Saturday, February 13, 2021

পির‍্যাম্যাস ও থিসবি

 

পির‍্যাম্যাস আর থিসবির গল্প বলি আজকে। গ্রীক পুরাণের যে কটি বিয়োগান্তক গল্প সারাজীবন মনে দাগ কেটে যায়, আর বহু যুগের পরেও তার অস্পষ্ট রেখা দেখা যায়, তার মধ্যে অন্যতম এই দুজনের গল্প। এঁদের গল্পটি অনেকে অনেকবার বলেছেন, তবে সবথেকে সুন্দর ও নির্মম বর্ণনা বোধকরি ওভিডের মেটামরফসিস ...

পির‍্যাম্যাস-থিসবি পাশাপাশি দুই বাড়িতে থাকে, দুই বাল্যবয়সের বন্ধু, একসাথে হাঁটতে হাঁটতে আলোকবর্ষ পেরিয়ে যাওয়ার স্বপ্ন। পিরাম্যাস সুন্দরতম যুবক, থিসবির পাণিপ্রার্থী গোটা ব্যাবিলন। কিন্তু দুই বাড়ির মাঝে একটি অলঙ্ঘ্য দেওয়াল, এবং আরোই অনতিক্রম্য বোধহয় দুইজনের পরিবারের আপত্তি।

কিন্তু 'কী মেঘ দেখালে তুমি মেঘের আড়ালে বসে, ... শিরায় শিরায় দিলে টান', একবার সে টান যার লাগে তার আর রক্ষা কি? উপায় বলতে ওই দুই বাড়ির দেওয়ালের মধ্যে একটি সূচীছিদ্র ফাঁক, সেই একটু ফাঁকের মধ্যে দিয়ে অস্পষ্ট ইশারা, চিহ্ন, সংকেত - শাসনের রক্তচক্ষু এড়ানো যেটুকু পৌঁছয় অপর পারে। দেওয়ালের দুইপ্রান্তে দুই উৎকীর্ণ হৃদয় বলে, 'Unfriendly wall, why do you hinder lovers?' ... তবু প্রাচীরগাত্রে ফাঁকটুকু আর বাড়ে না।




একদিন অবশেষে, সূর্য তাঁর শেষ বাতিটুকু নিভিয়ে দেওয়ার কিছু আগে, পির‍্যাম্যাস আর থিসবি ঠিক করলো তারা দেখা করবে লুকিয়ে, রাত্রির অন্ধকারে, সবাই ঘুমিয়ে পড়ার পর। দেখা হবে পূর্বনির্ধারিত জায়গায়, নিনাসের সমাধির কাছে, ঠিক যেখানে একটি হ্রদের ধারে একটি মালবেরি বৃক্ষে সাদা ফুল ফুটে থাকে আর যেখানে রাত্রি জন্ম নেয় ঝর্ণার জল থেকে।

থিসবি চুপিচুপি পালালো বাড়ির নজর এড়িয়ে, বসলো এসে ঝর্ণার ধারে। এদিকে তক্ষুণি একটি সিংহী সদ্য শিকার শেষ করে তৃষ্ণা মেটাতে এসেছে ঝর্ণার জলে, তাঁর মুখে তাজা রক্তের দাগ। চাঁদের আলোয় দূর থেকে দেখতে পেলো থিসবি, দৌড়ে গিয়ে লুকিয়ে পড়লো একটি গুহায়। কিন্তু পালানোর সময় তার পরনের ওড়নাটি পড়ে গেলো পিছনে। সিংহী থিসবিকে পায়নি, কিন্তু তৃষ্ণা মিটিয়ে ফেরার পথে গাছের কাছে সেই ওড়নাটি পেয়ে ব্যর্থ আক্রোশে সেটিকেই ছিন্নবিচ্ছিন্ন করলো রক্তমাখা নখর-দন্তে ...

পির‍্যাম্যাস বাড়ি থেকে বেরিয়েছিলো একটু পরে। রাস্তায় সিংহীর পায়ের ছাপ অনুসরণ করে খুঁজে পেলো সেই শতচ্ছিন্ন রক্তমাখা ওড়নাটি, এক মুহূর্তে যেন ভবিষ্যত হয়ে গেলো অর্থহীন অন্ধকার। পির‍্যাম্যাসের মনে হলো দোষ তার, থিসবি-হীন পৃথিবী বেঁচে থাকার যোগ্য নয়, 'two lovers will be lost in one night' - সে রক্তমাখা থিসবির ওড়নাটি সেই মালবেরি গাছের কাছে নিয়ে গেলো, যেখানে কথা ছিলো দেখা হওয়ার, একটিবার সেই শেষ চিহ্নটিকে চুম্বন করে বললো, 'Now, be soaked in my blood too.'

পির‍্যাম্যাস তার কোমরবন্ধনী থেকে তরবারি নিয়ে আমূল গেঁথে দিয়েছে নিজের বুকে, রক্তস্রোতে ভিজে যাচ্ছে চারিপাশ, ওভিডের বর্ণনায় -

'Out spun the blood, and streaming upwards flew.
So if a conduit-pipe e'er burst you saw,
Swift spring the gushing waters thro' the flaw:
Then spouting in a bow, they rise on high,
And a new fountain plays amid the sky.
The berries, stain'd with blood, began to show
A dark complexion, and forgot their snow;
While fatten'd with the flowing gore, the root
Was doom'd for ever to a purple fruit.'

