পির্যাম্যাস আর থিসবির গল্প বলি আজকে। গ্রীক
পুরাণের যে কটি বিয়োগান্তক গল্প সারাজীবন মনে দাগ কেটে যায়, আর
বহু যুগের পরেও তার অস্পষ্ট রেখা দেখা যায়, তার মধ্যে অন্যতম
এই দুজনের গল্প। এঁদের গল্পটি অনেকে অনেকবার বলেছেন, তবে
সবথেকে সুন্দর ও নির্মম বর্ণনা বোধকরি ওভিডের মেটামরফসিস ...
পির্যাম্যাস-থিসবি পাশাপাশি দুই বাড়িতে থাকে,
দুই বাল্যবয়সের বন্ধু, একসাথে হাঁটতে হাঁটতে
আলোকবর্ষ পেরিয়ে যাওয়ার স্বপ্ন। পিরাম্যাস সুন্দরতম যুবক, থিসবির
পাণিপ্রার্থী গোটা ব্যাবিলন। কিন্তু দুই বাড়ির মাঝে একটি অলঙ্ঘ্য দেওয়াল, এবং আরোই অনতিক্রম্য বোধহয় দুইজনের পরিবারের আপত্তি।
কিন্তু 'কী মেঘ দেখালে তুমি মেঘের আড়ালে বসে,
... শিরায় শিরায় দিলে টান', একবার সে টান যার
লাগে তার আর রক্ষা কি? উপায় বলতে ওই দুই বাড়ির দেওয়ালের
মধ্যে একটি সূচীছিদ্র ফাঁক, সেই একটু ফাঁকের মধ্যে দিয়ে
অস্পষ্ট ইশারা, চিহ্ন, সংকেত - শাসনের
রক্তচক্ষু এড়ানো যেটুকু পৌঁছয় অপর পারে। দেওয়ালের দুইপ্রান্তে দুই উৎকীর্ণ হৃদয়
বলে, 'Unfriendly wall, why do you hinder lovers?' ... তবু
প্রাচীরগাত্রে ফাঁকটুকু আর বাড়ে না।
একদিন অবশেষে, সূর্য তাঁর শেষ বাতিটুকু নিভিয়ে দেওয়ার কিছু আগে, পির্যাম্যাস আর থিসবি ঠিক করলো তারা দেখা করবে লুকিয়ে, রাত্রির অন্ধকারে, সবাই ঘুমিয়ে পড়ার পর। দেখা হবে পূর্বনির্ধারিত জায়গায়, নিনাসের সমাধির কাছে, ঠিক যেখানে একটি হ্রদের ধারে একটি মালবেরি বৃক্ষে সাদা ফুল ফুটে থাকে আর যেখানে রাত্রি জন্ম নেয় ঝর্ণার জল থেকে।
থিসবি চুপিচুপি পালালো বাড়ির নজর এড়িয়ে, বসলো এসে ঝর্ণার ধারে। এদিকে তক্ষুণি একটি সিংহী সদ্য শিকার শেষ করে তৃষ্ণা মেটাতে এসেছে ঝর্ণার জলে, তাঁর মুখে তাজা রক্তের দাগ। চাঁদের আলোয় দূর থেকে দেখতে পেলো থিসবি, দৌড়ে গিয়ে লুকিয়ে পড়লো একটি গুহায়। কিন্তু পালানোর সময় তার পরনের ওড়নাটি পড়ে গেলো পিছনে। সিংহী থিসবিকে পায়নি, কিন্তু তৃষ্ণা মিটিয়ে ফেরার পথে গাছের কাছে সেই ওড়নাটি পেয়ে ব্যর্থ আক্রোশে সেটিকেই ছিন্নবিচ্ছিন্ন করলো রক্তমাখা নখর-দন্তে ...
পির্যাম্যাস বাড়ি থেকে বেরিয়েছিলো একটু পরে। রাস্তায় সিংহীর পায়ের ছাপ অনুসরণ করে খুঁজে পেলো সেই শতচ্ছিন্ন রক্তমাখা ওড়নাটি, এক মুহূর্তে যেন ভবিষ্যত হয়ে গেলো অর্থহীন অন্ধকার। পির্যাম্যাসের মনে হলো দোষ তার, থিসবি-হীন পৃথিবী বেঁচে থাকার যোগ্য নয়, 'two lovers will be lost in one night' - সে রক্তমাখা থিসবির ওড়নাটি সেই মালবেরি গাছের কাছে নিয়ে গেলো, যেখানে কথা ছিলো দেখা হওয়ার, একটিবার সেই শেষ চিহ্নটিকে চুম্বন করে বললো, 'Now, be soaked in my blood too.'
