Monday, April 13, 2020

উজু !



এই গভীর, গভীরতর অসুখের মধ্যে বসে বসে মাঝে কলেজের টুকরো-টাকরা গল্প মনে পড়ে ... দু-একজন পুরোনো বন্ধু, যাদের সাথে অনেকদিন দেখা নেই ... এখন শনিবার-শনিবার সকালে বিভিন্ন প্রান্ত থেকে অনলাইন হচ্ছি সবাই, কারুর সকাল, কারুর বিকেল, কারুর চোখ ঘুমে ঢুলছে ... ছোট্ট ছোট্ট বাক্সের মধ্যে চেনামুখ গুলো দেখি আর ভাবি এই বন্দীদশা শেষ হলে সবার সাথে একদিন দেখা করবোই যাহোক করে ... বাক্সের ভেতরে-বাইরে সব্বাই ... সেইরকম এক-একজনের গপ্পো বলবো এক-একদিন...

আজকের যে হিরো, তার নাম উজু, উজু চেয়েছিলো ফিজিক্স পড়বে, এদিকে বাড়ির লোকে জোর করে ঢুকিয়ে দিলো স্ট্যাট পড়তে, শেষমেশ অবশ্য স্ট্যাটের পাট চুকিয়ে উজু কম্পিউটেশনাল ফিজিক্স-এই কাজ করেছে, এখন ডক্টরেট শেষ করে চাকরি করছে কোথাও ...  তা সেই কলেজে পড়ার সময় থেকেই একটা জিনিষ খুব স্পষ্ট ছিলো, এই আগাপাশতলা রিগ্রেশন টুওয়ার্ডস মিনের রাজত্বে উজু একটি জ্বলজ্বলে আউটলায়ার !

যাইহোক, উজুর প্রথম কেরামতি দেখতে পেলাম ফার্স্ট ইয়ারে - পিসি (না উনি নন, আরেকজন) ক্লাসে অ্যাসাইনমেন্ট দিয়েছেন স্টক মার্কেটের দৈনিক ওঠানামার মধ্যে কিছু একটা প্যাটার্ন খুঁজতে হবে - আর ডেটা জোগাড় করতে হবে রোজকার খবরের কাগজের 'শেয়ার বাজার' এর ছোট্ট একচিলতে ব্লক থেকে। এদিকে আমাদের বেশীরভাগ-ই আজন্ম ক্যাবলা, স্টক কাকে বলে তাই জানিনা, হঠাৎ মেসের সামনে কাগজ নিয়ে টানাটানি পড়ে গেলো ... দেখা গেলো বেশীর ভাগ-ই ল্যাদখোর, বোম্বে কি বড়োজোর ভারতের দু-একটা ইন্ডেক্স দেখেই ক্ষান্ত, রোজ সকালে কাগজ দেখে দুটো নাম্বার টুকে নেয়, আগের দিনের থেকে বেড়েছে (+১), না কমেছে (-১)... একটি ছেলে আবার হাফ-আমেরিকান-ডিজনিল্যান্ড-মায়ামি-ফেরত, সে সিধে নিউ ইয়র্কের নাম্বার টোকে ... (সব ডেটা-ই ডেটা, কিন্তু ডাও জোন্সের ডেটার গ্ল্যামার একটু বেশী) ... উজু কিন্তু এই হট্টগোলে অবিচলিত, কাগজের দিকে ফিরেও তাকায় না, কিছুই টোকে না ... যাহোক, মাস খানেক পরে অ্যাসাইনমেন্ট জমা দেওয়ার দিন - সবাই বীরবিক্রমে অনেক কিছু করে সাজিয়ে এনেছে প্রেডিকশনের ডালি, উজুও দিব্যি খাতা জমা দিলো, নম্বর-ও পেলো ... ক্লাসের পরে জিগ্যেস করলাম, কিরে ডেটা কোথায় পেলি? উজু নির্বিকার মুখে উত্তর দিলো, আরে প্লাস ওয়ান আর মাইনাস ওয়ান তো? মনে মনে র‍্যান্ডম নাম্বার ভেবে বসিয়ে দিয়েছি !