থিসবি একসময় বেরিয়ে আসে গুহা থেকে, তখন-ও ভয় পুরোপুরি যায়নি তার, শিকারের আশায় ওঁত পেতে বসে নেই তো হিংস্র পশু? মালবেরি গাছটির কাছে পৌঁছে সে দেখে শ্বেত মালবেরি রঙ পালটে হয়ে গেছে রক্তাভ লাল ... সে অপেক্ষা করতে থাকে 
পির‍্যাম্যাসের, সে কী আসছে? হঠাৎ হ্রদের বাতাসের ঝাপ্টার শেষরাতের আলোয় চোখে পড়ে রক্তাক্ত মাটিতে পড়ে থাকা নিথর পির‍্যাম্যাসের দেহ!

ঘাতক তরবারির উপর নিজেকে নিক্ষেপ করার আগে থিসবি বলে যায় তার শেষ আর্তি-অভিশাপ - যে প্রেম তোমাকে ধ্বংস করলো 
পির‍্যাম্যাস, আমার-ও তার কিছু জানা আছে, আমার-ও আছে দুটি হাত। মৃত্যুর ক্ষমতা নেই আমাদের পৃথক করার। মালবেরি গাছটিকে সে বলে,

'Now, both our cruel parents, hear my pray'r;
My pray'r to offer for us both I dare;
Oh! see our ashes in one urn confin'd,
Whom love at first, and fate at last has join'd.
The bliss, you envy'd, is not our request;
Lovers, when dead, may sure together rest.
Thou, tree, where now one lifeless lump is laid,
Ere-long o'er two shalt cast a friendly shade.
Still let our loves from thee be understood,
Still witness in thy purple fruit our blood.'

মালবেরির অক্ষয় রঙ সেই থেকেই রক্তাভ লাল।



------------------

পুনশ্চ ১- গ্রীক পুরাণ আর মালবেরির রঙ ছাড়াও এই গল্পটা বলার একটা অন্য কারণ আছে ...

রোমিও-জুলিয়েট এর গল্প সবার জানা, সেই গল্পটির মূল 'প্লট' গ্রীক পুরাণের 
পির‍্যাম্যাস-থিসবির বিয়োগান্তক কাহিনী। অবশ্য শেক্সপীয়ার ঋণস্বীকার করতে জানতেন, মিডসামারস নাইটস ড্রিম মনে করুন, থিসিয়াস আর হিপোলিটার বিয়ের আসরে অভিনীত হচ্ছে যে ট্র্যাজিক নাটকটি, সেটি এই পির‍্যাম্যাস আর থিসবি। (থিসিয়াস-কে নিয়েও একদিন লিখবো, সে এক মহাপাষন্ড ছিলো, যাঁকে বীরপুজোই করা হয় সাহিত্যে-সিনেমায়।)

পুনশ্চ ২ - ওভিডের মেটামরফোসিস নিয়েও ইচ্ছে আছে একদিন গুছিয়ে লিখবো, শুধু ঐ একটি প্রাচীন কাব্যে যে কতকিছুই বলা আছে। যাহোক, আসল কাব্যগ্রন্থটির (গুলির) অনুবাদ এইখানে -
 http://classics.mit.edu/Ovid/metam.html, কিন্তু এ এক সমুদ্রপির‍্যাম্যাস আর থিসবির গল্প পড়তে চাইলে সেটি মেটামরফোসিস-৪ এর অংশ, অর্থাৎএইখানে http://classics.mit.edu/Ovid/metam.4.fourth.html ("The Story of Pyramus and Thisbe" খুঁজতে হবে !)


Friday, February 12, 2021

ওর‍্যাকল, জ্যোতিষবিদ্যা ও প্রাচীন রোমের এক জাদুকর

 



"এই যে লুকিয়ে লুকিয়ে অবৈধ একখানা সম্পর্কে মজেছি, ধরা পড়বো কি?", অথবা,  "কোনোদিন কি স্বচক্ষে দেখবো মৃত্যুকে?", "যাকে মনে মনে চাই তাকে পাবো কী এ জীবনে?", "সফল হতে পারবো?", কিংবা ধরুন, "একদিন কী জাঁদরেল একজন নেতা হতে পারবো আমি?" 

ধরুন এই বেয়াড়া প্রশ্নগুলো মনে এলো, যার উত্তর না মেলা অব্দি শান্তি নেই - কী করবেন? হয় ভালো একটি বাবা দেখে হাত মেলে বসে পড়বেন, অথবা খবরের কাগজের দুয়ের পাতার ভেতরে খুঁজে দেখবেন 'ভাগ্য+চেষ্টা = ফল', জ্যোতিষী শ্রীভৃগু (আসল) বলে দিয়েছেন, 'প্রেমে আছে, কিছু কথা কিছু ব্যথা'। 

প্রাচীন রোমান সাম্রাজ্যে অবশ্য সংবাদ প্রতিদিন বেরোতো না, 'সব জ্যোতিষী বারবার অমৃতলাল একবার'-এর বিজ্ঞাপন-ও পড়তো না কলেসিয়ামের প্রাচীরগাত্রে - তবে উপায়? উপায় ছিলো আশ্চর্য একটি ভাগ্যগণনার বই - নাম 'Oracles of Astrampsychus' (ওর‍্যাকল অব অ্যাস্ট্রামসাইকাস)। আজকের গল্প সেই বইটি নিয়ে, এবং আরও খুচরো দু-পয়সা যা পড়তে গিয়ে কুড়িয়ে পেয়েছি, তাই ...

