Thursday, September 5, 2024

শিক্ষক দিবস ২০২৪

 এই লেখাটা যখন লিখতে শুরু করেছিলাম, কলকাতা শহরের রাজপথে বহু বহু মানুষ নেমে পড়েছেন আরজিকর কাণ্ডের প্রতিবাদে, কোথাও পথনাটিকা হচ্ছে, কোথাও মোমবাতি-মিছিল, কোথাও মানব-বন্ধন। তাদের সবাইকেই আমার অজস্র শুভেচ্ছা ও ভালোবাসা, এবং ঐক্যের অঙ্গীকার। গণ-আন্দোলন, গণ-জাগরণ যাই বলুন, তার একটা ভয়ের জায়গা দলীয় কু-রাজনীতির অনুপ্রবেশ, মঞ্চ বা স্লোগান কেড়ে নেওয়ার অপচেষ্টা, শহরের সাধারণ মানুষ সেইসব চেষ্টাকেও যে রুখে দিতে পারছেন বা সাধ্যমত চেষ্টা করেছেন তাদের ধন্যবাদ জানিয়ে ছোটো করতে চাই না, আপনাদের কাছে আমার অশেষ কৃতজ্ঞতা। এই সময়ে আশাবাদের মূল্য অপরিসীম।

আজ জাতীয় শিক্ষক দিবস। আমি নিজে পেশায় একজন শিক্ষক-অধ্যাপক, উচ্চশিক্ষাকর্মী। সেই পেশায় অর্থ, প্রতিপত্তি, খ্যাতি, যশ সব-ই বেশ দুর্লভ, অন্ততঃ আমার অভিজ্ঞতায়। কেউ কেউ পেয়ে থাকলেও সিংহভাগ কর্মীই আলোর বৃত্তের বাইরেই কাটিয়ে দেন জীবন, আর সামগ্রিকভাবেই সম্মান বা সামাজিক প্রতিষ্ঠাও গত দুই-তিন দশক ধরে ক্রমশঃ নিম্নমুখী, শিক্ষাক্ষেত্রের বিভিন্ন দুর্নীতি ও বিষাক্তচক্রের কথাও প্রায় সবাই জানেন, এবং সেই ধ্বংসের দায়ভার কেন্দ্র-রাজ্য, সবার-ই। নিয়োগ দুর্নীতি কী সাংঘাতিক আমাদের সামান্য ধারণা আছে। সে ক্ষত সারবে না কোনোদিন। তার উপরেই, এই কিছুদিন আগেই নীট পরীক্ষা নিয়ে বীভৎস কেলেঙ্কারি হয়ে গেলো। যদিও সে এখন অতীত, রিয়ারভিউ মিররে অপসৃয়মাণ দৃশ্য। এইগুলো তাও খুব বড়ো দুর্নীতি – খবর হয়, চোখে পড়ে, অল্প লেখালিখি হয়, এর আড়ালে খুচরো দুর্নীতিও কম নয়। ভেতরে ভেতরে যতই ঝাঁঝরা করে দিক, সেইসব দুর্নীতির বিচার দূরস্থান, সবসময় যে সেগুলো দুর্নীতি – তাইই প্রতিষ্ঠা করা যায় না।
এর-ই পাশাপাশি আরেক দৈত্য লাগামছাড়া বেসরকারিকরণ – ফলতঃ অকল্পনীয় অসাম্য, আর শিক্ষাকে ক্রমশঃ মানবাধিকার থেকে মুনাফাজাত পণ্যের দিকে ঠেলে দেওয়া। গত ২০ বছর ধরে ফুলেফেঁপে এই দৈত্য গোলেম এখন আমাদের হাতের বাইরে। গতকাল প্রোফেসর অম্বর হাবিবের লেখায় পড়ছিলাম, এই বছরেই শুধু ২৪ লাখ ছাত্র পরীক্ষায় বসেছে ১ লাখ এমবিবিএস আসনের জন্য, যার আবার মাত্র অর্ধেক সরকারি, অর্থাৎ সাধারণের আয়ত্তে। ওদিকে ১১ লাখ ইউজিসি-নেট পরীক্ষায় রেজিস্টার করেছেন মাত্র চার হাজার ফেলোশিপ, আর