছিল না। দুপুরে সবাই ঘুমোলেই পকেটে গামছা নিয়ে পাশের পুকুর, বা কোনোদিন বাবার লুঙ্গি চুরি করে জামরুল গাছের ডগায় ... প্রেমে পড়ার পরে একটা ডায়রিতে কয়েক লাইন চেষ্টা করেছিলো সে, ভালো কিছু নামেনি, বাপের বাজখাঁই গলার আওয়াজে বোধহয় কাব্যলক্ষ্মী তাদের পাড়া দিয়ে যাননি খুব বেশীদিন ... তবে ফেল-ও সে করেনি কোনোদিন, সকাল নটার বনগাঁ লোকালে যেমন প্রত্যেক স্টেশানেই ঝুলতে ঝুলতেও ঠিক আরেকটা লোক উঠেই যায়, তেজেনও তেমনি বেতের বাড়ি খেতে খেতেই বছর বছর ডিঙিয়ে যেতো ক্লাসের গন্ডি ...

ট্যালেন্ট অবিশ্যি তার-ও একটা ছিলো বটে, সেটা হচ্ছে অনর্গল ঢপ মারা - কাজে এবং অকাজে। পরীক্ষায় পঁচিশ পেলে বাড়ি এসে বলতো হায়েস্ট উঠেছে সাতাশ, ছাতা হারিয়ে গেলে সটান বলে দিতো চোখের সামনে চুরি হয়ে গেলো ধরতে পারলাম না  ... এমনকি পাড়ার বুড়িপিসি যেই জিগ্যেস করতেন, 'তেজেন, মুদির দোকান চললি?' ... তেজেন না ভেবেই বেমালুম বলে দিতো, 'না পিসি, রেশনে লাইন দিতে' ...

যেখানে বাপের ভয়, সেখানে সন্দ হয় ... বাবাও ছিলেন একেবারে সত্যবাদী চরকা, থেকে থেকেই ধরা পড়ে যেতো মিথ্যে আর কপালে জুটতো বেধড়ক পিটুনি ... ভেবেই এই শীতের দুপুরে এসি ঘরে বসেও গেঞ্জির ভেতর হালকা ঘেমে উঠলেন তিনি, ফাইলটা বন্ধ করে বার দুয়েক পায়চারি করলেন গোটা অফিসটা - তারপর চারটে বাজতেই ফোন করলেন স্কুলের বন্ধু খ্যাঁদা-কে ! আজকে আর বাড়ি ফিরতে ইচ্ছে হলো না ছ'টার ভিড়ে মারামারি করে, একটু গল্পগাছা করে-ই ফিরবেন আজকে ...
                                            
                                                                    <২>

"কনস্টিপেশান, বুঝলি, কন্সটিপেশান", সিগারেট টাকে টোকা মেরে গঙ্গার হাওয়ার উড়িয়ে দিয়ে বললো খ্যাঁদা !
"রাক্ষসদেরও হয়? জানতাম না"
"না না, আমার না - এমনি বাঙালী জাতির ... ওই কনস্টিপেশানে ভুগেই গেলো, এই তুই যেমন"
"বাজে বকিস না তো... আমার আজ --"
"আঃ শোন না, এটা মেন্টাল ... এই যে তোর ভেতর যে আরেকটা তেজেন, তারও ইচ্ছে করে, বাইরে বেরুই, একটু আড়মোড়া ভেঙ্গে সন্ধ্যের হাওয়া খেয়ে বাড়ি ফিরি? তাকে যে গত চল্লিশটা বছর আটকেই রাখলি খাঁচায়, কিছু লাভ হলো? ... ভেবে দ্যাখ একবার !"

                                                                      <৩>

ফিরতে ফিরতে ন-টাই বেজে গেলো তেজেন্দ্রনারায়ণের । কয়েক-কাপ চা সিগারেট পেয়ে মনটা আজকে বেশ ফুরফুরা শরীফ বোধ হচ্ছে । গিন্নির নাক পুরো ব্লাডহাউন্ড, ঢুকতেই  হাত থেকে টিফিন বাক্স নিতে নিতে বললেন,
"এই যে বললে ছেড়ে দিয়েছো?"
"আর বলো না, লালগোলা লোকাল তো, কোনটা প্যাসেঞ্জার - কোনটা ভেন্ডার বোঝা যায় না, পাশের একটা দিলখুস-ওয়ালা যাচ্ছিলো, গোটা রাস্তাটা বিড়ি ফুঁকতে ফুঁকতে গেলো"

গিন্নিও জেরা থামিয়ে টুবাই-টিকলুকে পড়া ধরতে চলে গেলেন। তেজেন-বাবুর মনে হলো শোয়েব আখতারের বলে আলতো খোঁচা দিয়ে উইকেট-কিপার, স্লিপ গলে যেন একটা বাউন্ডারি মারলেন তিনি ... বসার ঘরে ঢুকেই দেখলেন আবার অবিনাশবাবু, সকালের পড়া কাগজটাই পড়ছেন আরেক রাউন্ড চা ধ্বংস করতে করতে,

"হেঁ হেঁ, খুব লেট যে আজকে, খুব খাটাচ্ছে না রেল কোম্পানি? তা আর নতুন লাইন তো আর পাতছে না বাবা, খাটায় কেনো কে জানে? ... আচ্ছা আমার ওই রিজার্ভেশানটা? পারলেন নাকি একটা ম্যানেজ করতে ... দাদা- বৌদিকে কিন্তু কথা দিয়েছি"
"নাঃ মশাই, টিকিটটা এবার হলো না আর বুঝলেন? আসল খবর তো আর পড়েন না, এদিকে আন্দামানে ভল্ক্যানো-টা জেগে উঠেছে আর পুরীর সমুদ্রে নাকি হাঙর বেরিয়েছে ! তা-ই এবার পুজোয় ঝেঁটিয়ে সব বাঙালী ডাল-লেক ... এতো আগে থেকে কেটে ফেলেছে যে এবার বাথরুমে আপার-বার্থ -লোয়ার বার্থ লাগাতে হবে, আপনি বরং মুকুটমণিপুরটা ট্রাই করে ফেলুন "

অবিনাশবাবুর চুপসে যাওয়া মুখটাকে দেখতে দেখতে এবার সত্যি তেজেনবাবুর মনে হলো একটু হাততালি দিয়ে নেচে নেবেন, যেনো স্টেপ আউট করে স্টুয়ার্ট ব্রডকে ছয় মারলেন গাঙ্গুলী ... অনেকদিন পরে একটা হিন্দি গানের লাইন-ও মাথায় কোন কুঠরি থেকে বেরিয়ে পড়লো, তেজেনবাবু ঠিক করলেন, নাঃ টুবাই-টিকলুকে আজকে আর অ্য্যালজেব্রা না করিয়ে গল্পই শোনাবেন বরং ... বাৎসরিকের স্পিচটারও আইডিয়া আসছে মাথায় !

                                                                           <৪>

"থ্যাঙ্ক ইউ, থ্যাঙ্ক ইউ ... অবিনাশবাবু এবারে একটু বসুন, এই টুবাই দেখতো কলিংবেল বাজালো কে? টিকলু মা-কে দেখো তো কি লাগবে? ...

আপনারা যে এতোসবের মধ্যেও এসেছেন ... কি বলবো, খুব-ই একটা আনন্দের ব্যাপার, বাবা বেঁচে থাকলে ... অবশ্য তিনি থাকলে কি আর বাৎসরিক করতাম ... যাই হোক, বাবাকে যাঁরা চেনেন অনেকদিন - তাঁরা তো সব-ই জানেন, তা-ও দু-চারটে কথা বলবো আজকে...

আমার বাবা, রাজেন্দ্রনারায়ণ, সারা জীবন ইস্কুলে পড়িয়েছেন, কিন্তু শুধুই মাস্টার ভাবলে ভুল হবে! আমার বাবা ছিলেন একাধারে অনেক, তিনি ছিলেন ফুটবলার, পর্বতারোহী, আবার রীতিমতো প্রকাশিত হওয়া লেখক-ও ...এক-ই অঙ্গে এতো রূপ যাকে বলে !

যখন ফুটবল খেলতে নেমেছেন, ভারতবর্ষ তখনও পরাধীনতার শৃঙ্খলে আবদ্ধ, বাবা বললেন, নেটিভ রেফারী না দিলে টিম মাঠেই নামবে না - তার সাহস ছিলো, ইংরেজ শাসক মেনে নিলো, আবার যখন পাহাড়ে চড়েছেন, মাইনাস টেন-এ পাহাড় চড়ে পৌঁছেছেন অন্নপূর্ণা বেসক্যাম্পে - সেখানে কত দেশের লোকের সাথে আলাপ ছিলো, পেন ফ্রেন্ড ছিলেন অনেক ফরেনারের ... সেসব চিঠি আছে এই বাড়ির-ই কোথাও !
ফিরে এসে বই-ও লিখেছেন চাকরি করতে করতে, কিন্তু লজ্জার কথা, সে বই পড়ার সৌভাগ্য আমার হয়নি ... জন্মের আগেই লাস্ট কপিটাও হারিয়ে গেছে কোথায় কেউ জানেনা ...

আমি সে তুলনায় নিতান্তই সাদামাটা ছাপোষা একজন কেরানী, কোনো দাগ-ই কাটতে পারিনি ... কিন্তু আশা রাখি বাবা, তার কাজের দৌলতে আপনাদের মনে চিরজাগরূক থাকুন"


                                                                       <৫>

পরের দিন সকালে ঘুম থেকে উঠতে দেরি-ই হলো একটু তেজেনবাবুর, বড্ড ধকল এক-একটা ফাংশান ! উঠে দেখলেন সকাল দশটা দশ, গিন্নি টুবাই-টিকলুকে নিয়ে কোচিং ক্লাসে চলে গেছেন - সত্যি বাচ্চাগুলোর রোববার বলেও কিছু নেই ! কিচেনে একটা উলটে রাখা প্লেট, চ্যাঙ্গারিতে জিলিপি রাখা, আর কাগজের ঠোঙ্গায় কচুরি ... এখনও একটু গরম আছে। প্লেটটা নিজে দিকে টানতেই দেখলেন, তলায় একটা ভাঁজ করা কাগজ - ফুলস্ক্যাপ পায়োনীয়ার খাতা, ধারটা একটু এবড়ো-খেবড়ো  হয়ে গেছে টেনে ছিঁড়তে গিয়ে ...

বাবা, 

গতকাল তুমি ক্লান্ত ছিলে, মা-ও... তাই চিঠিটা আজকে দিচ্ছি, নিশ্চয়ই কোচিং থেকে ফেরার আগে তোমার পড়া হয়ে যাবে, তা-ই এসেই বকুনি বা মার খাবো এটা জেনেই আজকে আর মন বসবে না পড়ায় ... 

দাদুভাইয়ের হাত কাঁপতো খুব জানো তো? তাই দুপুরে বাড়ি থাকলেই আমাদের ডেকে ডিক্টেশান দিতেন, ডায়রি লেখার জন্য, এক ঘন্টা টানা লিখে দিলে দশ দশটা টাকা! বলতেন আত্মজীবনী লিখছেন, তাই বানান-গ্রামার যেন একটুও ভুল না হয় ... তা-ও একটা দুটো হয়েই যেতো, কি করবো !

ডায়রিটা এখন সবসময় আমাদের স্কুল ব্যাগেই ঘোরে, আমরা টিফিন টাইমে আর ছুটির পরে ছোটবাড়ির ঠাকুরদালানে বসে পড়ি মাঝেমাঝেই, যেদিন খুব মনে পড়ে ... এখন প্রায় সবকটা পাতাই মুখস্ত হয়ে গেছে ... তাই তোমাকে না দেখেই বলতে পারি কবে কি হয়েছিলো !

ছোটোবেলায় খুব হাঁপানির টান ছিলো দাদুভাইয়ের, তাই টানা খেলতে পারতেন না ... তবে পায়ে নাকি দারুণ কাটাতে পারতো এদিক ওদিক, তাই রিজার্ভ বেঞ্চে বসতে হতো সব ম্যাচেই ... একটা বড় ম্যাচের ফাইনালে ডাক পেয়েছিলো, তবে খেলতে নয়, রেফারি আসেনি বলে দাদুভাই বাঁশি নিয়ে নেমে পড়েছিলো মাঠে, ভাবতে পারো? 

