Saturday, October 21, 2017

মিমিক্রি


স্টেজে ওঠার সময় একবার টুক করে পকেট থেকে একটা লজেন্স বের করে মুখে দিলো সুমন, একটা জলের বোতল সঙ্গে থাকে, তা-ও গলাটা আর্দ্র না থাকলে পারফরম্যান্সে তার ছাপ টের পাওয়া যায়। এটা অবিশ্যি একটা দক্ষিণ কলকাতার মাঝারি সাইজের একটা বার - শুক্রবার সন্ধ্যে তাই এই সন্ধ্যে সাতটাতেই বেশ লোক হয়েছে। অবশ্য সবাই যে সুমনের স্ট্যান্ড-আপ কমেডির ফার্স্ট শো শুনতে এসেছে তা নয়, অনেকেই দূরে দূরে বসেছে, আর্ধেক উৎসাহ আর আর্ধেক বিরক্তি নিয়ে - তবে স্টেজের সামনে বেশ কয়েকটা চেনামুখ, পুরনো বন্ধুবান্ধব - অফিস কলিগ, উৎসুক হয়ে অপেক্ষা করছে।

সত্যি বলতে এই জনা-কয়েক ফ্যানদের উপর ভরসা করেই পাকা চাকরিটা দুম করে ছেড়ে দেওয়ার কথা ভাবছে সুমন । তার সেন্স অব হিউমার মোটামুটি ভালোই, সামান্য কথাকে ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে 'পান' করার অভ্যেসটাও এক্কেবারে ছোট্টবেলার থেকেই আছে, তবে তার আসল দক্ষতা লোকের গলা এবং আদব-কায়দা অর্থাৎ ম্যানারিজম নকল করা। ইস্কুল-কলেজে পড়ার সময় টিফিন বা ক্লাসের মাঝখানে বন্ধুরা ঘিরে ধরতো, 'একবার এস্কেজি-টু করে দ্যাখা, একবার হেডু যে মর্নিং প্রেয়ারে লেকচারটা দেয় সেটা কর !' ... কলেজে বেঞ্চের উপর বসেও একের পর এক প্রোফেসারদের নকল করে দেখাতো, একজন 'স'-কে 'শ'-বলতেন, একজন ছিলেন গায়ক, তার গম্ভীর ব্যারিটোন নকল করে 'আলফা-বেইটা-গ্যামা' বললেই হেসে গড়িয়ে পড়তো বন্ধুরা ... একটু নকল, আর একটু কল্পনা করে আজগুবি কিছু কথা জুড়ে দিলেই হলো ! সমস্ত পার্টির মধ্যমণি হয়ে থাকতে, আর লোককে এই প্রাণখোলা হাসি হাসাতে সে-ও কম উপভোগ করতো না ...

চাকরি ছেড়ে দেওয়ার আইডিয়াটাও এইভাবেই এলো ! মাস ছয়েক আগের কথা, অফিসের রিট্রিট হচ্ছে এক চা-বাগানের এস্টেটে ! শেষদিন খাওয়া-দাওয়ার পর সবাই ধরে বসলো, আজকে সুমনকে পারফর্ম করতেই হবে ! অল্প নেশা করেছিলো বলে হয়তো ইনহিবিশন-টাও কম ছিলো সেদিন, সুমন-ও রাজি হয়ে গেলো এককথায় ! নকল করার লোক-ও হাতের গোড়ায়, বস ছিলেন এক গোমড়া-মুখো ওড়িয়া লোক, মিস্টার উপাধ্যায় - বিদেশে বছরকয়েক থাকার ফলে তার উচ্চারণে আর হাবেভাবে স্পষ্ট আমেরিকান ছাপ .. সুমনের তার উপর অল্প রাগ-ও যে ছিলো না তা নয় ! ঘন্টাখানেক চলার পর যখন শেষ করলো, সেই বস এসে জড়িয়ে ধরে বললেন, অনেকদিন পর পেটফাটা হাসি হেসেছেন তিনি !

আজকে সুমন নকল করবে ঠিক করেছে তিনজন মোটামুটি নাম-করা সেলিব্রিটির, একজন বয়স্ক পলিটিশিয়ান, একজন হিন্দি সিনেমার হিরো আর একজন নামকরা খেলোয়াড় !

নকল করতে গেলে যে খুব ভালো পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা লাগে তা সুমনের আছে, সহজেই ধরে ফেলতে পারে কার বৈশিষ্ট্য কোনটা, এই যেমন পলিটিশিয়ান-টি বাংলা টোনে আশ্চর্য ইংরেজি বলেন, আর থেকে 'ইয়ে','মানে','ধ্যাত্তেরি' ঢুকে যায় স্পিচে ... আর খেলোয়াড়টির-ও তাই, এই কেরিয়ারের মধ্যগগনেও তার গলায় কৈশোর যায়নি, আর টিভি খুললেই যার বিজ্ঞাপন দেখা যায়, তার মুখে সংলাপ বসানো কি এমন কাজ ? সবথেকে সোজা মনে হয় হিন্দি সিনেমার হিরোটিকে নকল করতে, তাঁর পিলে-চমকানো ডায়লগবাজি আর কৃত্রিম-ব্যারিটোন গলা বোধহয় সুমন-ও আর কোত্থাও শোনেনি !