সত্যি বলতে ভবিষ্যত জানতে ইচ্ছে হয়নি এমন মানুষ খুঁজলে মেলা দায়, আর এই বোধহয় এমন একটি জিনিষ যা সেই সুদূর অতীত থেকে আজ অব্দি পাল্টায়নি। অদৃষ্ট-অস্পষ্ট ভবিষ্যত জানা সম্ভব নয় জেনেও মানুষ বারেবারে দ্বারস্থ হয়েছে জ্যোতিষীদের, ফরচুন-টেলারদের, এবং সেই ট্র্যাডিশন সমানে চলিতেছে। (যদিও এই লেখাটা লেখার  সময়েই কাকতালীয়ভাবে চোখে পড়েছে এক জ্যোতিষীর বিজ্ঞাপনের সদর্প স্লোগান - "জটিল কেসে আকাশে রকেট পাঠিয়ে গ্রহ-নক্ষত্রের পজিশন ঠিক করা হয়"!!)

সেইসব বুজ্রুকির ইতিহাসে আমার আগ্রহ নেই, এবং অ্যাস্ট্রামসাইকাসের বইটি যেন ভাগ্যগণনার বাইরেও অনেক কিছু। কারণ এই বইয়ের রহস্যময় প্রশ্নোত্তরের ধাঁচ আমাদের শুধুই স্বান্তনা দেয় না, বলে দেয় কেমন প্রশ্ন রাত্রে জাগিয়ে রাখতো সেই অন্ধকার অতীতের সাধারণ রোমের বাসিন্দাদের? কিসের উত্তর খুঁজতে তারা শরণাপন্ন হতেন ওর‍্যাকলের, আর কোন প্রশ্নের উত্তর জানতে চাননি কেউ? 

পেশায় জাদুকর অ্যাস্ট্রামসাইকাসের জন্ম-কর্ম খ্রীষ্টপূর্ব চতুর্থ শতাব্দীতে, অর্থাৎ আলেকজান্ডারের-ও অন্ততঃ বছর চল্লিশেক আগে, তবুও সেই প্রাচীন প্যাপিরাসের পুঁথির কিছু কিছু পাতা এখনো রয়ে গেছে - ব্রিটিশ লাইব্রেরীর মিউজিয়মে। তার কিছু মণিমুক্তো দেখা যাক?




অ্যাস্ট্রামসাইকাসের ওর‍্যাকলে মোট বিরানব্বুইটি প্রশ্ন, নম্বর দেওয়া বারো থেকে একশো তিন, আর তার একশো তিন সেট উত্তর, বা বলা ভালো দশটা করে অপশন প্রত্যেকটি উত্তরের, এক-একটি ভাগের নাম একটি 'ডিকেড'। এবার এক থেকে দশের মধ্যে একটা সংখ্যা ভাবুন চট করে ... তার পর যে প্রশ্নটা মনে ধরবে তার নম্বরের সাথে যোগ করে একটা টেবিল থেকে পেয়ে যাবেন আরেকটি সংখ্যা - যেটি বলে দেবে সেই নির্দিষ্ট ডিকেডের কোন উত্তরটি আপনার কপালে নাচছে ... 

একটা কাজের উদাহরণ দেওয়া যাক, ধরা যাক আপনার প্রশ্ন, আপনি কি অ্যাডাল্টারি করতে গিয়ে ধরা পড়বেন? এইটি হচ্ছে ১০০ নম্বর প্রশ্ন। আর ধরা যাক আপনার মনে মনে ভাবা সংখ্যাটি ৬, তাহলে টেবল অফ করেস্পন্ডেন্স বলে দেবে ২৮ নং ডিকেডে উত্তর পাওয়া যাবে। আঠাশে পৌঁছে ৬ নম্বরে গিয়ে দেখলেন লেখা আছে, 'এক্ষুণি ধরা পড়ছেন না, (চালিয়ে যান)'। যদি দৈবাৎ মনে ভেবে থাকেন ৫, ওর‍্যাকল বলে দেবে, 'ডোন্ট ওয়রি, ধরা পড়ার চান্স-ই নেই'। আবার যদি সংখ্যাটি হয় ৭, ওর‍্যাকলের ভবিষ্যদবাণীঃ 'আপনি অ্যাডাল্টারার নন, তবে আপনার বৌ অন্যের প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছে' ... 

বইটির কিছু প্রশ্ন, যেমন প্রেমে কত সাজা আর কত মজা, সেসব চিরন্তন ব্যাপারস্যাপার, বঙ্গজীবনে বোরোলীনের মত, কিন্তু বাদবাকি থেকে ফুটে ওঠে সেইসময়ের রোমের একটি খন্ডচিত্র। কেমন সে ছবি? 