টিক্লুরও হাঁপানির টান, ওর-ও বেশী হাইটে যাওয়া কষ্ট, তবে ওর-ও খুব ইচ্ছে একদিন যাবে । দাদুভাইয়ের সকালের সেই গানটা আছে না, "পঙ্কে বদ্ধ করো করী, পঙ্গুরে লঙ্ঘাও গিরি"। আমাদের বলতেন পাহাড়ের মাথায় আজকাল নাকি সোজা হেলিকপ্টারেই যাওয়া যায়, একদিন নিশ্চয়ই সবাই মিলে গিয়ে দেখবো , তাই না বলো?

বইটা সত্যি ছিলো কিনা সেটা কিন্তু আমরা জানিনা, হয়তো ছিলো, সে গল্পটা আর ডিক্টেশানের সময় পাইনি... তবে ডায়রিটা র ভেতরে লেখা তোমাকে উৎসর্গ করে গেছে দাদু, আর মলাটের উপর নামটা কাঁপা কাঁপা হাতে লিখে গেছে নিজেই । 
আগে পড়তে পারিনি, কাল সন্ধ্যেয় গানটা শুনে চিনতে পারলামঃ 
"আমার শেষ পারানির কড়ি কন্ঠে নিলেম " ... 


ইতি,
টুবাই ও টিকলু 



Sunday, November 13, 2016

নানা রঙের দিনগুলি


শীতকালের ভোরবেলা, ধরুন সাড়ে চারটে কি বড়ো জোর পাঁচটা, আকাশে অন্ধকার একটু একটু করে ফিকে হয়ে আসছে, দু চারটে বাড়িতে আস্তে আস্তে একটা করে আলো যেন জ্বলে উঠেই আবার নিভে গেলো, ছেঁড়া স্বপ্নগুলো জানলা দিয়ে আস্তে আস্তে মিশে যাচ্ছে কলের শব্দ আর বাসনের আওয়াজের সাথে, এমনি সময় ঠাহর করলে দেখবেন, বনহুগলীর ঝিলের পাশে একটা গুমটি ঘরে আলো জ্বলে উঠলো, তাপসদা জল চাপালেন একটা স্টোভে, আর একটায় সসপ্যানে তেলের ছ্যাঁকছোঁক আওয়াজ ...

এতো সকালে যখন উঠেই পড়েছিস, ভিতরে চলে আয় ... একটা ফাঁকা জায়গা দেখে এইবেলা বসে পড়, আরেক রাউন্ড স্পেশাল চা এসেই যাবে এক্ষুনি, কোনটা যে কার কেউ জানে না, আর নেভি কাটের প্যাকেট তো অক্ষয় তূণ - খুঁজলে একটা আধটা সিগারেট ঠিক-ই পেয়ে যাবি (ছেড়ে দিয়েছিস? কদিন? নাকি ঘন্টা?) ... চল তোকে নতুন একটা স্ক্রিপ্ট পড়ে শোনাই ! স্পটলাইট তো কবেই নিভে গেছে, এইবেলা স্টেজে উঠলেই বা দোষ কি?

 আমাদের বাড়ির ঠিক পিছনেই এক-কালে দু-দুটো বিশাল পানাপুকুর ছিলো, তাদের একটার পাশে পাঁচিল দিয়ে ঘেরা একটা ছোট্ট জমি - আইনি মারপ্যাঁচে ফেঁসে গিয়ে যে দেশলাই বাক্স হতে হতে হয়ে গেলো আমাদের খেলার মাঠ, আদরের নাম "প্রবাহ" ... নামটা কে দিয়েছিলো আজ আর মনে পড়ে না, তবে তার দূরদৃষ্টি যে অসামান্য তা স্বীকার না করে উপায় নেই, Y2K ক্রমে আসতে আসতে যে কয়েকটা জিনিষ হারিয়ে যায় সবার অলক্ষ্যে, প্রবাহ তাদেরই একজন ... তো প্রবাহ যে শুধুই পুকুরে ফুটবল ফেলে আর একটা স্পেশাল বাড়ির অ্যাসবেস্টসের ছাদে ক্যাম্বিস বল তুলেই দিন কাটায় না, সেইটা প্রমাণ করার দরকার পড়লো অচিরেই - এক বিকেলে মাঠে গিয়ে দেখি ওমা উইকেটের জায়গায় মাদুর পাতা - পাশাপাশি দু-দুটো নাটকের রিহার্সাল, একটা তো সেই রবি ঠাকুরের "পেটে খেলে পিঠে সয়", আর একটায় বোধকরি একটা ভয়ের গল্প। ভয় মানে বেশ ভালো ভয় - একজন হাবাগোবা লোক মিউজিয়ামে ঢুকে হারিয়ে গেছে আর রাত্রে মূর্তিগুলো জেগে উঠে তাকে গলা-ফলা টিপে ধরে বীভৎস কান্ডকারখানা - তো আমারও প্রথম রোল ওই মোমের মূর্তি, ডায়লগ নেই, মুখেচোখে কুটিল এক্সপ্রেশানও নেই - খালি রুমাদি ইশারা করলে পা টিপে টিপে এগোও ... কিন্তু পানাপুকুরের পাশে মাঠ, মশা-রা কি আর নাইট্যশালা বোঝে? বার পাঁচেক কানমোলা খেয়ে বোধহয় নিরীহ গলায় কিঞ্চিৎ প্রতিবাদ করেছিলাম ... পরের তিন মাসে বুঝলাম, পেটে খাও বা না খাও, নাটক করলে পিঠে অনর্গল সইতেই হবে, না হলে তুমি বাদ ...

কিলে কাজ দিয়েছিলো, সেই কচি বয়সের পর বহুদিন রিহার্সাল শুনলেই চোঁচা দৌড় দিতাম যেন ব্রিগেডে টিয়ারগ্যাস পড়েছে - কিন্তু ওই ডেস্টিনি, কোথায় আর যাবে, একদিন টিফিনে স্কুলের পিছনের সেই ক্রিকেটের মাঠে ক্লাস টেনের দাদাদের কাছে একটা সুখটান দেবো বলে তীর্থের কাকের মতো বসে আছি ঝোপের ধারে, হঠাৎ শুনি কংক্রিটের পিচের উপর জলদ্গম্ভীর গলায় কে যেন চেঁচিয়ে উঠলো, "আর ভয় নাই, সুপ্ত সিংহ জেগেছে ! ভীমসা !!" ...

ঝোপের আড়াল থেকে বেরিয়ে দেখি স্টেজের উপর দুইটি বেচারা ছেলে প্রাণপণে গাঁতাচ্ছে, যেটা লম্বা সে সেজেছে প্রতাপ, আরেকটি বেশ নাদুস-নুদুস, সে শক্ত সিংহ ! তো খানিক ধরা পড়ার ভয়ে, আর বাকিটা ডি এল রয়ের ডায়লগে রক্ত গরম হয়ে, উঠেই পড়লাম স্টেজে - এদিকে বিধি কিন্তু সমানে বাম, যেন অ্য্যাডিলেডের মাঠে শচীনকে আউট করতে নেমে পড়েছেন ম্যাকগ্রা আর ড্যারিল হার্পার ... আমাকে যে রোলটা দিলো, সে একটা সভাকবি, ছেলেদের স্কুল তাই নাটকে কোনো নারী চরিত্রই নেই - অত্তগুলো ডায়লগ জলে যাবে, তাই ছাই ফেলতে ভাঙ্গা কুলো আমি - ইদিকে আবার রামকৃষ্ণর নামে স্কুল, প্রতাপের ভোকাল টনিকে সৈন্যদল উত্তেজিত হয়ে গান গাইবে, "ধাও ধাও সমরক্ষেত্রে", হঠাৎ স্বামীজি মহারাজ এসে বায়না জুড়ে বসলেন না ওইখানে "জয় রামকৃষ্ণ জয়তু' গানটা গাইতেই হবে ...

নাটক অবিশ্যি বিশাল হিট হলো, ডি এল রয়ের সেইসব জ্বালাময়ী ডায়লগ শুনে জনতা রেগে গেলেন, প্রতাপ আর শক্তের ঝগড়ায় চোখ ছলোছলো করলেন, এমনকি চেতক মারা যাওয়ার সময় যা কান্নার রোল উঠলো শুনে পেত্যয় যাবেন না যে স্টেজে ঘোড়াও ছিলো না, ঘাস-ও না ... আমি যে খুব ক্ল্যাপ পেলাম তা নয় - স্টেজের উপর সময় দু-মিনিট দুলে দুলে কি বলেছিলাম জানিনা, অটোয় করে ফেরার সময় মা বললেন, 'বাবা পরের বার আর একটু জোরে গলায় বলিস, কেমন'?

সেই যে শ্লা রোখ চেপে গেলো, গলা শুনিয়েই ছাড়বো সে আর যাওয়ার নয়, এ পাড়া, ও পাড়া, ইস্কুল-কলেজ যেখানেই দেখি ম্যারাপ বেঁধে নাটক হবো হবো ভাব, গিয়ে নাম লিখিয়ে দিই ... কিন্তু কপালের নাম গোপাল, গলা কেউ-ই শুনতে পাবে না বলে পার্মানেন্ট জায়গা স্টেজের পাশে, হাতে একতাড়া চোতা নিয়ে প্রম্পটার ... লাগুক না লাগুক, গোটা নাটক বিড়বিড় করে আউড়ে যাও - কার কবে গাঁত উল্টোবে সেই আশায় ...

উল্টালোও, তবে গাঁত নয় - শিশি ! পাড়ারই নাটক ছিলো হবে, হিরো আমাদের সমাজের উপরে ঘেন্নায় মিনিট পয়ঁতাল্লিশ চিল্লমিল্লে লাস্ট সিনে বিষ খাবে - সব ডায়লগ বলা শেষ, অডিয়েন্সে তখন রুমাল খোঁজার হিড়িক পড়েছে চাদ্দিকে - এমন সময় হিরো বুঝলো, পকেটে চোতা থাকলেও বিষের শিশিটা ফেলে এসেছে ড্রেসিং রুমে ... আবার না মরলেও চলে না, এ তো আর কোয়েন ব্রাদার্স নয়, যা হোক করে শেষ করে দিলেই হলো - হিরোর মাথায় বাল্ব জ্বলে উঠলো, গোটা একটা অডিয়েন্স হাঁ করে দেখলো প্রতিবিপ্লব কেমন নিজের গলা টিপে আঁকুপাঁকু করে নিজেই মরে গেলো ...

কলেজে এসে দেখলাম, নাটকের ছড়াছড়ি - বছরে দুটো কালচারাল ইভেন্ট, রিপলস আর স্পটলাইট ... স্পটলাইটে সব ব্যাচ-ই একটা করে নাটক নামায়, আমরাও লেগে গেলাম হইহই করে ... প্রথম বছর ঠিক হলো বিরিঞ্চিবাবা ... দিব্যি নেমেও গেলো সেটা ... আমার রোল ছিলো নিবারণদা, রুমমেট ছিলো সত্য আর বিরিঞ্চিবাবা আর তার শাগরেদ ব্যাচের দুজন বাঘা অ্যাক্টর ... রিহার্সাল চলছে, আমরা গল্প থেকে স্ক্রিনরাইটিং করছি ... এক জায়গায় আছে সত্য হাসি চাপতে মনে মনে কল্পনা করছে ট্রেনের কলিসান হয়েছে আর রক্তারক্তি কান্ড, এক সিনিয়র দাদা রিহার্সাল দেখতে এসে আইডিয়া দিলো, "এই সিনটায় সব্বাই সাদা চাদর মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়বি, যেনো হাসপাতালের বেডে শয়ে শয়ে মৃতদেহ ... আর একটা ছেলে এইসময় কালো টিশার্ট পরে ঘরের মধ্যে দিয়ে দৌড়ে চলে যাবে" ... আমরা তো এসব শুনে ট্যান,রুমমেটের চিরটা কাল-ই খুব সাহস, আমতা আমতা করে জিজ্ঞেস করলো, "আচ্ছা কালো টিশার্ট টা কিসের প্রতীক?" সিনিয়র দাদা গম্ভীর মুখে বললেন, "মৃত্যুর কালো হাওয়া" ...

তো ফি বছর একটা করে নাটক হতো, সব-ই মজার গল্প, সেকেন্ড ইয়ারের নাটক হলো 'পানু গোয়েন্দা আর উডি অ্যাসিস্টান্ট', সেটা যে ঠিক কি ছিলো, whodunnit না ভূতের গল্প এখন আর ভালো মনে পড়ে না ... তবে রিহার্সালগুলো ছিলো দারুণ আড্ডা ! কিছু কিছু লোক হয় না, অসম্ভব এন্থু, আর ততোধিক এনার্জি, যেনো ওবেলিক্সের মতন ছোটোবেলায় রেডবুলের চৌবাচ্চায়র পড়ে গেছিলো, তাই বড় হয়ে আর কিছু লাগে না- আমাদের ব্যাচেও ছিলো ! অর্ণব বরাট ! তাঁর মহিমাকীর্ত্তন করতে গেলে বই লেখা হয়ে যায়, তাও ধরুন এই আপনি সন্ধ্যেবেলায় ক্লান্ত শরীরে ভাবছেন, আহ একটা এগরোল, অমনি দেখবেন ম্যাজিকের মতন সামনে বরাট, হাতে একটি বোর্নভিল ... আমরা নিশ্চিৎ ছিলাম তার বরাটের আসল টাইটেল ভগবান, অথবা ঈশ্বরের ন-লক্ষ কোটি নাম থাকতে পারে, কিন্তু পদবী একটাই, বরাট !