ফার্স্ট শোয়েই জ্যাকপট ! এতো মুহুর্মুহু হাততালি আর হাসির হররা কখনো শোনেনি আগে ! এ এক অদ্ভুত উত্তেজনা - তিনের জায়গায় চা-পাঁচটা ক্যারিকেচার করে দেখালো সুমন, একবার প্রাইম মিনিস্টারের সম্ভাষণ-ও নকল করতে ছাড়লো না - শেষ করার সময় দেখলো লোকে নিজের টেবিল ছেড়ে স্টেজের পাশে গোল হয়ে দাঁড়িয়ে, জীবনে প্রথমবার স্ট্যান্ডিং ওভেশান নিতে নিতে সুমন ঠিক করলো চাকরিটা ছেড়েই দেবে, এটাই আজ থেকে তাঁর জীবন ও জীবিকা !

-----------------

শহরের আশেপাশের বার অনেক, স্ট্যান্ড আপ কমেডির বাজার-ও বেশ উঠতির দিকে এখন, তাই সুমনের প্রথম প্রথম কাজ পেতে সমস্যাই হলো না।  আজকাল সে একটা নোটবুক নিয়ে ঘোরে, নতুন কোনো লাইন মাথায় এলে লিখে রাখে, রাস্তাঘাটে ইন্টারেস্টিং ক্যারেকটার দেখলেও নোট করে নেয় আর ঘন্টার পর ঘন্টা এ-চ্যানেল ও-চ্যানেল ঘুরিয়ে টিভি দ্যাখে, সারাক্ষণ-ই কেউ না কেউ কথা বলছেন ... কার ক্যারিকেচার করা যায় নোট নিতে থাকে সুমন !

অল্প অল্প নাম হলেও সুমনের একটা দুঃখ রয়েই গেছে, ওই শুক্রবারের সন্ধ্যের বারের বাইরে তাকে কেউ বড়ো একটা চেনে না ! কাফে-তে গিয়ে বসলে কেউ অটোগ্রাফ চায় না, রাস্তাঘাটে পাবলিক ট্রান্সপোর্টেও কেউ তাকে দেখে ফিসফিস করে সঙ্গীকে বলেনা, 'ঐ লোকটাকে চিনিস?'। সুমনের বদ্ধমূল ধারণা এই মিলেনিয়ামে সত্যি বিখ্যাত হতে গেলে টিভিতে মুখ দেখানো বা ইন্টারনেটে ভাইরাল হওয়া ছাড়া উপায় নেই ...

সুযোগটাও এসে গেলো দিন কয়েকের মধ্যেই ! ইস্কুলের এক বন্ধু বিপ্লব আজকাল টেলিফিল্ম-টিল্ম করে হাত পাকাচ্ছে, সেই এক চ্যানেলের সাথে যোগাযোগ করিয়ে দিলো, ম্যানেজার বিপ্লবের মেসোমশাই, জয়দেব বর্মণ। চুক্তি হলো, সুমনের পারফর্ম্যান্স ইন্টারনেটের মাধ্যমে সম্প্রচার করবে তারা, সরাসরি বার থেকেই, আপাততঃ একটাই শোয়ের বায়না, পাবলিক খেলে আরো ভাবা যাবে ...

সময় এগিয়ে আসছে, সুমন-ও নতুন নতুন ক্যারিকেচার খুঁজছে, এক ঘন্টার শো - অতএব, অনেকগুলো চাই আর সবার জন্য ছোট্ট ছোট্ট গল্প ... এই শো-টার জন্য নতুন কিছু চাই-ই চাই, আর সেই এক-ই জোক, এক-ই ক্যারিকেচার করে চলবে না !

আইডিয়াটা এলো টিভির চ্যানেল ঘোরাতে ঘোরাতেই, হঠাৎ একটা চ্যানেল-এ এসে একটা অতিপরিচিত গলার আওয়াজ শুনে থমকে গেলো সুমন। এ তো সেই ছোটোবেলার বিখ্যাত ম্যাজিশিয়ান, তার কত শো দেখেছে মহাজাতি সদনে, এমনকি টিভিতেও বাচ্চা-বড়ো সবরকমের প্রোগ্রামে আসতেন তিনি। সুমনের মনে হতো সত্যি জাদু !  এই তাকে হাতে-পায়ে শেকল বেঁধে বাক্সবন্দি করে তাকে সাগরে ফেলে দেওয়া হচ্ছে, তিনি ঠিক কোথাথেকে অক্ষত শরীরে উদয় হচ্ছেন, একবার স্টেজে দেখেছে তাকে চোখে রুমাল বেঁধে দেওয়া, আর হাতে চক - দর্শকদের থেকে একজন উঠে একটা ব্ল্যাকবোর্ডে কিছু ফরমুলা লিখছে, আর পাশেই চোখ বাঁধা অবস্থাতেই যাদুকর মল্লিক অন্য ব্ল্যাকবোর্ডে হুবহু লিখে যাচ্ছেন সে-ই এক-ই ফর্মুলা ! সুমন-ও হাত তুলে ভলান্টিয়ার করেছিলো সেইদিন, খুব শক্ত একটা অ্যালজেব্রার ফর্মুলা লিখতে গিয়ে দেখলো, এ প্লাস বি হোল স্কোয়ার ছাড়া কিস্যু মাথায় আসছে না !