এই প্যানডেমিকের বাজারে ভেবে দেখেছি, ওইটেই আসল সত্য, কে যে কোথায় আপন মনের মাধুরী মিশিয়ে ডেটা জেনারেট করে যাচ্ছে কেউ জানে না, আমরা মিয়ার মর্টালস অ্যানালাইজ করে উলটে দিচ্ছি !

বছর দুয়েক পরের ব্যাপার, হোস্টেলে দাবা টুর্নামেন্ট ! সবাই হঠাৎ বিশ্বনাথন আনন্দ না হোক দিব্যেন্দু বড়ুয়া হয়ে গেছে। আমি এদিকে ঘোড়া যে আড়াই ঘর লাফায় সেই মনে রাখতেই হিমশিম খাই, ওদিকে লোকে কাকে দিয়ে শুরু করে কাকে খাবে এইসব ভেবে প্যাঁচ কষে চা খেতে খেতে ... যথারীতি উজু এসবের মধ্যে নেই ... তাও একদিন হঠাৎ দেখি, উজুর ঘরে দাবার আড্ডা, আমাদের পাড়ার কাসপারভ-কে রীতিমত চাপে ফেলে উজু লড়ছে ! হাড্ডাহাড্ডি ম্যাচ শেষ হওয়ার পরে জিগালাম, তুই যে বললি দাবা খেলতে পারিস না? উজু বলেছিলো সত্যি-ই পারে না, সারা ম্যাচ সিমেট্রিক চাল চেলে গেছে, ওদিকে সাদা সৈন্য এগোলে, উজুও এগোয়, ওদিকের গজ গড়াগড়ি দিলে এদিকে ওর গজ-ও গড়িয়ে যায় ... বললে পেত্যয় যাবেন না, সেই বিচিত্র ম্যাচ উজু আরেকটু হলেই জিতেও যেতো !

সেই বছরটাই ছিলো আতঙ্কের থার্ড ইয়ার ! কম্প্রিহেন্সিভ নামে এক ভয়ানক পরীক্ষা, মানে তিন বছরের সব সিলেবাস ঘেঁটে একটা বিভীষিকাময় কক্টেল ... সব পরীক্ষার আগে এক হপ্তা পড়ে পাস করে যাই, হঠাৎ এই মক-রাক্ষসের সামনে এসে আমাদের তখন কাপড়ে-চোপড়ে অবস্থা ! উজুর ঘরে এই সময় একদিন হানা দিলাম, দেখি ছেলে তিন বছরের খাতা-ফাতা ফেলে দিয়ে চাপ নিয়ে পিরিওডিক টেবল গাঁতাচ্ছে... (বলাই বাহুল্য আই-এস-আই-এর তিন বছরে যতোই খট্টাং পুরাণ থাকুক না কেন, আফবাও প্রিন্সিপল ছিলো না) ... কিন্তু উজু গাঁতাচ্ছিলো কেন? না একদিন সকালে উঠে মনে হয়েছে কোন এলিমেন্টের কতো অ্যাটমিক নাম্বার মনে নেই ... কোথা থেকে কি হোলো জানিনা, সন্ধ্যের মধ্যে দেখি গোটা হোস্টেলে সবাই কম্প্রি কাটিয়ে পিরিওডিক টেবিল আওড়াচ্ছে !

আনন্দের কথা আমরা কেউ-ই সে যাত্রা ফেল করিনি! তবে এখনো খুব চাপের মধ্যে মাঝে মাঝে মনে হয় বেরিলিয়মের কনফিগারেশন-টা ঝালিয়ে নিলে হয়তো আর অ্যাসিম্পটোটিক্স আদৌ চাপের মনে হবে না ...

ও হ্যাঁ, আরেকটা কথাও বলে রাখি, উজু আমাদের ক্লাসে বলে দেওয়া কোনো টেক্সট-ই পড়তো না, ও জোগাড় করে আনতো সেই সাবজেক্টের রাশিয়ান কোনো লেখকের বই ! শুধু সেইগুলোই পড়তো নিজের মনে ... আর পরীক্ষার হলে যেখানে লোকে মুন্ডুমাথা যতেক পারি ততেক লিখি করে যাচ্ছে, উজু প্রথমে পেন্সিলে লিখে রাফ কপি বানাতো, তারপরে সেই লেখার উপরে পেন বুলিয়ে বুলিয়ে ফেয়ার ... জীবনে সব প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করা আসলে যে মূর্খামি সেটাও সেই থেকেই শিখেছি - স্বীকার করতে বাধা নেই ...


