Tuesday, July 13, 2021

এভাবেও ফিরে আসা যায়?

একটাই কবিতা, জীবনে কতোবার কতরকম ভাবে ফিরে আসে!

দ্য লাস্ট রাইড টুগেদার, ব্রাউনিং-এর, যেমন।

ছোটোবেলায় পড়েছি বলে মনে হয় না কারণ অতো ইংরেজি পড়ার ক্ষমতা ছিলো না। মনে হয় কলেজে পড়ার সময় একটা অ্যান্থলজি কিনেছিলাম, সবুজ মলাটের পেপারব্যাক বই, প্রথম পাতায় ঝর্ণা কলমে আবছা নাম সই করা। ভেতরে অনেক লোকের বিখ্যাত বিখ্যাত কবিতা আর মার্জিনে ছোটো ছোটো নোট - সিলেবাসের, সাজেশনের আঁচড়। তার মধ্যে একটা কবিতা ছিলো 'দ্য লাস্ট রাইড টুগেদার'।
পড়ার পরেই ইচ্ছে হয়েছিলো একজন কলকাতা ছেড়ে পাকাপাকি চলে যাওয়ার আগে তাকে শোনাবো। জিভের জড়তা, বাংলা মিডিয়ামের শ-ষ-স-হ হোঁচট ও খানাখন্দের ভয়ে আর শোনানো হয়নি। A. E. Housman-এর একটা লাইন বলে এসেছিলাম।
'The wind and I, we both were there,
But neither long abode;
Now through the friendless world we fare
And sigh upon the road.'
তার প্রায় বছর বারো কি তেরো পরে একদিন বাঙালনামা পড়তে গিয়ে দেখি ও'মা আমি একা নই। তপনবাবুও ভেবেছিলেন, এবং পারেননি, এবং আর সবাইকে ছেড়ে হাক্সলি লিখে এসেছিলেন। সে-ও এক অদ্ভুত মেলানকলিক বর্ণনা, পড়তে পড়তে একটা দীর্ঘশ্বাস চেপে যেতে হয়। 'বাঙালনামা'র সেই অংশটুকু হুবহু টুকে দিলাম নীচেঃ
"জেইব্রুখ থেকে এস্টোয়ার্প। বহুবার দেখা এই শহর। সেখানে পুরাতন বান্ধবী রিকা ওরফে ফ্রেডারিকা অপেক্ষা করছিল। হেগ অভিলেখাগারে ওর সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল। সে তখন এন্টোয়ার্প বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণার ছাত্রী। ডাচ ভাষায় যাকে বলে ব্লন্ডচ্যা, স্বর্ণকেশী বালিকা, চোখের মণিতে সবুজের আভা। তারপর ক’বার এন্টোয়ার্পের কাছে ওদের বাড়ি হোবোকেন গ্রামে গিয়েছি। একসঙ্গে বুখ খেন্ট বেড়িয়েছি। এবারও গেলাম। একবার ইচ্ছে হয়েছিল ব্রাউনিংয়ের লাস্ট রাইড টুগেদার ওকে শোনাই। কিন্তু কেমন যেন হাসি পেল। ব্রাউনিংয়ের বদলে অলডাস হাক্সলি থেকে দুটি লাইন ওর অটোগ্রাফের খাতায় লিখে দিলাম: “ট্র্যাজেডি ইজ দা ফার্স হুইচ ইনভলভস আওয়ার সিমপ্যাথি। ফার্স ইজ দা ট্র্যাজিডি হুইচ হ্যাপেনস টু আদার্স।” এন্টোয়ার্প স্টেশনে ডেন হাগের ট্রেনে উঠলাম। অনেক দূর অবধি দেখতে পেলাম—রিকা রুমাল নেড়ে বিদায় জানাচ্ছে। ওর সঙ্গে আর কখনও দেখা হয়নি। চিঠিপত্র মারফত যোগাযোগ রাখার চেষ্টাও কখনও করিনি। সত্যিই কি রাতের সব তারাই থাকে দিনের আলোর গভীরে? লাইনটা লিখে কবি নিজেই সন্দিগ্ধ হয়েছিলেন। “সত্যি বললাম তো?"
তারপর আবার ভুলে গেছিলাম। মনে পড়লো কাল। আত্মজীবনী নয়,
আমার মতন বাচালের বিশ্রম্ভালাপ নয়, অন্যতম বিখ্যাত একটা পেপার - ব্র্যাডফোর্ড হিলের প্রেসিডেন্সিয়াল অ্যাড্রেস। যাতে সেই ন-খানা কজালিটি-র ক্রাইটেরিয়া দেওয়া আছে। পেপারের শেষ দুইটি প্যারা তুলে দিলাম। কবিতার পংক্তি উদ্ধৃত করছেন, কিন্তু সে কি সুন্দর, নাটকীয় এবং এমফ্যাটিক-ভাবে দেখুন।