পরের বছর আরেক কাঠি সরেস, টাইম মেশিনে করে ঝিলাম নদীর পারে, সেই আলেকজান্ডার আর পুরুর সময় ... নাটকের নাম "সত্য সেলুকাস", তাঁর স্ক্রিপ্টখানা ছিলো হীরক রাজার দেশের মতন, কবিতায় ঠাসা ... আর মধ্যে মধ্যে এল্ভিস-এর গান ... সেসব বড়ো সুখের সময় !

আরেক বছর বড় হলাম যখন, দেশে তখন আগুন জ্বলছে ! নন্দীগ্রাম আর সিঙ্গুরের ছবি দেখে শিউরে ওঠা তখন রুটিন ... কিছু একটা বলার ইচ্ছে গলা বেয়ে উঠে আসে কিন্তু বেরোতে পারছে না ... সে বছরে আমরা নাটক করলাম, নাম "ব্যাঙ্গমঙ্গল" ... সেই অ্যাবসার্ডিস্ট প্লট, রাজসভায় দুই রাজা, বুদ্ধু আর ভুতুম, তাদের বিপক্ষে এক ক্ষমতাময়ী দিদি আর তার চ্যালা বিব্রত, আর প্রোটাগনিস্ট - মার্স থেকে জমির লোভে এসে পড়া দুই অ্যালিয়েন, মঙ্গল আর পান্ডে ... এত কিছু থাকবে আর স্টার আনন্দ আসবে না, তাই হয়? ক্যারেক্টার তৈরী হলো সাংবাদিক কুমন দে ...

নাটক তখন আমাদের সবকিছু জুড়ে, কলেজ স্ট্রিটে গিয়ে হাতে পেলাম অজিতেশের অনুবাদ চেকভের পাঁচটি একাঙ্ক (অতীশ দাশগুপ্ত এক্ষুণি বকে দিয়ে বলবেন, ওটা চেকভ নয়, শেকভ!) ... আর টিউশনি করতে যাওয়া এক বাড়িতে একের পর এক দারুণ নাটকের বই ... এক সন্ধ্যায় মেসের বাইরে নোটিশ পড়লো, হইহই কান্ড, রইরই ব্যাপার, আ গিয়া ড্রামা ক্লাব ...

দারুণ শুরুয়াৎ হলো, সপ্তাহে সপ্তাহে মিনি ওয়ার্কশপ গোছের রিহার্সাল, নাটক ও চলছে, কিন্তু তার ডায়লগ কেউ মুখস্ত করবে না ... পরিস্থিতি বুঝে নিজেরাই লিখে নেবে নিজেদের সংলাপ ! গল্প সমানে তৈরী হতো, রিহার্সালের ভিতরে-বাইরে - আমরাও কোনো এক কোণে বসে মুহুর্তে মুহুর্তে লিখে ফেলতাম কত গল্প, আর রাত বাড়লে অ্য্যাশট্রে তে ছাইয়ের সঙ্গে তাদের ফেলে চলে যেতাম ছাদের মালপার্টিতে ... আমার এফ এম-এ শ্রীকান্ত আর ওল্ড মঙ্ক !

বীজ থেকে গাছ হতে লাগলো পাক্কা একটা গোটা বছর ! কলেজের জিওলজি অডিটোরিয়ামে একসাথে দু-দুটো নাটক নামলো সেবার, একটার নাম 'চেক-মেট' আরেকটা 'প্রস্তাব' ...

চেক-মেট আসলে ঠিক নাটক নয়, একটা পালানোর গল্প - হঠাৎ করে অনেকদিন আগে ফেলে, মাড়িয়ে আসে অতীত যদি সামনে এসে বলে 'বাবু দুটো পয়সা দে' ... কি করবেন সেই কলেজের অধ্যাপক? একটা ঠান্ডা নল, একটা দুর্বল মুহুর্ত  - আর এস্কেপ? নাহ, হাসালেন ...

উল্টোদিকে প্রস্তাব ছিলো দারুণ মজার, ওই অজিতেশের বই থেকেই ... মাত্র তিনজনের কাস্ট, প্রাণগোপাল, রমা, আর রমার বাবা - দুই জুনিয়র দুটো মেন রোল, আর রমার বাবা - আমার ক্লাসমেট এবং গ্লাসমেট... সিনে সিনে অডিটোরিয়াম ফেটে পড়ছে হাত্তালিতে ... কোনো বন্ধুর মুখ হয়তো একটু গোমড়া, অনস্ক্রিন আর অফস্ক্রিন ঘেঁটে যাচ্ছে থেকে থেকে, তবু বুকে পাথর রেখে সেও হাততালি দিয়ে যাচ্ছে সমানে ... সেই বছরেই শ্রুতিনাটক কম্পিটিশানে, দুই বন্ধু করে ফেললো অজিতেশের দু-দুটো একাঙ্ক, 'তামাকু সেবনের অপকারিতা' আর 'নানা রঙের দিনগুলি' ...

নাটক সিরিয়াস হোক বা মজার, রিহার্সালগুলো ছিলো খিল্লিবাজির ঠেক ... স্টেজেও কি কম হতো? চেকমেট হওয়ার সময়, উইংসের উপর থেকে আলো কন্ট্রোল করার কথা দুই বন্ধুর ... এদিকে এক সিনে ছিলো পাড়ার গুন্ডারা মূল চরিত্রকে মারধর করছে খুব, হঠাৎ দেখি উইংস ফেলে সব্বাই গিয়ে প্রোটাগনিস্টের প্রতিবাদী পাছায় দমাদ্দম লাথি ! পুষে রাখা রাগ, আর কি !

আই-এস-আইও এদিকে শেষ হয়ে আসছে, এই সময় একদিন বাবুদার দোকানে চা খেতে গিয়ে রাস্তায় দেখি একটা পুঁচকে বেড়াল, বেচারা-কে কাকে ঠোকরাচ্ছে খুব ... একটা পেপ্সির ক্রেটে তাকে ভরে নিয়েই চলে এলাম হোস্টেলে, নাম রাখা হলো ঘঞ্চু, ভালো নাম তেজেন্দ্রনারায়ণ বসু (কেন বসু তা বলতে গেলে ঝুলি থেকে যে আরও কটা বেড়াল বেরোবে কেউ জানেনা, তাই চেপে গেলাম) ...

ঘঞ্চু বলাই বাহুল্য একা এলো না, এলো অনেককে নিয়ে, যাঁরা বেড়াল ভালোবাসেন, যাঁরা বেড়ালকে যাঁরা ভালোবাসেন তাঁদের বড়োই ভালোবাসেন (অর্থাৎ সেকেন্ড অর্ডার পশুপ্রেমী) , যাঁদের বেড়াল দেখলে তিড়িতঙ্ক হয় কিন্তু তা-ও হৃদয় অবাধ্য ম্যাও ... অচিরেই দেখা গেলো সন্ধ্যে নামলেই আমার রুমে প্রচুর লোকের কিলবিল, আর আমরা সেই তাপসদার চায়ের আড্ডায় ! এই "আচ্ছে দিন"-এর জোয়ারেই হয়তো হবে বা, ড্রামা ক্লাব-ও হঠাৎ সুদিন ফিরে পেলো ... বিমলদা বললেন, টাকা নিয়ে ভাবিস না, একটা ড্রামা ফেস্ট শুরু করে ফ্যাল ! ব্যাস ! শুরু হয়ে গেলো প্রতিচ্ছবি ২০০৮ !

প্রতিচ্ছবির পোস্টার ব্যাপারটা বুঝতে পারছেন? সেই ছোট্টবেলায় সরস্বতী পুজোর নেমন্তন্ন নিয়ে রাজকুমারী যেতাম, সেই আর এই ... একদিন যাদবপুর, তো একদিন জেভিয়ার্স ... সকালে কৌশিক সেনের গ্রীন্রুম তো বিকেলে নান্দীকারের অফিসে স্বয়ং রুদ্রপ্রসাদ । একদিন আমি আর এক বন্ধু চলে গেলাম শান্তিনিকেতন, দারুণ একজন লোকের সাথে আলাপ হলো, তারক সেনগুপ্ত - বললেন সঙ্গীত ভবন তোতাকাহিনী নিয়ে আসবে । জেভিয়ার্সের দল এলো, যাদবপুরের-ও । প্রত্যেক রাত্রে তখন আম্রপালী-তে রিহার্সাল, সেই আম্রপালী - উৎপল দত্ত যেখানে মন্ত্রমুগ্ধ করে গেছেন দর্শকদের আমি জন্মানোরও আগে । ঝিঁঝিঁ ডাকা রাত্তির, স্টেজের উপর বলে-কয়ে একটামাত্র লাইট, আর শেষ না-হওয়া মঞ্চে আমরা কজন ...

শান্তিনিকেতন-এর দল যেদিন পৌঁছবে, তার আগের দিন তারকদা এসে দেখে গেলেন সব - আমরাও রেডি, চুয়ান্ন জন কলাকুশলী, তাঁদের রাখা হবে আইসেক-এর গেস্ট হাউসে, সব মেস-এ নোটিশ পৌছেঁ গেছে খাওয়া-দাওয়ার আয়োজন করার । আসার দিন সক্কালবেলা বাস যখন স্টেশন থেকে ফিরলো, দেখি সেই চুয়ান্ন জনের মধ্যে পঞ্চাশজন-ই শান্তিনিকেতনের ছাত্রী ...

সেদিন ক্যাম্পাসে যা হুড়োহুড়ি তেমন বুঝি বয়েজ হোস্টেলের ছাদে বোম ফাটলেও হতো না । সকালে হয়তো ভজমুরারীবাবু প্যান্টে শার্ট গুঁজে ক্যাম্পাস যাচ্ছিলেন হেলেদুলে, হঠাৎ একদঙ্গল মেয়ে দেখে ব্যাগ কাঁধেই মেসে গিয়ে তিনবাটি সম্বর খেয়ে, চারবার বোতলে জল ভরে ফেললেন । যে ছেলেটি জিন্দেগিতে ক্লাস ডুব মারেনি নোট না পাওয়ার ভয়ে, সে-ও দেখি কটিমাত্র বস্ত্রাবৃত ও যারপরনাই বলিপ্রদত্ত হয়ে ঘুরতে লাগলো সাউথ উইং-এর করিডরে ...

সেবার যে নাটক করেছিলাম, তার কথা আজ বরং থাক (সব কথা কি খুলে বলতে পারবো কোনোদিন?) শুধু এইটুকু বলা যায় সে নাটকের নাম ছিলো "সব চরিত্র কাল্পনিক নয়" (এবং না টুকি নি, আমাদের নাটক ঋতুপর্ণ বাবুর ছবির আগেই বেরিয়েছিলো) । আর নাটকের লাস্ট সিনে যে শিখাটা নিভে গিয়েও নিভলো না, সেটা আর যাই হোক, কাল্পনিক নয় । নাটক হিট করেছিলো জানেন? তবে অডিয়েন্স ডাহা ফেল ...

সেই যে সেদিন স্টেজ থেকে নামলাম, জানতাম না সেটাই শেষ স্পটলাইটের আলো । তারকদা নাটকের পরে যখন এসে বললেন, নাটক তো দারুণ হলো বাবা - কিন্তু এ তো শুধুই হতাশা, শুধুই অন্ধকার - এর থেকে উত্তরণ কোথায়? বলেছিলাম, সেও একদিন হবে তারকদা, আরো বড়ো হই !

