Thursday, September 28, 2017

রাঙিয়ে দিয়ে যাও



একটা সময় ছিলো, আমাদের বয়েস তখন একক ছেড়ে দশকের ঘরে পৌঁছয়নি, এই চতুর্থী-পঞ্চমীতেও রাস্তাঘাটে নিরাপদে বেরোনো যেত, এমনকি সামনের রায়পাড়ার মাঠে ষষ্ঠীর দিনও দেখেছি প্যাণ্ডেলের বাঁশে কাপড় পরানো হচ্ছে আর সেই ফাঁক দিয়ে দেখা যাচ্ছে এক চিলতে প্রতিমা, তার হাত খালি আর মুখের সামনে তেরপল টাঙানো ... মা বলতেন, 'এই তো মা একটু ঘুমোচ্ছেন, অনেকটা জার্নি করে এসেছেন কিনা !' আর বেশ মনে পড়ে, জ্ঞান হওয়া ইস্তক সপ্তমীর রাতটা বাঁধা ছিলো হোল-নাইট ঠাকুর দেখা্র জন্যে, আর আমি ষষ্ঠী থেকেই রাতবিরেতে উঠে মাকে ঘুম ভাঙ্গিয়ে জিজ্ঞেস করতাম, 'সপ্তমী কি এসে গেছে?'

আমাদের সেই ছোট্টবেলায় পুজো শুরু হতো একটা অদ্ভুত রিচুয়াল দিয়ে, বাবা সকাল হতে না হতেই ঝাঁপিয়ে পড়ে বলতেন এই লাইন টানা খাতায় একশো বার শ্রী শ্রী দুর্গা সহায় লেখো ... সে এক দুঃসহ যাতনা !

তবে এর উদ্দেশ্য কিন্তু হাতের লেখা প্র্যাক্টিশ নয়, সে তো আপনি চাইলেই পি আচার্যের রচনা লিখতে পারতেন, বা আনন্দবাজার থেকে গৌতম ভটচাযের দাদাইস্ট পেইন্টিং-ও অক্লেশে টুকে দিতে পারতেন...  কিন্তু নাহ, ওই একটাই বাক্য, সেই যাত্রাপথের "মা খু চিহল ও পঞ্জম হস্তম" এর মতন ... বড়ো হয়ে বুঝতাম ওটার আসল উদ্দেশ্য দিনের পর দিন একঘেয়ে কাজ করে যাওয়ার নেট প্র্যাক্টিশ - ব্যাঙ্কে কাজ করতে গিয়ে দিনের পর দিন একটা পাওয়ারপয়েন্টে ভুষিমাল-টু-ডেসিমাল করতে গিয়ে দেখেছি, খুব কাজে দেয় ...

পুজোর উপহার পেতাম চারটে জিনিষ, নতুন জামা-প্যান্ট-জাঙ্গিয়া, নতুন একজোড়া জুতো এবং সেটা পড়ে ফোস্কা পড়বেই তাই একপাতা ব্যান্ড-এড আর একটা খেলনা ক্যাপ পিস্তল। সেই পিস্তল ছিলো আমার সবসময়ের সঙ্গী, পুজোর ভিড়ে ঘামতে ঘামতে, পায়ের পাতা বাঁচাতে বাঁচাতে কল্পনা করতাম একটা বিশাল দৈত্যাকৃতি টেরোড্যাক্টিল এসে মহম্মদ-আলির মাঠে নেমেছে আর আমি একা অকুতোভয় যোদ্ধা, হাতে একটি উদ্যত ক্যাপ পিস্তল ...

এইসব আগডুম-বাগডুম ভাবতাম বলেই কিনা ঠিক জানিনা, থেকে থেকেই ছড়িয়ে মাঠ ময়দান করতাম। স্পষ্ট মনে পড়ে বাবার সাথে ঠাকুর দেখতে বেরিয়েছি, হঠাৎ রাস্তায় দেখা বাবার অফিস-কলিগ আর তাঁর মেয়ে, আমার-ই বয়সী। যদিও আমি নেহাত-ই শিশু এবং সে বয়সে ছক বলতে শুধুই এক্কা-দোক্কা বা লুডো, তা-ও ভদ্দরলোকের মতন পিস্তল কোমরে গুঁজে, হাত বাড়িয়ে জিজ্ঞেস করলাম, 'তোমার নাম কি?' মেয়েটি ফিক করে হেসে উত্তর দিলো, 'এমা তোমার প্যান্টের চেন খোলা' ... দামড়া বয়সে তার সাথে আরেকবার দেখা হয়েছিলো, বাবার চেম্বারে, আমি চিনতে পারিনি, সে-ও না, বাবাই পরিচয় করিয়ে দেন, 'সেই যে তোকে বলেছিলো, তোর পোস্টাপিস খোলা'?