চার হাজার লেকচারারশিপের সার্টিফিকেটের জন্য প্রতিযোগিতায়। অন্যদিকে জোর করেই চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে কুয়েট, কমন ইউনিভার্সিটি অ্যাডমিশন টেস্ট, তাতে শুধুই মাল্টিপল চয়েস কোশ্চেন অর্থাৎ এমসিকিউ-র জ্বলন্ত জঞ্জাল। সেই এমসিকিউতেও বিচার্য শুধুই গাদা মুখস্থবিদ্যা আর অপ্রাসঙ্গিক খুচরো তথ্য-উপাত্ত। এর-ও ফল সেই এক-ই। ‘পেটের মধ্যে শুকনো পুঁথির শুকনো পাতা খসখস গজগজ’। স্কুলশিক্ষাকে, বৃহত্তর শিক্ষাকে আরও একটু অপ্রাসঙ্গিকতার দিকে ঠেলে দিয়ে খুব সংকীর্ণ ঐ কম্পিটিশন-সাকসেস মার্কা কিছু ট্রেনিং-এর দিকে ঝুঁকে পড়া ছাড়া গতি নেই ছাত্রদের। প্রোফেসর হাবিব এক্কেবারে শেষে যথার্থই লিখেছেন, ‘coaching no longer supplements the regular education, but supplants it.’
এসব পড়তে পড়তে ভয় হয়। মনে হয় আর কিছু না, এই আমার-ই মত আর্থসামাজিক পরিস্থিতিতে বড় হওয়া একজন ছাত্র আর তিরিশ বছর পরে জন্মালে তার পক্ষে তার পারিপার্শ্বিকের বাধা ঠেলে উচ্চশিক্ষার দিকে যাওয়াই দূরাগত স্বপ্নের মতই মনে হত। অত্যন্ত সংকোচ হলেও লিখতে বাধ্য যে এই মনে হওয়াটা মিথ্যে হলে, ভ্রান্ত হলে খুশি হব, কিন্তু আমি জানি এটাই সত্যি।
এইসব ছাড়াও আছে শিক্ষার উপর রাজনৈতিক দুরভিসন্ধির প্রভাব। কয়েকদিন আগেই অন্তত দুটো খবরে আঁতকে উঠেছিলাম। প্রথমটা – পাঠ্যবই থেকে বিবর্তন ও অন্যান্য উড়িয়ে দেওয়া, যার প্রতিবাদে প্রায় হাজার দুয়েক শিক্ষক-অধ্যাপক-গবেষক চিঠি লেখেন সরকারকে। অন্যটা ইতিহাস বদলে দেওয়ার অপচেষ্টা – বাবরি মসজিদের নাম বদলে লেখা হয়েছিল ‘তিন গম্বুজের কাঠামো’ - প্রতিবাদ করেছিলেন সুহাস পালশিকর আর যোগেন্দ্র যাদব। ফল কী হয়েছে, জানা নেই। আর কেন্দ্রীয় শিক্ষানীতির ফলে মাতৃভাষা শিক্ষার কী দুর্গতি হচ্ছে সে আর নাই বা বললাম। ধরে নিচ্ছি এইসবের ভিড়ে ঐটা তালিকায় আরও অনেক পরে লুকিয়ে পড়েছে, তার হয়ে আর সওয়াল করবে কেউ এমন আশা নেই।
এবং স্বীকার করতে কষ্ট হলেও ব্যক্তিপর্যায়েও সেই দায়ের ভাগ একটু এসে পড়ে। সেইসব অভিযোগ সারাবছর করি। আজ করবো না। কারণ করবোই বা কাকে? আঙ্গুল তুলবো কোন আয়নার দিকে? কোথা থেকে সংস্কার শুরু করতে হবে, নিচ থেকে উপরে, না উপর থেকে নিচে? 'আমরা সবাই দোষী' কথাটা শুনতে মহৎ এবং বেশ আকর্ষণীয় লাগলেও আসলে একটি ঢপের চপ, এবং ক্ষতিকারক, কারণ ঐ যৌথ, সমবেত আর্তনাদের আড়ালে সত্যিকারের দোষীদের-ও কিছুটা, বেশ কিছুটা ছাড় দেওয়া হয়। হ্যানা আরেন্ট বলেছিলেন, "Where all are guilty, nobody is." …