জেরি টোনার দেখিয়েছেন কেমন করে অ্যাস্ট্রামসাইকাসের ওর‍্যাকল শুধুই জ্যোতিষীদের হ্যান্ডবুক নয় - একদিক থেকে দৈনন্দিন জীবনের বিভিন্ন ঘটনার, বিশেষ করে লাইফ-চেঞ্জিং ইভেন্টের, রিস্ক ক্যালকুলেটর-ও বটে। 

যেমন বিভিন্নভাবে ঘুরিয়েফিরিয়ে করা প্রশ্ন, 'আমার ব্যবসাটা কি দাঁড়াবে?' - ওর‍্যাকলের যত উত্তর তার মধ্যে ইতিবাচকের সম্ভাবনা ১৮% - টোনার দেখিয়েছেন, এইটা আকাশ থেকে পড়েনি, বরং সেই সময়ের রোমে নতুন ব্যবসা শুরুর আগে ধারকর্জ্জ করলে যা সুদ দিতে হতো প্রায় তার কাছাকাছি, অর্থাৎ অ্যাস্ট্রাম-বাবু আন্দাজে ঢিল মারেননি নেহাৎ। 

শুধু ব্যবসা-ই নয়, জনস্বাস্থ্য-ও, 'আমার শিশুটি কি বাঁচবে?' - উত্তরে দশের মধ্যে দুটো বলবে, এমনিও বাঁচবে না, অমনিও না, আর একটি বলছে, 'প্রতিপালিত হবে না'। সেযুগে শিশুমৃত্যু, এবং শিশুহত্যা, দুই-ই যে বেশ বেশী-ই ছিলো তার-ই প্রতিফলন। 

তবে অন্ধকারের মধ্যেও ঐতিহাসিক-রা কখনো কখনো আলোকবিন্দু দেখতে পান, যেমন দেখেছেন টোনার। আশর্য ঘটনা, প্রায় পুরো বইটিতে কোত্থাও হিংসাত্মক অপরাধের বলি হওয়ার প্রশ্ন নেই, এক বিষে মৃত্যুর ভয় ছাড়া, অথচ প্রাচীন রোমান সাম্রাজ্য বলতে যে ছবিটি ভেসে ওঠে মনে তাতে রাস্তায় খুনী, ডাকাত, তস্কর-দের দৌরাত্ম্য এবং থেকে থেকেই যুদ্ধ অথবা খুনোখুনি সাধারণ ঘটনা বলে মনে হওয়াই স্বাভাবিক। তাহলে কেউ জিগ্যেস করেননি কেন? টোনার-সাহেব এ কথা স্পষ্ট করে লিখে যাননি, তবে এই দুর্দিনে দাঁড়িয়ে আমি একটু-একটু বুঝতে পারি কেন। 

তবে মৃত্যুভয় অথবা কিভাবে জীবনপাখি খাঁচাটি ছেড়ে পালাবে সে কৌতূহল তো ভাগ্যগণনার ব্রেড-অ্যান্ড-বাটার - 'আমি কি দেখবো মৃত্যুকে, স্বচক্ষে'? দশের মধ্যে সাতটি উত্তর 'হ্যাঁ', কেউ বিষ খাইয়েছে? ৫০% চান্স, আমাদের জুনিয়রের ভাষায়, 'ডোন্ট টেক চাপ, টেক পি ইক্যুয়ালটু হাফ' ! 

এইখানে বলে রাখা যায়, অ্যাস্ট্রামসাইকাসের থেকেও এক কাঠি সরেস Homeromanteion, 'হোমারের ওর‍্যাকল'। তার নির্দেশমালায় বলা আছে,

'প্রথমতঃ, জানতে হবে কোন দিন ব্যবহার করতে হয় ওর‍্যাকল। দ্বিতীয়ত, প্রার্থনা করতে হবে ঈশ্বরের, মন্ত্রোচ্চারণ করে, নিজের মনে মনে চাইতে হবে অভীষ্ট ফল। তারও পরে, একটি ছক্কা (dice) নিয়ে তিন-তিনবার রোল করতে হবে ভাগ্যফল জানতে'। 

এতো কান্ড করে যে সংখ্যাটি পাবেন আপনি, হোমারের কাব্যের সেই পংক্তিটি বলে দেবে কপাললিখন। এই যেমন, আমি ছক্কা চাললাম, নাম্বার তিনটি এলো ৪, ১, ৩ - ইলিয়াডের পাতা থেকে জানা যাবে ভবিষ্যদবাণী 'λάϊνον ἕσσο χιτῶνα κακῶν ἕνεχ' ὅσσα ἔοργας.' 

পড়তে পারলেন না? আচ্ছা, ইংরেজিতে দাঁড়ায়, "You would have worn a cloak of rocks for all the wrongs you have done." (বলাই বাহুল্য, আমার অপকর্মের কথা বলা হচ্ছে, আশ্চর্যের কিছু নেই)


আপনিও করে দেখতে পারেন, ইলিয়াড-ওডিসি হাতের কাছে না থাকলে কুছুই পরোয়া নেই, অনলাইন সিমুলেটর আছে কী করতে? চলে যান এই ঠিকানায় - 
http://www.homeromanteion.com/ ! 

চেষ্টা করে দেখুন, কপালে তিলক কাটা বাবাজির থেকে হোমারের এই এপিকদুটি যদি ভাগ্য বলে দেয়, মন্দ কী?