দোষটা আসলে আমার-ই, ক্যাপ হাতে পেয়ে বীররস একটু বেশী-ই বেড়ে গেছিলো হবে, আমার বাবা আবার খেলনা-বন্দুক জিনিষটাকে অত্যন্ত অপছন্দ করতেন, তাঁর ধারণা ছিলো মানুষের মধ্যে হিংস্রতা জাগায় এমন জিনিষ আর যাই হোক বাচ্চার খেলার জিনিষ হতেই পারে না। এখন মাঝে মাঝে চারদিকে দেখে মনে হয়, এটাই যদি আর-ও দু-একটা লোক ভাবতো, মন্দ হতো না ...

ঠাকুর দেখতে বেরোনোর আগে আমাদের পকেটে একটা চিরকুটে নাম ঠিকানা লিখে দেওয়া হতো, হারিয়ে গেলে এবং গাঁত উলটে বাড়ির ঠিকানা ভুলে গেলে যাতে কেউ বমাল ফেরত দিয়ে যান তার ব্যবস্থা ... বাবা নির্ঘাৎ জানতেন যে আমার হারানোর ষোলো-আনা ইচ্ছে - তার অবিশ্যি দুটো জায়েজ কারণও ছিলো -- এক, গোপাল ভাঁড়ের গল্পে পড়েছি, গোপালের ছেলে মেলায় হারিয়ে গিয়ে তারস্বরে 'গোপাল, অ্যাই গোপাল' বলে চিল্লামিল্লি জুড়ে দিয়েছে, গোপাল এসে কান মুলে ধরতে তার অকাট্য যুক্তি, 'বাবা, বাবা' ডাকলে তো সবাই ছুটে আসবে, আসল বাবা বুঝবে ক্যামনে? সেই অপাপবিদ্ধ বয়সে মনে হতো আমার দোর্দন্ডপ্রতাপ বাপকে নাম ধরে ডাকার সুযোগ এই একটাই - সন্তোষ মিত্রর লাইনে হাল্কা করে হাওয়ায় মিশে যাওয়া ... (বলাই বাহুল্য সব সদিচ্ছা পূর্ণ হয় না! হাজারোঁ খোয়াইশের অ্যায়সে-কি-ত্যায়সে)

আর দুই, ওই যে মাইকে ডাকে, 'পাইকপাড়া থেকে এসেছেন পিন্টু প্রামাণিক, আপনি যেখানেই থাকুন আমাদের অনুসন্ধান অফিসে এসে সত্বর বডি ফেলে দিন' ... বড়ো শখ ছিলো ওর'ম একটা জমায়েতে আমার নামটাও দিকে-দিগন্তরে ছড়াবে অশ্লীল এস-এম-এসের মতন ... এই ইচ্ছেটি পূর্ণ হয়েছিলো, কিন্তু সে আরেক লজ্জার কাহিনী !

বম্বে থেকে কলকাতা এসেছি কাউকে না জানিয়ে - পুজোর কলকাতা এ প্যান্ডেল থেকে ও প্যান্ডেলে আছড়ে পড়ছে আর আমিও জোয়ারের বিষ্ঠার মতন ভেসে চলেছি। পুজোর বাজারে একা একা, উদ্দেশ্যহীন ঘোরার ভারি মজা  - প্যান্ডেলে ঢোকার দায় নেই, অসুরের জ্যাবোরান্ডি চুল দেখে হিংসে হওয়ার ভয় নেই - খালি এ রাস্তা থেকে ও রাস্তা, উত্তর কলকাতার অলি-গলি-পাকস্থলী চষে এই উন্মত্ত ভিড়কে মুগ্ধ হয়ে দেখে যাওয়া ... হঠাৎ দেখি সামনে এক পরিচিত দিদি দু হাত তুলে ছুটে এসে পাকড়াও করে বললেন, 'একা একা ঘুরছিস কেন? চল আমাদের সাথে' ... স্নেহ ভারী বিষম বস্তু, বিশেষ করে পাইকিরি রেটে এলে... একটু এদিক ওদিক দেখলাম, এই তো বাঁশ উঠেছে, পাল ছুটেছে, আমিও টুক করে গলে বেরিয়ে পড়লাম রাস্তায়, দৌড়ে বাগবাজারের মোড়-ও পেরোইনি, দৈববাণীর মতন মাইকে পষ্ট শুনলাম সেই অমোঘ, অমায়িক গলা, 'অনুসন্ধান অফিসে আপনার জন্য বসে আছেন ... '

