“I took a deep breath and listened to the old brag of my heart.
I am, I am, I am.”
Sylvia Plath, The Bell Jar
“Nobody wanted your dance,
Nobody wanted your strange glitter, your floundering
Drowning life and your effort to save yourself,
Treading water, dancing the dark turmoil,
Looking for something to give.”
Ted Hughes, Birthday Letters.
সিলভিয়া প্ল্যাথের মৃত্যুর পয়ঁত্রিশ বছর পরে,
আর নিজের মৃত্যুর কয়েক মাস আগে টেড হিউজের শেষ কবিতার বই,
বার্থডে লেটারস প্রকাশিত হয়
...৮৮ খানা কবিতা,
অথবা চিঠি,
যেন মাটির গভীরে ঘাস হয়ে যাওয়ার আগে রুমাল নাড়তে নাড়তে ইশারা করে গেলেন বিংশ শতাব্দীর অন্যতম সেরা কবি টেড হিউজ,
পোয়েট লরিয়েট টেড হিউজ, প্ল্যাথের মৃত্যুর আগে তাকে বেধড়ক মারধোর করা টেড হিউজ,
ঈশ্বরীর মৃত্যুকামনা করা ঈশ্বর টেড হিউজ
...
প্ল্যাথের সমাধির উপর উৎকীর্ণ লেখাটি পছন্দ করেছিলেন টেড নিজে,গীতার বাণী থেকে। সেই সমাধি ফলকের উপর হিউজের পদবী ঘষে তুলে ফেলতে চেষ্টা হয়েছে বহুবার ... অথচ, ক্ষতচিহ্নের মতো ওয়েস্ট ইয়র্কশায়ারের সেই সমাধির উপরে এখনো জ্বলজ্বল করে এপিটাফ, "In Memory, Sylvia Plath
Hughes, 1932-1963, ‘Even amidst
fierce flames the golden lotus can be planted’”
কিন্তু আমার এ লেখা হিউজ-এর কথা নয়, এ লেখা
ময়না তদন্ত নয়, রাক্ষসের গল্প নয়,পরকীয়া প্রেমের বা পাপবোধের নয়,
এ লেখা এক
কবির মৃত্যুকে
দেখা নিশ্চিন্ত দূরত্ব থেকে ...অন্ধকার উত্তাল সমুদ্রকে যেমন শোনে বধির নাবিক ...
আর তার চোখে পড়ে জাহাজ আছড়ে পড়ার কিছু আগে ও কিছু পরে রয়ে
যাওয়া দু-একটি অস্পষ্ট আলোর বিন্দু ... যে দু-একটি বিন্দু দূর থেকে জেগে থাকে লাইট-হাউসের মতো
...
----
পাশাপাশি দুটো ছবি দেখা যায় ঠাহর
করলে – প্রথমটা ১৯৫৩-
কোনো একটা অজানা সমুদ্রতীর-এ
প্ল্যাথ, আলোর মত বেয়ে চলেছে তার হাসি,
একে দেখে লেখাই যেতো,
'সূর্য খুশি হলেন,
তার পুনরায় যুবা হওয়ার সাধ হলো'
... সেই বছরেই অগাস্টে মায়ের বাড়ির সেলারে ওভারডোজ করবেন লেডি ল্যাজারাস
... কিন্তু খাদের ধারে পড়তে গিয়েও দু-একটা পাথর আটকে যায় যেমন ঝোপে
... রয়ে
গেলেন প্ল্যাথ ...
আর একটি ছবি ঠিক তার পাশেই,
একটা সাদা-কালো দুঃস্বপ্ন
... এটির তারিখ ১১ ফেব্রুয়ারী,
১৯৬৩
- খোলা ওভেনের ভেতর থেকে একটি অর্ধেক দেহ বেরিয়ে আছে,
পায়ে হিল,
হাতে গ্লাভস।
ফিটজরয় রোডের বাড়ি (যে বাড়ির এককালের বাসিন্দা ছিলেন বিখ্যাত কবি W. B. Yeats)। পাশের ঘরে দুই ঘুমন্ত শিশু,
মাঝের দরজার
ফাঁক-ফোঁকর বন্ধ করা টেপ দিয়ে,
টাওয়েল
গুঁজে। দুধ-রুটি সাজিয়ে রাখা ঘুম থেকে উঠে খিদে পেলে তারা যাতে খুঁজে পায় ... প্ল্যাথের বয়েস সেই সকালে ত্রিশ বছর,
তিন মাস,
ষোলো দিন
!
