Monday, June 24, 2019

আশায় আশায়



শহরের বাইরে দাঁড়িয়ে শহরের দিকে তাকালে একটা অদ্ভুত আভা দেখা যায় রাত্রের দিকে, সেটা গাঢ় হয় ক্রমশঃ তারপর একসময় কেউ যেন ফুঁ দিয়ে নিভিয়ে দেয় একটা বিশাল মোমবাতি ...যাদের ঘুম নেই তারা বোঝে রাত গভীর হলো, এবং এই বিশাল অন্ধকারের নীচে তারা এই মুহুর্তে বোধহয় সম্পূর্ণ একা ...  অথচ এক একটা রাত্রে জেগে থাকে একটা দূরের বারান্দা, আর এক এক রাত্রে কেউ জিগ্যেস করে ফেলে, "জেগে আছিস? একটা ফোন কর না !"


আশায় আশায় 

৫২-৮১১৩ - এটা আমাদের পাশের বাড়ির অলোক জেঠুর নম্বর, এখনকার নয়, সেই সময়ের যখন ফোন নম্বর-ও ছিলো আমাদের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের মতন সহজ এবং অল্প কিছু লোকের করায়ত্ত ! আমার স্কুল ইউনিফর্মের বুক-পকেটে একটা ছোট্ট চিরকুটে এই ছ-খানা নম্বর থাকতো, কোনোদিন-ই কাজে লেগেছে মনে পড়ে না, তবুও মা নিশ্চয়ই শান্তি পেতেন, কিছু অঘটন ঘটলে বা দরকার পড়লে কেউ হয়তো খবর দেবে ...

দরকার পড়েনি, যদিও অঘটন যে ঘটতো না এমন নয় ! তা-ও ... আমার জন্যে মা-কে গ্যাসের আঁচ কমিয়ে আঁচলে হাত মুছতে মুছতে দৌড়তে হয়েছে এমন মনে পড়ে না ...

বাবার দুঃখ ছিলো, একটা ফোন না হলে লোকে ডাক্তারবাবুকে খবর দেবে কি করে? সত্যি কথা ! ক্লাস নাইনে উঠতে একদিন একটা লাল টুকটুকে ফোন এলো বাড়িতে ... উফ কি উত্তেজনা তখন ! ফোনের সাথে এলো পাতার পাশে পাশে অক্ষর দেওয়া ফোনের ডায়রি, পদবী মিলিয়ে মিলিয়ে সবার নম্বর সেখানে থাকবে ... সব পেশেন্ট, আত্মীয়, কিছু কোচিং-ক্লাসের স্যার, যেসব বন্ধুর মায়েরা মায়ের বন্ধু, তাদের নাম ... আর এইসব নম্বরের মাঝে জ্বলজ্বল করবে নিষিদ্ধ ইস্তেহারের মতন দু-একজন বান্ধবীর নাম ... সেসব নম্বরে ফোন করা হয়ে উঠলো না আর কোনোদিন-ই, তবু দু-একটা রাংতায় মোড়া ইচ্ছে আমরা জমিয়ে রাখতাম হাতের কাছে, দৃষ্টির সামনেই ...

একদিন তা-ও একটা ফোন এসেছিলো ! একটি মেয়ে, যে আকাশী রঙের একটা ওড়না মাথায় দিয়ে কোচিং-এ এসেছিলো বৃষ্টির দিন, সে শুধু জিগ্যেস করেছিলো, 'কাল ক্লাস হবে?' ... উত্তর দেওয়া হয়নি তাকে ... তবে তার জন্য ব্যাকগ্রাউণ্ডে বাবার বজ্রনির্ঘোষ না শুধুই আমার ক্যাবলামি, কে দায়ী তা ঠাহর করতে পারি না ...