সেটাই আমার শেষ কলকাতায় পুজো, এখন যার অস্তিত্ব শুধুই বন্ধুদের গল্পে, ছবিতে - এই অর্ধেক পৃথিবী দূরেও অবশ্য পুজো হয়, যেখানে বাঙালী কলোনি রীতিমত বর্ধিষ্ণু, সেখানে ঘটা করে - ইন্ডিয়ানার গ্রামে থাকার সময় দেখেছি, তিনটে আশেপাশের রাজ্য জুড়ে বিশাল ট্রাই-স্টেট পুজো, তার কর্মযজ্ঞ কলকাতাকে লজ্জা দেবে ... আর তার আড়ালে ইউনিভার্সিটি টাউনে হয় বাচ্চাদের অনাড়ম্বর ঘরোয়া আড্ডা-পুজো ।

পার্ডুতে দেখতাম একা হাতে অলোক-দা, তৃপ্তি বৌদি আমাদের কয়েকপিস এনথু কাটলেট পাবলিক-কে নিয়ে একটা গোটা পুজো নামিয়ে দিতেন । সেই জনাকয়েক লোক - তারাই প্যান্ডেলে পেরেক ঠুকছে, সাতসকালে এসে খিচুড়িতে খুন্তি নাড়ছে, ময়দা ঠেসছে, দুপুরে আবার তারাই কুইজমাস্টার, বিকেলে গলায় ক্যামেরা ঝুলিয়ে খচাখচ ক্যান্ডিড মোমেন্টস-ও তারাঁই ধরবেন, অল্প ধুনুচি নাচেও কোমর দোলাতে ভরসাও এয়াঁরাই ... সবাই চলে যাওয়ার পরেও বন্ধুরা কয়েকজন থেকে যেতাম জঞ্জাল ্ফেলতে, গোটা চার্চ ভ্যাকুয়াম করে, দুগগা ঠাকুরকে ইউ-হল-এ করে আবার গ্যারেজ-কৈলাসে ফেরত নিয়ে যেতে যেতে সেই বিলেটেড বিজয়াতেও মনটা ভারি খারাপ করে আসতো ... নাস্তিক আমি সবার অলক্ষ্যে টুক করে মূর্তির পা-টা ছুয়েঁ বলতাম, 'আসছে বছর আবার এসো' ...

চ্যাপেল হিলে থাকার সময় দেখেছি একদল বাচ্চা সারা-রাত জেগে কি অমানুষিক পরিশ্রম করে সাজিয়ে তুলেছে একটা ছোট্ট অ্যাপার্ট্মেন্টের মধ্যে একটা আস্ত প্যান্ডেলের কারুকাজ... সারা রাত ধরে রান্নাবাটি খেলা, মাঝে গান আর আড্ডা, তাঁর আওয়াজ কানে লেগে আছে, থাকবে ...



(উপরে দুর্গা-ডুডল, ভালো করে দেখুন, প্রতিটা রেখাই আসলে লেখা, এঁকেছিলো সোহিনী, আর নীচে রঙিন কাগজের পুষ্পাঞ্জলি, র‍্যালে আর চ্যাপেল হিলের বাচ্চাদের সারা-রাত জেগে তৈরী করা সাজ) 

গান-বাজনার কথায় মনে এলো আমাদের প্রবাসী কলচর-বিলাস, সন্ধ্যেবেলায় একটা মাইক জোগাড় করে বসে যেতাম সবাই । একদল কুঁচোকাঁচা উঠে নাচতো, গাইতো, আধো গলায় 'এসেচে শরত, হিমের পরশ' - সদ্য ফোটা উচ্চারণের বাংলা শুনে কান জুড়িয়ে যেতো ... এক দিদি ছিলেন, যারপরনাই অনুরোধের পর বসতেন আধুনিক গানের খাতা খুলে, একের পর এক গেয়ে যেতেন। তিনি গেয়েছিলেন 'কথা দাও ভুলবে না গো', সত্যিই ভুলতে চেয়েও পারিনি ... আমি ছিলাম শ্রুতিনাটক-আবৃত্তির টিম-এ, এক এক বছর খুব উৎসাহ নিয়ে স্ক্রিপ্ট লিখতাম, আর না হলে ছাই ফেলতে ভাঙা কুলো চেনা কবিতা, জয় গোঁসাই আছেন কি করতে...

'আমি যখন ছোটো ছিলাম,
           খেলতে যেতাম মেঘের দলে,
আর কিছু তো গাঁত করিনি,
            'মেঘবালিকা'-ই হোক তাহলে?'