তারপর ? তারপর যা হয়, তা-ই ... বড়ো হলাম, বুড়ো হলাম, কোথায় সেসব রিহার্সালের দিন, কোথায় সেই সব কুশীলব, যে যার পার্ট বুঝে নিয়ে, লাইন মুখস্ত করছে নিজের নিজের ঘরে বসে । স্পটলাইট নিভে যায় এইভাবেই, আমাদের অজান্তে । এক একদিন এখনো ঘুম ভেঙ্গে উঠে বসি ভোর চারটে, সাড়ে চারটেয় - বাথরুমের আলোটা হঠাৎ জ্বলে উঠলে মনে হয় যেনো উইংসের ধারে ভুল করে একটা দেড় হাজারের হ্যাজাক লাগিয়ে গেছে বাপ্পাদা । আবার সেই পুরোনো ভয়টা ফিরে আসে - নেক্সট উইকে স্টেজ রিহার্সাল আর এখনো একটা গোটা সিন লেখা বাকি ! এক একদিন বাড়ি ফেরার রাস্তায় ক্লান্ত পা টললে নিজেই নিজেকে বলে উঠি, "প্রে ডু নট মক মি, আই অ্যাম আ ফুলিশ, ফন্ড ওল্ড ম্যান" !

তাও সেই ভোরবেলায় জানলার কাঁচে কুয়াশার মতন লেগে থাকে দু-একটা ছেঁড়া স্বপ্ন ! সেই স্বপ্নের মধ্যে আমি হাঁটতে হাঁটতে চলে যাই আম্রপালীর মাঠটায় । দেখি খুব ভিড় হয়েছে, লোক দাঁড়িয়ে গেছে গেট পেরিয়ে ... স্টেজে সেই লাস্ট সিনটা হচ্ছে আর দেশলাইটা জ্বলেও জ্বলছে না । উইংসের ধারে কয়েকজন পায়চারি করছে কপালে ভাঁজ ফেলে, হাতের সিগারেট টা টানতে ভুলেই যাচ্ছে টেনশনে ...

আর একটু দূরে ভিড়ের মধ্যে আমি, মনে মনে ভেবে ফেলছি আরেকটা নাটকের প্লট ... এবার আর কলেজ ক্যাম্পাস না, একধাক্কায় গিরীশ মঞ্চ, পরেরবার অ্যাকাডেমি, বিশ্বাস কর !

Saturday, November 5, 2016

কলকাতা - ১০৩ !


এই হাল্কা হাল্কা শীতকালের সকালে যদি মর্নিং ওয়াক করতে করতে চলে যান জামরুলতলায় আমাদের সেই ছোট্টো ভাড়াবাড়িটায়, একদম কোনের ঘরটায় দেওয়ালে দেখতে পাবেন, অল্প-অল্প খসতে থাকা পলেস্তারার পাশ থেকে, শাহরুখ খান আর মধুবালার থেকে নিরাপদ দূরত্বে একটা ঢাউস বাঁধানো ছবি - আস্তে আস্তে ড্যাম্প ধরে ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে দিন কে দিন, ছবিটা মাটি থেকে দেখলে মাথামুন্ডু কিস্যু বোঝা যায় না, একটা ছাদে ইউনিফর্ম পরা গুচ্ছের লোকজন, লিট্যার‍্যালি-ই যাকে বলে 'দেড়শো খোকার কান্ড'। অত্যুৎসাহী দর্শকদের জন্য তলায় একটা লিস্টও দেওয়া, 'যে যেখানে দাঁড়িয়ে'। সেইটা না দেখলে বোঝা মুশকিল যে যাঁরা গাঁটের পয়সা খরচা করে এই বিশাল জিনিষটা টাঙ্গিয়ে রেখেছেন, তাঁদের পোলাপান-ও ওই ভিড়ের-ই অংশ ... কোথাও একটা পিছনের দিকে লুকিয়ে আছে, চট করে ধরা মুশকিল ...

সত্যি বলতে নরেন্দ্রপুর নিয়ে আমার দশা ওই ছবিটার মতন-ই, ঝাপসা, অন্ধকার, আস্তে আস্তে নামগুলো মুছে যাচ্ছে। তাও, হঠাৎ একটা রোববারের বিকেলে পুরোনো ছবি থেকে ধুলো ঝাড়তে কার না ভালো লাগে বলুন?

আজকের এই লেখাটা অনেকটা সঞ্জয় মঞ্জরেকারের কমেন্টারির মতন, ধরুন শচীন একটা দারুণ ইনিংস খেলে যখন আউট হয়ে গেলো আর অকর্মার ঢেঁকি বাকি তিনটে উইকেট মিলে সামান্য সতেরোটা রান-ও তুলতে পারলো না, অমনি ম্যাচের পরে স্যুট-টাই পরে এসে মঞ্জরেকার বলে বসলেন, 'আরেকটু চালিয়ে খেললেই পারতো'।
মনে মনে চার অক্ষর বলে টিভিটা অফ না করে দিয়ে কি ওয়েট করেছিলেন সেদিন? গ্রীক ট্রাজেডির মতন লাস্ট সিনে ম্যান অব দ্য ম্যাচটা তো শচীন-ই পাবেন আর পরের দিন হেডলাইনে বেরোবে, India snatched defeat from the jaws of victory. তাহলে সবুর করুন, মেওয়া না ফলুক, গবার ভবিষ্যৎবাণী অবিশ্যি ফলবে ...

নরেন্দ্রপুরে যাঁরা পদধূলি বা কোমল খুলি কোনো একটা বিলিয়ে গেছেন, তাঁদের কাছে আর ভেতরের বর্ণনা দেওয়া বাহুল্য, আর যাঁরা সেমুখো হননি এজীবনে, তাদের কাছে বলে শেষ করা যাবে না, তবু চেষ্টা করতে দোষ নেই - মেইন গেট দিয়ে ঢুকে ডাইনে-বায়েঁ-আর সিধে তিনদিকেই যাওয়া যায়।
যদি সোজা হাঁটেন, তাহলে কলেজ, স্কুল, একটা নালা, নালার উপরে ব্রিজ, এসব পেরিয়ে একের পর এক কলেজের হস্টেলঃ  ব্রম্ভানন্দ, গৌরাঙ্গ আর সবশেষে রামকৃষ্ণানন্দ, আমার নরেন্দ্রপুরের জীবন প্রায় পুরোটাই ওই "যে জন আছেন মাঝখানে" তার কাছেই. .. অর্থাৎ গৌরাঙ্গ ভবন এবং তার একতলা, দোতলা আর মধ্যিখানের চাতাল।

আর কিছু গল্প রয়েছে ঐ ডানদিকের রাস্তাটায় মিশে, যার আদরের নাম 'এক বিড়ি পথ' - সত্যি সত্যি রাস্তাটার এমুখে একটা বিড়ি ধরালে, ওমুখ অব্দি সে আপনার সঙ্গ দেবে, আর ঝড়বৃষ্টির রাতে সব আলো নিভে গেলে যদি ওই রাস্তায় পায়চারি করেন, বিড়ির সঙ্গে আরো কিছু, আরো কেউ ...
আমার বন্ধু সন্দীপ বলতো, ওকে নাকি রোপন-দা* বলেছেন, ওঁরা ঠিক পিছনে পিছনে আস্তে আস্তে হাঁটেন এই সব অন্ধকার রাত্রে। সবসময়েই মনে হয় এই বুঝি পেরিয়ে গেলো কেউ, হয়তো এক ঝটকায় পেছনে তাকালেই তিনিও চমকে যাবেন, কিন্তু তাকানোর সাহস আজ-ও হয়ে ওঠেনি, সত্যি ...

তো মাধ্যমিকের ছুটি ফুরোলো, আর উদভ্রান্ত সেই আদিম দিবসে হঠাৎ একদিন বগলে পুঁটলি নিয়ে পৌঁছে গেলাম হোস্টেলে, দেখলাম সে এক দুরন্ত জায়গা, এক-একটা ঘরে চারটে বিছানা, চারটে করে আলমারি আর অজস্র ইরোডভ, এইচ-সি-ভার্মা, দত্ত-পাল-চৌধুরীরা গড়াগড়ি খাচ্ছেন। কোনো কোনো ঘরে স্কুলের চোখা ছেলেরা দাপিয়ে শক্ত প্রব্লেম নামাচ্ছে, আর কয়েকটায় সদ্য বাড়ি ছেড়ে আসা ধেড়ে খোকারা হাপুস নয়নে কাঁদছে ...

এসব কান্নাকাটি আর আই-আই-টির ধাক্কা সামলে বুঝলাম, হঠাৎ লাইফ পালটে গেছে, যা আগের ষোলো বছরে ছিলো না, পরের ষোলোয় তো আরোই থাকবে না, সেই ডিসিপ্লিন এলো জীবনে। জীবন মানে তখন "চারিদিকে মোর একি কারাগার ঘোর" আর সকাল-বিকেল গগনবিদারী একটি করে ঢং - সেটা শুনে ধুতি-ফুতি সামলে কাকভোরে "খন্ডণ ভব" করতে ছোটো, আর সন্ধ্যেয় মাইক্রোস্কোপিক মাছভাজা আর অড়হর ডাল খেতে। বিকেলে পাওয়া যেতো ধুলো বিস্কুট আর মাঝেসাঝে মুড়ি-ঘুগ্নি - সে আবার এমনি ঘুগ্নি নয়, কপাল খারাপ থাকলে তাতে শুধুই মান্ডেন মটরডাল, আর খুলে গেলে সে এক ভূমধ্যসাগর, এক সিনিয়র একবার পাতে একটা পোড়া বিড়ি পেয়ে খুব দুঃখ করে বলেছিলো, "আলাদা করে দিলে দুটোই খেতাম, একসাথে কেনো দিলেন দাদা?"

দাদা মানে অরুণদা, ভালো নাম আগা খাঁ, হপ্তায় একদিন মাংসের বাটি আর বুভুক্ষু জনতার মাঝে যিনি সাদা বেম্মচারীর ড্রেস পরে দাঁড়িয়ে বলবেন, 'কই, মন্ত্র দাও'**, তিনিই আগা। আগা আসলে অনেকটা জুজুর মতন, তফাৎ এই যে একটা বয়েসের পরে আর জুজুর ভয় লাগে না, আগা-র লাগে ...

আর ভয় লাগে কিছু সত্যদার থাপ্পড়ের, ওরেব্বাস সে কি জোর মাইরি লোকটার হাতে! আমাদের সময় নিয়ম ছিলো প্রেয়ারের সময় দেরি করে পৌঁছলে হয় রেকর্ডবুকে উঠে যাবে বা গার্জেন কল হবে, তো একদিন দেরি হচ্ছে দেখে যেই না উল্টোদিকে ফিরেছি, দেখি হোস্টেলের দিক থেকে কট্মট করে এগিয়ে আসছেন সত্যদা ... আমার স্থির বিশ্বাস সেইদিন ডানগালে ওই বিরাশি সিক্কার চড়টা খেয়ে যে মাথাটা কিঞ্চিৎ লেফট লিবেরাল হয়ে গেছিলো, আজ-ও পুরোপুরি সারেনি ...

সত্যদার সেকেন্ড-ইন-কম্যান্ড ছিলেন গবা মহারাজ, নরেন্দ্রপুরের গল্প হবে, গবা আসবেন না, এ যেন ইন্ডিয়া টিম ব্যাট করতে নামছে আর শচীন বললেন আজ গা-টা ম্যাজম্যাজ করছে, বা পুজোবার্ষিকী আনন্দমেলা বেরুলো, কিন্তু শীর্ষেন্দু মাইটোসিস আর মিয়োসিসের তফাৎ নিয়ে রচনা ফেঁদে বসলেন।
আমাদের এক সিনিয়র গুরুচন্ডালির ব্লগে লিখেছিলেন, স্বামী বিবেকানন্দের পরে সবথেকে বিখ্যাত সন্নিসী গবা, খুব একটা অত্যুক্তি নয় সেটা !

গবার নাম কেন গবা তা কেউ জানেনা, ওনার বয়েসও যে কি করে ওই এক জায়গায় গিয়ে আটকে গেছে, তা-ও না, ওই ইস্টার আইল্যান্ড বা বারমুডা ট্র্যায়াঙ্গলের মতোন। অনেকে বলে, ভগবানে র 'ভ' আর 'ন' কেটে গবার আবির্ভাব, তবে এর সত্যাসত্য যাচাই করা আমার সাহসের বাইরে ... তবে হ্যাঁ তিনি ফোক লিজেন্ডের মাথায় বাড়ি, তাঁর সব গল্প করতে গেলে অবশ্য এ লেখা আর শেষ হবে না, তবে দু-এক পিস না বললে বেম্মপাপ হবে, যদিও সবকটাই এদিক-ওদিক থেকে হাওয়ায় ভেসে আসা বা কুড়িয়ে পাওয়া, নিজের চোখে দেখা নয় !

