Sunday, October 11, 2020

ইতি ও পুনশ্চ


 

বছর দুই হলো একতলার বাসা ছেড়ে দোতলায় উঠেছি, সামনে এখন কোনো উঁচু বাড়ি নেই, তাই দৃষ্টি অনেকদূর যায় বাধাহীন। তবে সেই দৃশ্যে শুধুই রুক্ষ, অযত্নে লালিত অনেকখানি জংলা জায়গা, যার একদিক থেকে আস্তে আস্তে এগিয়ে আসছে ছোট্ট, ছোট্ট নতুন দেশলাই বাক্সের মতন বাড়িঘর। আজ থেকে আর সপ্তাহ তিনেক পরেই যদি এসে ব্যালকনিতে বসেন একটা চেয়ার টেনে, হেমন্তের শেষ পাতার ফাঁক দিয়ে হুই দূরের একটা হাইওয়ের একটু আলো দেখা যাবে রাতে, আর ক্রমে ক্রমে কমে আসা জঙ্গলের যেদিকটায় আলো পড়ে না, সেইখান থেকে শোনা যাবে পাখির ডাক, ক্কচিৎ দুই-একটা খরগোশ কিংবা হরিণের আওয়াজ। কোত্থাও কোনো হর্ণ নেই, কোনো সাইরেন নেই, চারিদিকে তাকিয়ে দেখি, আর কোথাও কেউ ব্যালকনিতে শীতের রাতে একা-একা দাঁড়িয়ে নেই। 

মনে হয় এই নিস্তব্ধতা এতোই গাঢ়, এতোই তরল, যেন চোখ বুজে কান পাতলেই বহু দূর থেকে চেনা স্বর এসে পৌঁছবে কানে। যেন এই ডানা-ঝটপটানো রাতে একদিন হঠাৎ-ই ফোন আসবে সেই ইচ্ছে করে সেভ না করা নম্বরটা থেকে, এবং সে জিগ্যেস করবে, 'জেগে আছিস?' 

***** 

বাবার কাছে চিঠি আসতো প্রচুর। পুজোর ঠিক আগে আগে আমাদের ছোট্ট কাঠের ডাকবাক্স ভরে যেতো প্রায় প্রায়। কতোরকমের সে সব চিঠি ! মালদা থেকে শিবুকাকুদের চিঠি আসতো, দাদুর বয়ানে, 'কল্যাণীয়েষু জগন্নাথ'আর বিজয়ার ঠিক পরে প্রত্যেক বছর নিয়ম করে অশ্বিনীকুমার কাকুর চিঠি, একটা গোটা ইনল্যান্ড লেটারের ভেতরে এক প্যারা খুদি খুদি করে লেখা, 'হোপ দিস লেটার ...'উত্তর লিখে দিতাম আমি-ই, সুন্দর হাতের লেখায় যতোটা সম্ভব ছোটো করে একটা পোস্টকার্ডে এক মহাভারত ধরিয়ে ফেলতাম ডিকটেশন নিতে নিতে ... অবশ্য ডাক-ব্যবস্থাও ছিলো আরেক পরাবাস্তব দুনিয়া, মহালয়ার শুভেচ্ছা পেতে পেতে পেরিয়ে যেতো কালিপুজো, কালিপুজোর উত্তর যেতো নিউ ইয়ারের পরে।  

তবে সব চিঠি-ই কি কেজো ছিলো? বাবা বলতেন বাবার নাকি অল্প বয়সে দারুণ দারুণ সব পেন-ফ্রেন্ড ছিলো - একজন ছিলেন নাকি ইজরায়েলের এক মহিলা, যাঁর সাথে আলাপ পাহাড় চড়তে গিয়ে। সুখিয়া-পোকরিতে পোস্টিং ছিলো বাবার, মাইনাস দশ ডিগ্রি, ওরে বাবা। তার মধ্যে বরফ কেটে পাহাড় চড়তে যেতেন বন্ধু জুটিয়ে। সেইখানেই আলাপ। 