এখন অবশ্য মল্লিকের অনেক বয়েস, ম্যাজিক শো-ও সুমন শেষ কবে দেখেছে মনে নেই , এখন  কোনো একটা চ্যানেলে এসে তিনি তাঁর সেই অননুকরণীয় গলায় বলছেন, 'এই কলকাতা শহর থেকে দুষ্টু লোকগুলোকে সব ভ্যানিশ করে দেবো' ... সুমন শুনতে শুনতেই ঠিক করে ফেললো তাঁর নতুন ক্যারিকেচার -  এক ম্যাজিশিয়ান - যাঁর সব ম্যাজিক-ই ফেল করে !!

যথারীতি এবারের শো-ও খুব হিট, প্রত্যেকটা স্কেচের পরে সুমন-কে পাক্কা তিরিশ সেকেন্ড অপেক্ষা করতে হয়েছে  শুধু হাততালি থামাতে! শেষ হওয়ার পরে বাইরে বেরিয়ে এলো সুমন - একটা সিগারেট ধরাতে গিয়ে দেখলো পকেটে লাইটারটা নেই, অথচ এই একটু আগেই ...

'দেশলাই ভ্যানিশ?'
গলাটা শুনে চমকে গেলো সুমন, অনতিদূরে দাঁড়িয়ে আছেন যাদুকর মল্লিক, তার আঙ্গুলের ফাঁকেও একটা জ্বলন্ত সিগারেট ! এগিয়ে এসে সুমনের সিগারেট-টা ধরিয়ে দিতে দিতে বললেন,
'আপনার তো সেন্স অব হিউমার মন্দ না, গল্প বলার কায়দা-ও ভালো, তাহলে এই আমাদের মতন বৃদ্ধ, বাতিল লোকেদের ভেঙিয়ে পয়সা উপার্জন করতে হচ্ছে কেন?'
সুমন বলার চেষ্টা করলো, 'ইমিটেশান ইজ দ্য বেস্ট ফ্ল্যাটারি', মল্লিক কান করলেন না। হাতের সিগারেটটা পাশের নালায় নিক্ষেপ করে চলে যেতে যেতে বললেন, 'ভাঁড়ামি করে লোক হাসাচ্ছেন, হাসান, আমার আপত্তি করায় কিছু যায় আসে না, কাজটা কিন্তু তা-ও ভালো করলেন না' ।



সারা শরীর যেন লজ্জায় রাগে অবশ হয়ে এলো সুমনের, কোনো রকমে একটা ট্যাক্সি ডেকে বাড়ি ফিরে এলো যখন মনে হলো অল্প জ্বর এসে গেছে ইতিমধ্যে, একটা প্যারাসিটামল খেয়ে শুয়ে পড়তে পড়তে সে ঠিক করলো যাই হোক না কেনো, আর কোনোদিন ঐন্দ্রজালিক মল্লিকের ক্যারিকেচার নয়।

পরদিন ঘুম ভাঙলো জয়দেব-বাবুর ফোনে, সুমনের শোয়ের ভিডিও ইতিমধ্যে ভাইরাল হয়ে গেছে ! ইউটিউবে হাজার কুড়িবার লোকে দেখে ফেলেছে এই অল্প সময়ের মধ্যে ! সুমন ভাবলো একবার বলে দেখবে ভিডিও-টা সরিয়ে নেওয়ার কথা, তারপর ভাবলো হাতের তীর, মুখের কথা - একবার যা বেরিয়ে গেছে আর কি ফেরানো যায়?

পরের শোয়ের আগে আর-ও সপ্তাহ হয়েক সময় চেয়ে নিলো সুমন, জয়দেব-বাবু যদিও অধৈর্য্য হয়ে উঠেছেন ক্রমশঃ, কিন্তু সুমনকে নতুন ক্যারেকটার ভাবতেই হবে ! ম্যাজিশিয়ানের শেষ কথাগুলো কোথাও যেন একটা কাঁটার মতন ফুটে আছে । এর মধ্যে তার নাম-ও হয়েছে বেশ খানিকটা, একদিন মলে জামা কিনতে গিয়ে ক্যাশিয়ার তাকে দেখেই চিনতে পেরে খানিকটা এক্সট্রা খাতির করলেন - এমনকি পাড়ার সে কাফেটায় গত এক বছর ধরে যাচ্ছে সুমন, তার ব্যারিস্তাও আজকাল সুমনের জন্য কাফের এককোণে একটা কাউচ রিজার্ভ করে রাখছে, সুমন জানে এইভাবে একটু একটু করেই খ্যাতি আসে !

ক্যাফে-তে বসেই মাথায় এলো পরের ক্যারিকেচারের আইডিয়া, তার ছেলেবেলার ইস্কুলের মহারাজ, নাম ছিলো অজপানন্দ - মুখে সারাক্ষণ অনাবিল হাসি লেগে থাকতো বলে দুষ্টু বাচ্চারা নাম দিয়েছিলো অযথানন্দ ! এখন তিনি বেশ নাম-টাম করেছেন, টিভির চ্যানেলে এসে গান-টান করেন, টক-শোতেও এসে মানুষের সঙ্গে ফোনে কথা-টথা বলে শান্তির উপায় বাতলে দেন ! অযথানন্দকে নকল করাও ভারি সহজ, তাঁর ভাবভঙ্গি-গলার স্বর সব-ই যে বেশ মেয়েলি ! এফিমিনেট পুরুষ-মানুষের নকল করা যতই রাজনৈতিক-ভাবে অশুদ্ধ হোক, লোকে যে দেদার হাসে সে সুমনের জানা !