আই-এস-আই আস্তে আস্তে শেষ হয়ে আসছে, লোকজনের ধুম লেগেছে জি-আর-ই পরীক্ষার, সাউথ উইঙ্গের আকাশে-বাতাসে বিচিত্র সব ইংরেজি শব্দ শোনা যাচ্ছে, যে সব বাংলা মিডিয়ামের ছেলে অ-আ পড়েই আলফা-বেটা করতে শিখেছে, তারাও হাত ধুয়ে হাসি-হাসি মুখে বলছে দ্যাখ কেমন অ্যাবলিউশন করে এলাম ... উজুও জি-আর-ই দেবে, ডেট এগিয়ে আসছে, কিন্তু উজু স্বভাবতই নির্বিকার !

কালক্রমে দিন এলো - এদিকে সেইদিনেই আবার তাসা*-র ক্লাসে হোম-ওয়ার্ক জমা দেওয়ার শেষ দিন ! খুব-ই জটিল পরিস্থতি ... আর সেই অ্যাসাইনমেন্ট-ও এতোই লম্বা, যে টুকতে গেলেও দু-রাত লেগে যাবে !

উজু সকালে উঠে বললো, আজকে অনেক কাজ, কাজেই অতো ওয়ার্ড পড়ছিনা, খালি ব্যারনের বইয়ের সামনে একটা high frequency wordlist আছে, শ-তিনেক শব্দ, সেইটে গাঁতিয়ে চলে যাচ্ছি ! আমি বললাম শব্দগুলো গাঁতাবি, শব্দগুলোর মানে গাঁতাবি না? উজু অবাক ! শব্দ-ও জানবো, আবার তার মানেও জানতে হবে?

এমনি আম-আদমি হলে রণে ভঙ্গ দিয়ে লেপমুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়তো ... উজু কিন্তু অকুতোভয়, পরীক্ষা তো দিতে গেলোই, তাসার অ্যাসাইনমেন্ট-ও জমা দিয়ে এলো !

এসে বললো এই তো প্রথম পাতায় দুটো অঙ্ক করলাম, তারপর ভাবলাম এতো পাতলা খাতা জমা দিলে অনেক বকাঝকা খাওয়ার চান্স, এদিকে দেরী হয়ে যাচ্ছে ... তাই ব্রেকফাস্টের পরেই মেসে গেলাম, দেখলাম একটা ভাঙা চেয়ারের উপর ফার্স্ট ইয়ারের কারুর কি একটা সাবজেক্টের নোটের খাতা পড়ে আছে, সেইটাই নিয়ে মাঝখান থেকে এক দিস্তে পাতা ছিঁড়ে আমার ওই একটা পাতার সাথে স্টেপ্ল করে জমা দিয়ে এলাম ... মোটাসোটা দিস্তে দেখে তাসা-ও খুশি, পরে পাতা উল্টোলে শাপ-শাপান্ত করেছেন নির্ঘাত, কিন্তু ততোক্ষণে উজু উড়ে গেছে !

মাঝে মাঝেই নাক-উঁচু জার্নালে দুরুদুরু বক্ষে পেপার সাবমিট করার আগে বেশ টেনশন হয়, তারপর এই গল্পটা মনে পড়লে ভাবি ... আসলে চোতাটা বেশ মোটাসোটা কিনা সেইটাই তো লোকে দেখে, কাজেই ভয়ের কারণ নেই !


উজুর সাথে শেষ কথা হয়েছে বছর চার-পাঁচ আগে, কোনো একটা ফিজিক্সের কনফারেন্সে এসেছিলো বল্টিমোরে ... এক বন্ধুর সাথে দেখা, তারপর ফোন! উজু ফেসবুকে নেই, কাজেই এই লেখাটা পড়ে আমাকে ক্যালাতে আসবে, সেই ভয় পাওয়ার কারণ নেই, তা ছাড়া এমনিতেও ছেলেটা শান্ত !