নরেন্দ্রপুরে যখন পড়তাম গৌরাঙ্গ ভবনের পাশে ছিলো রবীন-দার দোকান ... একটা ছোটো ফোনের বুথ আর নাইলনের দড়ি থেকে ঝুলতো হজমোলা, সার্ফ এক্সেল, পার্লে জি ... হাত খরচা পেতাম সপ্তাহে তিরিশ টাকা, যাতায়াত আর এটা-সেটা ... আর এগরোল না খেয়ে, গেট টপকে গড়িয়ায় সিনেমা না দেখে সেইটুকু জমিয়ে ফোন করতাম বান্ধবীদের ... রবীন-দা বুঝতেন, জানি! মাঝে মাঝে একদিন বেরিয়ে দেখতাম প্রাণপণে গম্ভীর মুখ করে বসে আছেন ...

তো এই ভালো মানুষ রবীন-দার দোকানে একদিন একটা ঘটনা ঘটে গ্যালো ... আমি যথারীতি এক বান্ধবী-কে ফোন করছিলাম, তো তার করালমূর্তি মা ফোন ধরায় টুক করে কেটে দি, তারপর রবীন-দাকে পয়সা দিয়ে বেরিয়ে আসছি হঠাৎ দেখি বুথের মধ্যেই ফোনটা তারস্বরে বাজছে - তা রবীন-দা-ই গিয়ে ধরলেন - তারপর টানা দু মিনিট খিস্তি খাওয়ার পর আমার দিকে ফিরে খুব বেচারা মুখ করে বলেছিলেন "উনি মনে হয় আমাকে নয় তোমাকে খুঁজছেন"

আমার প্রথম উপার্জন এবং প্রথম প্রেম এর না হোক তিন বছর পরে ... কলেজে স্টাইপেন্ড পেতাম, আর কোচিং করতাম চুটিয়ে ... কাজেই শুভদিন দেখে একদিন কোচিং থেকে ফেরার পথে "উর্দ্ধমুখে মুগ্ধচোখে গর্তে দিলাম পা" ...

পা দিয়েই বুঝলাম, প্রথম (এবং দ্বিতীয় এবং তৃতীয় এবং প্রায় প্রত্যেকবারেই) প্রেমের অবশ্য কর্তব্য রাত-বিরেতে ফোন করে কুশল জিগ্যেস করা এবং খুব গভীর রাজনৈতিক সমস্যার আশু সমাধান করা ... এই যেমন অর্কুট-এ প্রোফাইল তো খোলা হলো, এবার রাজস্থানে বিমর্ষ উটের পিঠে ছবি ভালো না নিক্কো পার্কে ইউরিনালের পাশে ছবি? হৃদয় তো চিরকাল-ই অবাধ্য মেয়ে, তাকে কি আর বলতে পারি, প্রেমের মাশুল মিনিটে এক টাকা আটষট্টি পয়সা?

আশার আলো দেখা দিলো ... হোস্টেলে এসে দেখলাম আই-এস-আই-এর মেস-এ একটা বহু-ব্যবহৃত ফোন রাখা, তার রঙ উঠে গেছে, ফিতে জায়গায় জায়গায় দীর্ণ আর নম্বরগুলোও প্রায় পড়া যায় না বললেও চলে ... তবে সে অলৌকিক ফোনের ডায়ালে '৯' টিপলেই গোটা পৃথিবী এবং তার তাবৎ রোম্যান্স আপনার হাতের মুঠোয় ... তবে সাপ্লাই আর ডিম্যান্ড এ পৃথিবীতে কোনোদিন-ই মেলেনি ... এক হোস্টেল প্রেমিক-পুরুষ, একটি মাত্র টেলিফোন ... এক এক রাত্রে ভালো একটা কবিতা গাঁতিয়ে নিয়ে মেসে গিয়ে দেখতাম সিনিয়র ব্যাচের দাদা পাশের হোস্টেলের দিদিকে ফোনে রিগ্রেশন বোঝাচ্ছেন ... সেসব রাত্রে যা দীর্ঘশ্বাস ফেলেছি, জয় গোস্বামী-ও ঘুমোতে পেরেছেন কিনা সন্দেহ !