একটা জিনিষ কিন্তু পেয়ারাবাগান টু পেন্সিলভ্যানিয়া কোত্থাও পালটায় না - পড়তে পড়তে আড়চোখে দেখতাম কেউ হাই তুলছে, কেউ ঘড়ি দেখছে আর সিলিং, আর বাকিরা কর্তাব্যক্তি, কবিতাপাঠের ব্যাকগ্রাউন্ডে তুমুল পায়চারি করে যাচ্ছেন, পাঁঠার ট্রে-টা আসতে আসতে যদি ক্যালোরি ও পাপ দুটোই ঝরে যায় ...  দু-একবার এই মওকায় নিজের লেখা ন্যাকা কবিতা শ্রীজাতর বলে ঝেড়েও দিয়েছি নির্লজ্জের মতোঃ

প্যান্ডেল আজ জ্বালেনি কেউ আলো
           বাঁশ দাঁড়িয়ে, ছোট্ট-সরু-বাঁকা ...
প্রেম জোটেনি এবার পুজোর ভিড়েও
           পথ ও আমি, শুনশান আর ফাঁকা ...

এবারে যেন একটু বেশি-ই মন কেমন - আসলে আমাদের এই ভূষুন্ডির মাঠে পুজোর জলুষ একটু কম, পোস্ট-ইলেকশনে সিপিএমের মতন, সবাই জানে সে আছে, ঘনঘন মিটিং হচ্ছে, প্ল্যান হচ্ছে, তবু আমাদের মতন কিছু নিবেদিতপ্রাণ পুজো-ফ্যান ছাড়া বেগার খাটার লোক পাওয়া দুষ্কর ... পুজোর দিনগুলো তাই চুপচাপ কেটে যায়, ক্লাসে পড়ানোর ফাঁকে অগুন্তি মেসেজ আসে, উজ্জ্বল শাড়ির ছবিতে আর কাঁপা হাতের ভিডিও-তে ভরে যায় ফেসবুকের দেওয়াল... তার মাঝে মাঝে কয়েকটা আবার আমার-ই মতন লোকের, সত্যি পুজোর রেশ নেই, তাই পুরোনো অ্যালবামটাই বারবার উলটে পালটে ধুলো ঝেড়ে দেখা, তাও সব আস্তে আস্তে ঝাপসা হয়ে আসে ...

দু-এক টুকরো তবু জানি মুছবে না -  মুছবেন না সিংজী, সেই বৃদ্ধ ট্যাক্সিচালক, বাবার পেশেন্ট ছিলেন, জোর করে ঠাকুর দেখাতে নিয়ে যেতেন ... বেচারির প্রস্টেট-এর সমস্যা ছিলো, পুজোর বাজারে যেখানে সেখানে পাগড়ি পরে হিসু করতে বসলে যে মার খেতে হতো, সে নিজের চোখে দেখা ... তা-ও, আসতেন, প্রত্যেকবার, রাত্রে দেখতে পেতেন না যখন, দিনের বেলায় আসতেন তার পক্ষীরাজ নিয়ে... আলোর কারিকুরি কিস্যু দেখা যেতো না, তাও লাইটিং-এর কঙ্কালের দিকে তাকিয়ে মনে মনে ভেবে নিতাম মারাদোনার গোল, মাদার টেরেজার বলিরেখা ভরা মুখ, সৌরভের সেঞ্চুরি ... লাল-নীল টুনি গুলো একে-একে জ্বলছে-নিবছে ...

আর একটা আশ্চর্য পুজোর সন্ধ্যে মাঝে মাঝে ফিরে আসে - ২০০৮, মাস্টারস-এর ফাইনাল ইয়ার, সপ্তমীর দিন এক বন্ধুর ফোন এলো, বললো ভিড়ে আর আওয়াজে পাগল পাগল লাগছে, চ' একটা নিরিবিলি জায়গায় বসে আড্ডা মারি - চলে এলাম নন্দন চত্ত্বরে, শুনশান ফাঁকা এলাকা, এমনি দিনেও যেসব ঝোলা-চপ্পল-শোভিত আঁতেল মিছিল দেখা যায়, সেও নেই, কড়ে আঙ্গুল ধরে থাকা প্রেমিক-প্রেমিকারাও না ... খালি একটা এগরোল-চাউমিনের দোকানে টিমটিম করে আলো জ্বলছে আর কয়েকটা লোক ফতুয়া পরে হাত নেড়ে নেড়ে তর্ক করছে ...

আমি আর আমার বন্ধু যে গাছের তলায় বসে একের পর এক সিগারেট ধ্বংস করছিলাম, তার সামনের গাছ তলাটায় এক মহিলা বসেছিলেন - উস্কোখুস্কো চুল, কাঁধে একটা ঝোলা থেকে একটা একটা করে লেখা পাতা বের করছেন, উল্টেপাল্টে দেখে আবার ঢুকিয়ে রাখছেন ভিতরে, একটা সিগারেট বোধহয় চেয়ে এনেছিলেন, আর্ধেকটা খেয়ে বাকিটা আবার প্যাকেটে ঢুকিয়ে রেখে দিলেন সযত্নে, কেউ দূর থেকে বললো 'পাগলিটা আবার এসচে' ...