ইলিয়াড, ওডিসি পড়েছি, আবার-ও পড়বো সময় পেলেই, তবে, অ্যাস্ট্রামসাইকাসের ওর‍্যাকলের যে নমুনাগুলি ব্রিটিশ লাইব্রেরীতে আছে, সেগুলোর শহরে গিয়েও দেখা হয়ে ওঠেনি আমার। যা বললাম সব-ই অন্যান্য পত্র-পত্রিকায় পড়া। আক্ষেপ হয়। পরেরবার ইচ্ছে আছে স্বচক্ষে এই আশ্চর্য বইটি দেখে আসা। 

তবুও মনে একটা প্রশ্ন খচখচ করেই যায়, এই যে প্রোবাবিলিটির ছাত্রদের ক্লাসে গিয়ে বলি সাধারণ মানুষের randomness, risk নিয়ে ধারণা এত অকাজের ও কাঁচা হওয়ার একটি কারণ, বাকি অনেক কিছুর থেকে অনেক পরে সদ্য অষ্টাদশ শতকের কাছাকাছি প্রোবাবিলিটির শাখাটির জন্ম হওয়া ... হয়তো সেটা সত্যি হলেও, পুরোপুরি সত্যি না। 

হয়তো Fermat বা Pascal-এর অনেক অনেক আগে, প্রাচীন রোমের সেই জাদুকর অ্যাস্ট্রামসাইকাস শুধুই জ্যোতিষী ছিলেন না, ছিলেন একজন পাক্কা প্রোবাবিলিস্ট? 

আর সত্যিই কী ভবিষ্যত কেউ জানে? সে তো অজ্ঞেয় ... তবু, একবার সেই জাদুকর-জ্যোতিষীকে ধরতে পেলে জিগাতাম, এই অন্ধ রাত্রি কবে শেষ হবে? অ্যাস্ট্রামসাইকাসের ওর‍্যাকলে হদিশ আছে তার? 




রেফারেন্সঃ

১> Fortune Telling, Bad Breath and Stress / Confronting the Classics / Mary Beard. Liveright Publishing Corporation. (এইসব বই পড়লে আরেকবার ষোলোয় ফিরে গিয়ে শুরু করতে ইচ্ছে হয়, অঙ্কের জায়গায় ক্লাসিকস)

২> https://blogs.bl.uk/digitisedmanuscripts/2019/04/fortune-telling-the-ancient-way.html (ব্লগটির নাম Medieval manuscripts blog, অলমিতি বিস্তারেণ)

৩> http://www.homeromanteion.com/ (অনলাইন সিমুলেটর)





লটারি, যুদ্ধবিমান আর ক্লিওপেট্রার আতঙ্ক - যে ভুল কোনোদিন শুধরোয় না !

(১) 

এয়ারপোর্টের বুকস্টলে দু-মিনিট দাঁড়ালেই একতাক ভর্তি হিতোপদেশের বই দেখা যাবে, টেন হ্যাবিটস অফ মারকাটারি সাকসেসফুল পিপল, অথবা দ্য ঝুঁটিকাকা হু ফেইলড হিজ ওয়ে টু দ্য টপ। 

এমন-ই একটি বই 'গুড টু গ্রেট', ২০০১ সালের লেখা, জিম কলিন্স, নামকরা আমেরিকান ফিনান্সিয়াল কনসাল্ট্যান্ট। লেখক সেখানে প্রায় হাজার দেড়েক কোম্পানির থেকে বেছে নিয়েছেন এগারোটি সবথেকে সফল কোম্পানি, তাদের বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য গুনেগেঁথে টোটকা দিয়েছেন সাফল্যের চাবিকাঠির। বই বিকিয়েছে 'লাইক হট কচৌরিস' ... কিন্তু তবুও, তবুও এই "অ্যানালিসিস", আসলে শুধুই খুব-ই মুষ্টিমেয়ের ইতিহাস, আসলে সারশূন্য ! যে চাবিকাঠি দিয়ে একটি সাফল্যের দরজা খুলে গেছে একজনের জন্য, অন্য একশো জনের জন্য হয়তো সেই দরজার ওপারে ছিলো খাদ ... পার্থক্য এই যে সেই একশোজনের গল্প আমাদের কান অব্দি পৌঁছয়নি, আমরা শুধুই ফোকাস করেছি যাঁরা সফল হয়েছেন, ভাগ্য, চেষ্টা অথবা অন্য কোনো কারণে শেষ অব্দি পেরিয়ে এসেছেন মাঠের শেষ অব্দি ... তাও হয়তো নয়, জিম কলিন্সের সেই গ্রেট এগারোখানা কোম্পানির মধ্যে ছখানা কোম্পানি-ই ক্ষতি করেছে বেশ কিছু, গড়ের থেকে নীচে চলে গেছে তাদের লাভের অঙ্ক ... 

r/LateStageCapitalism - Survivorship Bias


অবশ্য এয়ারপোর্টে না গিয়ে বিখ্যাত লোকের সাক্ষাৎকার শুনলেও চলে, বাড়ি থেকে বেরোনোর হ্যাপা নেই। স্টিভ জবস-এর গল্প গোটা দুনিয়া জানে, কলেজ ড্রপ-আউট করে বন্ধুকে নিয়ে গ্যারেজে খুলে ফেললেন একটা কোম্পানি, যা একদিন হয়ে যাবে "a ding in the universe" ... জুকারবার্গের গল্প-ও কাছাকাছি, আর এই যে গল্পটা আপনি পড়ছেন, সেটাও কি সম্ভব হতো, যদি না তিনি হার্ভার্ড ছেড়ে দিয়ে নিজের নতুন সোশ্যাল নেটওয়ার্কের সাইট-টিকেই নিয়ে পড়ে না থাকতেন? 