"All scientific work is incomplete - whether it be observational or experimental. All scientific work
is liable to be upset or modified by advancing knowledge. That does not confer upon us a freedom to ignore the knowledge we already have, or to postpone the action that it appears to demand at
a given time.
Who knows, asked Robert Browning, but the world may end tonight? True, but on available
evidence most of us make ready to commute on the 8.30 next day."



ব্রাউনিং-এর কবিতাটিঃ https://www.bartleby.com/42/665.html
হিলের প্রেসিডেন্সিয়াল অ্যাড্রেসঃ https://www.ncbi.nlm.nih.gov/.../pdf/procrsmed00196-0010.pdf

Friday, July 9, 2021

“ফসল কাটা মাঠে এখন সদ্যকৃত বধ্যভূমি”




আমি লোরকা-র কথা প্রথম পড়ি শুভঙ্করকে লেখা নন্দিনীর চিঠি-তে,

নতুন কবিতা কিছু লিখেছো কি?

লোরকা পড়ছো খুব? বেশি পড়ো, কম সিগারেট খাও”

(কথোপকথন ৩, পূর্ণেন্দু পত্রী)

 

দিন-কয়েক পরে একটা বাংলায় অনুবাদ করা লোরকার কবিতার বই পেয়ে যাই কলেজ স্ট্রীটে, পড়তে পড়তে প্রেমে পড়ে যাই নিজের অজান্তে। কি অদ্ভুত ম্যাজিকে লোরকার কবিতার প্রাগৈতিহাসিক আন্দালুশিয়া হয়ে যায় আমার-ই ভিটেমাটি - তার বইয়ের পাতায় কান পাতলে শুনতে পাই ফ্ল্যামেঙ্কো-র ছন্দ, টের পাই অবিকল শরীরের উত্তাপ আর মরা বাতাসে ফিসফাস করে বয়ে চলে ‘সনেটস অফ ডার্ক লভ’-এর অস্ফুট গোঙানি আর জমে-থাকা চিৎকার ... অনন্ত কবরের তলা থেকে উঠে আসা দেহহীন প্রেতশব্দের মতো।

মাত্র আটত্রিশ বছর বয়সে, ১৯শে আগস্ট, ১৯৩৬, খুন করা হয় লোরকা-কে, গ্রানাডা-র তখতে তখন উগ্র-জাতীয়তাবাদী ফ্যালাঞ্জিস্ট গুন্ডাবাহিনী, আর লোরকা? সোশ্যালিস্ট, স্পষ্টবক্তা, মুক্তচিন্তক, তায় সমকামী, ফ্যাসিস্ত রাষ্ট্রযন্ত্রের সাক্ষাৎ জুজু। তিরিশ-তিরিশটা বছর লেগেছিলো (১৯৭০ অব্দি) শুধু এই কথাটুকু প্রকাশ্যে স্বীকার করতে যে লোরকার খুন ব্যক্তিগত দ্বন্দ্বে-ঈর্ষায় নয়, বরং হয়েছিলো একটি রাষ্ট্রশক্তির হাতে – তাঁর বধ্যভূমি আজ-ও নিশানাহীন।