কিন্তু আমি দেখলাম তার মুখে চোখে কি অনাবিল, অনর্গল, অবৈধ একটা আনন্দ, যার তল পাওয়া যায় না ... যেন একটা বেয়াড়া প্রশ্নকে ধাওয়া করে করে সারা জীবন শুকতলার মতন ক্ষয়ে ক্ষয়ে এসে তিনি পৌঁছেছেন এই নির্জন গাছতলায় - আর ওদিকে যখন শহরটা একটা বিশাল যন্ত্রদানবের মতন নিজেকে ছেঁচড়ে ছেঁচড়ে টেনে নিয়ে যাচ্ছে একটা থেকে আরেকটা ঝিলমিল আলোর চারপাশে, আজ সেই উত্তরটা তিনি পেয়েছেন কল্পনায় ...

 ... আমার ফোনে এদিকে লাগাতার টুংটাং করে এস-এম-এস বেজেই যাচ্ছে, 'কিরে কখন আসবি?' -

আজ যদি আবার ফিরে যেতাম পুজোর কলকাতায়, ভিড়ের বাইরে খুঁজে বের করতাম তাঁকে... আর জিজ্ঞেস করতাম, "তাঁরও কি পুজো হারিয়ে গেছে হাত ফস্কে, আমার মতন?"




Tuesday, September 19, 2017

১৭-ই সেপ্টেম্বর



আমাদের এই অঙ্কের লাইনে অনেক ওপেন প্রব্লেম আছে, মানে এমন অদ্ভুত অঙ্ক, যার উত্তর আগেই বলা আছে, কিন্তু কি করে অঙ্কটা কষতে হবে কেউ জানে না ... তো আমার জীবনেও ওই লার্ভা থেকে পিউপা হওয়ার মাঝখানটা ভর্তি ছিলো এরম গাদা গাদা প্রশ্নে ... ওপেন প্রবলেম! না না বারমুডা অথবা তজ্জনিত ট্রায়াঙ্গল নয়, ঈস্টার দ্বীপপুঞ্জ বা লক নেসের জলোসরাস-ও নয়, একদম পাতি ছাপোষা শহরতলির বাঙলা মিডিয়াম প্রব্লেম, এই যেমন  ধরুন, ১) আসল দুলাল চন্দ্র ভড় কে? (R) চিহ্ন না পুরো নাম? ২) আসল বেণীমাধব শীল বা আদি-তম শ্রীভৃগুই বা কারা? ৩) আর সন্তান দল প্ল্যাটফর্মের দেওয়ালে দেওয়ালে রাম নারায়ণ রাম লিখতে লিখতেই বা কিকরে জানলেন নেতাজী এবার ল্যাদ কাটিয়ে রিটার্ন টিকিটটা বুক করলেন কবে ?

কিন্তু সবথেকে আশ্চর্য লাগতো এইটা দেখে যে বাকি সব পুজো-পার্বণ এদিক-ওদিক গড়াগড়ি খায়, কিন্তু ওই এক বিশ্বকর্মা পুজো নট-নড়নচড়ন, ফি বচ্ছর ১৭-ই সেপ্টেম্বর বাঁধা ... সেই দমদম জংশনের প্ল্যাটফর্মে যেমন সদর্পে ঘোষণা থাকতো, 'সব জ্যোতিষী বারবার, অমৃতলাল একবার!' ... (বলাই বাহুল্য, অমৃতলালের কেরিয়ার নিয়ে সেই থেকে কিছুটা সংশয় এযাবৎ রয়েই গেছে) ... তো এবারের গল্প আমাদের সেই  'নিষ্পাপ' ছোটোবেলার একমাত্র ফিক্সড পয়েন্ট নিয়ে, যার নাম ১৭-ই সেপ্টেম্বরের আকাশ, ধারকাছ দিয়ে গেলে সাবধান, এই বয়সে ভোঁকাট্টা হলে দায়িত্ব কিন্তু কর্তৃপক্ষের নয় ...


তো বিশ্বকর্মা পুজোর দিনটা কিন্তু আসলে সিজন ফিনালে, মেগা-ফাইনাল, যাঁকে বলে পাঁচ সেটের হাড্ডাহাড্ডী নাদাল-ফেডেরার ... এক মাস আগে থেকে চলতো মাঞ্জা দেওয়া, ভাতের মাড়ের সাথে কাঁচের গুঁড়ো, সাগু, শিরিষ মিশিয়ে সুতোয় প্রলেপ - আর মাঞ্জার ধার নিয়ে নিউটনের একটা সূত্র আছে, যত আজগুবি লজ্জাঘেন্নার-মাথা-খাওয়া জিনিষ সে মাঞ্জায় গেছে - ততই তার ধার ... বন্ধুরা সব বাসে যেতে যেতে রোমহর্ষক গল্প শোনাতো, কে পচা ডিম দিয়ে মাঞ্জা দেবে বলে ডিম পচিয়ে শহীদ হয়েছে, কে আবার কাঁচের গুঁড়োর জন্য দিদিদের কিছু চুড়ি কুরবান করতে গিয়ে নিজেই কুরবান হয়ে গেছে, এক পাড়াকাকু ছিলেন মাঞ্জা-স্পেশালিস্ট, তাঁর মাঞ্জা-ফর্মুলার রহস্য কে-এফ-সি-র চিকেনের মতো, কেউ জানে না কি দেয়, বদলোকে বলতো কুকুরের এবং মানুষের সম্মিলিত ইয়ে থাকে তবে পূতীগন্ধময় লাটাই ছাড়া তার প্রূফ দেখিনি কখনো-- মাঝ আকাশে তাঁর ঘুড়িটি যখন বে-রেহমি-সে আগে বাড়তো আশেপাশের ছাদে সমবেত আর্তনাদ শোনাও এক অভিজ্ঞতা বটে !