অথচ, আমি-আপনি দিব্যি জানি একজন স্টিভ জবসের পাশাপাশি একশোজন জবলেস (সংখ্যাটা বেশীই হবে) আছেন যাদের প্রতিভা কিচ্ছু কম ছিলো না, শুধু তারা সাফল্য পাননি, কোনো একটা কারণে যা আমাদের অধিগত নয়। একটি ভেঞ্চার ক্যাপিটালিস্ট কোম্পানি (সম্ভাবনাময় স্টার্ট-আপ দের যাঁরা মূল্ধন যোগান) ক্যালকুলেট করে দেখেছেন, আমেরিকার একটি স্টার্ট-আপের গ্যারেজ থেকে শুরু করে আইপিও (অর্থাৎ ইনিশিয়াল পাবলিক অফারিং) অব্দি পৌঁছনোর চান্স মাত্র ১৩% এর আশেপাশে। 

ব্যাপারটা তো জলের মতন সহজ, তবুও ভুল তো লোকে করে, এয়ারপোর্টের বুকস্টল-ই বলুন আর কৃতী ছাত্রদের সাক্ষাৎকার, মানুষ শোনে তো মন দিয়ে সেই সব টোটকা আর ভাবে এই তো সকাল পাঁচটায় উঠে চিরতার জল খেলেই আমিও আজ ফেরারি-বেচা মঙ্ক ... ভুলটা তাহলে কোথায়? 

ভুলটার নাম সার্ভাইভার বায়াস। শুধুমাত্র সফল উদাহরণগুলিই দেখলে মনে মনে যে ছবিটা আঁকা হয় সেটা সত্যিটার থেকে এক পোঁচ বেশী উজ্জ্বল, ব্যর্থতার মলিনতা তাকে যে বাস্তবের মাটিতে দাঁড় করায় সেটা অস্বীকার করার মাশুল কম কিছু নয়। 

বিশেষ করে সেই মাশুল যদি হয় মানুষের প্রাণ ! 

(২)

প্রাণের মাশুল অর্থাৎ যুদ্ধ । 

সেই গল্প করার আগে পরিচয় করিয়ে দিই, এই গল্পের সবথেকে বর্ণময় চরিত্রটির সাথে, যাঁর নাম আব্রাহাম ওয়াল্ড - রাশিবিজ্ঞানের জগতে যাঁর তূল্য প্রতিভা কজন এসেছেন হাতে গুনে বলা যায় বোধহয় ! ওয়াল্ডের জন্ম ১৯০২ সালে, তৎকালীন ট্রান্সিল্ভ্যানিয়ায়, অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরিয়ান সাম্রাজ্যের শেষদিকে। ধর্মপরায়ণ একটি ইহুদি পরিবারের ছেলে ওয়াল্ড ইস্কুলের পাঠ নিয়েছিলেন বাড়িতেই বাবা-মার কাছে, তারপর সোজা কলেজের পাট চুকিয়ে ভিয়েনায় অধ্যাপনার চাকরি নেন। ব্রিলিয়ান্ট গবেষক, কিন্তু ততোদিনে অস্ট্রিয়ার ইহুদিদের উপরে শুরু হয়েছে ভয়ানক অত্যাচার, নাৎসিজমের কালো মেঘ প্রায় ঢেকে ফেলেছে ইয়ুরোপের অস্তমিত সূর্য। ওয়াল্ড ১৯৩৮ সালে চলে এলেন আমেরিকায়, ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ে, অর্থনীতির অধ্যাপকের চাকরি নিয়ে। 

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয় এর পরেপরেই, ওয়াল্ড সেইসময় যোগ দেন Statistical Research Group (SRG)-তে, সামরিক কৌশলের সাথে বৈজ্ঞানিক চিন্তার সূত্র খুজঁতে। 

আমেরিকান মিলিটারির প্রধান শিরঃপীড়া তখন যুদ্ধবিমানের ক্ষয়ক্ষতি। মিলিটারি কর্তারা দেখলেন যে যুদ্ধবিমানগুলো ফিরে আসতে পেরেছে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে, তাদের বেশীরভাগের-ই সবথেকে বেশী বুলেটের গর্ত দুই ডানায় আর ল্যাজে, অথচ ইঞ্জিনগুলি প্রায় অক্ষত। (বুলেট হোলের ম্যাপটি খানিকটা নীচের ছবিটি দেখলে আন্দাজ পাওয়া সম্ভব)! মিলিটারি কর্তারা ভাবলেন, এর একমাত্র অর্থ দুই ডানা আর ল্যাজ-ই দুর্বল জায়গা, অতএব ওইগুলি-ই আরো শক্তপোক্ত করা উচিত ... 