১৭-ই আগস্ট, ১৯৩৬, ভোরের আলো ফুটতে তখনো দেরী খানিকটা। গ্রানাডার ঠিক বাইরে যে মেঠো রাস্তাটা জুড়েছে ভিজনার আর আলফাকার শহর-কে, সেইখানে থামলো একটি গাড়ি – দরজা খুলে একে একে নেমে এলেন চারজন বন্দী আর পাঁচজন বন্দুকধারী সৈন্য। বন্দীদের দুজন নৈরাজ্যবাদী বুলফাইটার, একজন পক্ককেশ স্কুলশিক্ষক যাঁর একটি পা কাঠের, আর চতুর্থ ব্যক্তিটির পরণে একটি ব্লেজার আর শাদা পাজামা, অন্ধকার আন্দালুশিয়ান আকাশের নীচে উদ্যত মাউজার রাইফেল আর অ্যাস্ট্রা-৯০০ পিস্তলের নিশানার তাঁরা হেঁটে যাচ্ছেন আল পেরিয়ে একটি জমিতে, জলপাই গাছের সারি উজ্জ্বল ভাসমান হয়ে আছে ঘাতকদের গাড়ির তীব্র হেডলাইটের আলোয়। ওঁরা জানেন সেই রাত্রিটির শেষ নেই।  

লোরকা জানতেন, লোরকা-রা যেমন জানেন, মৃত্যুর অনেক আগেই  আর তিনি যেন মিশে যান মার্কেসের সান্তিয়াগো নাসারের সাথে, হত্যার আগেই ঘাতকের ছুরি থেকে ঝরতে থাকে রক্ত, ‘Fable and round of three friends’ এ অভ্রান্ত তার এপিটাফঃ

“Then I realized I had been murdered.

They looked for me in cafes, cemeteries and churches

.... but they did not find me.

They never found me?

No. They never found me.”

 

১৮৯৮-এ উচ্চবিত্ত পরিবারে জন্ম। শুধু সোনার চামচ-ই নয়, প্রতিভাও নিয়েই এসেছিলেন স্বল্পায়ু জীবনটুকুর তলানি অব্দি শুষে নেবেন বলেই যেন। একাধারে সঙ্গীতজ্ঞ, নতুন ধারার কবি, আবার রঙ্গমঞ্চ-ভরিয়ে-ফেলা নাট্যকার – কী-ই না পারতেন গার্সিয়া? জেনারেশন অফ টোয়েন্টি-সেভেনের কবি শুধুই যে নতুন বাঁকে নিয়ে গেছিলেন স্প্যানিশ কবিতাকে তাই-ই নয়, ফোকলোরের সঙ্গে মিশিয়ে দিতে পেরেছিলেন বড়ো হয়ে ওঠার আন্দালুশিয়ার জিপসি-সুর। নেরুদা লোরকাকে নিয়ে উচ্ছ্বসিত হয়ে বলেছিলেন, “I have never seen grace and genius, a winged heart and a crystalline waterfall, come together in anyone else as they did in him.”

কিন্তু সেই ডানাওয়ালা হৃদয়ের মধ্যেই সিসিফাসের পাথর-প্রমাণ ভার - ভয়ঙ্কর হোমোফোবিক সমাজে একজন সমকামী মানুষ তিনি, সেই চেপে রাখা অস্ফুট গোঙানি ছড়িয়ে-ছিটিয়ে লোরকার প্রায় সব লেখায়, কোথাও সে বিরহ-অদর্শন, কোথাও ভয়ানক ট্রাজিক পরিণতি প্রেমের।

“The whole world’s broken.

Only silence remains.

(Leave me here, in this field,  weeping.)”                                  

[“Poem of the Solea”]

 

লোরকা যখন আস্তে আস্তে হয়ে উঠছেন স্পেনের কণ্ঠস্বর, পর্দার আড়াল থেকে শ্বদন্ত নিয়ে বেরিয়ে পড়েছে ফ্যাসিজমের দৈত্যরা। দীর্ঘদিন বামপন্থী শাসনে আনা হয়েছে একের পর এক পরিবর্তন – নারীর সমানাধিকার, কৃষিক্ষেত্রে ভূমিহীনদের রক্ষা করার নতুন আইন, চার্চ ও মিলিটারির জনজীবনে প্রতিপত্তি খর্ব করার একের পর এক নীতি। আর যতো সামনের দিকে এগোতে চেষ্টা করেছে স্পেন, ততোই বিত্তবান, ক্ষমতাবান, ঘৃণার কারবারিরা এক হয়েছেন জেনারেল ফ্র্যাঙ্কোর বাহিনীর আশ্রয়ে, সেই কুখ্যাত ঘাতকদের দল, যাঁদের স্লোগান ছিলো, “ভিভা লা মুয়ের্তে – মৃত্যু দীর্ঘজীবী হোক”।