বহুযুগ পরে ট্যারান্টিনোর কিল-বিল দেখছি, একটা সিনে জাপানী সন্নিসী উমা-দিকে তরোয়াল দিয়ে বললেন, 'If on your journey, you should encounter God, God will be cut' -  মনে হলো আমাদের পাড়াকাকুর মাঞ্জা নিশ্চয়ই ট্যারান্টিনোর ঘুড়িও কেটেছিলো ...

সব গল্পেই একটা খিঁচুটে ভিলেন থাকে, আমাদের ঘুড়ির গল্পে ছিলেন পাড়ার এক দাদু*,  নাম ধরা যাক সদার বাবা গদা, নিয়মিত খেলা ভন্ডুল করে দেওয়ায় পাড়ায় তাঁর আদরের নাম ছিলো বাল ঠাকরে ... তিনি বাচ্চাকাচ্চাদের ছাদে দেখলেই পরিত্রাহি চিৎকার করতেন আর অমনি আদেশ হতো সুড়সুড় করে নেমে আসার ... এতেও ছাদময় ঘুড়ির দৌরাত্ম্য না কমায় তিনি একবার সভা ডেকে বানিয়ে বানিয়ে ভয়ানক গল্প বলতে লাগলেন, কাকে দেখা গেছে কার্নিশ বেয়ে হাঁটতে, কে লগা নিয়ে হাইওয়েতে স্পিড লিমিট ক্রস করে দৌড়চ্ছিলো ইত্যাদি ...  অল্পেতেই কাজ হলো, অবিলম্বে ব্যান হলো আমাদের ছাদে যাওয়া ... বেরিয়ে দেখি সদাকাকু গম্ভীর মুখে বললেন, বাবার এই কাঠি করার হ্যাবিট-টা আর গেলো না ...

অবিশ্যি সত্যি বলতে গেলেও আমার যে কিছু উন্নতি হতো এমন নয়, মাঞ্জা-টাঞ্জা দেওয়া তো দূর, ঘুড়িও যে খুব একা-একাই দারুণ ওড়াতে পারতাম এমন দাবী করলে পাড়ার বন্ধুরা এসে চাঁটি মারবে। তবে গ্যলারি যদি খ্যালার-ই অঙ্গ হয়, তাহলে আমিও একটা প্রত্যঙ্গ তো বটেই ... মিলেনিয়াল-রা জানে কিনা জানিনা, তবে ঘুড়ি যখন ওড়াতে হয়, ছাদ থাকলে ছাদ থেকে সুতো ধরে তলায় ঝুলিয়ে প্রবল একটা হ্যাঁচকা-টর্ক, না থাকলে খোলা মাঠে এক অভাগা এক যোজন দূরে দুহাত তুলে ঘুড়ি ধরে দাঁড়াবেন আর পেশাদার উড়িয়ের কাজ মওকা বুঝে হ্যাঁচকা-টান ... ছেলেবেলার সেই মাঠে সব্বাই পেশাদার, যে একটি ছেলে এপ্রান্ত থেকে ও-প্রান্ত ছুটে ছুটে সবার ঘুড়ি প্রাণপণে ঠেলছে উপরে সেই ক্যাবলা ছানাটিই আমি ...

যৌবনের শুরুতে এক বান্ধবীকে প্রাণপণ ইম্প্রেস করতে চেয়ে বলেছিলাম, 'না ওড়াতে জানিনা, কিন্তু ঘুড়ি কেন ওড়ে সেই মেকানিক্স টা জানি' ... ফিজিক্স-এ যে আমার ফুটুরটি নেহাত-ই ডুম, সেই সন্ধ্যেয় প্রথম বুঝি ...