একদিকে
উজ্জ্বল আলো,
আর তাকে পরতে পরতে জড়িয়ে থাকা পাপের মত নিকষ অন্ধকার
... প্ল্যাথের জীবনের সব ছবি মিশে গিয়ে যেন এই একটি অবয়ব-ই ফুটে ওঠে
!
আত্মহত্যা বড়ো কলঙ্কময়, বাড়ির কেউ চাননি বেশী প্রচার হোক।
বস্টন গ্লোব আর বস্টন হেরাল্ডে বেরিয়েছিলো সামান্য অক্ষরে একটি খবর, তাও ‘H’
এর ঘরে, প্ল্যাথের বিবাহোত্তর পদবী-ই
যে তার পরিচয়! খবর তাও বেরিয়েছিলো, সেন্ট প্যানক্রাস ক্রনিকলের
পাতায়, “Tragic Death of Young Authoress” … খবরে এ-ও বলা ছিলো, যে মনোরোগের ডাক্তার
দেখানোর পরামর্শ দিয়েছিলেন মিসেস সিলভিয়া প্ল্যাথ হিউজের ডাক্তারবাবু, কিন্তু সে চিঠি
ঠিকানায় পৌঁছয়নি, ইশ !
অবশ্য আশ্চর্য যে কেউ হয়েছিলেন, একথা
হলফ করে বলা যায় না ! ১৯৬২-তে ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছে টেড হিউজের সাথে (যাঁর সাথে ঘর
ছেড়ে ঘর বেঁধেছিলেন হিউজ সেই অ্যাসিয়া উইভিল-ও পরে আত্মহত্যা করেন, সেই এক-ই উপায়ে,
গ্যাস ওভেনে মাথা রেখে) ...আর তার কিছুদিন পরে উপন্যাস “বেল জার” প্রত্যাখ্যাত
হয়েছে জুডিথ বি জোন্স-এর কাছে ! “বেল জার” পড়ে যার প্রতিক্রিয়া ছিলো, “To be
quite honest with you, we didn’t feel that you had managed to use your
materials successfully in a novelistic way,” ...
জীবনের শেষ কয়েক
মাস সিলভিয়া প্ল্যাথ লিখে চলেন একের পর এক কবিতা, যে কবিতা একদিন ওকে এনে দেবে
অমরত্ব তুচ্ছ করার অধিকার ... পৃথিবীকে তাঁর মনে হতো একটি দূরের নিভে যাওয়া
নক্ষত্র, একটি বেল জার ! "To the person in the
bell jar, blank and stopped as a dead baby, the world itself is a bad
dream."
অক্টোবর সাতাশ,
১৯৩২ সালে জন্ম হয় প্ল্যাথের (হিসেব করে দেখলাম, বেঁচে থাকলে আমার দিদুর বয়সী হতেন
তিনি) ... বাবা প্রোফেসর অটো এমিল প্ল্যাথ, মারা যান আট বছর বয়সে, না অরেলিয়ার পরিশ্রমে
চলতে থাকে তালি-দেওয়া সংসার ... বাবা হারানোর শোক বোধহয় কোনোদিন-ই কাটিয়ে উঠতে
পারেননি প্ল্যাথ, তার জীবনের সেই কয়েক বছরের দিকে বারবার ফিরে তাকিয়েছেন লেখার
মধ্যে ... সেই ন’বছর যেন "sealed themselves off like a ship in a
bottle—beautiful, inaccessible, obsolete, a fine, white flying myth"
১৯৫৩ সালে হার্ভার্ডের রাইটিং কোর্সে রিজেকশন
এলো, সঙ্গে এলো ব্রেক-ডাউন ! শক-থেরাপি চালু হলো, আর সেই বছরেই গ্রীষ্মেই ঘুমের
ওষুধের শিশি গলায় উপুড় করলেন সিলভিয়া প্ল্যাথ ...
