Sunday, December 9, 2018

কামাই



রবিবারের বিকেল, বাইরে বরফ পড়বে বলেও পড়েনি, এমন সময় এক কাপ কড়া কফি নিয়ে ক্লাসের বাচ্চাদের সেমেস্টারের শেষে পার্টিসিপেশানের জন্য নম্বর-টম্বর দিচ্ছিলাম ! তা এমনিতে আমি হালকা কিপটে বলে বদনাম থাকলেও  এসব ব্যাপারে হাতখোলা নই এর’ম বললে অন্যায়-ই হবে – তা-ও, পরপর পাঁচে পাঁচ বসাতে বসাতে একজনের নামে এসে চোখ আটকে গেলো – অনেক চেষ্টা করেও একে ক্লাসে শেষ কবে দেখা গেছে মনে করতে পারলুম না, তো দাগটানা খাতায় শুন্যটা বসাতে যাচ্ছি হঠাৎ শুনলেন ফাঁপা ছাদের উপর থেকে কে যেন খ্যাঁক খ্যঁক করে হেসে উঠলো ... প্রথমে ভাবলাম ফুর্তিবাজ আন্ডারগ্র্যাড, পার্টি-ফার্টি করছে –এমন সময় খেয়াল পড়লো কই উপরে তো কেউ নেই, সে ফ্ল্যাট তো বহুদিন ফাঁকা ... তারপর বুঝলাম নাহ পোলাপান প্রতিবেশী নয়, এ নিশ্চয়ই আমার-ই বিবেকের রোলে পার্ট পেয়েছে ... এখন ক্যিউ পেয়ে একটা অট্টহাস্য ছেড়ে দিয়েছে ... তা মনটা বেশ উদাস হয়ে গেলো, তাই ভাবলাম আজ না হয় কামাইয়ের গল্প বলেই দু-পয়সা কামাই !


তা সত্যজিতের যেমন ফেলুদা-শঙ্কু-তারিণীখুড়ো, আমার-ও এইসব গল্পের নায়ক কিন্তু জনাকয়েক অকুতোভয়, অ্যাডভেঞ্চারাস কিন্তু আপাদমস্তক ল্যাদখোর বাঙালী-শাবক, আমি ছুটির দিন দেখে এইসব ছেঁদো আষাঢ়ে গপ্পো ফেঁদে বসলেই তারাও দেখি মাদুর পেতে একঠোঙা মুড়ি নিয়ে বসে পড়ে ...


সত্যি বলতে, আমি স্কুলে পড়ার সময়, বিশেষ করে নাইন-টেনে, বিশেষ কামাই-টামাই করতাম না, তখন স্কুলে না যেতে পারাটাই শাস্তি – একে তো রেকর্ড বুকে সই না করে নিয়ে গেলে ক্যালানি, তার উপর বাড়ি বসে থাকলেও যে পরিস্থিতি খুব অনুকূল হতো সেরম নয়! বরং ইস্কুলে গেলে দেদার বাঁদরামো করার অনির্বচনীয় হুন্ডি ... কামাই করার আর্টে হাতেখড়ি হলো কলেজে উঠে ... আর এটাও বেশ বুঝতে পারলাম যে এই লাইনে ভালো করতে গেলে বেশ নিবেদিতপ্রাণ মেথড অ্যাক্টর না হলে কপালে দুঃখ আছে !


এই যেমন নরেন্দ্রপুরের সেই এক ছোকরা, বেশ একটু মস্তান-মস্তান ভাব ছিলো, ক্লাসের পিছনে বসে অম্লান বদনে একেরে পর এক প্রক্সি দিয়ে যেতো হাল্কা হাল্কা গলা পালটে, অমন যে তুখোড় সাত্যকি-দা (যিনি ‘টেক্সট কার নেই?’ বলে হাঁক ছাড়লে স্বয়ং শেক্ষপীর স্পার্কনোটস হাতে হাজিরা দিতে পারেন), তিনিও ধরতে পারতেন না ... এখন অবশ্য সে ডাক্তার-বদ্যি হয়ে ঘোর সংসারী হয়ে গেছে, এই অসামান্য প্রতিভা সেই ক্লাসরুমেই ফেলে এসেছে সে।


সেদিক থেকে আই-এস-আই-এর লোকজন বেশ নিরীহ প্রকৃতির, কেউ কোনোদিন প্রক্সি দেবে বলে ভেবেছে এমন-ও মনে হয় না, তবে মাঝে-মাঝে যে কামাই করতে গিয়ে ঘোর বিপদ হয়নি এমন নয় !