আর ছিলো বিখ্যাত সব লোকের উত্তর, তারাশঙ্করের চিঠি, উত্তমকুমারের নিজের হাতে সই করা ফটো। সব-ই, বাবা বলতেন, আছে আমাদের আলমারির ভেতরে দস্তাবেজের ভেতর চেপ্টে, কিংবা ট্রাঙ্কে হারিয়ে যাওয়া জমির দলিলের সাথে মারামারি করতে করতে। অ্যাশট্রে-তে ছাই ঝেড়ে ফেলে দিয়ে বাবা বলতেন, 'সব-ই ছিলো, বুঝলি, আসলে গুছিয়ে রাখার কেউ নেই।'

(এখানে বলে রাখা ভালো, পরে সেই তোরঙ্গ খুলে আমি প্রচুর হাঁটকেছি। দাদুর আমলের গাদা কাগজ আর ফালতু, রদ্দি জিনিষের মাঝে কোনো চিঠি-ই দেখিনি, খালি পেয়েছি একজোড়া কাঁসার ভারী বাসন, যার উপরে খোদাই করে লেখা ঠাকুমার নাম, 'চাঁপারাণী দত্ত')

তবু হতোদ্যম হইনি, ছোটোবেলার কাগজে দেখতাম শ্রেনীবদ্ধ বিজ্ঞাপনের পাতা জুড়ে প্রেমে ব্যর্থ/বশীকরণ, জয়েন্টে সাফল্য আর নাম-বদলের এফিডেভিটের মাঝে একটা-দুটো টিমটিম করছে পত্রমিতালীর ডাক। কখনো নিঃসঙ্গ প্রৌঢ়, অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক সঙ্গ চাইছেন সমমনস্ক মানুষের, অথবা মাঝবয়েসী ব্যবসায়ী বা শিক্ষক চাইছেন নি-ছক বন্ধুতা। 

আমিও প্রায়-ই পনেরো পয়সার পোস্টকার্ড নিয়ে গুছিয়ে চিঠি লিখতাম সেইসব বিজ্ঞাপনের উত্তরে, বলাই বাহুল্য তারা আর যাই চেয়ে থাকুন, আমার চিঠি চান নি। দু-একবার ভেবেছি জ্যোতিষ্ক-র জায়গায় জেসমিন নামে দু-এক পিস পাঠিয়ে দেখি কেমন উত্তর আসে, তারপর বাবার থাবার কথা ভেবে সে আশালতার মূলোচ্ছেদ স্বহস্তেই করেছি।

নিজের চিঠি পাওয়ার আশায় তখন প্রায় জল ঢেলেই দিয়েছি, এই সময় বুঝলাম চিঠি লেখার সবথেকে ভালো উপায় দুমদাম প্রেমে পড়া - সত্যি বলতে তখন মনে হতো মানুষে প্রেমে পড়ে কেবলমাত্র চিঠি লেখার অজুহাত পাবে বলে। অতএব, উর্ধ্বমুখ মুগ্ধচোখে গর্তে দিলেম পা, শুরু হলো অভাগীর স্বর্গ কিংবা ককলিয়ার ২-৩/৪ প্যাঁচের নোটের মাঝে পাচার করা নিষিদ্ধ-গন্ধমাখা চিঠি। 

কিন্তু বিধি বাম ! 

অনেক ভেবেচিন্তে একজন, এবং তার অনতিকাল পরেই আরেকজনকেও চিঠি ধরালাম (কাজটা মোটেও ভালো করিনি, এরা দুইজন বুজুম ফেরেন্ড ছিলেন)। সেসব চিঠির মধ্যে বাছাই-করা কোটেশন, শুধু বাংলা তেমন স্মার্ট না লাগার রিস্ক নেবো না বলে জয়বাবু ও জন ডান একত্রে হাঁটু গেড়ে বসেছেন নীল রঙের খামে। তবুও, তবুও ... কথোপকথন আর হলো না ... প্রেম সেই কৈশোরে নিঃশব্দ চরণে এসেছিলো কিনা জানা নেই, তবে এসেই যে সে সশব্দ চরণে পালিয়েছিলো সে বিষয়ে আমি দৃঢ় নিশ্চিত। 