পির্যাম্যাস তার কোমরবন্ধনী থেকে তরবারি নিয়ে আমূল গেঁথে দিয়েছে নিজের বুকে, রক্তস্রোতে ভিজে যাচ্ছে চারিপাশ, ওভিডের বর্ণনায় -
'Out spun the blood, and streaming upwards flew.
So if a conduit-pipe e'er burst you saw,
Swift spring the gushing waters thro' the flaw:
Then spouting in a bow, they rise on high,
And a new fountain plays amid the sky.
The berries, stain'd with blood, began to show
A dark complexion, and forgot their snow;
While fatten'd with the flowing gore, the root
Was doom'd for ever to a purple fruit.'
থিসবি একসময় বেরিয়ে আসে গুহা থেকে, তখন-ও ভয় পুরোপুরি যায়নি তার, শিকারের আশায় ওঁত পেতে বসে নেই তো হিংস্র পশু? মালবেরি গাছটির কাছে পৌঁছে সে দেখে শ্বেত মালবেরি রঙ পালটে হয়ে গেছে রক্তাভ লাল ... সে অপেক্ষা করতে থাকে পির্যাম্যাসের, সে কী আসছে? হঠাৎ হ্রদের বাতাসের ঝাপ্টার শেষরাতের আলোয় চোখে পড়ে রক্তাক্ত মাটিতে পড়ে থাকা নিথর পির্যাম্যাসের দেহ!
ঘাতক তরবারির উপর নিজেকে নিক্ষেপ করার আগে থিসবি বলে যায় তার শেষ আর্তি-অভিশাপ - যে প্রেম তোমাকে ধ্বংস করলো পির্যাম্যাস, আমার-ও তার কিছু জানা আছে, আমার-ও আছে দুটি হাত। মৃত্যুর ক্ষমতা নেই আমাদের পৃথক করার। মালবেরি গাছটিকে সে বলে,
'Now, both our cruel parents, hear my pray'r;
My pray'r to offer for us both I dare;
Oh! see our ashes in one urn confin'd,
Whom love at first, and fate at last has join'd.
The bliss, you envy'd, is not our request;
Lovers, when dead, may sure together rest.
Thou, tree, where now one lifeless lump is laid,
Ere-long o'er two shalt cast a friendly shade.
Still let our loves from thee be understood,
Still witness in thy purple fruit our blood.'
মালবেরির অক্ষয় রঙ সেই থেকেই রক্তাভ লাল।
------------------
পুনশ্চ ১- গ্রীক পুরাণ আর মালবেরির রঙ ছাড়াও এই গল্পটা বলার একটা অন্য কারণ আছে ...
রোমিও-জুলিয়েট এর গল্প সবার জানা, সেই গল্পটির মূল 'প্লট' গ্রীক পুরাণের পির্যাম্যাস-থিসবির বিয়োগান্তক কাহিনী। অবশ্য শেক্সপীয়ার ঋণস্বীকার করতে জানতেন, মিডসামারস নাইটস ড্রিম মনে করুন, থিসিয়াস আর হিপোলিটার বিয়ের আসরে অভিনীত হচ্ছে যে ট্র্যাজিক নাটকটি, সেটি এই পির্যাম্যাস আর থিসবি। (থিসিয়াস-কে নিয়েও একদিন লিখবো, সে এক মহাপাষন্ড ছিলো, যাঁকে বীরপুজোই করা হয় সাহিত্যে-সিনেমায়।)
পুনশ্চ ২ - ওভিডের মেটামরফোসিস নিয়েও ইচ্ছে আছে একদিন গুছিয়ে লিখবো, শুধু ঐ একটি প্রাচীন কাব্যে যে কতকিছুই বলা আছে। যাহোক, আসল কাব্যগ্রন্থটির (গুলির) অনুবাদ এইখানে - http://classics.mit.edu/Ovid/metam.html, কিন্তু এ এক সমুদ্র, পির্যাম্যাস আর থিসবির গল্প পড়তে চাইলে সেটি মেটামরফোসিস-৪ এর অংশ, অর্থাৎ, এইখানে http://classics.mit.edu/Ovid/metam.4.fourth.html ("The Story of Pyramus and Thisbe" খুঁজতে হবে !)