টেড হিউজ এলেন তার তিন বছর পরে, কেমব্রিজের এক পার্টিতে আলাপ – ডায়রিতে প্ল্যাথ
লিখেছেন সেই ‘এনকাউন্টারের’ কথা, টেড হিউজের গাল কামড়ে রক্ত বের করে দেওয়ার গল্প !
এর চার মাসের মধ্যে ভবিষ্যতের পোয়েট লরিয়েট-কে বিয়ে করেন সিলভিয়া ...
সে সম্পর্ক ভেঙে যায় বাষট্টিতে। ঈর্ষায়, ঘৃণায়
জর্জরিত, স্লিপিং-পিলস-অ্যাডিক্ট প্ল্যাথ তখন একা, সঙ্গে দুই ছেলেমেয়ে ... ভোরবেলা
তারা ঘুম থেকে ওঠার আগে প্ল্যাথ লিখে চলেছেন একের পর এক নষ্ট রূপকথা – একে একে
নেমে আসছেন ‘লেডি ল্যাজারাস’, আসছে ‘ড্যাডি’র মতো স্বীকারোক্তি-কাব্য (কনফেশনাল
পোয়েট্রি) !
সে রূপকথায় তবু ভালোবাসা ছিলো বলে বোধ হয়,
যেন আঘাতের মোড়কে ছিলো আশ্লেষ,
দীর্ঘ যন্ত্রণার ছদ্মবেশে ছিলো প্রেমের চিঠি ... প্রেমিক-কে লেখা কবিতা তাই যেন হয়ে ওঠে প্রেমিকের থেকেও স্পষ্ট,
আরো কাছের ...
“I shut my eyes and all the world drops dead;
I lift my lids, and all is born again.
(I think I made you up inside my head.)
The stars go waltzing out in blue and red,
And arbitrary blackness gallops in:
I shut my eyes and all the world drops dead.”
১৯৬২-তেই বেরোয় ‘উইন্টারিং’, যার শেষ
কবিতায় প্ল্যাথ লিখে রাখলেন, "Will the hive survive,
will the gladiolas/Succeed in banking their fires/To enter another year?"... আরেকটি বসন্ত আসবে কি? ভিতরে-বাইরে? "The bees are flying,"
শেষ পংক্তিতে উত্তর মিশে যায় আকুতিতে, “They taste the
spring."
যেন এক ক্রমশঃ আবর্তে ঘুরপাক খেতে থাকা একজন হাত বাড়িয়ে ছুঁতে চাইছে বুঝতে চাইছে ঘূর্ণির গতিপথ,
আর প্রত্যেক মুহুর্তে আরেকটু অন্ধকারের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে সে
... প্ল্যাথ লিখে রাখছেন তার জর্নলে, “It is as if my life were
magically run by two electric currents: joyous positive and despairing
negative. “Whichever is running at the moment dominates my life, floods it.”
আর
সেই ঘূর্ণির ফাঁকে ফাঁকে তিনি যেন বুঝে ফেলছেন জীবনের গভীরতম এবং তুচ্ছতম রহস্য
... ‘অর্থ নয়, কীর্তি নয়, স্বচ্ছলতা নয়’, প্ল্যাথের জার্নাল বলে চলেছে ...
“With me, the
present is forever, and forever is always shifting, flowing, melting. This
second is life. And when it is gone it is dead … It’s like quicksand… hopeless from the start.”
এই তো সেই পরিচিত চোরাবালি, যাতে
ডুবে যেতে চেয়েছি আমি যাবতীয় জন্মদোষ-সমেত? এই তো সেই বোবামানুষের গলা বেয়ে উঠে
আসা আপ্রাণ চিৎকার ...এই তো সেই বিষ, এই তো সেই বিষণ্ণকরণী?
লিখতে ইচ্ছে করে না যখন, যখন
মাঝে মাঝে মেঝেতে পড়ে গোঙাতে ইচ্ছে করে, তখন ফিরে যেতে চাই প্ল্যাথের পৃথিবীতে
... জার্নালের এক পাতায় দেখি আমি-ই যেন
লিখে রেখেছি, “Very depressed today. Unable to
write a thing. Menacing gods. I feel outcast on a cold star, unable to feel
anything but an awful helpless numbness.”