সেই বিষবৃক্ষের ফল সর্বত্র। আইআইএসইআরের সেই আত্মঘাতী ছাত্রর ঘটনার সুবিচার আজও হয়নি। এবং সে একা নয়। সুবিচার হয়নি র্যাগিং-এর শিকার ছাত্রটির-ও। যদিও, সেইসবও পেছনে ফেলেই আমরা এগিয়ে গেছি। সবাই ভুলে গেছে এটা আমি বিশ্বাস করি না, তবে সবাই মিলেই হাল ছেড়ে দিয়েছি বললে বিন্দুমাত্র মিথ্যা বলা হয় না।
অতএব, উত্তরণ আদৌ সম্ভব কি না, আমার জানা নেই। আর বানান করে না বললে যদি কেউ ভুল বোঝেন, এই সবকটা সমস্যাই আমি যে দেশের শিক্ষাব্যবস্থার কর্মী, অর্থাৎ এই প্রথম বিশ্বের পশ্চিমা দুনিয়াতেও ভয়ানক পরিমাণেই আছে। বেশি বই কম না। প্রদীপ বড়ো হলে তার নিচে অন্ধকার-ও কী বেশিই হয়? এও জানি না।
যা লিখতে বসেছিলাম কিছুই লেখা হল না। যা লিখলাম সবটুকুই নৈরাশ্যের, আশঙ্কার। তবে, আশঙ্কার মেঘের মধ্যে দু-একটা আলোর ক্ষীণ রেখা যে দেখি না এমন না। আমার নিজের পরিচিত অধ্যাপক/শিক্ষকদের মধ্যেই অসামান্য বন্ধুবান্ধব আছেন, দেশে-বিদেশে দুই-ই। তারা সবাই সম্যক জানেন কী প্রতিকূল পরিস্থিতিতে তারা লড়ে যাচ্ছেন, তবুও মাটি কামড়ে লড়ে যাচ্ছেন, ভালোবাসার জোরে। কী-ই না করেছেন তারা ছাত্রছাত্রীর মুখে হাসি ফোটানোর জন্য, তাদের একটু সামান্য উজ্জ্বল আগামীর জন্য। নিজের ব্যক্তিগত সুখস্বাচ্ছন্দ্য তুচ্ছ করা তেমন কিছুই না, তারা দুর্যোগ মেনে নিয়েছেন, ক্ষয়ক্ষতি স্বীকার করেছেন, এবং কিছুতেই পিছু হটেন নি। সেসব গল্প পৃথিবীর কোনো রূপকথার থেকে কোনো অংশে কম না। তাদের দু-একজনকে কাছ থেকে দেখার সৌভাগ্য হয়েছে। নাম টুকে জমা দেওয়ার মত ক্লাস মনিটর আমি নই, তবুও ভাবতে ভারী ভালো লাগে যে একজন পুলকবাবুকে, অথবা একজন সুনন্দকে, একজন পার্থদাকে, অথবা একজন ভ্রমরদিকে আমি চিনি। চিনি শুধু না, গর্ব করে ভাবি যে জীবনের একমাত্র অর্জন এই যে এরাও হয়তো আমাকে বন্ধু বলেই ভাবেন।
তাই, এই শিক্ষক দিবসে কারুর প্রতিশ্রুতি অথবা অঙ্গীকার চাই না, সংস্কারের দশ দফা দাবিও চাই না, জনরোষ বা গণচেতনা এইসবের দুরাশা করি না, শুধু খুব স্বার্থপরের মত চাই এই সব ভালোবাসা ও বন্ধুত্ব দীর্ঘজীবী হোক।

No comments:

Post a Comment