 

সেই ফ্যাসিস্ত শক্তির রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে লোরকা লিখে চলেছেন তার কবিতা, আকাশে উড়িয়ে দিয়েছেন তার ইশ্তেহারঃ

 

“The artist, and particularly the poet, is always an anarchist in the best sense of the word. He must heed only the call that arises within him from three strong voices: the voice of death, with all its foreboding, the voice of love and the voice of art.”

 

১৯৩৬-এ হত্যা, ১৯৫৩ অব্দি সমস্ত লেখার উপর নিষেধাজ্ঞা, ১৯৭৩-এ ফ্রানিসিস্কো ফ্র্যাঙ্কো মারা না যাওয়া অব্দি লোরকার মৃত্যু (অথবা জীবন) নিয়ে আলোচনা-ও ছিলো অবৈধ, ১৯৮৪-র আগে অব্দি পাওয়াই যায়নি তার ‘ডার্ক লভ’-এর সনেটগুচ্ছ, এখনো কেউ জানেনা শেষ খসড়া কোথায় – তবু লোরকা বেঁচে আছেন, থাকবেন, আর স্পেনের ফ্যাসিস্ত ফ্যলাঞ্জিস্ট গুন্ডার দল নেই। কবিমাত্রেই প্রফেট হন কি না বলা খুব শক্ত, তবে লোরকা জানতেন শেষ সংলাপটি তাঁর-ই, বলেছিলেন পৃথিবীর আর সব জায়গায় মৃত্যুই শেষ অঙ্ক, যার পদশব্দ পেলেই পর্দা টেনে দিই আমরা, কিন্তু স্পেন আলাদা, স্পেনে মৃত্যু নিজের হাতে উন্মোচন করে পর্দা’। তিনিই বলেছিলেন না A dead man in Spain is more alive than a dead man anywhere else in the world”?

রুইজ আলোনসো, যে অফিসার-ইন-চার্জ সেই ১৬-ই আগস্টের রাত্রে একশো ফ্যালাঞ্জে সৈন্য নিয়ে ঘিরে ফেলেছিলেন লোরকার বাল্যবন্ধুর বাড়ি, খুনের পরেই তিনি বলেছিলেন, “He’s done more damage with a pen than others have with a pistol”!

সত্যি বলতে, প্রথমবার বিশ্বাস হয়নি, ভাবতে পারিনি একজন দুর্বল কবিকে জল্লাদবাহিনী টেনে দাঁড় করাচ্ছে ফায়ারিং স্কোয়াডের সামনে? একজন কবি-কে এতো ভয়?

অথচ পালটায় না কিছুই, অন্ধ, দিকশূন্য মানুষ দৌড়ে মরে সেই এক-ই বৃত্তে।

দেশ পালটে যায়, শাসকের কুনাট্যরঙ্গের মঞ্চ বদলে যায়। কিন্তু আজ-ও যতদূর চোখ যায় দেখা যায় কবিকে, তার স্পর্ধা, তার ধক, তার সামান্য কটি বজ্রবিদ্যুৎময় খাতা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন ফ্যাসিস্ত শাসকের চোখে চোখ রেখে।

আর পালটায় না মানুষের ভেতরের-ও ভেতরে ঘৃণার সেই রক্তবীজের ঝাড় - “plus ca change plus ca meme chose”!

১৯শে অগাস্ট, ১৯৩৬। লোরকার মৃত্যুর পর রাষ্ট্রযন্ত্র বলেছিলো, “he died because he was a fagg*t”!

জাম্প কাট, গত মঙ্গলবার, ৬-ই জুলাই, ২০২১। স্যামুয়েল লুইজ মুনিজ। ২৪-বছরের নার্সিং-এর ছাত্রটিকে ১২ জন উন্মত্ত মানুষ কিল-চড়-ঘুঁষিতেই মেরে ফেলেছে, স্পেনের একটি নাইটক্লাবের বাইরে।

তাঁর একমাত্র দোষ? সে সমকামী।