অগত্যা আউটসোর্সিং ! বন্ধুরা বরাত দিতো, লম্বা চিঠির পারিশ্রমিক একটা আস্ত নেভি-কাট, বিফলে মূল্য ফেরত নাই, তবে সফল হলে আরো কিছু এগরোল-চাউমিন উপরি। লিখেওছি দেদার, যে যেমন চায় ঠিক তেমন - কারুর চিঠি সামান্য ভীতু, বেনামি, 'বুক-ফাটে-তাও-মুখ-ফোটে-না', তলায় সই করা - স্বশিক্ষিত প্রেমিক হলে 'অমিত রায়', অশিক্ষিত ড্যাকরা হলে রাহুল/রাজ। কারুর চিঠিতে শাহ্রুখীয় সেন্টু কিংবা অঞ্জনের গান, আবার কারুর নচিদার স্টাইল, 'এই! তুমি কি আমায় ভালোবাসো?' 

জীবনে কোনো আনন্দ-ই চিরস্থায়ী নয়, হলে জানবেন সেটা জীবন নয়, জি-বাংলা, অতএব এই কেরিয়ারের ইতিও অচিরে। দুই বন্ধুই যে লাবণ্যকে লিখতে বলেছে, সে যে একমেবাদ্বিতীয়ম একজনা-ই, এবং সে যে দুইটি চিঠির স্যাম্পল দেখেই বুঝে যাবেন নিবারণ চক্কোত্তি আর অমিত সব-ই আসলে দাদু ঠাকুর, সে কি আর আমি জানতাম? 

সুন্দর লম্বা চিঠি লিখতো শুভ্রকান্তি, কখনো-সখনো শৌভিক, একবার-আধবার সন্দীপ । শুভ্র একদিন লিখলো ওদের দামোদরের জল শুকিয়ে চড়া পড়ে যায় গরমে, হেঁটে হেঁটে পেরোনো যায় দিব্যি। সে চিঠি যেদিন পৌঁছলো আমার বাড়িঘরময় তখন বন্যার জল থইথই, বাবা ইঁট পাতছেন গলির ভেতরে, আর মা সেই জলের মধ্যে হাঁটুর উপর কাপড় তুলে বালতি বালতি জল ঘরে তুলে রাখছে, আর গলায় তাঁর দীর্ঘদেহী ঈশ্বরের কোনো একটা বর্ষার গান।

এক বর্ষার দিনে শুধু বাড়ি ফিরতে গিয়ে দেখি সেই ইঁটগুলো আর নেই -- গলির মধ্যে জল পাড়িয়ে ঢুকতে গিয়ে কেডস ভিজে যাবে বলে এক শ্রাবণে ভিজে ভিজে বাবা যে ইঁটগুলো পেতে রেখেছিলেন আমার আজন্ম বর্ষাকালে ... সেই প্রকান্ড মহীরুহ তার ডালপালা, তার শেকড়, তার কোটরে বাস করা তক্ষক, তার বর্ষার জলে পাতা ইঁট – সব নিয়ে একদিন চলে গেছেন কোনো একটা দৃশ্যের ওপারে ... সেইখানে যেখানে আর কোনো চিঠি-ই পৌঁছয় না।

হাতে লেখা চিঠির-ও সেই শেষ বসন্ত। দিদির সাথে কাফেটেরিয়ায় গিয়ে ইমেল খুলছি, ইয়াহু আইডিতে নামধাম-জন্মসাল সব দেওয়া, বন্ধুদের সেই কাফে থেকেই ইমেল করলাম, বললাম, শোন এই হচ্ছে আমার ইউজারনেম আর এই হচ্ছে পাসওয়ার্ড, পত্রপাঠ উত্তর দিস প্লীজ। এক সপ্তাহ সে কী উত্তেজনা তারপর, ইনবক্স(১) দেখবো কি পরের বার? রোজ-ই সাইবার কাফের বাইরে চটির মেলা দেখি, পকেটে টাকা গুণে ফিরে আসি চুপচাপ, পরের দিন অফ-টাইমে যাবো, ভর দুপুর বেলা। 