এই লেখাটা লেখার আগেই খুঁজে বের করলাম উজু-কে, একটা রিকোয়েস্ট পাঠিয়ে গল্প লিখলাম ... এইসব আষাঢ়ে গপ্পের ছুতোয় একটা পুরোনো চেনা মুখে খুঁজে পেলে ক্ষতি কী?


-----


*আমার খুব-ই প্রিয় শিক্ষক, কান মুলে দিতে পারেন, তাই পুরো নাম লিখলাম না ...













Saturday, April 4, 2020

"ফলিবেই ফলিবে" ...


এই যে পাবলিক হেলথ-এর ' না জানা পাবলিক উদুম ডিপ লার্নিং আর কার্ভ ফিটিং করে রোজ সকাল-বিকেল দশটা কোভিড-১৯ ফোরকাস্টিং এর মডেল নামাচ্ছে, দৃশ্য দেখেই ইহজগত-কে টাটা করতে হবে মনে হচ্ছে !

যে দিকে জিনিষ যাচ্ছে তাতে অনিশ্চয়তা (আন্সার্টেনটি) কিছুদিন পরে উঠেই যাবে, রাস্তার মোড়ে মোড়ে দোকান হবে মাতৃ মেশিনলার্নিং স্টোরস কিংবা বগলার ব্যাকপ্রপ কর্ণার, উপরে সাইনবোর্ড ঝুলবে সব জ্যোতিষী বারবার, ডিপ লার্নিং একবার” ...

সে যাই হোক, এই প্যানডেমিক মডেলিং-এর হিড়িক দেখে একটা সদ্য-যৌবনের গল্প মনে পড়ে গেলো! আমার আই-এস-আই-এর প্রাণের বন্ধু মাতাল (ভালো নাম গোপন থাকুক) তখন বিবাহযোগ্য ব্যাচেলর। বাড়ির লোকেও স্বাভাবিক ভাবেই উন্মুখ উদবিগ্ন ... তা মাতালের মায়ের সাথে একদিন বাজারে পুরোনো বান্ধবীর দেখা, -কথা-সে-কথায় জানা গেলো সেই বান্ধবীর- একটি বিবাহযোগ্যা কন্যা আছে, এবং সে মডেলিং করে। মাতালের মা হাতে চাঁদ পেলেন, বললেন বাঃ আমার ছেলেও তো সারাদিন মডেলিং- করে ...

শোনা যায়, নির্দিষ্ট দিনে এরপর দুজনের দেখাও হয়েছিলো বাবা-মায়ের তত্ত্বাবধানে, কিন্তু মডেলার মডেলকে দেখতে না দেখতেই মডেলার মাতালের মা বলে ওঠেন, না রে বাবা তোর দ্বারা হবে না ...

আজকের এই মডেলার-দের যদিও সেরম কিচ্ছু বলতে চাই না একেবারেই, এটা নিছক-ই একটা গপ্পো!


পুনশ্চ ১ - কেউ ভুল বুঝবেন না, আমার মনে হয় ইন্টার-ডিসিপ্লিনারি কাজ না করলে এরকম সাংঘাতিক প্যান্ডেমিক রোখা সম্ভব নয়, অথবা পরের বারের জন্য প্রস্তুত হওয়াও খুব খুব শক্ত ... তবে একটা বীভৎস পাবলিক হেলথ ক্রাইসিসের আগাপাশতলা না বুঝে এই ঘোলা জলে একটি খ্যাপলা জাল রেডি রাখার চেষ্টা, অথবা নিজের দু-পহার কোডিং স্কিল শো-অফ করা যে কতখানি crass এবং বিপজ্জনক, সে বোধ কিছু ডেটা-চচ্চড়ির হলে ভারি খুশি হই এই আর কি!

হ্যাঁ, এই বাজারে বরং ডানিং-ক্রুগার এফেক্ট নিয়ে এট্টু পড়ে নিন (যার মোদ্দা কথা হচ্ছে যে লোকের নিজেদের বিদ্যে-বুদ্ধির দৌড়, তাদের নিজেদেরই সচরাচর বোধগম্য হয় না!

পুনশ্চ আমার সব গল্প- অতিরঞ্জিত (নাহয় নির্জলা আর্বান লিজেন্ড)এটাও ব্যতিক্রম নয়তবে একটু রঙ না চড়ালে জীবন বড়োই মান্ডেন ...