নরেন্দ্রপুর একটু ঝড়বাদলা হলেই সব আলো নিভিয়ে এক্কেরে নিঝুমপুরী হয়ে যেতো, আর যেই আলো নিভতো হোস্টেলের ব্যালকনি থেকে শয়ে শয়ে পোলাপান কোরাসে চিল্লাতো, 'গবা আলো দে, গবা আলো দে' ... সে এক অতিপ্রাকৃত দৃশ্য ! এক সিনিয়রের গল্প শুনেছি, একবার নাকি আম্রিগার এক সিনেমা হলে আলো নিভে যাওয়ায় পুরোনো অভ্যেসে ভুল করে চিল্লে ফ্যালেন, 'গবা আলো দে' বলে, অমনি পিছন থেকে স্পষ্ট বাংলা গলায় ভেসে আসে, 'আমি নাইন্টি টু-এর ব্যাচ, আপনি?'

এমনও গপ্পো শুনেছি যে, গবার অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে নাকি একবার এইরকম-ই এক লোডশেডিং-এর রাতে মাথায় বালতি চাপা দিয়ে কয়েকজন দুষ্কৃতী ছাত্র দুই-ঘা কষায়, নিজের মুণ্ড বালতির তলায় তাই ছাত্রদের মুখ দেখতে না পেয়ে মহারাজ হুমকি দেন, যার বালতি তার কপালে টিসি নাচছে! বিধাতার কি পরিহাস, আলো এলে দেখা গেলো বালতিটাও গবার-ই ...

আর একবার নাকি এক জাপানী ভিজিটর নরেন্দ্রপুরে এসেছেন, তাঁকে লাঞ্চে আপ্যায়ণ করে খাওয়াতে নিয়ে গেলেন সত্যদা আর গবা, এটাসেটা খাওয়ার পর দই এলো। জাপানী অতিথি যাতে এই সুবর্ণ সুযোগ হাতাছাড়া না করেন তাই গবা মহারাজ দই নিয়ে যারপরনাই পীড়াপীড়ি শুরু করলেন - তাতে অতিথি খানিক উৎসাহ বোধ করে জিজ্ঞেস করেই ফেললেন জিনিষটি কি? গবা মুখ উজ্জ্বল করে বললেন, This is spoiled milk, বলেই বোধহয় অতিথির মুখের দিকে চেয়ে খেয়াল হলো হেব্বি ছড়িয়েছেন, তাই তড়িঘড়ি নিজেকে সামলে বললেন, 'না রে বাবা এটা Intentionally spoiled milk ..'

(যতই  মশকরা করি, এ ব্যাপারে আমার সত্যিই একটা গর্বের জায়গা আছে, গবা মহারাজ সন্নিসী হওয়ার আগে যে স্কুলে তরুণকান্তি দে হয়ে  দশ-দশটা বছর কাটিয়েছেন, আমিও সেই বরানগর মিশনের বাই-প্রোডাক্ট !)

আমাদের সময় ইলেভেন-টুয়েল্ভ ছিলো কলেজে, আর ক্লাস নিতেন হরেক রকমের মজার লোক, আর তাদের ডাকনামগুলোও দারুণ, HKC হয়ে গেলেন হিরণ্যকশিপু, আর BKS, বকাসুর ... আর কিছু ছিলেন বহুমুখী প্রতিভা, কেমিস্ট্রি ক্লাসে প্রথম দিন-ই এসে বেঞ্জিন রিং দেখিয়ে যিনি আমার বাপের নাম খগেন করে ছেড়ে দিলেন, একদিন লাইব্রেরীতে গিয়ে দেখি সেই সন্তোষ মাজীর একটা আস্ত কবিতার বই - বাংলা পড়াতেন দুইজনায়, গোবিন্দ-স্যার আর প্রণব-স্যার, অর্থাৎ পেনো ... পেনোস্যারেরও একটা গল্পের বই ছিলো, তাতে আবার দুষ্টু ছেলেরা হাল্কা উত্তেজক জায়গাগুলো আণ্ডারলাইন করে রাখতো, পরবর্তী প্রজন্মের জন্য ... বইটার নাম মনে পড়ে না, তবে তার একটা গল্পে অমর একটা স্লোগান ছিলো, সেইটে গেঁথে আছে ভিতরেঃ "নেশার খেয়ালে, মুতেছে দেওয়ালে' ...

অঙ্ক করাতেন বিজয় বেরা, পি এস এম আর ননী-দা, দারুণ লোকজন সব, শেষের জনের উপর সত্যি বলতে দশ নম্বরের নামকরণের সার্থকতা লিখে ফেলা যায় চাইলেই। বিজয়বাবু অসম্ভব ভালোমানুষ, আমরা ভুল করলে উনি-ই লজ্জা পেয়ে যেতেন, আর পিএসএম একেবারে যাকে বলে tour de force, শক্ত শক্ত অঙ্ক ওনাকে দেখলে চুপচাপ নিজেরাই QED লিখে বসে থাকতো ... আর ছিলেন ইংরেজী স্যার সতীপ্রসাদ মাইতি, নিশ্চিন্তে লাস্ট বেঞ্চে বসে ঢুলছি - হঠাৎ তুলে বললেন বানান করো তো ম্যানুএভর ... আমি তো ইদিকে বাংলা মিডিয়াম, প্যান্টে হেগে একশেষ ...

পাশ থেকে ছোট্ট চিরকুটে কোনো কোনোদিন চলে আসতো শক্ত বানানগুলো, কখনো পরীক্ষার হলে অরগ্যানিক কেমিস্ট্রির ফরমুলা, একবার অঙ্ক পরীক্ষায় বন্ধুকে একটা গোটা ইন্টিগ্রেশান দায়িত্ব নিয়ে টোকালাম, সে বেরিয়ে বললো, সব-ই বুঝলুম, খালি ওই পাশে চাউমিনের মতন কি একটা একেঁ গেলি সারা পাতা জুড়ে ওইটা বুঝিনি, বাকিটা দাঁড়ি-কমা শুদ্ধু টুকে দিয়েছি ...

কোনো-কোনোদিন পড়াশুনো মুলতুবি থাকতো, সে বিকেলগুলো বড়ো মায়াময় হতো, এক একদিন অনি বা সৌম্যর সাথে বসে কবিতা পড়তে পড়তে ভাবতাম প্রেম বোধহয় শঙ্খ ঘোষের কবিতা, হয়তো বিপ্লবও তাই - একদিন সন্দীপ এসে বলতো চল রাজপুরের কালিবাড়ি নিয়ে যাবো, সন্ধ্যে ছটায় আরতি হবে - একটা এইটুকুনি ছেলে ঢাক বাজায় আর তার আওয়াজ এক মাইল দূর থেকে স্পষ্ট শোনা যায় ...

একটা দারুণ বন্ধু ছিলো, শুভ্রকান্তি - অনেক অনেকদিন পরেও তার চিঠি আসতো আমার ঠিকানায়, সে লিখতো গরমকালে কেমনি দামোদর নদের জল শুকিয়ে গেলে হেঁটে হেঁটে পেরিয়ে যাওয়া যায়, আর আমিও লিখতাম তাকে, ঘোর বর্ষায় আমার বাড়ির পাড়াই কেমন দামোদর হয়ে যায়, আর বাবা কেমন সকালে উঠে ইঁট পেতে দেন যাতে ইস্কুলের জুতোটা না ভিজে যায় গলিটা পেরোতে গিয়ে ...

আমাদের ইস্ট উইং-এর একদম শুরুর ঘরটায় থাকতো অরিজিৎ আর দেবাঞ্জন, মাঝে মাঝে বসতো আড্ডা আর অন্তাক্ষরী - বানিয়ে টানিয়ে ভুজুং-ভাজুং দিয়ে গান মিলিয়ে দারুণ হতো ব্যাপারটা ... সেই একবার তো আমি, রবিরঞ্জন আর সুদীপ্ত একটা গান-কুইজ প্রায় জিতেই গেছিলাম, লাস্ট রাউন্ডে জিজ্ঞেস করলো বাংলাদেশের একটা আধুনিক গান গাও (নাঃ, আমার সোনার বাংলা গাইলে হবে না), তখন কোথায় আয়ুব বাচ্চু, কোথায় এল আর বি আর জেমস, আমরা তো হতাশ হয়ে পাস করে দিলাম - ওমা, পাশের টিম দেখি লজ্জাঘেন্নার মাথা খেয়ে শুরু করে দিলো আজগুবি একটা গান, 'সাতদিন এক হপ্তা, বারোদিনে মাস, তিনমাস পর এগজামেতে, টিচার দিলো বাঁশ' ... তুমুল আপত্তি সত্ত্বেও জাজদের সেইদিন মানতে হয়েছিলো, যে কোনো জিনিষের Existence disprove করা ভয়ানক কঠিন, সে নিরাকার ঈশ্বর -ই হোন বা বাংলাদেশী র‍্যাপ ...

ভয়ানক দুষ্টূ ছেলে ছিলো জ-বাবু (আসল নামটা চেপে গেলাম, সে এখন একটা সফল স্টার্ট-আপের সি-ই-ও), পেনো-গোবিন্দো তো এসেই তাকে বের করে দিতো, তাও জ-বাবু ঠিক টাইমে পৌঁছে যেতো ক্লাসে, এক একদিন আবার একগাছা জংলা ফুল থান ইঁট দিয়ে চাপা দিয়ে রাখতো স্যারের টেবিলে, "ভিতর থেকে" সরি বলবে বলে ... একদিন গোবিন্দো-স্যার ক্লাসে বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস পড়াচ্ছেন, হঠাৎ জ-বাবু সামনের বেঞ্চ থেকে বলে উঠলো, 'স্যার জয়েন্টের সাজেশান দিন' ... গোবিন্দ-দা হেব্বি খচে গিয়ে বল্লেন, 'হয় তুমি ক্লাসে থাকবে, নয় আমি', জ-বাবু সাজা শুনলো, আস্তে আস্তে উঠে ক্লাসের দিকে ফিরে বললো, 'তোরা তো শুনলি, স্যার বলেছেন, হয় স্যার থাকবেন, নয় আমি থাকবো, এবার তোরা বল, তোরা কি চাস?'

আরো কত্ত-কত্ত মজার গল্প, রাত কাত হয়ে যাবে লিখতে লিখতে, এই এতোদিন পরে লিখতে বসে নিজেই একচোট হেসে নিলাম সেসব ভেবে ভেবে, আর মনটাও বেশ ফুরফুরে হয়ে গেলো, মনে হলো যেনো শীতের ছুটি পড়েছে, সেই এক-বিড়ি পথটায় হাঁটছি পুরোনো বন্ধুদের সাথে, হাতে একটা ব্যাট আর ক্যাম্বিস বল, আর কদিন পরেই টেস্ট পরীক্ষা, তারপর জয়েন্ট, সব্বাই কে কোথায় ছিটকে যাবে কেউ জানে না, কিন্তু কিছুই যায় আসে না, আজকে জমিয়ে খেলা হবে, আর সন্ধ্যেবেলায় মহামায়াতলার দোকানটায় শেয়ার করে এগরোল, বা গড়িয়া মোড়ের রাঁদেভুতে গিয়ে তড়কা-রুটি।

একজন দুজন তবু পাশে থেকে যাবে, বড় ক্লান্ত হয়ে ব্যালকনিতে গিয়ে একটা সিগারেট ধরালেই জানি অরিজিতের একটা ফোন আসবে এক্ষুনি, বা ইনবক্সে অনির একটা সদ্য হাতে লেখা কবিতার ছবি এসে বলবে, 'আমার চিঠিটা কবে আসবে, হাবু?'

আমিও এসব ভাবতে ভাবতে, সেই স্মৃতিগুলোর সাথে আড্ডা মারতে মারতে ফিরে যাই সেই শীতের দুপুরগুলোয়, পা ছড়িয়ে বসি একটা পুরোনো পুকুরের পাড়ে, আর এই  রংলাগা রোদ্দুরটায় আমাদের কি যেন একটা হয়ে যায়!