কতো বড়ো হলাম তারপর, কতো হাজার-লক্ষ ইমেল পেলাম, হারিয়ে ফেললাম আস্ত আস্ত ইমেলের বাক্স, নিজের নামের আই-ডি, নিজের আর সেই প্রথম প্রেমিকার নাম জুড়ে আইডি, আর ইনবক্স ভরা কতো ঝগড়া-অভিমান-কতো তুচ্ছ রাগ, হারিয়ে ফেলেছি সব-ই। কতো ইমেল লিখতে হবে কোনোদিন ভাবিনি, কতো ইমেল পেতে চাইনি কোনোদিন, এখন ভাবলে হাসি পায়, আর কেউ দেখার না থাকলে, অন্ধকার ব্যালকনিতে মাঝে মাঝে কান্না-ও। তবু, ইমেল তো, কুটি কুটি করে ছিঁড়ে জানলা দিয়ে উড়িয়ে দেওয়া যায়না হাওয়ায়, পুড়িয়ে দেওয়া যায়না অন্ধ রাগে, লুকোনো যায়না পেঙ্গুইনের পুরোনো পেপারব্যাকটার ঠিক মাঝখানে। একটা ব্যর্থ প্রেমের আবর্জনা পোড়াতে বসলে, একটা মাত্র ডিলিট-এর বোতাম টিপে সুখ হয়, বলুন?  

জয় গোস্বামীর একটা কবিতার বই আছে আমার বইয়ের তাকে, তার ব্যাক কভারে লেখক-পরিচিত-র তলায় লেখা - "শখঃ পুরোনো চিঠি পড়া" ... ছোটোবেলায় পড়তে পড়তে ভাবতাম, কবে সেই বয়সে পৌঁছবো যখন আমার-ও পুরোনো চিঠি থাকবে ! 

তাই এখন ধুলো ঘেঁটে ঘেঁটে বের করি পুরোনো সব হাতে-লেখা চিঠি ... মাঝে মাঝে সে চিঠিগুলো নিজে নিজেই জ্বলে উঠে ছাই হয়ে যায়, আবার মাঝে মাঝে দেখি সেই ছাই থেকে ফিনিক্সের মতন নতুন একটা কবিতা হয়তো জন্ম নিলো ... যদিও এখন দেখছি ছাই-ই বেশী, কবিতা কম ...  

সেই সব হারিয়ে যাওয়া ছাইদের জন্যে এখনো একটু আফশোস রয়ে গেছে মনে মনে, অবশ্য এ-ও ঠিক যে সেসব উদ্ধার হলে যে সমূহ বিপদ একথা অস্বীকার করার উপায় নেই। তাই আশা ছেড়েই দিয়েছি। 

খালি একজন লিখেছিলো, ‘তোকে উপায়হীন ভাবে ভালোবাসি আমি’ ... শুধু সেই চিঠিটা এখনো মাঝে মাঝে খুঁজি ... 


Tuesday, June 16, 2020

ছাদের গান



এই অঞ্চলের গ্রীষ্মকালের রাতগুলি বাষ্পহীন, মেঘহীন এবং নিঃশব্দ। সামনের একটা মাঠ ছাড়া চোখের সীমানায় কোথাও আলোর কোনো উৎস নেই, খালি দূরে হাইওয়ে যেন জ্বলন্ত আংরার শেষ আভাটুকু হয়ে ফুটে থাকে। এই রাত্রের অন্ধকারের মধ্যে মিশে বসে থাকি রোজ, মাথার উপরে তাকিয়ে খুঁজতে থাকি বাল্যবন্ধুর মতো চেনা তারামন্ডল - লুব্ধক চিনতে পারি, চিনতে পারি কালপুরুষের কোমরবন্ধনী, জিজ্ঞাসাচিহ্নের মত হাতড়ে হাতড়ে খুঁজি সপ্তর্ষিদের -- পুলহ, পুলস্ত্য, অত্রি, অঙ্গিরা ... আর? নামগুলো মনে পড়ে না আর, শুধু মনে পড়ে আগের জন্মের শহরে ফেলে আসা একটা অলৌকিক ছাদ আর সে ছাদের কোণায় কোণায় জমে থাকা ধুলোর মত ময়লা একটুকরো ছেলেবেলার গল্প ... 