সেসব সন্ধ্যে গুলোয় হোস্টেল থেকে বেরিয়ে হেঁটে হেঁটে চলে যেতাম বনহুগলীর রাস্তাটায়, লেকের দিকে যেটা গেছে ... বাপ্পাদার দোকানের পাশেই ছিলো একটা ছোট্ট এস-টি-ডি, আই এস ডি, পি সি ও ... দাদুর দোকান, দাদু একটা মোটা কাঁচের চশমা পরতেন, আর সাদা পাঞ্জাবী-পাজামা ... আমি ফোন করতাম বেশ খানিকক্ষণ, হয়ে গেলে দাদু খবরের কাগজ-টা পাশে রেখে হিসেব করে পয়সা ফেরত দিতেন অনেকক্ষণ ধরে ... কোনো-কোনোদিন যাকে ফোন করতাম সে বারবার কেটে দিতো রাগে ... বেরিয়ে দাদুকে বলতাম, অনেকগুলো এক-দু সেকেন্ডের কল আছে, পুরোটা দেখে নিন ...

আস্তে আস্তে ফোন নাম্বারগুলো বদলে যেতে থাকে ... নাইন-ফোর-থ্রি-থ্রি ... নাইন-এইট-ওয়ান-জিরো ... সেই ঘুপচি ঘরে একটা ছোট্ট কাঁচের বাক্সে আমার মিথ্যেগুলোও পাল্টাতে থাকে প্রত্যেক-টা মিসড কলের পর ... খালি পাল্টান না সেই দাদু  ...

আর এক একদিন দেখতাম আমার-ই বয়েসী (বা অল্প ছোট-ও হতে পারে) একটি মেয়ে সেই বুথে বসে ... সামনে ঢাউস বই খোলা, সম্ভবতঃ বায়োলজি-র কোনো শাখা হবে ... ফোন হয়ে গেলে সে বইয়ের পাতা থেকে চোখ না তুলে বিনিময় করতো খুচরো আধুলি, এক-টাকা, দু-টাকা ... অনেকদিন ভেবেছি তাকে জিগ্যেস করবো কি নিয়ে পড়ো? ভেবেছি জিগ্যেস করবো ইনি কি তোমার দাদু-ই হন, মা-বাবা আছেন তোমার? তবু কাঁচের বাক্সের কালো একটা যন্ত্রের লাল অক্ষরে লেখা সময় আর খুচরোর বিনিময়ের মধ্যে কোথাও একটা সে সাহস আর হয়নি আমার ...

পাশ করার বছর ঘুরতে না ঘুরতেই আবার দৌড়ে গেছিলাম হোস্টেলে ... কনভোকেশন, প্রচুর হইচই, দেদার আড্ডা, বন্যা বইলো মদের ... পরের দিন সন্ধ্যেয় গিয়ে দেখলাম সেই ছোট্ট দোকানটার উপর জন্মের শোধ ঝাঁপ পরে গেছে ... বাপ্পাদা বললো সে দাদুই নাকি আর নেই ... গোটা পাড়ার বার্তা দেওয়া-নেওয়ার মাঝে কখন যে তাঁর ডাক পড়েছে কেউ জানতে পারে নি ...

আজ চব্বিশে জুন, দু হাজার উনিশ, দশ-দশটা বছর কেটে গেছে ... এস-টি-ডির মানে আর ফোন বুথ নেই এই প্রজন্মের ডিকশনারি-তে ! এখন ফোন খুললে ঝাঁপিয়ে পড়ে অর্থহীন অকারণ চিৎকার, মিথ্যে, ঘৃণা আর জঘন্য সব টিটকিরি ...

মাঝে মাঝে তখন সেই ছোট্ট ফোন বুথটায় ফিরে যাই ... একটা নতুন পাওয়া নম্বরে ফোন করি, রিং হয় ... চেনা একটা গানের রিংটোন ... পরের সুনিপুণ মিথ্যেটা সাজাতে সাজাতে আমি আড়চোখে দেখে নিই অন্য একজন-কে ...

আর তখন সেই ছোট্ট কাঁচের অ্যাকোরিয়ামে আমার না ভাঙা নেশা, আমার না লেখা কবিতা আর আমার আছড়ে পড়া যাবতীয় ইচ্ছে ভাসতে থাকে রঙীন মাছেদের মতন, যাদের সমুদ্রে মেশা হবে না আর কোনোদিন-ই ...