Saturday, October 22, 2016

সেই ছিলো এক দিন আমাদের


আমার পুরো ছোটোবেলা জুড়েই বাড়িতে একটা দারুণ ব্ল্যাক-অ্য্যান্ড-হোয়াইট টিভি ছিলো, আপট্রন কোম্পানির - তার সঙ্গী ছিলো ছাদের উপর একটা নড়বড়ে অ্যান্টেনা, তাতে কাক-পায়রা একসাথে বসে পাড়া পাহারা দিতো, আর মা বলতেন বাইরে বাজ চমকালেই দৌড়ে গিয়ে টিভি অফ করে দিতে - বজ্রবিদ্যুত-সহ বৃষ্টি  না হলে ওই অ্য্যান্টেনা বেয়ে টিভিতে ঢুকে পড়বে যে কোনোদিন। সত্যি বলতে কোনোদিনই জানা হয়ে ওঠেনি, সত্যি ওর'ম হয় কিনা, তবে এখনো বাইরে বাজ-টাজ পড়লে অল্প-স্বল্প ভয় করে ওঠে।

আপট্রনের কৈবল্যপ্রাপ্তি আর কোনোদিনই হয়নি - শুধুই ডিডি ওয়ান, ডিডি টু আর মাঝে মাঝে টিভির কানটা আরো বেশ কয়েক ঘর মুলে দিলে ঝাপসা করে ডিডি থ্রি। আমাদের পাশের ঘর ভাড়াটেদের আবার বাংলাদেশের লাইন ছিলো, মাঝে মাঝে বিকেলের মলয় বাতাসে দুই অ্য্যান্টেনায় ঠোকাঠুকি লাগলে দিব্যি ঢাকার খবর শুনতে পেতাম, কিস্যু বুঝি আর না বুঝি - বেশ খানিকক্ষণ হাঁ করে দেখে নিতাম, এখন যেমন জুপিটারে নাসার পাঠানো প্রোবের তোলা ছবি দেখি অবাক বিস্ময়ে ...

ঠিক মাঝের ঘরে একটা মান্ধাতার আমলের পুরোনো টেবিল ছিলো, তার উপরে রামকৃষ্ণ-সারদা-বিবেকানন্দের ছবি আর দুটো সাদা ফুলদানির মাঝে জ্বলজ্বল করতো আমাদের আপ্ট্রন, মাথায় মায়ের বোনা নক্সা-করা কভার পরে। আর তার চিরসাথী ছিলো তাপসদা, পাড়ার বেকার যুবক, এদিক-ওদিক অ্যাপ্লাই করে বেড়ানোর ফাঁকে ফাঁকে পড়শিদের বাড়ি বাড়ি টিভি আর রেডিও সারাতো। মধ্যেমধ্যেই মাস ছয়েক কেঁপে কেঁপে, বাবার হাতের চড়-থাপ্পড় খেয়ে যেদিন আপট্রন দেহ রাখতো, আমার উপর হুকুম পড়তো - সারা পাড়া ঘুরে কোনো একটা রকের আড্ডা বা ক্যারমের বোর্ড থেকে তাপসদাকে ধরে আনা ! গাঁইগুঁই করতে করতে তাপসদা আসতো, সারাদিন লেগে থেকে সন্ধ্যে সাতটার খবরের ঠিক আগে টিভি আবার জেগে উঠতো কি করে যেন, তাপসদা কি কি চার অক্ষর বলতে বলতে রকের আডডায় ফিরতো তা জানিনা, তবে আমি ভাবতাম লোকটা নির্ঘাত ম্যাজিক জানে ... শেষের দিকে তাপসদা আর টিভি কেমন মায়ার বাঁধনে জড়িয়ে গেছিলো, বিকেলে ঘুরতে ঘুরতে তাপসদা চলে আসতো বাড়িতে, চা খেতে খেতে টিভির পেছন খুলে কিসব চিপ-ফিপ লাগিয়ে গায়ে-মাথায় হাত বুলিয়ে যেতো, পয়সাও নিতো কিনা কে জানে, সেদিন রাতে আপট্রনের আওয়াজে যেন একটু জোর পেতাম ...

প্রাইমারী থেকে সবে সেকেন্ডারি উঠলাম, বিকেলে বাড়ি ফিরতাম স্কুলে বকুনি-প্যাঁদানি খেয়ে, কোনো-কোনোদিন আবার খাতায় গার্জেন-কলের চোখরাঙানি - ফিরেই মেট্রো চ্যানেলে শুরু হতো সুপার-হিউম্যান সামুরাই, সে এক অন্য লেভেলের ফিউচারিস্টিক শো, কম্পিউটারের তার বেয়ে কিছু ইংলিশ মিডিয়ামে পড়া বাচ্চা গিয়ে ডাইনোরূপেণ সংস্থিতা ভাইরাসদের কেলিয়ে আসতো, আমার বাংলা মিডিয়ামের বিদ্যেয় তাদের কথাবার্তা বুঝতাম না, কিন্তু ক্যালাকেলি দেখতাম রসিয়ে-রসিয়ে ... গোগ্রাসে গিলতাম মহেশ ভাটের টার্নিং পয়েন্ট, আর মানেকা গান্ধীর শো 'হেডস অ্য্যান্ড টেলস', যার একটা এপিসোড দেখে প্রায় এক বছর নিরামিশাষী হয়ে গেছিলো সেই দশ-বারো বছরের আমি !

এসব হলো গিয়ে সেই শেষ নব্বুইয়ের কথা, তখনও জীবনে দফা ৩০২ আসেনি, ডেবোনেয়ার তখনও কীটসের কবিতার মধ্যে লালকালিতে দাগানো একটা শব্দ, যার মানেটা দিদিকে জিগ্যেস করে নিতে হবে একদিন - সেই সময় আমার জীবনে নিষিদ্ধ আনন্দের জানলা ওই ব্ল্যাক-অ্য্যান্ড-হোয়াইট আড়াই চ্যানেলের বোকাবাক্স। সেও এক রোমহর্ষক অ্য্যাডভেঞ্চারের গল্প। ওদিকে বিষ্যুদবার পৌনে আটটা বাজবো, বাজবো করছে - বাবা মুখের সামনে আনন্দবাজার বা লাইব্রেরী থেকে আনা শঙ্কু মহারাজের ভ্রমণকাহিনী ধরে একটার পর একটা সিগারেট টানছে আর মা রান্নাঘরে তিন-চারটে রোবিন্দোসঙ্গীত আর অতুল্প্রসাদী ম্যাশ-আপ করে একটা মেলোড্রামাটিক ভজন গাইতে গাইতে রুটি বেলছে, আমার আর দিদির তো আর বীজগণিতে মন নেই, চিত্রহারে নিশ্চয়ই এতক্ষণে আর্ধেক শেষ - এমনি সময় deuce ex machina-র মতন অব্যর্থ কলিং বেল, নিতাইকাকু ওষুধ নিতে এসেছে - অর্থাৎ বাবার থাবা মিনিট দশেকের জন্য অন্য কোথাও, অন্য কোনোখানে - সত্যি বলছি, ঐ যে শেষ হতে হতে, কোনোরকমে ভল্যুমটা আস্তে করে লাস্ট দুটো গান শুনে নেওয়ার যে তৃপ্তি, টাকা দিয়ে কনসার্টে গিয়েও পাইনি আর কোনোদিন ...

বাবা ঠিক করে দিতেন কোনগুলো বাচ্চাদের উপযুক্ত শো, আর কোনগুলো এক্কেরে নৈব-নৈব চ, যেমন ধরুন আপনি রোববার সক্কালে টিভি খুলে বসে গেলেন, টেলস্পিন চলেগা, ডাকটেলস-ও চলেগা, কিন্তু চন্দ্রকান্তা-কি-কাহানি? নোপ ! ওদিকে মহাভারত, রামায়ণ, স্বপ্নিল যোশির শ্রীকৃষ্ণ চলতে পারে, মাঝদুপুরে জননী, সন্ধ্যে পড়লেই জন্মভূমি, কিন্তু সি-হক্স দেখলে চ্যানেল ঘুরিয়ে দেওয়া হবেই হবে, আর সুপারহিট মুকাবিলা? ভাবাই যায় না ... সে যখন নাম পালটে হয়ে গেলো আওয়াল নাম্বার, লুকিয়ে-চুরিয়ে দেড় মিনিটের গান শোনার আশায় কত মিনিট যে বাবা সায়গলকে সয়েছি, ভাবলে গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে ...

তাও বিদ্রোহ তো হতোই, নীলাঞ্জনা যদি নচিকেতার হন, আমার তবে নিকি অনেজা, আর দিদির তবে আধাআধি করে এদিকে রাঘবন, ওদিকে ক্যাপ্টেন ভ্যোম, মিলিন্দ সোমান। আর বিকেল হলে মা যখন একটু গড়িয়ে নিচ্ছে, সেই ফাঁকে অকথ্য বাংলায় ডাব করা সোওয়াভিমান ... প্লটের মাথামুন্ডু কিচ্ছু বুঝতাম না, হাঁ করে কিটু গিদোয়ানিকে দেখতাম ...

রোব্বারের বিকেলে বাংলা সিনেমাটা চলতো বটে, মাঝেসাঝে পাড়ার দু-একটা কাকা-জ্যেঠা শুদ্ধু হই-হই ব্যাপার, তবে সেন্সর-সমেত, যেই না বৃষ্টির রাত্রে দেবশ্রী ছাদে উঠে গান ধরলেন, 'আর কত রাত একা থাকবো?', বাবার চোয়াল অমনি কঠিন হলো, আর তক্ষুণি জানা গেলো শীতলা-মন্দিরের পাশে চপ ভাজা হচ্ছে, দু মিনিট দেরি হলেও একটাও কচুরি থাকবে না আমাদের জন্য ...

যে দুটো জিনিষ এইসবের ফাঁক গলে বেরিয়ে আসতো অক্ষত দেহে, একটা হলো খেলা, আর এক ছিলো ডিটেক্টিভ সিরিজ, আর ছিলোও সেসব দারুণ দারুণ, কুচো বয়সে রজিত কাপুরের ব্যোমকেশ, তারপর এলো শেখর সুমনের রিপোর্টার, সুদেশ বেরির সুরাগ ... সুরাগ কিন্তু এর মধ্যে একটা মাস্টারপিস, যারা দেখেননি, তারা জানেনও না সে কি জিনিষ, সুদেশ বেরি ঠিক লাস্ট মোমেন্টে এসে খুনীকে ধরবেন, আর ধরার পরেই সেই মুখের সবকটা মাসল কাঁপিয়ে সেই অমর ডায়লগঃ দিস ইস চেক, মেট !

বাংলাও অবিশ্যি পিছিয়ে ছিলো না, দুপুরের দিকে হতো এক-শুন্য-শুন্য, আর সপ্তাহে একদিন (?) রাত্রে 'আবার যখের ধন', যাতে আবার একটা গোরিমান-টাইপের কস্টিউম পরা ঘটোৎকচ এদিক-ওদিক ঘাড় মটকে বেড়াতো, আর দ্বিজেন বন্দ্যো যেই বলতেন 'বিমলবাবু ভাই', সব্বাই হেসে গড়িয়ে পড়তো ... (অনেক, অনেক পরে বাংলায় একবার ব্যোমকেশ হয়েছিলো, সুদীপ মুখার্জীকে দিয়ে, সে যাকে বলে চাঁদেও দ, আর পোঁদেও দ, দেখতে দেখতে মনে হতো দিই এক ঠাস করে !), আর ছিলেন পঙ্কজ রায়, বিকেলে আসতেন দর্শকের দরবারে, আর সেইসব একলা বৈশাখের দিন নববর্ষের বৈঠক নিয়ে ...

এর মধ্যে কোত্থেকে যেনো হুহু করে বাজারে ছেয়ে গেলো কেবল লাইন, আর সে 'অনির্বচনীয় হুন্ডি শুধু দু-একজনের হাতে' ... স্কুলের বাসেই তখন আসল ক্লাসটা হয়, যাদের কেবল, তাঁদের কারুর কারুর আবার কুল বাপমা, বাসে যেতে যেতে সবাই জুলজুল করে শুনতাম রাত্রে রেন্দেজভ্যুস-এ সিমি গারেওয়াল কি কি বল্লেন, আর জি-তে কি সিনেমা আসবে সে সপ্তায় ...

আস্তে আস্তে বড় হতে লাগলাম, আমি আর সব বন্ধুরাই, নাইন-টেনে উঠতে উঠতে বুঝলাম, ডিডি-১ আর ২ ততদিন ডাইনোসরের প্রপিতামহ, বন্ধুরা বড়দের সামনে ইএস্পিএন, ডিসকভারি, ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক এবং আড়ালে এফ-টিভি আর রেন টিভির গল্প করতো, আগের সপ্তাহে কারা লুকিয়ে বেওয়াচ দেখেছে, আর আমরা, বাকিরা টিভির দোকানের সামনে জমা ভিড়কে জিজ্ঞেস করে নিতাম, 'দাদা, ক'টা উইকেট পড়লো?', আর পরের দিনের আনন্দবাজারে খেলার পাতাটা পড়তে পড়তে ভাবতাম একদিন শালা আমাদেরও দিন আসবে ...