এই ছাদটা কিন্তু আসলে আমাদের নয় ... সত্যি বলতে আমাদের কোনোদিন-ই ছাদ ছিলো না, মাথার উপরে তাও যা ছিলো নাম-কা-ওয়াস্তে, পায়ের তলায় সর্ষে বই আর কিচ্ছু ছিলো না... কিন্তু তাতে কী? জীবনে যা কিছু আমাদের অধিগত নয়, শুধু তাই নিয়েই তো গল্প লিখি আমরা, তাই না? এও, তাই একরকমের আনরিক্যুইটেড লাভস্টোরি ... আর সেই প্রেমের গল্পের মুখ্য চরিত্র আমাদের ভাড়াটে বাড়ির মাথার উপরের এক চিলতে একটুখানি ছাদ। 


***

একটা লম্বা-চওড়া-ত্যাড়াব্যাঁকা দোতলা বসতবাড়ির মধ্যে দরমার বেড়া, টিনের চাল বসিয়ে ভাগ করে করে এক-এক ঘর ভাড়াটে। একতলার ভেতরের দিকে আমরা, একপাশে ব্যানার্জীদের ঘর, একপাশে বাড়িওয়ালারা দুইভাই, আর ঠিক মাথার উপরের ঘরটায় ভাড়া থাকতো বাবুদা-রা। ছাদটা ছিলো ওদের অংশেই - বাবুদা, সাধনাদি, আর বাবুদার বাবা-মা ... মাঝেমাঝে এসে উঠতেন বিভিন্ন দেশগায়েঁর আত্মীয়-স্বজন, আর অল্পদিনের জন্য এক ঠাকুমা। বাবুদার মাকে আমি ডাকতাম "মাঈ" - ছোটবেলায় তাদের কোলে-পিঠে চড়েছি বলে নয়, মাঈ যে মাতৃসমা, আর বাবুদাও যে ছিলো অনেক বড়ো এক দাদার মতো একথা বললে একবিন্দু অত্যুক্তি হয় না। 

তা স্নেহের কারণেই হোক, বা অভ্যেসে ... ওই বাড়িটার ছাদে আমার যাতায়াত ছিলো অবারিত, আক্ষরিক অর্থে অন-অর্গল ... বন্ধুহীন বিকেলে বা অসহ্য রাত্রে ওই ছাদটাই ছিলো আমার একার রাজ্য, ওইটাই আমার জাহাজের ডেক, ওইটাই শিকারীর মাচা, আর ক্রিকেটের সময় এলে ওইটাই আমার ইডেন গার্ডেন্স ... 

***

ছাদের মেঝেটা ছিলো রুক্ষ, কর্কশ - খালি পায়ে গেলে বকুনি খেতে হতো বড়োদের কাছে, আর দৈবাৎ চলে গেলে দেখতাম পায়ের পাতা কুষ্টি কালো হয়ে গেছে দীর্ঘদিনের জমা ময়লায়। তবু সেই ছাদের একটা অপূর্ব গন্ধ ছিলো, যা আমি ছাড়া আর কেউ পেতো না ... রোদে তেতেপুড়ে থাকা ছাদের উপর বৃষ্টি শুরু হলেই সেই ছাদের গা বেয়ে উঠতো আশ্চর্য সোঁদা গন্ধ, মনে হতো যেন জ্যান্ত হয়ে উঠছে পায়ের তলার পরিত্যক্ত ইঁট-পাথরের রাক্ষস ! 