আর বুঝি, গল্প কেন সত্যি হয় না ... বললাম না, নেহাত-ই নিষ্পাপ এবং ক্যাবলা ছেলেবেলা ছিলো আমার - যা পড়তাম সব ভাবতাম সত্যি ! সেবার পুজোবার্ষিকীতে শীর্ষেন্দুর একটা গল্প পড়লামঃ একজন লোক, যাঁর জীবনে ভারি কষ্ট - তিনি রোজ ঘুড়ি ওড়ান আর রোজ একটা করে আজগুবি আদেশ পেতে থাকেন ঘুড়ির গায়ে লেখা, কোনোদিন বলে বসের মাথায় ঘোল ঢালতে, কোনোদিন বলে ঝাঁপ মারতে তিনতলা থেকে ... ও মা, গল্পের শেষে দেখা যাবে, যা যা করেছেন সবেতেই খুব উপকার হয়েছে তাঁর - বসের টাকে চুল, মাজার ব্যথা গন এবং লাইফ ঝিঙ্গালালা ... তো আমার খুব ফ্যান্টাসি হতো, একদিন নিশ্চয়ই মাঠে নেমে আসা শেষ ঘুড়িটা যখন কুড়িয়ে পাবো, আকাশের কোনো এক বন্ধু কিছু পাঠাবে লিখে? হয়তো বলে দেবে কি করলে আর টিফিনে জলের বোতল চুরি হবে না, বা বন্ধুরা আর খ্যাপাবে না ... কিন্তু নাঃ, সে ঘুড়ি আর আসে না ... তারপর একদিন ভেবে দেখলাম, ইনকামিং যখন নেই, আউটগোয়িং-ই সই ... পাড়াকাকুকে বলে বিশাল দো-ত্তে ঘুড়ির ওপর স্কেচপেনে লিখে রাখতাম মহার্ঘ সব সদুপদেশ, কোনোটা গভীর জীবন-দর্শন, কোনও কোনোটা আবার নিতান্তই ছাপোষা, যেমন "এক মাস নখ কাটবেন না", কিংবা "আজ চান করার সময় একটু শ্যাম্পু খেয়ে দেখুন" ইত্যাদি ...

"বোম-মারা" বলে বিকট আওয়াজ হতো কাটা পড়ার সময়, আর বহুদূরে ঘুড়িগুলো হারিয়ে যাওয়ার সময় চেয়ে চেয়ে দেখতাম কোথায় পড়ছে ...

আজ বাড়ি ফেরার সময় একবার আকাশের দিকে তাকালাম, নাঃ, তাদের একটাও অতলান্তিক ক্রস করেনি দেখছি ...

Wednesday, September 6, 2017

“ফসল কাটা মাঠে এখন সদ্যকৃত বধ্যভূমি”

আমি লোরকা-র কথা প্রথম পড়ি শুভঙ্করকে লেখা নন্দিনীর চিঠি-তে, “নতুন কবিতা কিছু লিখেছো কি?
লোরকা পড়ছো খুব? বেশি পড়ো, কম সিগারেট খাও” ... (কথোপকথন ৩)

দিন-কয়েক পরে একটা বাংলায় অনুবাদ করা বই পেয়ে যাই কলেজ স্ট্রীটে, পড়তে পড়তে প্রেমে পড়ে যাই নিজের অজান্তে – কি অদ্ভুত ম্যাজিকে লোরকার কবিতার প্রাগৈতিহাসিক আন্দালুশিয়া হয়ে যায় আমার-ই ভিটেমাটি - তার বইয়ের পাতায় কান পাতলে শুনতে পাই ফ্ল্যামেঙ্কো-র ছন্দ, টের পাই অবিকল শরীরের উত্তাপ আর মরা বাতাসে ফিসফাস করে বয়ে চলে ‘সনেটস অফ ডার্ক লভ’-এর অস্ফুট গোঙানি আর জমে-থাকা চিৎকার ... অনন্ত কুয়োর তলা থেকে উঠে আসা শব্দের মতো।

মাত্র আটত্রিশ বছর বয়সে, ১৯শে আগস্ট, ১৯৩৬, খুন করা হয় লোরকা-কে, গ্রানাডা-র তখতে তখন উগ্র-জাতীয়তাবাদী ফ্যালাঞ্জিস্ট গুন্ডাবাহিনী, আর লোরকা? সোশ্যালিস্ট, স্পষ্টবক্তা, মুক্তচিন্তক, তায় সমকামী, ফ্যাসিস্ত রাষ্ট্রযন্ত্রের সাক্ষাৎ জুজু [১]

তিরিশ-তিরিশটা বছর লেগেছিলো (১৯৭০ অব্দি [২]) শুধু এই কথাটুকু প্রকাশ্যে স্বীকার করতে যে লোরকার খুন ব্যক্তিগত দ্বন্দ্বে-ঈর্ষায় নয়, হয়েছিলো একটি রাষ্ট্রশক্তির হাতে – তাঁর বধ্যভূমি আজ-ও নিশানাহীন ...