দিন চারেক পরে শো শুরু হলো সুমনের, শুরুতেই অযথানন্দ-কে নিয়ে একটা আনকোরা নতুন স্কিট ! কাল্পনিক কথোপকথন - একদিকে অযথানন্দ, আরেকদিকে পলিটিশিয়ান চক্কোত্তি !

কিন্তু এ কি? আজকে তো কই হাসির হররা উঠছে না, স্টেজের সামনের দিকে অল্প আলোয় পুরোনো বন্ধুদের মুখ চোখে পড়ছে, তারা-ও কেমন যেন অবাক হয়ে তাকিয়ে সুমনের দিকে ! এই স্কেচ তার সেরাগুলোর মধ্যে একটা, তা হলে?

মাইকে হঠাৎ একটা বিশ্রী জোরে ফিডব্যাকে সম্বিত ফিরে এলো সুমনের, তাতেই ব্যাপারটা দিনের আলোর মতন স্পষ্ট বুঝতে পারলো সে- মাইকে যে গলা শোনা যাচ্ছে সুমনের সেটা অযথানন্দ-ও না, পলিটিশিয়ান চক্কোত্তিও না ... সেটা একটা অচেনা অদ্ভুত গলা ! নাঃ, একটা নয়, একের পর এক বিভিন্ন গলা, কোনোটা ভারি, কোনোটা মিহি, কোনোটা অত্যন্ত কর্কশ  - এবং আশ্চর্য ব্যাপার, গোটা ব্যাপারটা হয়ে চলেছে সুমনের ইচ্ছের কোনোরকম তোয়াক্কা না করে ! পুরোনো স্যাটেলাইট রেডিও-র মতন, কখন যে কি সিগ্ন্যাল ধরে চলেছে, সুমন-ও জানে না !


এক ঘন্টার শো ছিলো। হল যখন প্রায় ফাঁকা, সুমন দেখলো মিনিট কুড়িও পেরোয়নি ! রাস্তায় বেরিয়ে আজ আর ট্যাক্সি নয়, এক ঘন্টার রাস্তা হেঁটেই ফিরলো সুমন। তার মাথায় কি চলছে সে নিজেও জানেনা, রাস্তায় বার দুয়েক চাপা পড়তে পড়তে বেঁচেছে আজকে - একবার মোড়ের মাথায় গুমটিটায় দাঁড়িয়ে এক প্যাকেট সিগারেট কিনতে গিয়ে দেখলো, অবিকল মহিলার গলা বেরিয়ে এলো ভেতর থেকে ! দোকানদার চেনা লোক, এক-গাল হাসলো, সুমন আবার তাঁকে কিছু বলতে গেলো, গলা থেকে কিছু যান্ত্রিক আওয়াজ বেরিয়ে এলো !

ঘরে ফিরে দরজা বন্ধ করে একগ্লাস ঠান্ডা জল ঢকঢক করে খেয়ে একটু যেন ধাতস্থ হলো সুমন ! একবার নিজের গালে একটা চড় মারলো, বাথ্রুমে গিয়ে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে দেখলো কোথাও কোনো অস্বাভাবিক চিহ্ন ফুটছে কিনা, গলার কাছেও কিছু নেই - সম্পূর্ণ সুস্থ একটা লোক আয়নার ওপাশে দাঁড়িয়ে ! খালি তার চোখে-মুখে অপার্থিব ভয়ের ছাপ !

সুমনের মনে হলো সে পাগল হয়ে যাচ্ছে, পৃথিবীটা যেন দুলছে তার -  ইচ্ছে হলো প্রচন্ড জোরে একটা চিৎকার করে ওঠে - আর অবাক হয়ে দেখলো তার সমস্ত প্রাণশক্তি নিঙড়ে বের করা আর্তনাদটা গলা দিয়ে বেরলো ঠিক একটা পোষা টেরিয়ারের রাগী গর্জনের মতন ! ...

--

অনেক রাতের দিকে জ্ঞান ফিরলো বিপ্লবের ডাকাডাকিতে !
দরজা ভেঙে ঢুকে দমকল তাঁকে যখন সংজ্ঞাহীন অবস্থায় উদ্ধার করে, সুমন বাথ্রুমের মেঝেতে গলা আঁকড়ে পড়েছিলো ! পাশের বাড়ির বয়স্ক ডাক্তার চৌধুরী রাতের শেষ পেগটা ব্যালকনিতে বসে আরাম করে খান, আজ পাশের ফ্ল্যাট থেকে একের পর কুকুর-বিড়ালের পরিত্রাহি আর্তনাদ শুনে ভয় পেয়ে পুলিশকে ফোন করেন তিনি-ই!
বিপ্লব-ও শোয়ের সময় ছিলো, কিছু একটা অদ্ভুত ব্যাপার হচ্ছে দেখে রাত্রে বন্ধুকে অনেকগুলো ফোন করেও না পেয়ে একটা ট্যাক্সি ধরে চলে আসে সুমনের ফ্ল্যাটে !
বিপ্লবের ডাকে সাড়া দিতে দিতে সেই আবছা-অবচেতনের মধ্যেও সুমন বুঝলো, তার গলা দিয়ে যে আওয়াজ বেরোচ্ছে সেটা তার-ই, নিজের চেনা গলা !