আমাদেরও দিন এসেছিলো, তবে কেবল লাইন দিয়ে নয়, সেই দুরদর্শনেই, সে এক আশ্চর্য schadenfreude, নরেন্দ্রপুরে ঢুকে দেখলাম বড়োসড়ো খেলা বাদে টিভি চলে না, খালি একচিলতে রোদ্দুর, শুক্রবারের রাত, একবাটি মাংসের ঝোল, আর একটা হিন্দি সিনেমা - এক গোটা হোস্টেল একটা পঁচিশ ইঞ্চির টিভিতে হাঁ করে সুনীল শেঠঠির 'ভাই' কি সানি দেওলের 'ঘায়েল' দেখছে, এমনকি চোর চুরি করতে এসে বোঁচকা পাশে রেখে হাত্তালি দিয়ে উঠছে, এ দৃশ্য যদি দেখতে চান, চলে আসুন কলকাতা - ১০৩!

টিভির সাথে সম্পর্কটা সেখান থেকেই আস্তে আস্তে ফুরিয়ে গেলো, নরেন্দ্রপুর শেষ করলাম, আই-এস-আইতে এসে দেখলাম একটা টিভি লাউঞ্জ আছে বটে, তবে কেউ না কেউ সবসময়ই বসে কিছু না কিছু  খেলা দেখে - আর কখনো কখনো বনহুগলির মোড় থেকে ভাড়া করে আনা সিডি। এক বন্ধুর কাছ থেকে ফ্রেন্ডস দেখা শিখলাম, দেখলাম কেউ মজার কথা বল্লেই নেপথ্যে হাসির রোল পড়ে যায়, কেমন জানি কথামৃত মনে পড়ে গেলো, ঠাকুর বসে পিজে মারলেই যেখানে শ্রীম ব্র্যাকেটে লিখে দেন "পার্ষদবৃন্দের হাস্য" ... আর যে গার্লফ্রেন্ড ছিলো তখন, তার বাড়িতে গেলেই দেখতাম একঘরে তার মা বসে কিউঁকি দেখছেন, আরেক ঘরে তার বাপ বসে সিএনবিসির ফুটনোট !

তারপর সে যেন কয়েকশো বছর পেরিয়ে গেলো কি করে, সিনেমায় নামার শখ চেপে চেপে একদিন একটা স্টেজে উঠে পড়লাম, দেখলাম উইংসের ধার থেকে কেমন মায়ামাখানো লাগে অডিয়েন্সের আবছা অস্তিত্ব, সে এক অন্য বসন্ত আমাদের - কমল্কুমার এলেন জীবনে, ক্রমে আলো এলো, আগুন, মুখোশ, পরচুলা ইত্যাদি নিয়ে  এলেন সন্দীপন, একদিন একটা রিহার্সালে গৌরবদা অ্য্যাক্টিং করতে করতে মেঝেয় ঠুকে পাটাই ভেঙ্গে ফেললো - নাটক-ক্লাব শুরু হয়েও বন্ধ হতে হতে, পড়লো আমাদের হাতের তালুতে ... টিভি তখন সময়-নষ্টের নামান্তর !

এই তো পরশুদিন ভারত ক্রিকেটে একদম লাস্ট ওভারে গিয়ে হেরে যাওয়ার পর এক জুনিয়রের পোস্ট দেখে মনে পড়লো দশ, না কুড়ি বছর আগের এক রাতের কথা, ব্যাঙ্গালোরে ইন্ডিয়া-অস্ট্রেলিয়া ম্যাচ, আমাদের সব ব্যাটসম্যান আউট, মা-বাবা মন-খারাপ করে বাইরের ঘরে বসে আছে যাতে টিভিতে হেরে যাওয়াটা দেখতে না হয়, আমার তো বৃথা আশা মরিতে মরিতেও মরে না ... এমনি সময় জ্বলে উঠলেন কুম্বলে আর শ্রীনাথ, স্টিভ ওয়া-র বলে একটা বিশাল উঁচু শট আর অম্নি আপ্ট্রন অন্ধকার, আমার চিৎকার শুনে বাবা দৌড়ে এসে এক চড় কষালেন টিভির পাশে, আর একটা বিশাল ছক্কা গিয়ে পড়লো চিন্নাস্বামীর গ্যালারিতে, আহ নস্ট্যালজিয়া !

তারপর অনেক কষ্টেও মনে করতে পারলাম না, শেষমেশ কি হলো সেই টিভিটার? তাপসদাই কি শেষে একদিন এসে নিয়ে গেছিলো না সকাল আটটার কর্পোরেশনের বাঁশির আওয়াজে একদিন রাস্তার ধারে নামিয়ে দিয়ে এসেছিলাম আমি-ই? মনে পড়লো না! মনে পড়লো তাপসদাকে দেখে দেখে আমার বাবাও টিভির কলকব্জা শিখে গেছিলেন দিব্যি, মাঝে মাঝে একটা ইস্ক্রুপ ড্রাইভার নিয়ে টিভি খুলে বসে পড়তেন, ঠোঁট থেকে ঝুলতো উইলস ফ্লেক! আমরা তখন মনে মনে প্রমাদ গণতাম ... এই গেলো বুঝি !

সত্যি বলতে গেলে খুব রাগ হতো, পাশের বাড়ির টুব্লুদাই কেবল টিভির ডিস্ট্রিবিউটার, তাও নেবে না -
ওরা অবশ্য ভাবতো ওইটা নেই বলেই না আমরা ফি বছর ব্যাগভর্তি নম্বর নিয়ে বাড়ি ঢুকছি আর দেশের-দশের মুখ উজ্জ্বল করছি -

বললে পেত্যয় যাবেন না, দেশের নাহক পাড়ার মুখ প্রায় উজ্জ্বল হয়ে গেছিলো আরেকটু হলেই, সেবার জয়েন্টে নরেন্দ্রপুরের সবাই স্ট্যান্ড-ফ্যাণ্ড করে ফাটিয়ে দিয়েছি, আর চ্যানেলে চ্যানেলে বেমক্কা ব্যাচের লোকজনের ইন্টারভিউ দেখাচ্ছে - অনেকক্ষণ এদিক-ওদিক ঘুরিয়েও আপট্রন সেদিন কিছুই দেখালো না, সন্ধ্যে ছটার খাস-খবর খুলেই লাফিয়ে উঠলো বাবা, কিন্তু টাইটেলেই যে টাইপো - দত্তকে কে যেন দানা করে দিয়েছে, একবার নয়, দু-দুবার !

ছানার শোক, না দানার শক কোনটা বাপের গায়ে বেশী লেগেছিলো সে জানিনা, কিন্তু আপ্ট্রনের গল্পের ইতি সেইখানেই ...


Sunday, October 9, 2016

ইস্কুলের গল্প - ১

(শীর্ষেন্দু একজায়গায় লিখেছিলেন, 'মানুষ মরে গেলে ভুত হয়, আর ভুত মরে মার্বেল হয়', তেমনি আমাদের অনেক মুখচোরা, ভয় পাওয়া ইচ্ছেরা মরে তৈরী হয় এক-একটা মন-কেমন করা বিকেল, আর বিকেলগুলো মরে কী তৈরী হয় জানো? 
             বাজারের থলে দেখেছো? উল্টোলেই একটা দুটো পেয়াঁজের খোসা কোত্থেকে ঠিক বেরিয়ে পড়বে, সেইরকম কতগুলো জিনিষ কেমন করে যেন আলগা হয়ে লেগে থাকে আমাদের সাথে, কবে এসেছিলো জানিনা, আবার কোনদিন ঝাড়তে গিয়ে বেরিয়েও যাবে, তাই গল্পগুলো এইবেলা লিখে ফেলা ভালো।)


আমরা যে স্কুলটায় পড়তাম, তার নাম বরাহনগর মিশন, এবং তার নামকরণ যে সার্থক একথা কেউ কোনোদিন অস্বীকার করবে বলে মনে হয় না, যদিও সরকারী বানানে 'হ'টা বেমালুম উড়ে গেছে কাউকে না বলে - আমাদেরও তাই আর কিছুই হয়ে ওঠা হয় নি শেষমেশ। তা এই বরানগর স্কুলে ওয়ান থেকে টেন অব্দি ক্লাস, প্রথম পাঁচটা ক্লাস ভেতরে প্রাইমারি, শেষের পাঁচটা সামনের খেলার মাঠের পাশেই, বি-আই কোম্পানির সঙ্গে পাচিঁল ভাগাভাগি করে। দিব্যি ছিলো স্কুলটা, পাড়াতেই রাজকুমারী স্কুল, আর রোজ সকালে ঠিক দশটা বাজতে দশে সামনে দিয়ে এক এক করে বাসগুলো যায়, একটা মাল্টিপারপাস, একটা নিবেদিতা, আর ফেরে বিকেলে ছুটির পর ... ছেলেদেরও ওই দুবার শারুখখানী পোজ দিয়ে গেটের সামনে দাঁড়ানো ছাড়া খুব একটা জীবনে খুব যে আর বেশী উদ্দেশ্য-বিধেয় ছিলো এমন ভাব্বার সত্যিকারের কোনো কারণ নেই, তো মোট কথা দিব্যি ব্যাপারটা চলতো আস্তে আস্তে, ফিসফিস করে, যেমন সব ছোট্ট শহরতলিতে হতো সেই নব্বুইতে। সেই সাইকেল করে টবিন রোডের কাছে কোচিং, তার পাশেই জেরক্সের আর একটু এগোলে চপ-ফিশফ্রাই-এগরোলের দোকান -- আর দোকানের পাশে মাঠ, "ছুটির বৈঠক"। ঠিক এই সন্ধ্যে ছটার সময় যদি যান, দেখবেন আলোগুলো আজকেও কেউ জ্বালতে ভুলে গেছে, এদিক ওদিক দূরে দূরে, ঠিক যতটা দূরে বসলে আর কথা বোঝা যায় না তেমনি দূরে কয়েকটা জমাট বাঁধা অন্ধকার। আমরাও আসুন একটা সাইড দেখে একটা সান্ধ্য আজকাল পেতে বসে পড়ি, সিগারেটও আছে, ঘটিগরমের লোকটাও আসবে এক্ষুনি, আমরা বরং হাঁটতে হাঁটতে ফিরে যাই সেই অবুঝ, অস্পষ্ট, অন্ধকার রাস্তাটায়, যার নামটা সবাই ভুলে গেছে, ল্যাম্পপোস্টের আলোয় খালি নম্বরটা পড়তে পারছিঃ  ১৯৯৯।


সেই সময় স্কুলে একসাথে দু-দুটো ঘটনা ঘটলো। এক নম্বর, বলা-নেই-কওয়া-নেই দুম করে স্কুলে একটা ওয়ার্ল্ড রেকর্ড হয়ে গেলো, বোর্নভিটা অ্যাকাডেমির কাছে স্কুলের টিম গিয়ে শুন্য রানে অল আউট হয়ে ফিরে এলো - আর তাকে সামাল দিতেই হবে হয়তো, একটা গোবেচারা-পানা ছেলে গাঁতিয়ে পড়ে মাইধ্যমিকে ফার্স্ট হয়ে গেলো (আমার ধারণা ছায়া প্রকাশনীর আদি-অকৃত্রিম পোস্টার বয় সেই, যদিও আমার গেঁজেল মেমোরি যা চায়, ইতিহাস তাই নয়)। তা এসব মহাজাগতিক ঘটনা চাক্ষুষ-টাক্ষুষ করে কয়েকটা জেনারেশন বাপ-মার মাথাটা গ্যালো বিগড়ে। হঠাৎ সবাই বুঝলো যে সাফল্যের চাবিকাঠি খুজঁতে আর টর্চ লাগবে না, এক্কেবারে হোলসেলে কিলো-দরে পাওয়া যাচ্ছে যোগেশদা-দিব্যদা-সুদীপ্তদার আখড়ায়। আমার বাপ-মা, অর্থাৎ আমি, যে এই রেনেঁশায় এক্কেবারে দুম করে গিলোটিন হয়ে গেছিলাম তা নয়, তবে অচিরেই দেখলাম স্কুলের পরে বাড়ি গিয়ে আর সাতটা পয়ঁতাল্লিশের চিত্রহার নেই, আছে হুড়ুদ্দুম করে 'অভাগীর স্বর্গে'র নোট টোকা। এমনকি রোববার সকালেও যে জম্পেশ করে চন্দ্রকান্তা কি কাহানি দেখবো আর ক্রূর সিং কে খিস্তাবো, সে গুড়ে বালি, চুন ও সুড়কি। পি আচার্যের ভাষায় আমার দুর্যোগে তখন ঘনঘটার ভাগ্যাকাশ, কিন্তু ঠিক এই সময় একজন দারুণ লোকের সাথে আলাপ হয়ে গেলো, তার কোচিং-এ পড়তে গিয়েই - ভদ্রলোকের নাম সুভাষদা, সুভাষ মুখোপাধ্যায় - নাঃ সেই কবি সুভাষ নন, যিনি ফুল খেলবার দিন নয় বলে অদ্য মেট্রো স্টেশন হয়ে গেলেন, তবে এই গল্পটা ইনি না হলে হতোই না হয়তো ...