এই যেমন সেইবার – আই-এস-আই-এর হোস্টেল থেকে মেইন ক্যাম্পাসে (মানে এ-পাড়া থেকে ও-পাড়া) যাওয়ার জন্য দুই ক্যাম্পাসের মাঝখানে একটা সুড়ঙ্গ আছে, যাতে কোমলমতি ছাত্রদের বিটি রোডে না বেরোতে হয়, আমাদের প্রথম তিন বছর সেইটে ছিলো না ... ওই এক গেট দিয়ে নর্দমার পাশ দিয়ে হেঁটে হেঁটে, অফিসযাত্রী পথচারীদের উড়ন্ত হিসু-মিসাইল কাটিয়ে আরেক গেটে ঢুকতাম। তা সেইবারে ব্যাপক বৃষ্টি হলো, রাস্তাঘাটে জল জমবো-জমবো করছে, গোড়ালি তো নির্ঘাৎ ডুবে যাবে! লোকজন সকালবেলা উডুপি ব্রেকফাস্ট খেয়ে বললো আজ ক্লাস না হলে মন্দ হয় না – কিন্তু ইচ্ছে না করলেই যদি ক্লাস কেটে যেতো তাহলে বলছি পেত্যয় যাবেন না, আমাদের পাঁচ বছরের যাতনা মেরে কেটে মাস তিনেকে নামিয়ে দেওয়া যেতো, কিন্তু সে কী হয়? তাই বভ-র[1] ঘাড়ে দায়িত্ব পড়লো ব্যাপার-টা সামলানোর ... তার পর যেটা হলো সেটা সুররিয়্যাল বললেও কম বলা হয়! বভ ডিন্স অফিসে ফোন করলো, ডিন্স অফিসে একজন গাঁজাখোর লোক বসতেন যিনি কিছুই কোনোদিন জানতেন না, জানলেও বলতে মন চাইতো না ... তিনি যে বভকে কী মুন্ডুমাথা বলেছিলেন আর বভ সেদিন বাকি জনতা-কে কী রিলে করেছিলো তা জানা যায়নি, তবে পরেরদিন শোনা গেলো, সবার স্টাইপেন্ড কেটে গেছে – কারণ দুর্ধর্ষ প্রোফেসার গোঁসাইবাবু জল ঠেঙ্গিয়ে ক্লাসে এসে দ্যাখেন তিরিশ জনের ক্লাসে টিচার বাদে হাজির দুজন – একজনের বাড়ি নরেন্দ্রপুর, আরেকজন বর্ধমান !

(সে যাত্রা কী করে স্টাইপেন্ড উদ্ধার হয়েছিলো সেই নিয়ে আরেকদিন আষাঢ়ে গপ্পো ফাঁদবো, তবে এইটে মনে আছে যে পকেট-মানি চলে যাওয়ার ভয়ে সেই এক সপ্তাহ এক-একটা সিগারেট এক-ডজন লোকে কাউন্টারে খেতাম, জীবনে কিছু ভালোবাসতে গেলে যে সেটা হাত ফস্কে পড়ে যাওয়ার ভয়ে থাকতে হয়, সেই ঘটনা না হলে বুঝতাম না কোনোদিন-ই)


তবে এই এক ডোজেই মোক্ষম কাজ হলো, গণ-কামাই সেই শেষবারের মত ! তবে এদিক-ওদিক কামাই হতেই থাকতো, আমাদের নিয়ম ছিলো ৭৫% এর কম অ্যাটেন্ডেন্স হলে স্টাইপেন্ড কাটা যাবে ... এদিকে ক্লাসেও যাওয়া খুব মুশকিল ! জানা গেলো বনহুগলীতে এক ডাক্তার থাকেন, তাকে বললেই সার্টিফিকেট পাওয়া যায় – আপনি গিয়ে বলবেন কদিনের চাই, মানে দিন সাতেক হলে জ্বর-টরের উপরেই থাকবেন, আবার মাস খানেক লাগলে চেহারা দেখে জন্ডিস কিংবা ঘোর ডায়রিয়া – শ-পাঁচেক ছাড়লে হয়তো হাত-পা ভাঙার প্রমাণ-ও পাওয়া যেতো, কিন্তু সেই অব্দি বোধহয় আর কাউকেই যেতে হয়নি !