--

বিপ্লবের মেসোমশাই অনেকবার অনুরোধ করেছিলেন, আর কয়েকটা শো করতে - একটা একটু গন্ডগোল তো কি হয়েছে? সুমনের সেই প্রথম শোয়ের ভিডিও এতদিনে দশ লক্ষ লোক দেখেছেন ! জয়দেব-বাবুর বাকি সব প্রোডাকশন মিলিয়েও এতো লোক হবে না ...

সুমন এখন আর স্ট্যান্ড-আপ করে না ! পুরনো চাকরিটা পেতেও তেমন বেগ পেতে হয়নি, বস উপাধ্যায় তাকে এককথায় আগের পোজিশান-টাই ফিরিয়ে দিলেন, এরকম একজন সেলিব্রিটি থাকলে টিমের সবদিক থেকেই ভালো, কোম্পানির ভিজিবিলিটি-ও বাড়ে, আজকাল তো লোকে চাকরির পাশাপাশি কতকিছুই না করছে !

তবুও সুমন আর স্ট্যান্ড-আপ করে না, বন্ধুদের পার্টিতেও না - সে বই পড়ে পড়ে ম্যাজিক শিখছে ! আয়নার সামনে বসে বসে একমনে পামিং আর পাসিং করতে করতে সময়টা দিব্যি কেটে যায়! বিপ্লবকে বলেছে জাদুকর মল্লিকের নাম্বারটা যদি এনে দিতে পারে - স্টেজে উঠুক না উঠুক, একটা কয়েন ভ্যানিশ করা শিখতে পারলেও অনেক !



পুনশ্চঃ  আমি গত কয়েকদিন ধরে টানা 'গল্প ১০১' পড়ছি, কেন ঠিক জানিনা ! হয়তো হঠাৎ ছোটোবেলা ফিরে পাওয়ার ইচ্ছে - সেই যখন পড়ার বইয়ের তলায় গোগ্রাসে গিলতাম 'এবারো বারো', 'আবার বারো'-র গল্পগুলো ... আমার এই গল্পটা সেই সব  আশ্চর্য গল্পের স্রষ্টা সত্যজিত রায়ের প্রতি সামান্য এবং অতিশয় অক্ষম একটা ট্রিবিউট !

Thursday, October 12, 2017

টুকি !



আমাদের মতন অ্যাকাডেমিকদের জীবনের একটা বড়ো সময় কাটে ক্লাসঘরে, আর ছোটো থেকে বড়ো হওয়া মানে আসলে প্রবল সংগ্রাম করে কোনোমতে টেবিলের একদিক থেকে আরেকদিকে এসে বসা - আজ থেকে দশ বছর আগের এই দিনে হয়তো কোথাও কাঁপতে কাঁপতে পরীক্ষা দিচ্ছিলাম, আজ হয়তো হাই তুলতে তুলতে গার্ড দিতে দিতে ভাবছি সময়টা কোথায় কেটে গেলো, টের-ই পেলুম না ... ভাবতে ভাবতে মনে পড়লো ছোটোবেলার সেই পরীক্ষার দিনগুলোর কথা - জীবনে সব থেকে ভয়ের দুটো শব্দ, হাপিয়ার্লি আর অ্যানুয়াল ... আর মনে পড়লো সেইসব দুর্যোগের দিনে কিছু অসাধারণ সাহস এবং তার চাইতেও অসাধারণ উদ্ভাবনী শক্তির গপ্পো ...

বলাই বাহুল্য, সব চরিত্র কাল্পনিক ... এবং সব ঘটনাও কাল্পনিক, আর তা ছাড়া আমার বয়ানে টুকলি বা হলে-ম্যানেজ করার গপ্পো মানে গাভাস্করের টি-টোয়েন্টির কমেন্টারি, মাঠে নামলে কি ছড়াতাম কেউ জানে না, তা-ও ... বলতে কি আছে?

ইস্কুলে পড়ার সময়ে দেখতাম পরীক্ষার গার্ড দুই প্রজাতির হয়, প্রথম প্রজাতি মহা ঘোড়েল, হলে টুকলি ধরায় সাক্ষাৎ শার্লক, চোখে কালা চশমা পরে টহল দেন যাতে কার উপর শনি দৃষ্টি পড়ছে বোঝা দায় হয়, হিসু করতে গেলে পিছু নিয়ে টয়লেট অব্দিও যেতে থামেন না, আর ধরা পড়লে হয়ে গেলো ... সে ট্রমা আর ইহজীবনে কাটার নয় ... আরেক দল, নির্বিবাদী, সাতে-পাঁচে নেই, উদাস মুখে খাতা বিলোন, ব্যাজার মুখে বসে থাকেন, বড্ড টোকাটুকি হলে মৃদু গলায় বলবেন, 'এই তোমরা একটু আস্তে গোলমাল করো, পাশের ঘরেও পরীক্ষা হচ্ছে' ... দুঃখের (মতান্তরে আনন্দের) বিষয় আমাদের ইস্কুলে প্রথম ক্যাটেগরির অনেক স্যার ছিলেন, কেউ কেউ হলে ঢুকলে চোতা করুন না করুন, মনে ঘাড় ঘোরানোর চিন্তা এলেও কেমন যেন শিরশিরিনি হতো ... বাধ্য হয়েই বাঙালী শাবক অল্প কল্পনাপ্রবণ হয়ে পড়তো ...