ওয়াল্ড এইসময় লিখলেন তাঁর উপদেশ। কর্তারা যা বলেছেন, তার ঠিক উলটো - ডানা/ল্যাজের আর্মার বাড়িয়ে কাজ নেই, বরং ইঞ্জিনের আর্মার বাড়ালে উপকার হবে। 

 

বম্বার বিমানে বুলেট-হোলের (কাল্পনিক কিন্তু বাস্তবানুগ) ম্যাপ, উইকিপিডিয়া থেকে

ওয়াল্ড যেটা বুঝেছিলেন, আর কর্তারা বোঝেননি, সেই অদৃশ্য এফেক্টটির নাম সার্ভাইভার বায়াস। ওয়াল্ড বলেছিলেন, মিলিটারি-কর্তারা শুধু সেই এয়ারক্র্যাফটগুলিই দেখছেন যেগুলি মিশন থেকে ফিরেছে প্রাণ বাঁচিয়ে, অর্থাৎ সার্ভাইভ করেছে যেগুলি । 

যে বোমারু বিমানগুলি গুলির আঘাতে ধ্বংস হয়েছে, অথবা হারিয়ে গেছে, সেগুলির কোনো তথ্যই পাওয়া সম্ভব নয়। আরেক ভাবে বললে, বুলেট হোলের ম্যাপ যা দেখাচ্ছে তা বিমানের দুর্বল অংশ নয়, উলটে এমন অংশ যেখানে বুলেটের ক্ষত নিয়েও ফিরে আসতে পেরেছে সেই বম্বারগুলি। 

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে মার্কিন যুদ্ধবিমানের ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিলো অপরিসীম, ৮৮০০০ বোমারু বিমান হারিয়ে যায় বা নিখোঁজ হয় মিলিটারি ক্যাম্পেইনে গিয়ে - ওয়াল্ডের উপদেশ না মানলে সেই সংখ্যাটা কোথায় যেতো তা ভাবতেও আঁতকে উঠতে হয়। 

(আব্রাহাম ওয়াল্ডের আরোও অনেক গল্প ্লেখার বা বলার আছে, সময় পেলে সেসব হবে কখনো। শুধু এই যুদ্ধকালীন গবেষণার খুঁটিনাটি নিয়েই কত গল্প করা যায়। এই অসম্ভব প্রতিভাবান বৈজ্ঞানিকের অকাল্মৃত্যু হয় মাত্র আটচল্লিশ বছর বয়সে, ভারতে বেড়াতে এসে নীলগিরি পর্বতের কাছে বিমান দুর্ঘটনায়। মৃত্যু না হত্যা, সেই নিয়ে কিছু রহস্য এখনো রয়ে গেছে। এটাও বলে রাখা যায়, ওয়াল্ড পৃথিবীর একমাত্র বিজ্ঞানী নন যিনি রহস্যজনকভাবে বিমান দুর্ঘটনায় নিখোঁজ হয়ে যান।)

(৩)

সার্ভাইভার বায়াসের উদাহরণ কিন্তু চারিদিকে চোখ মেললেই বিস্তর প্রাঞ্জল দেখতে পাওয়া যায়। 

ওয়াল্ডের আগেই, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় যেমন। ব্রডি হেলমেটের প্রচলনের পরেই দেখা যায়, যেসব সৈনিক ওই হেলমেট-টি পরে যুদ্ধে গেছিলেন, অনেকেই মাথায় গুরুতর চোট নিয়ে ফিল্ড হাস্পাতালে ভর্তি। আর্মির লোকে ভেবেছিলেন নিশ্চয়ই পিথ হেলমেটের ডিজাইনেই কিছু গণ্ডগোল আছে, যতক্ষণ না একজন স্ট্যাটিশটিশিয়ান শুধরে দেন। ব্রডি হেলমেট মাথায় পরা সৈনিকরা তাও তো হাসপাতালে পৌঁছেছেন, যারা পরেননি মাথায় শ্র্যাপনেলের আঘাতে তাদের ভবলীলা সাঙ্গ হয়েছে যুদ্ধের মাঠেই। 

আরো অনেক অনেক আগে পিছিয়ে যাওয়া যায়। ভিসুভিয়াসের অগ্ন্যুৎপাতে পম্পেই ধ্বংস হয়ে গেছিলো ৭৯ খ্রীস্টপূর্বাব্দে। লাভাস্রোতের তলায় চাপা পড়া পম্পেই-এর ধ্বংসাবশেষ থেকে যে কঙ্কাল পাওয়া যায়, তাদের করোটি এবং দাঁতের গড়ন থেকে ঐতিহাসিকরা সিদ্ধান্ত করেন রোমান সাম্রাজ্যে সবার দাঁত নিশ্চিত খুব খারাপ ছিলো, দোর্দণ্ডপ্রতাপ রোমানদের মুখে যে দুর্গন্ধ হতো সে কথা প্রায় প্রচলিত রসিকতা হয়ে গেলো সময়ের সাথে সাথে। শেক্ষপীরের লেখায় দেখি, রাণী ক্লিওপেট্রার সবথেকে বড়ো ভয় ছিলো রোমান প্রেমিকের দন্তরুচির গন্ধ, ("in their thick breaths, / Rank of gross diet, shall we be enclouded, / And forced to drink their vapour?")। ওভিডের আর্ট অফ লভ-এও দেখি উপদেশ দিয়েছেন, একটিও দাঁত কালো থাকলে প্রেয়সীর সামনে দন্তপাটি না ক্যালানোই শ্রেয়। 