লোরকা জানতেন, লোরকা-রা যেমন জানেন, মৃত্যুর অনেক আগেই আর তিনি যেন মিশে যান মার্কেসের সান্তিয়াগো নাসারের সাথে, হত্যার আগেই ঘাতকের ছুরি থেকে ঝরতে থাকে রক্ত, ‘Fable and round of three friends’ এ ভেসে আসে –

“Then I realized I had been murdered.
They looked for me in cafes, cemeteries and churches
.... but they did not find me.
They never found me?
No. They never found me.”

১৯৩৬-এ হত্যা, ১৯৫৩ অব্দি সমস্ত লেখার উপর নিষেধাজ্ঞা, ১৯৭৩-এ ফ্রানিসিস্কো ফ্র্যাঙ্কো মারা না যাওয়া অব্দি লোরকার মৃত্যু (অথবা জীবন) নিয়ে আলোচনা-ও ছিলো অবৈধ, ১৯৮৪-র আগে অব্দি পাওয়াই যায়নি তার ‘ডার্ক লভ’-এর সনেটগুচ্ছ, এখনো কেউ জানেনা শেষ খসড়া কোথায় – তবু লোরকা বেঁচে আছেন, থাকবেন, স্পেনের ফ্যাসিস্ত ফ্যলাঞ্জিস্ট গুন্ডার দল নেই ...

সত্যি বলতে, প্রথমবার পড়ে বিশ্বাস হয়নি, ভাবতে পারিনি একজন দুর্বল, রোম্যান্টিক, প্রেমের কবিকে জল্লাদবাহিনী টেনে দাঁড় করাচ্ছে ফায়ারিং স্কোয়াডের সামনে? একজন কবি-কে? কিসের ভয়?

আর আজ?


পুনশ্চঃ  একটু আগে এক বন্ধুর (অনির্বাণ) দেওয়ালে দেখলাম, আজ সুনীল-বাবুর জন্মদিন, তাই লোরকার স্মরণে তাঁর কবিতার একটু আর না দিয়ে থাকা গেলো না একেবারেই ..[৩]



কবি অত মানুষের মুখের দিকে চেয়ে খুঁজলেন একটি মানুষ
নারীদের মুখের দিকে চেয়ে খুঁজলেন একটি নারী
তিনি দু’জনকেই পেয়ে গেলেন
কবি আবার তাদের উদ্দেশ্যে মনে মনে বললেন,
বিপ্লব দীর্ঘজীবী হোক! মিলিত মানুষ ও
প্রত্যেক মানুষের নিজস্ব বিপ্লব!
প্রথম গুলিটি তাঁর কানের পাশ দিয়ে বেরিয়ে গেল-
যেমন যায়,
কবি নিঃশব্দে হাসলেন
দ্বিতীয় গুলিতেই তাঁর বুক ফুটো হয়ে গেল
কবি তবু অপরাজিতের মতন হাসলেন হা-হা শব্দে
তৃতীয় গুলি ভেদ করে গেল তাঁর কন্ঠ
কবি শান্ত ভাবে বললেন,
আমি মরবো না!
মিথ্যে কথা, কবিরা সব সময় সত্যদ্রষ্টা হয় না।
চতুর্থ গুলিতে বিদীর্ণ হয়ে গেল তাঁর কপাল
পঞ্চম গুলিতে মড় মড় করে উঠলো কাঠের খুঁটি
ষষ্ঠ গুলিতে কবির বুকের ওপর রাখা ডান হাত
ছিন্নভিন্ন হয়ে উড়ে গেল
কবি হুমড়ি খেয়ে পড়তে লাগলেন মাটিতে
জনতা ছুটে এলো কবির রক্ত গায়ে মাথায় মাখতে-
কবি কোনো উল্লাস-ধ্বনি বা হাহাকার কিছুই শুনতে পেলেন না
কবির রক্ত ঘিলু মজ্জা মাটিতে ছিট্‌কে পড়া মাত্রই
আকাশ থেকে বৃষ্টি নামলো দারুণ তোড়ে
শেষে নিশ্বাস পড়ার আগে কবির ঠোঁট একবার
নড়ে উঠলো কি উঠলো না
কেউ সেদিকে ভ্রূক্ষেপ করেনি।
আসলে, কবির শেষ মুহূর্তটি মোটামুটি আনন্দেই কাটলো
মাটিতে পড়ে থাকা ছিন্ন হাতের দিকে তাকিয়ে তিনি বলতে চাইলেন,
বলেছিলুম কিনা, আমার হাত শিকলে বাঁধা থাকবে না!

[১] Documents confirm fascists murdered Spanish poet Federico Garcia Lorca:  http://www.wsws.org/en/articles/2015/04/30/lorc-a30.html
[২] “Lorca and the Gay world”