ইতিহাস পড়তে গিয়ে দেখতাম, পাতায় পাতায় গাদা গাদা নাম আর কোটেশান ...  এই রোমিলা থাপার মহেঞ্জোদাড়ো নিয়ে কি বললেন, তো তারপরেই ব্যাশাম-সাহেবের কবিতার মতন উক্তি ... সেসব গাঁত করতে গিয়ে সত্যি বলতে যতো ঐতিহাসিকদের নাম শিখেছিলাম, অতো অঙ্কবিদকে এখনো চিনি কিনা সন্দেহ ... আর ইতিহাস একে ভারী রোম্যান্টিক সাবজেক্ট, তায় মাটির মতো নমনীয়, শেপ-শিফটার ... এই বয়সে এসে বুঝি ইতিহাস শুধুই বিজয়ীর গল্প, বিজিতের নয় ...

যা হোক, ইতিহাস পরীক্ষা চলছে, এক বন্ধু নীলু অনেক টেনে হিঁচড়ে সিন্ধু সভ্যতা-টভ্যতা নিয়ে অনেক কান্নাকাটি করে দেখলো, একটাও কোট মনে পড়ছে না, এমন কি লোকের নাম-ও না (সেই যুগে উড়ুক্কু কুমীর-ওয়ালা সিনেমাও বেরোয়নি) ... কিং করিষ্যামি? কি বুদ্ধি এলো, পাশে পরীক্ষা দিচ্ছিলো একটা ক্লাস ফাইভের বাচ্চা, তাকে জিজ্ঞেস করলো, 'এই তো বাবার নাম কি?' নিরীহ ব্যাঙ্ক বাবু জানতেও পারলেন না, কতো গম্ভীর-জ্ঞানমারানি উক্তি সেদিন তাঁর নামের সাথে জুড়ে গেলো ... অবিশ্যি আমাদের দ্যাশের ইতিহাসে পুষ্পক রথ এসে হরপ্পার খানা-খন্দরে পার্ক করতে শুরু করেছে এখন, সে তুলনায় এ আর কি এমন ...

নাইন-টেনের সিলেবাস সেদিক থেকে বেশ সোজা, স্বাধীনতা আন্দোলন, বই না হয় পড়িনি, কিন্তু সিনেমা দেখেচি, টিভিতে দুর্দান্ত সিরিয়াল দেখেচি 'দেশ আমার দেশ', আমায় কে ঠেকায়? কিন্তু প্রশ্ন-ও তেমন বিটকেল, পাঁচ নম্বরের টীকা লেখো, 'তিনকাঠিয়া ব্যবস্থা কি?' মনে অনেক কাঠির কথা আসে, সে কি আর লেখা যায়? একবার টেস্টে এলো নব্যবঙ্গ আন্দোলন ... তা আন্দোলন হবে, দু-চারটে বডি পড়বে না, সে কি হয়? ডিরোজিও বোধহয় সেই শীতে কবরে কয়েকবার এপাশ-ওপাশ করেছিলেন ...

এক দিদির মুখে (কলমে বলা ভালো) এই নিয়ে একটা গল্প শুনেছিলাম, তাদের প্রশ্ন এসেছিলো থিওসফিক্যাল সোসাইটি ... পাশে খোঁচা মেরে জানা গেছে শুধু দুটো নাম, অ্যানি বেসান্ত আর তিলক, ব্যাস ওইটুকুই ... বললাম না কল্পনাশক্তি? সে উত্তর শুরু করলো 'থিওসফিক্যাল সোসাইটি শুরু করায় তিলক ও অ্যানি বেসান্তের ভূমিকা অপরিসীম', মাঝে অনেক কিছু হাবিজাবি, সাহেবদের ক্যালানি, কিছু বন্দেমাতরম, কিছু ডান্ডী মার্চ ঢুকিয়ে পাতা ভরিয়ে শেষে মহার্ঘ উক্তি, 'এইভাবে থিওসফিক্যাল সোসাইটির মধ্যে দিয়ে অ্যানি বেসান্ত ও তিলকের খুব ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে ওঠে' ...

ইতিহাস অবিশ্যি আমার সত্যি বলতে দারুণ লাগতো (এখনো লাগে) - ভয় পেতাম লাইফ সায়েন্স, কোচিং ক্লাস থেকে দিস্তে দিস্তে নোটস নিয়ে আসতাম, প্রকট ও প্রছন্ন বৈশিষ্ট্য কারে কয়? (উঃ প্রকট আমি ক্যাবলা, প্রছন্ন আমি অত্যন্ত হিংস্র), কানের ককলিয়ার কটা প্যাঁচ থাকে? (উঃ ২ পূর্ণ ৩/৪, গাঁত দেখেচো?) ... মুখস্ত করতে করতে চোখে জল এসে যেতো, তাও নিস্তার নেই ... এতো সব গেঁতে গিয়ে প্রশ্ন এলো, মেন্ডেল-সাহেব কেনো মটর গাছ নিয়ে পেয়াঁজি করেছিলেন? এবং নাঃ, তাঁর গীর্জার পাশে মটরের ক্ষেত ছিল লিখলে শুন্য পাবেন !