আর ছিলো ক্লাসের ঠিক আগে গিয়ে প্রোফেসরদের ধরে ক্লাস কাটাতে বলা, কোনোদিন বলতে হতো আজকে ভারত-অস্ট্রেলিয়ার ম্যাচ, কোনোদিন গিয়ে বলতাম কালকে হোস্টেলে কালচারাল ... আবার কোনোদিন কিছুই বলতে হতো না, এই যেমন একবার আমাদের পানু অনেকদিন টানা কামাই করার পরে ভেবে দেখলো মেইন ক্যাম্পাস-টা অনেকদিন দেখেনি, হয়তো এর মধ্যে পালটে গেছে, নতুন কিছু বিল্ডিং উঠে পড়েছে হয়তো ! তা একদিন পড়ন্ত বিকেলে একটা হাওয়াই চটি পায়ে ক্যাম্পাসে এলো, আর্ধেক রাস্তা এসেই দেখা আমাদের সাথে, আমরা তখন একজন নিরীহ লোকের ক্লাস কাটাতে যাচ্ছি ... পানুকে দেখে ওকেও বগলদাবা করে নিয়ে গেলাম! ভদ্রলোক তখন পুরোনো SMU-র অফিসে বসে হয়তো ডান হাতের সাথে বাঁ হাতের কাটাকুটি খেলছিলেন, পানু দুম করে অফিসে ঢুকে বললো, ‘স্যার আজকে কিন্তু ক্লাস হবে না’ ... আ-বাবু ভয়ার্ত চোখে খানিকক্ষণ আমাদের তিন গন্ধমাদন দামড়া দাড়িয়াল পুরুষের দিকে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে বললেন, ‘না না তোমরা যখন বলছো কেন হবেই বা কেনো?’ ... আমরা বিজয়ীর গর্বে বেরিয়ে আসছি, এমন সময় পানু জিগ্যেস করলো, ‘হ্যাঁরে ওটা কিসের ক্লাস কাটালাম?’ গুন্ডা বললো, কেন মাল্টিভ্যারিয়েট? পানু বিমর্ষ হয়ে বললো, ‘এ বাবা এই ক্লাস-টাতো আমি নিইও নি!’


সেবারে অবিশ্যি একটু বাড়াবাড়ি-ই হয়েছিলো, আ-বাবু সারা সেমিস্টার ক্লাসে এসে দেখেছেন পাঁচ জন ছাত্র ক্লাসে আসে, মিড সেমিস্টারের দিন পাঁচ খানা কোশচেন প্রিন্ট করে হলে এসে জিগ্যেস করলেন, “কারা কারা মাল্টিভ্যারিয়েট নিয়েছো, হাত তোলো?” দেখলেন হঠাৎ জনা তিরিশেক হাত শুন্যে উঠে নাচছে, আ-বাবু ভয়ানক রেগে গিয়ে বললেন, “নাঃ যে পাঁচজন ক্লাসে রেগুলার এসেছো খালি তাদের পরীক্ষা দিতে দেবো” ... তিরিশ জন ছাত্র সমস্বরে বলে উঠলো, “স্যার আমি-ও সেই পাঁচজনের একজন” ... বলাই বাহুল্য, পরীক্ষা সেদিন তিরিশজনেই দিয়েছিলো, ফেল-ও কেউ করেছিল বলে বিশ্বাস হয়না ...


এই যে সব দুর্মদ দামাল ছেলেপুলে, এখন না হয় তারা সব মধ্য-তিরিশের ধেড়ে খোকা, কিন্তু সেই কলেজের অলীক দিনগুলোয় তারা সবাই দারুণ সব মেথড অ্যাক্টর ছিলেন ... ক্লাস কাটানো তো কোন ছাড় ... যে কোনো সিচুয়েশানে আঊট অফ কনটেক্সট দুম করে রেগে যেতে বা হঠাৎ কান্নাকাটি জুড়ে দিতে হলে অথবা শুধুমাত্র ফ্যালফ্যাল করে আকাশের দিকে চেয়ে এক্সিটেনশিয়াল ক্রাইসিস বোঝাতে এরা অব্যর্থ টোটকা ...  আর প্রতিভা কি রে ভাই, একজনকে ডিপ্রেশানের রুগীর রোল দিলে হয়তো নাওয়া-খাওয়া বন্ধ করে ফাঁকা ফ্ল্যাটে তিনমাস বসে থাকবে,  আরেকজনকে যোদ্ধার রোল দিলে নিশ্চয়ই সেটে জংধরা তরবারি আর টিটেনাস নিয়ে পৌঁছে যাবে ... আর ডাক্তার বদ্যির রোল দিলে তো কথাই নেই, ঠিক স্টেথো গলায় বাজার করতে যাবে রোজ সকালে ... ছুটি-ছাটা ভিক্ষে করার সময় এদেঁর কয়েকপিস ভয়ানক করুণ মুখ পেঁচিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতো, নেহাৎ পাষাণ না হলে তারপরে ক্লাসে আসা অসম্ভব !