ছাদেই প্রথম শিখেছিলাম ঘুড়ি ওড়ানো ! দুহাত শূন্যে তুলে ছুঁড়ে যে ফার্স্ট-ক্লাস ওড়ানো সে নয়, মাঞ্জা ধরে ছাদ থেকে ঝুলিয়ে দিয়ে হ্যাঁচকা টানে শূন্যে তুলে ওড়ানো ... কিন্তু বিধি বাম, চারদিকে ঘেরা সে দোতলা বাড়ির ছাদে হাওয়া-ও আসতো নিষিদ্ধ প্রেমের মতন লুকিয়ে-চুরিয়ে, তাতে টান থাকে না শুন্যে উড়িয়ে নিয়ে যাবার, তবুও বেপরোয়া টানাটানির মাঝে কখন যেন হঠাৎ আকাশে ল্যাগব্যাগ করে উঠে পড়তো কুড়িয়ে পাওয়া ঘুড়ি। ভয়েভয়ে একটু আকাশ-বিহার করে, নিপুণ মাঞ্জার লড়াই এড়িয়ে আবার সে নেমেও আসতো অন্ধকারের আগে, সাতটার খবরের আগে  ...

ঘুড়ির সিজন না হলে খেলতাম একাই-একশো-ক্রিকেট, ছাদের এই প্রান্ত থেকে ছুটে আসতাম আমি-ই যেন আক্রম, দেওয়ালে বল লাগলেই তারস্বরে অ্যাপিল, এবং আম্পায়ারের তোয়াক্কা না করে সারা ছাদ জুড়ে ভিক্ট্রি ল্যাপ ... বোলিং হয়ে গেলে ব্যাটিং-ও আমি, দেওয়ালে বল মেরে ফিরতি বলে আনতাবড়ি হুক-পুল-স্কোয়্যার-কাট, সেসব রোমহর্ষক ম্যাচের কাছে কোথায় লাগে আই-পি-এল ... সত্যি বলছি, পরে অনেক বড়ো মাঠে খেলেও সেই ছাদ-ক্রিকেটের মজা আর পাইনি ! 

আর শিখেছিলাম সূর্যগ্রহণ - ভাঙা হাড়ের এক্স-রে প্লেটের পাত নিয়ে ঠায় দাঁড়িয়ে দেখেছি সূর্য ঢাকা পড়ে যাচ্ছে চাঁদের অন্ধকার বৃত্তে। মনে আছে ঝাঁকে-ঝাঁকে পাখি বাসায় ফিরছে সন্ধ্যে নেমে গেছে ভেবে ... এতোকাল পরেও মনে পড়ে সেই ফিরতি পাখির ডাক শুনে আশ্চর্য হওয়া, ওরা তাহলে সময় বোঝে আলো দেখে, ভয় পায় অন্ধকারে? (ঘালিব বলেছিলেন না, সন্ধ্যের অন্ধকার কত ভয়ানক হতে পারে, গৃহহীন পাখিদের থেকে কে-ই বা ভালো বোঝে?)

সবথেকে মজা হতো লোডশেডিং হলে, একটা হ্যারিকেন বা লম্ফ জ্বালিয়ে চলে যেতাম ছাদে, গল্প শুনতাম দিদির মুখে, আর এক-একদিন নতুন আনা লাইব্রেরীর বইয়ের পাতা থেকে এক-এক করে রুদ্ধশ্বাসে শেষ করতাম গল্প, আর মনে মনে চাইতাম যেন রাত্রে শোওয়ার আগে আর কারেন্ট-টা না আসে ... ভূতের গল্প পড়তে পড়তে এক-একদিন দূরের হাওয়ায় দোলা গাছের পাতা দেখে শিউরে উঠতাম, সেই রাত্রে আর ঘুম আসতো না সহজে ... আর যেদিন পড়া হতো না, দুই ভাইবোনে গলা ছেড়ে গান ধরতাম, "আলো আমার আলো ওগো" ... যতো জোরে গান ততো তাড়াতাড়ি ফিরে আসবে কারেন্ট, আর সত্যি বলছি আসতোও ফিরে ... (এ কিন্তু আমার নিজের চোখে দেখা ম্যাজিক, বিশ্বাস না হয় পরের বার লোডশেডিং হলে গেয়ে দেখতে পারেন, যদিও শুনি খুচরো লোডশেডিং এখন চড়াই পাখির থেকেও বিরল কলকাতা শহরে)