বলাই বাহুল্য, আমাদের থেকে প্রাচীন রোম্যান-দের দাঁত যে একটু হলেও বেশী খারাপ ছিলো সে নিয়ে সন্দেহ নেই, কারণ হাজার হোক তাদের টুথপেস্টে নুন ছিলো না। কিন্তু ঐ যে ঐতিহাসিক-রা পম্পেই-এর করোটি দেখে ভাবলেন সবার দাঁত পচা? সেইটেও আসলে সিলেকশন বায়াস। অগ্ন্যুৎপাতে যাঁরা পালাতে পারেননি, সেই বৃদ্ধ-অশক্ত লোকের দাঁতের গড়ন দেখেছিলেন বিশেষজ্ঞরা। পরের দিকে লোকে দেখেছেন, খারাপ ছিলো বটেই, তবে বয়সের তুলনায় আর পাঁচ জায়গায় যেমন ছিলো তেমনি, আলাদা কিছু নয়। 

শুরু করেছিলাম ওয়াল স্ট্রীট গুরুদের টোটকা-বইয়ের কথা বলে, সেই একটি শাখায় সার্ভাইভার বায়াস এতোই প্রচলিত যে এই ২০২০ সালেও দেখছি একের পর এক সায়েন্টিফিক এক্সপেরিমেন্ট ভুল প্রমাণিত হচ্ছে, শুধু এই একটি গ্যাঁড়াকলের জন্য। সবটাই যে অজ্ঞতা তা নয়, যেই এক্সপেরিমেন্টেই সাবজেক্ট-রা ভলাণ্টিয়ার করেন, সে ডায়েট হোক, দৌড় হোক ... সেখানেই একরকমের সিলেকশন বায়াসের সম্ভাবনা থাকে, তবে এও ঠিক যে এইসব বায়াস থেকে বাঁচার উপায় স্ট্যাটিশটিশিয়ান-রাই বের করে গেছেন। লোকে তাদের কথা শোনে কম, সে এক অন্য কথা। 

শেষ করবো দুটি কথা বলে। 

প্রথমটা করোনাভাইরাস নিয়ে মিস-ইনফর্মেশন, বিভ্রান্তি। যেখানে যতো সার্ভাইভাল রেটের ক্যালকুলেশন দেখছেন, বিশ্বাস করুন প্রায় সব-ই সত্যিকারের রেটের থেকে একটু হলেও বেশী, অর্থাৎ অপটিমিস্টিক। কারণ প্রথমতঃ, প্রচুর লোকে কোভিড টেস্ট না করেই অন্যান্য কারণে মারা যাবেন, যাচ্ছেন, ভাইরাসের ডেথ কাউন্টের হিসেবে তারা পড়েন না, পজিটিভ হোন বা না হোন। আর দ্বিতীয়টি তো শাসকরা অপব্যবহার করার জন্য উঠে পড়ে লেগেছিলেন, যদি টেস্ট-ই না করা হয়, কাউন্ট বাড়বে কেমনে? 


আর দ্বিতীয়টা এই যে পৃথিবীতে যেখানে যতো ভয়ানক প্রতিযোগিতার জায়গা আছে, সিনেমা বলুন, অ্যাথলেটিক্স বলুন, বা আমাদের সময়ে একটা সাধারণের থেকে একটু ভালো, স্বাচ্ছন্দ্যের চাকরি। শুধু যাঁরা হাতে অনির্বচনীয় হুণ্ডি পেয়েছেন, তাদের দিকে তাকালে ভুল হবে। পাশে সেইসব অজস্র উদাহরণ দেখতেই হবে যা গণনার বাইরে। নাসিম নিকোলাস তালেবের ভাষায় সেই সব অসফল মানুষ, ব্যর্থ প্রাণের আবর্জনা যা ঢাকা থাকে ঔজ্জ্বল্যের আড়ালে, তা-ই আমাদের 'সাইলেন্ট এভিডেন্স', 'নির্বাক প্রমাণ'? 

আরো সাদামাটা ভাষায়, কবিত্ব কাটিয়ে দিয়ে বললে, সমস্ত সফল মানুষের দুটিই মাত্র কমন হ্যাবিট, এক সার্ভাইভার বায়াস, দুই ভাগ্য।  

সেই বো বার্ণহ্যাম যেমন বলেছিলেন, "Taylor Swift telling you to follow your dreams is like a lottery winner telling you to liquidize your assets and buy Powerball tickets.”

অথবা জর্জ অরওয়েল যেমন বলে গেছেন আমাদের, 'keep the aspidistra flying' ! আমরা যাঁরা লিখবো লিখবো বলেও সাহস করে লেখক হয়ে উঠিনি কোনোদিন, হাতছানি পেয়েও সব ছেড়ে ঝাঁপ দিইনি মঞ্চের আলোর বৃত্তে। সার্ভাইভারশিপ বায়াস বুঝে গেছিলাম বড্ডো ভালো করে? হয়তো বা ! 



সূত্রঃ 

১) Marc Mangel & Francisco J. Samaniego (1984) Abraham Wald's Work on Aircraft Survivability, Journal of the American Statistical Association, 79:386, 259-267, DOI: 10.1080/01621459.1984.10478038

২) https://mcdreeamiemusings.com/blog/2019/4/1/survivorship-bias-how-lessons-from-world-war-two-affect-clinical-research-today

২) https://www.scientificamerican.com/article/how-the-survivor-bias-distorts-reality/

৩) M., Han, L., MD, P., & Singhal, S. (2020, May 27). Major challenges remain in COVID-19 testing. Retrieved July 27, 2020, from https://www.mckinsey.com/industries/healthcare-systems-and-services/our-insights/major-challenges-remain-in-covid-19-testing