অর্ধেক
জীবন জোড়া বিষাদ, অনন্ত
সে বিষাদ,
পুকুরের ঘাটের কাছে পোষা রুই-কাতলার মতো বিশ্বস্ত বিষাদ
... গোড়ালি ডুবতে-না-ডুবতে চলে আসে তারা
...
আর একরকমের ভয় !
বুড়ো,
বাতিল হয়ে যাওয়ার ভয়,
বিশাল বড়ো মেলায় গেলে যে ভয়-টা করে,
এই বুঝি কোথাও একটা দুম করে আওয়াজ হলো,
অমনি শয়ে শয়ে বুটজুতোপরা পা আমার ঠিক ওপর দিয়ে চলে যাবে, অথচ চিৎকার-ও
বেরোবে না গলা দিয়ে ... সেই,
একদম অবিকল সেই ভয়
!
"What horrifies me most is the idea of
being useless: well-educated, brilliantly promising, and fading out into an
indifferent middle-age."
এ লেখা পড়ে আমি চমকে উঠি,
ভয় পেয়ে যাই,
এই গলার স্বর আমি চিনি! আমার কানের কাছে বিনবিন করেছে কে যেন জন্মমুহূর্ত থেকে প্রত্যেকটা
দিন, কে যেন বলেছে মিলিয়ে যেয়ো না হাওয়ায়, ঘরের ধুলোর মতো
... অমনি
আমি ঘেমে উঠি কলারের নীচে
... সেই
মুহূর্তে কোথা থেকে যেন একটা ঠান্ডা হাওয়া দেয়,
শৈত্যপ্রবাহ হয় অবিকল,
হিমাঙ্কের নীচে এক-পা এক-পা করে যেতে প্ল্যাথ এঁকে রাখছেন,
"How she longed for winter then! –
Scrupulously austere in its order
Of white and black
Ice and rock, each sentiment in border,
And heart’s frosty discipline
Exact as a snowflake.”
আর না,
আমি জানিনা,
আমার খাদ ভালো লাগে না তার পাশের অভ্রংলেহী পর্বত
- তিমিরবিলাস না তিমিরবিনাশ?
জানিনা,
যেমন এই মূহুর্তে আমি জানিনা,
দরজা খুললে বাইরে আলো না অন্ধকার
...
“Tomorrow I will curse
the dawn, but there will be other, earlier nights, and the dawns will be no
longer hell laid out in alarms and raw bells and sirens.”
সেই দরজার চাবিকাঠি কি ছিলো প্ল্যাথের হাতে?হয়তো বা ! মার্কেজের নায়ক সান্তিয়াগো নাসারের মতো, প্ল্যাথের মৃত্যুও যেন হয়ে ওঠে chronicle of a death foretold … যেন হত্যার আগেই ঘাতকের ছুরি থেকে ঝরতে থাকে রক্ত ! প্ল্যাথের শেষ কবিতা ‘Edge’, শেষ দুটি চিঠির মধ্যে, অনন্ত আগামী আর দীর্ঘ গতকালের ক্ষতচিহ্নের মধ্যে ভ্রূণের মত শুয়ে থাকা সে কবিতায় স্থির চাঁদ যেন দেখতে থাকে নিঁখুত একটি মৃতার দেহ -
‘The moon has nothing to be sad about,
Staring from her hood of bone.
She is used to this sort of thing.
Her blacks crackle and drag.’
আর
ঠিক সেই মূহুর্তে প্ল্যাথ হয়ে ওঠেন আমার একান্ত বাঁশিওয়ালা
... আমার
মিথ্যে রূপকথার একমাত্র নায়ক,
সে যেন রাক্ষসের গুহায় যেতে যেতে একটু একটু করে ছড়িয়ে যাচ্ছে রুটির টুকরো
... অথচ
সে গুহা থেকে আমরা কেউ-ই ফিরতে চাই নি
কোনোদিন ...