আর সে ছাদে ছিলো আশ্চর্য একটা অ্যান্টেনা - খেলার মাঝে লাইন চলে গেলে আমার কাজ ছিলো ছাদে উঠে সেইটাকে ঝুলঝাড়ু দিয়ে আলতো আলতো টোকা দেওয়া। ভক্ত ধ্রুবের কাতর ডাকে বিষ্ণু-টিষ্ণু নেমে আসেন, ডিডি-ওয়ান-টু আর এমন কী? আর অ্যান্টেনার পাশেই ছিলো পায়রা বসার একটা উঁচু জায়গা, সকাল-বিকেলে পায়রার দল সেই সিংহাসনে বসে বকম-বকম করতে করতে বিশ্ব-জগতের মুখে নির্বিকারে, নির্বিচারে পটি করে চলতো ... সে অ্যান্টেনাও বেশীদিন টেঁকেনি, সেই পায়রাসন-ও নয়। এখন অবশ্য ভেবে দেখলে মনে হয় দুটো পাশাপাশি না রাখলেই মঙ্গল হতো, উচ্চাসনে বসে বাহ্য করার কাজটা যে অ্যান্টেনা বেয়েই একদিন টিভির পর্দায় ঢুকে যাবে, এ কথা কবির কিংবা বাড়িওয়ালার কল্পনায় আসেনি ! 

তবে নাঃ, ছাদে প্রেমে পড়া হয়নি কোনোদিন - বয়ঃসন্ধি হওয়ার মুখে প্রাণপণে খুঁজতাম, যদি কোনো বিকেলের পড়ে-যাওয়া ম্লান আলোয় দূরের কোনো বাড়ির ছাদে কেউ আসে, যদি ... কিন্তু লুঙ্গি-শোভিত কাকুর দল আর উচ্চিংড়ে বোম্মারা মাঞ্জাকিশোর ছাড়া কাউকে কখনো দেখেছি বলে স্মরণে আসে না। 

যদিও এ কথাটা বলে রাখতেই হবে যে, এক্ষেত্রে exception proves the rule, আমার সেরার সেরা বন্ধুদের মধ্যে অন্যতম যে, তার প্রেমে পড়া ওই টবিন রোডের ছোট্ট ছাদে বাঁশির হাত ধরে - বিটিরোডের কর্কশ যন্ত্রদানবের চিৎকার সেই প্রথম প্রেমের বাঁশির ডাক যে ঢাকতে পারেনি, ম্যাজিক বলতে এখনো এইটুকুই বুঝি ... 


তবে কী, সব ম্যাজিক-ই ক্ষণস্থায়ী, একসময় শো শেষ হবেই হবে - ম্যাজিশিয়ান তাঁর টুপি, খরগোশ আর ধবধবে শাদা পায়রা নিয়ে,  রুমাল নাড়তে নাড়তে মিলিয়ে যাবেন পর্দার আড়ালে ...

আমার ছোটবেলার ছাদের ম্যাজিক-ও কিছুটা ওইরকম। বাবুদার বাবা সারা জীবনে বোধহয় ঐ একদিন-ই এসেছিলেন আমাদের বাড়িতে, হাতে মিষ্টির হাঁড়ি নিয়ে। ভাড়াবাড়ি ছেড়ে ফাইন্যালি ওঁরা পেরেছেন নিজেদের ঠিকানা বানাতে, তবে অনেক-অনেক দূর, ঠিকানা দিয়ে বলেছিলেন, মাঝে মাঝে বাপ্টুকে নিয়ে এসো, আমার স্ত্রী তো খুব ভালোবাসেন ওকে ... সে ঠিকানা খুঁজে আমার বাবা আর নিয়ে যাননি আমাকে, আমার নিজের যাওয়ার বয়স হতে হতে আস্তে আস্তে সেই সব-ই কোথায় যেন হারিয়ে গেলো পাথর চাপা কঙ্কালের মত, কখন যে তার উপর অন্যের বসতবাটী গড়ে উঠলো কেউ জানে না ... 