এর মাঝে ক্লাস সেভেন-এইটে অল্পদিনের জন্য আতঙ্ক ছড়িয়ে চলে গেছে সংস্কৃত - আমাদের হিন্দি-ফ্রেঞ্চ বা জর্মন এর ব্যাপার ছিলো না, বটুকদা পান খেতে খেতে এসে বেত দিয়ে তশরিফ লাল করে চলে যেতেন, তাতেও অবশ্য কাজ হতো বলা যায় না ... এক বন্ধু খেলার কথা ভাবছিলো, অতো খেয়াল করেনি কি হচ্ছে ক্লাসে, দেবনাগরী হরফ দেখে হিন্দি-র কিছু একটা জটিল ব্যাপার ধরে নিয়ে পরীক্ষার খাতায় ট্রান্সলেশন করে এসেছিলো, 'অযোধ্যাং মেঃ দশরথং নামশ্চ একং রাজন থাঃ' ... হয়তো সে এখনো দুঃস্বপ্নে শব্দরূপ আর অনুস্বার-বিসর্গ দ্যাখে !

স্কুল পেরোতেই দেখলাম  সবাই মিলে হুড়ো তুলে এমন অঙ্ক-ফিজিক্স-বায়োলজি করে যে বেচারা বাংলা-ইংরিজি ফাঁকি পড়ে যায় ... মাধ্যমিকে লোকে তা-ও যা পড়তো একটু নম্বরের লোভে, উঃমাঃ আর জয়েন্ট ফয়েন্ট এসে তার বাজার এক্কেবারেই মেরে দিয়ে গেলো ... টুয়েলভের সিলেবাসে শরৎবাবুর গল্প ছিলো, 'মহেশ', ভারী কষ্টের ... আমিও চোখ মুছতে মুছতে পাতা দুয়েক লিখে ঠাহর করলাম, গরুর নাম মহেশ না গফুর কিছুতেই মনে পড়ছে না, গল্পটা সেই ছোটোবেলার পরে আর পড়িনি ... শেষমেশ লিখে এলাম, 'গল্পের শেষে এক করুণ বিয়োগের সুর বাজে, আর সেই সুরে গফুর আর মহেশ, গরু আর মানুষ, কোথায় যে মিশে যায় বোঝা যায় না ... '

এদিকে অল্পদিন পরেই জয়েন্ট, তবে এক রামে রক্ষা নেই, লক্ষ্মণ দোসর, তাই আমি উজিয়ে শহরের অন্য প্রান্তে গিয়ে মক-টেস্ট দিয়ে বেড়াই। তো এরম এক মক-টেস্ট দেওয়ার আগে এক প্রাণের বন্ধু, (ধরে নেওয়া যাক তার নাম শিবু) সে-ও আমার মত দুর্ভাগা, বললো বায়োলজি আর অঙ্কটা একটু হেল্প করে দিলে সেও বাবার ক্যাল থেকে বেঁচে যায়, আমার-ও কপালে মহামায়াতলার দোকানের এগরোল নাচছে ...

তো পরীক্ষা শুরু, দুটো হাফ, মাঝে টিফিন ব্রেক - ইনভিজিলেটার আসছে, এদিক-ওদিক দেখে চা নয় বিড়ি খেতে কেটে পড়ছে আর  আমি মাঝে মাঝে কনুইয়ের গুঁতো খেয়ে রিলে করে যাচ্ছি, হঠাৎ শুনি আরেকটা মৃদু গুঞ্জন ঠিক ইকোর মতন কানে আসছে ! তাকিয়ে দেখি মহানুভব শিবু আমার থেকে জ্ঞান আহরণ করে থেমে থাকছে না, জনকল্যাণে সবার মধ্যে ছড়িয়ে দিচ্ছে । তা উদ্দেশ্য মন্দ নয়, কিন্তু বিধি বাম, কানে অল্প খাটো ... তাই যা দাঁড়াচ্ছে তা এক অসামান্য চীনে-ফিসফাস, এই যেমন ... প্রশ্ন একটি endangered species-এর নাম লিখ, শিবুকে স্পষ্ট বললাম ওয়ান-হর্ণড রাইনোসেরস, দু-সেকেন্ড পরে শুনলাম পিছনে রিলে হচ্চে ওয়ান-হর্ণড ডাইনোসরাস ... ভেবে দেখলাম প্রতিবাদ করে লাভ নেই - endangered আর extinct এর মধ্যে ফারাক-ই বা কতটুকু?



অঙ্ক পরীক্ষা চুপচাপ কাটিয়ে দিলাম, হল থেকে বেরিয়ে শিবু একগাল হেসে বললো, ওই কি একটা অঙ্কে দেখলাম প্রত্যেক লাইনে একটা চাউমিন সিম্বল দিয়ে গেলি, আমি ওইটা কাটিয়ে বাকিটা হুবহু মেরে দিয়েছি ... (বাসে উঠে বাড়ি ফিরতে ফিরতে বুঝেছিলাম, চাউমিন সিম্বল আসলে ইন্টিগ্রেশানের লম্বাটে S! )


(প্রসঙ্গতঃ, শিবু এখন একজন সফল ডাক্তার, আমাদের নিশ্চয়ই কোনোদিন দেখা হবে, হয় এপারে, নয় ওপারে, নয়তো আসা-যাওয়ার ঠিক মাঝে) ...