সুভাষদা ঠিক কেমন ছিলেন বলে বোঝানো অসম্ভব, একটা গোলগাল পরিতৃপ্ত চেহারা, মাথায় একঝাঁক কোঁকড়া চুল, আর সত্যিকারের উদাত্ত গলা ... সবথেকে বড়ো ব্যাপার, প্রথম দিন-ই ক্লাসের পর ডেকে বললেন বইয়ের ওসব বাজে কবিতা না পড়ে এসো আমরা টি এস এলিয়ট পড়ি, আর রিলকের দুইনো এলেজি ... আর শুধু ওই 'যদু হে, মাছ কিবা'র ভাব সম্প্রসারণ না করে, চলো বইটাই পড়ে ফেলি ... এখন যখন পিছনে তাকাই, মাঝে মাঝে সেই বিকেলটার কথা মনে পড়ে, জয়েন্টের রেজাল্ট বেরোনোর পরের দিনই, সুভাষদার বাড়ির ছাদে আমরা বসে চা খাচ্ছি, খুব চুপচাপ, সেই মধ্যবর্তী নৈঃশব্দ - খানিকক্ষণ পরে সুভাষদাই ভাংলেন, "তা তুমি যাদবপুরেই যাবে, সেই একটা টি কাঁধে ঘুরে বেড়াতে, আর গাছতলায় বসে গাঁজা খেতে?" ... উত্তর দিতে পারিনি।


যাহোক, আমি আসল গল্পটার থেকে এদিক-ওদিক বাইলেনে ঢুকে পড়ছি, সেই ছোটোবেলার অভ্যেস তো, চট করে যেতে চায় না, না? তা এই গোটা টাইমটায় আমার একমাত্র অ্যাচিভমেন্ট বলতে গেলে ওই মাঠে দু-একবার সিগারেট খেয়ে দেখা, আর একবার ক্লাস মনিটর হয়েও স্কুল পালানো বন্ধুদের নাম হেডুকে না বলে দেওয়া -- মোটামুটি ঐ বইতে আর নোটসে মুখ গুঁজেই কেটে যাচ্ছিল নাব্য নব্বুই, কোত্থেকে যে দখিন বাতাস ঢুকে একে একে সবকটা বন্ধুরই উইকেট ফেলে দিয়েছে সেটা বুঝতে একটু বেশ দেরি-ই হয়ে গেলো, একদিন দেখলাম কোচিং থেকে বাসস্ট্যান্ড অব্দি সঙ্গে হাঁটার আর কেউ নেই, সিগারেট টাও একাই কিনতে হচ্ছে স্কুলব্যাজ টা পকেটে লুকিয়ে।



নিয়তি দেখেছেন তো, নিয়তি? মাতালকে যা নিয়ে যায় বাংলার বোতলের দিকে, আর ডিপ্রেশানের রুগীকে রেললাইনের ধারে, এই সেই নিয়তি, তা প্রেমে আমিও ধপ করে পরেই গেলাম, সঙ্গে পড়ার মতন লোকের আর অপেক্ষা না করেই। সে এক দারুণ সময় বটে, যাই দেখি, বয়ঃসন্ধির ব্রণর মতন থেকে থেকেই অল্প বসন্ত জেগে ওঠে, সে কুমার শানুর নাকিগলায় গান শুনে-ই হোক, কিংবা টিভিতে ক্যাডবেরির অ্যাড দেখে। কিন্তু বিধি বাম, 'শুধাইলো না কেহ' ... হঠাৎ এই সময় একদিন দেখি কোচিং-এর পরই একটা ছেলে দাঁড়িয়ে আছে গলির মোড়ে, হাত একটা সদ্য কেনা - রাংতাটাও না ছাড়ানো উইলস ফ্লেকের প্যাকেট ...


ছেলেটির আসল নামটা চেপে যাচ্ছি, ধরা যাক ওর নাম সন্দীপ আর ও সেদিন ওই সিগারেটের প্যাকেটটা হাতে যার কথা বলবে বলে দাঁড়িয়ে ছিলো, তার নাম ধরে নেওয়া যাক অমৃতা ... সন্দীপ ভালো ছেলে, বাপে-মায়ে পড়িয়ে-পিটিয়ে মানুষ করছেন, ছেলেও কেসিনাগ-কেপিবোস আর মাইতি-সাঁতরা করে ফি বছর ক্লাসে জ্বলজ্বল করে ওঠে। যদিও বাংলাটা একটু ইয়ে, মানে জয়েন্টে লাগবে না কাজেই পড়ে খুব একটা লাভ নেই যাকে বলে -- তো সন্দীপ এসে বললো যে একটা চিঠি খুব দরকার, যার মূল বক্তব্য হচ্ছে যে ও অমৃতাকে খুবই ইয়ে করে, কিন্তু একটু কবিতা-টবিতা না থাকলে ঠিক ব্যাপারটা জমছে না। আমি তো হাতে স্বর্গ পেলাম (এবং একটা গোটা প্যাকেট ফ্লেক!) ... জানা গেলো, আমি-ই পত্রলেখক ও বাহক, খালি তলায় নামটা আমার নয়। যেমন ফেলুদার গল্পে হয়, সেরকম পারিশ্রমিক, শুরুতে ফ্লেক, মাঝে একটা দুটো এগরোল, আর উঠে গেলে নেভি কাট ...
আমার দৌড় তখন শেষের কবিতা অব্দি, তাও আবার দিদির দৌলতে, যে নিবেদিতায় পড়ার সৌভাগ্যে বোধহয় পুরো বইটাই এপাশ-ওপাশ গাঁতিয়ে ফেলেছে ততোদিনে ... তা শুরতে ভাবলাম অমিত রায়কে টুকলি করে জন ডান ঝেড়ে দিই, (যাকে বলে টুকলি-অব-অর্ডার-টু) ...

"For God's sake, hold your tongue and let me love" ... 

একটা পায়োনিয়ার কোম্পানির ফুলস্ক্যাপ পাতা ছিঁড়ে উপরেই সেটা লিখেও ফেললাম ... কিন্তু কেমন একটা বুকটা ছ্যাঁতছ্যাঁত করতে লাগলো, হাজার হোক - ব্যাঙ্কের কেরাণী মধ্যবিত্ত বাঙালি বাপ, Tongue দেখে পানু ভেবে কেলিয়ে দিলে হয়ে গেলো আর কি ... আবার তন্নতন্ন করে খুঁজলাম শ্যাষের কবতে, এইবার এলো সংস্কৃত -

 'স্মরগরল খন্ডনং মমশিরসি মন্ডনম, দেহি পদপল্লবমুদারম' ... 


লিখেই কেমন একটা সাত্ত্বিক শাহরুখ ভাব এলো, কিন্তু সন্দীপ টিফিনের সময় বললো অমৃতাদের ইস্কুলে হিন্দি অ্যাডিশনাল, সংস্কৃত নাই ... ওসব চলবে না ...

দিন যায়, রাত যায় - এদিকে আমি তো আর যুতসই কবিতা পাই না, প্রথমে গিয়ে ধরলাম পাড়ার একটা পাতাখোর কবিকে, সে আবার সকালে প্রাইমারী স্কুলে পড়ায়, দুপুরে পার্টি অফিসে ম্যানিফেস্টো বিলোয় আর রাত্রে অল্প তন্ত্র-মন্ত্র করবে বলে গাঁজা টেনে 'মা-মাগো' করে আর্তনাদ করে। সে বললে, "প্রেম মানে নীরা, নীরা মানে যে রানীর উল্টোস্রোত, যেমন ধারার বীপ্রতীপ রাধা" ... তখনো 'গুগুল তোমার দারুণ দীপ্তি ফেলেছে জগৎ ঢাকিয়া' টাইপের টাইম নয়, আর পাড়ার নবজাতক লাইব্রেরীতে হেমেন রায় আর সত্যজিৎ ছাড়া কিছু ঢোকে নি কোনোদিন ... অনেক কষ্টে এক বন্ধুর বাড়ি থেকে চুরি করিয়ে আনলাম সুনীলের একটা বই, মলাটে আবার বাড়ির লোককে ধোঁকা দেওয়ার জন্য লেখা 'প্রশ্ন বিচিত্রা' ... সে কবিতাগুলি যে কি ভালো ছিলো কি আর বলবো, সেই যে সুনীল লিখছেন যে তিনি সাবান হয়ে যেতে চান, নীরা তাকে নিয়ে কি কি সব তারপর করবেন ...
নাঃ, নীরা সেই চিঠিতে জায়গা পেলোনা, আমার সাহস-ও যে হয়েছিলো তা নয় ... তবে একদিন 'বুকে বল, হাতে পেশী, কথা কম, কাজ বেশী' করে সুভাষদাকেই ধরলাম ক্লাসের পরে ...

"স্যার, দু মিনিট সময় হবে? একটা সাজেশান চাইবার ছিলো ... "

জীবনে সাজেশান শব্দটাকে সুভাষদা কেনো, আমার ধারণা সব মাস্টাররাই হেব্বি ঘেন্না করে, তবে এই একবার ভদ্রলোক দেখলাম একেবারে উদ্ভাসিত হয়ে উঠলেন, বললেন, "আমার যে গুরু বাংলায়  লিখে আরেকটা পৃথিবী বানিয়ে ফেলেছেন, তাঁরই দু-লাইন বরং তোমাকে বলি, কনিষ্ক ...

"তুমি তো জানো না কিছু – না জানিলে,
আমার সকল গান তবুও তোমারে লক্ষ্য করে" 

...
আমার বুকের ‘পরে সেই রাতে জমেছে যে শিশিরের জল,
তুমিও কি চেয়েছিলে শুধু তাই;
শুধু তার স্বাদ
তোমারে কি শান্তি দেবে?"

পুরোটা বলে অনেকক্ষণ বাইরে চেয়ে থাকলেন সুভাষদা, বললেন ধার-দেনা করে বাজারে আলু-পটল কেনা যায়, প্রেমের চিঠি লেখা যায় না। 

            সেদিন রাত্রে আর ঘুম হলো না ঠিক করে, জেগে থাকলাম - বাবা-মা শুয়ে পড়ার পর বাগানের জবা গাছটার তলায় দাঁড়িয়ে একটা ফ্লেক খেয়ে ফেললাম সাহস করে, অনেক অনেক ভাবলাম - তাকে কি লেখা যায়, যাকে আমি হয়তো এই একবারই কিছু বলবো? অন্ধকার সিঁড়ি দিয়ে যেন নিজেরই ভিতরে নামছি মনে হলো, কিন্তু কই টর্চ নিয়ে পাশে দাঁড়ালেন না তো রবি ঠাকুর ! -- অনেক ভেবে ভেবে সেই রাত্রে দুটো লাইন লিখলাম আমার বেনামী প্রেমপত্রের জন্যঃ  

"বৃষ্টি, কি নামে ডাকলে তোমায়,
ঝরে পড়বে আমার ঘরে, 
এই এখানে, এই এখন-ই?"

নাঃ, সন্দীপ আর অমৃতার বিয়ে হয়নি, ওরা একে অন্যজনকে নিশ্চয়ই অ্যাদ্দিনে ভুলেও গেছে, আমার-ই বা কি মনে আছে আর? সেই চিঠিটা গন্তব্যে যে পৌঁছেছিলো তা জানি, আর আমি সেই নেভিকাটের প্যাকেট-টাও একবিকেলে ছুটির বৈঠকের মাঠে দেদার উড়িয়ে দিয়েছি দখিনা হাওয়ায়, যে বিকেলে ওরা ঘুরতে গেছিলো ময়দানে ... তারপর কত গল্প আসে, কত বিকেল যায়, ছুটির বৈঠক থেকে সিগারেটদের ঠিকানা হয় প্রথমে হোস্টেলের ঘর, তারপর আর্ধেক পৃথিবী দূরে একটা বরফ-ঢাকা শহর,  তারপর তারাও হারিয়ে যায় ... এখন কেউ জানে না কে কোথায়, সত্যি বলতে কি, সেই সুভাষদা কি বেঁচে আছেন এখনো? তাও জানার সুসময় আসেনি ... তবে যে কৈফিয়ত দিয়ে শুরু করেছিলাম সেটাই আবার দিই, ওই শুকনো পেঁয়াজের খোসার মতন এই একটা-দুটো লাইন কোথায় যেন লেগে ছিলো, আজ ঝাড়া দিয়ে ফেলে দিলাম এক্কেরে ...