তবে আমরা ভয়ানক ভদ্রলোক ছিলাম ! সবাই যে হয় তাও নয়, এক সিনিয়রের লোকগাথা শুনেছি – প্রবাদপ্রতিম সি আর রাওয়ের ক্লাস, এবং সে যথারীতি আসেনি – প্রোফেসার রাও তাকে পরেরদিন দেখে জিগ্যেস করলেন কি হে আসোনি কেনো? শরীর খারাপ ছিলো? সে বললে ‘কই না তো!’ ... তাতে প্রোফেসার রাও আরো চিন্তিত হয়ে বললেন, ‘বাকি সব ঠিক তো, মন-টন খারাপ নয় তো, বা খুব রাত্রে জেগে পড়ছো বুঝি?’ – সেই দুর্দান্ত সিনিয়র অম্লানবদনে জবাব দেন, নানা সব-ই ঠিক আছে, জাস্ট আপনার পড়ানো ভাল্লাগেনা বলে আসিনি, এই তো পরের ক্লাসটাই করবো ...


এই ছাত্রজীবন শেষ করে টেবিলের এপারে চলে এসে সত্যি বলতে সবচে’ যেটা মিস করি সেটা কিন্তু এই হঠাৎ ডুব মারা ! এখন আমার সব ক্লাসে আমার হান্ড্রেড পারসেন্ট অ্যাটেনডেন্স – অবশ্য সত্যি বলতে এদেশের মডেল-টাও আলাদা, আর আমি পড়াতে গিয়ে বুঝি কী ভয়ানক প্রিভিলেজড জীবন কাটিয়ে এসেছি আমরা ... আর এটাও বুঝি যে খুব ভালো করে পড়ালে, দারুণ-দারুণ গল্প ব’লে, অ্যানেকডোটস ব’লে এমন পড়ানো সম্ভব যাতে শেখার টানে বাচ্চারা ক্লাসে ছুটে আসতে পারে ... পার্দুতে পড়ার সময় অনির্বাণদার ক্লাস করতাম, শক্ত অঙ্ক-ঘেঁষা স্ট্যাটের ক্লাস – কিন্তু কি অসম্ভব গাঁথুনি ! শরীর অসুস্থ, চোখের দৃষ্টি ক্ষীণ হচ্ছে দিন-দিন - কিন্তু ক্লাসে ঢুকে অনির্বাণদা বোর্ডের সামনে দাঁড়াতেন, আর একসময় বলতেন আজ এ পর্যন্ত-ই, মাঝে যে একটা ঘন্টা কোথায় কেটে যেতো জানতে পারতাম না ... সত্যি বলছি, কামাই করা তো দূরস্থান, সেমিস্টারের পরে দুঃখ হতো যেন একটা দারুণ বই পড়া হয়ে গেলো, যেন একটা সুসময় চলে গেলো আমাদের অতিক্রম করে ...


নাঃ, অনেক ভেবে-টেবে দেখেছি, জীবনে তো কিছুই আর হওয়া হলো না, সেই হাজারোঁ খোয়াইশের মধ্যে একটাই টিম-টিম করে জ্বলছে, সে আলোয় একটা ছোট্ট ক্লাসরুম দেখা যায় – কটা টেবিল-চেয়ার পড়ে আছে অযত্নে, আর হাড়ভাঙা কষ্ট করে পার্ট-টাইম চাকরি করে, সংসারের আর পাঁচটা জিনিষ সামলে গুটিকয় ছাত্র-ছাত্রী অঙ্ক শিখবে বলে এসে বসে আছে সেখানে, সেই ক্লাসরুম-টুকুই আমার পৃথিবী, আর যতোদিন এই নিবু-নিবু সলতেটুকু আছে, আমি চক-ডাস্টার হাতে রোজ ঠিক সেই বোর্ডের সামনে গিয়ে দাঁড়াবোই দাঁড়াবো ...



[1] ব(রাট)+ভ(গবান) = বভ, নামকরণের উৎপত্তি জানতে গেলে আপনাকে প্রথমতঃ, আইএসাইএর সচিত্র ইতিহাস পাঁচ ভলিউম পড়তে হবে, যেটা হাইলি অঞ্জলি কোম্পানি জেরক্স করতে গিয়ে হারিয়ে ফেলেছে, নয়তো বেঙ্গালুরু গিয়ে গান্ডেপিন্ডে গিলতে হবে !