আই-এস-আইতে তো এমনিতেই ক্রিয়েটিভিটির চাষ, উত্তর-ও সব আসতো বাঘা বাঘা - তবে সেসব গপ্পো ফেঁদে বসলে এই বুড়ো বয়সে ভাত-কাপড়ে মারা পড়ার সমূহ সম্ভাবনা, তাও গোটা দুয়েক না করে থাকা যাচ্ছে না, করেই ফেলি ...

আমাদের পরের ব্যাচ, পড়ানো হয়েছে স্পুরিয়াস কোরিলেশান, মানে আপাত সম্পর্কহীন দুটো জিনিষের একটা বাড়লে অন্যটাও বাড়ে, আসলে হয়তো ভেতরে অন্য কেউ কলকাঠি নাড়ছে - চাদ্দিকে এর মেলাই উদাহরণ, এই যেমন আপনার মাইনেও বাড়ছে আর পাল্লা দিয়ে ব্লাড প্রেশার, হয়তো দেখা যাবে, মাইনে বাড়ছে বয়সের সাথে, রক্তচাপ-ও তাই ... আবার কিছু মাথামুন্ডু নেই এমন জিনিষেও কোরিলেশান বেশি হতেই পারে, Zআনতি পার না ... (অত্যুৎসাহীদের জন্য একগাদা উদাহরণ রইলো এখানে) ... যা হোক, তা মিড-সেমেস্টার প্রশ্ন এসেছে, 'মানুষের উচ্চতাও যেমনি বাড়ছে, মাথার চুলের ঘনত্ব তেমনি কমছে ... ক্যায়সে?' আমার এক প্রিয় জুনিয়র দুর্ধর্ষ উত্তর লিখে এলো, 'লম্বা লোকের টাক সূর্যের অনেকটাই কাছে, সেখানে গরম বেশী, খুব ঘাম ... ঘেমো টাকে অল্প চুল যদি না-ই পড়লো, তা'লে আর ঘেমে লাভ কি?' (বলাই বাহুল্য, বোরিং লোক হলে আপনি ভাবতেই পারেন, না আসলে হয়তো হাইট আর জেন্ডার সম্পৃক্ত, কিন্তু তাতে কার কি?)

দুই, আমাদের অনেক অনেক পরের ব্যাচের এক ছাওয়াল, দেখি মনের কষ্টে ঘুরে বেড়াচ্ছে, গাদা ব্যাক পেয়ে অল্প ফুস অবস্থা, তাকে বললাম এতো শক্ত শক্ত কোর্সগুলো বেছে বেছে কেউ নেয়? সে রেগে গিয়ে বললো ,"কি করবো, যার থেকে টুকি সে ব্যাটাও ঐগুলোই নিয়েছে !"

বিদেশে এসে অবশ্য আর টোকাটুকি খুব দেখি না, হয় লোকে টোকে না, বা এত বুদ্ধি করে ম্যানেজ করে যে চট করে দেখা মেলে না ... এখানে টুকলি-কে আর লোকে হল-কালেকশন বলে গ্লোরিফাই-ও করে না, সোজা বলে চিটিং ... আর ধরা পড়লে ওইখানেই গর্ত খুঁড়ে ঢুকে পড়াই বোধহয় সবথেকে ভালো, বেরিয়ে বাকী জীবনে আর কিছু করার চান্স প্রায় নেই বললেই চলে ...

তবে টুকলি তো সারাদিন-ই চোখে পড়ে, ফেসবুকে-হোয়াটস-অ্যাপে ... কপি-পেস্ট করে পানু জোকস থেকে শুরু করে বিবেকানন্দ-র বাণী, সিনেমার খিল্লি, দেশাত্মবোধক টোটকা সব-ই ভেসে বেড়াচ্ছে নিরন্তর ... সেই শিকলি-গাঁথার মতোন, কোনো এক খচড়া লোক কোনো এক স্টেপ লেখকের নামটা টুক করে মুছে লিখে দ্যান, #copied অথবা আরো এক কাঠি সরেস, ভুল বানানে লেখা থাকে #সংগ্রহীত !!

'গঙ্গা তুমি-কোথা হইতে আসিতেছো?'
Ctrl-C র জটা হইতে
'গঙ্গা, তুমি কোথায় যাও?'
Ctrl-V -র পদতলে


যে বয়সে করলেও করা যেতো, পারিনি ... মিথ্যে বলবো না, সেই যৌবনের উপবনে বার দুয়েক চোতাও বানিয়েছিলাম ... বানাতে বানাতে দেখলাম দিব্যি পড়া হয়ে গেলো, আর নিয়ে যাওয়ার দরকার পড়লো না ... এখন এই বার্ধক্যের বারাণসীতে অনেক প্রশ্ন আসে সামনে, জীবনের পরীক্ষার হলের এপাশে বসে বসে ঘেমে যাই কলারের তলায়, এদিক-ওদিক তাকিয়ে দেখি গার্ডও নেই, বন্ধুরাও পাশ-টাশ দিয়ে অফিসের বড়োবাবু হয়ে বসে আছে ... এদিকে দশ নম্বরের প্রশ্ন, না পারলেই লেটার মিস ...

সেই ভয়েই গ্যাঁজাখুড়ি দিয়ে দিয়ে পাতা ভর্তি গল্প লিখে যাই আজকাল, সময় ফুরিয়ে গেলে খাতা জমা দিয়ে যেতে যেতে বলে দেবো, "যা পেরেছি লিখে দিয়েছি, এর বেশী আর কিছু জানিনা স্যার" !!