বাবুদা-মাঈ-দের পরে যাঁরা ওই বাড়িতে থাকতেন, তাঁরা বাড়িওলার-ই আর এক ভাই, আর তাঁর দুই বিশ্ব-বখাটে উচ্ছৃঙ্খল ছোঁড়া ... একদিন রাত্রে ঘুম ভেঙে শুনি পাশের বাড়ি থেকে তীব্র ঝগড়ার আওয়াজ, উত্তর কলকাতার রক্ষণশীল পাড়া তখনো শেখেনি ছাদে ডিজে পার্টি আর গড়িয়ে যাওয়া খালি বোতলের আওয়াজে অভ্যস্ত হয়ে যেতে ... 

কলকাতা ছাড়ার আগে আর মাত্র একবার যাওয়া হয়েছিলো সেই ছাদে, চটি খুলে খালি পায়ে উত্তপ্ত ছাদে দাঁড়িয়ে ছিলাম অনেকক্ষণ - দেখলাম পলকা অ্যান্টেনা কবেই উড়ে গিয়ে একটা কালচে খুঁটি দাঁড়িয়ে আছে এক কোণে, পায়রার দল অন্য কোনো ছাদে পাকাপাকি চলে গেছে সংসার গুটিয়ে, আকাশেও কোনো মিলেনিয়াল কিশোরের ওড়ানো দোত্তে-পেটকাটি নেই ... 

খালি চিলেকোঠার ঘরের জানলার তলায় লাল খড়ি দিয়ে আঁকা তিনটে ঢ্যাঙা উইকেট তখনো দেখলাম দিব্যি দাঁড়িয়ে আছে, হয়তো সেই শেষ-না-হওয়া খেলাটা-ই আবার একদিন খেলবে বলে, সেই ছোট্টবেলার ছাদের পিচে বাপ্টুবাবু এখনো যে নট-আউট !




 














Monday, April 13, 2020

উজু !



এই গভীর, গভীরতর অসুখের মধ্যে বসে বসে মাঝে কলেজের টুকরো-টাকরা গল্প মনে পড়ে ... দু-একজন পুরোনো বন্ধু, যাদের সাথে অনেকদিন দেখা নেই ... এখন শনিবার-শনিবার সকালে বিভিন্ন প্রান্ত থেকে অনলাইন হচ্ছি সবাই, কারুর সকাল, কারুর বিকেল, কারুর চোখ ঘুমে ঢুলছে ... ছোট্ট ছোট্ট বাক্সের মধ্যে চেনামুখ গুলো দেখি আর ভাবি এই বন্দীদশা শেষ হলে সবার সাথে একদিন দেখা করবোই যাহোক করে ... বাক্সের ভেতরে-বাইরে সব্বাই ... সেইরকম এক-একজনের গপ্পো বলবো এক-একদিন...

আজকের যে হিরো, তার নাম উজু, উজু চেয়েছিলো ফিজিক্স পড়বে, এদিকে বাড়ির লোকে জোর করে ঢুকিয়ে দিলো স্ট্যাট পড়তে, শেষমেশ অবশ্য স্ট্যাটের পাট চুকিয়ে উজু কম্পিউটেশনাল ফিজিক্স-এই কাজ করেছে, এখন ডক্টরেট শেষ করে চাকরি করছে কোথাও ...  তা সেই কলেজে পড়ার সময় থেকেই একটা জিনিষ খুব স্পষ্ট ছিলো, এই আগাপাশতলা রিগ্রেশন টুওয়ার্ডস মিনের রাজত্বে উজু একটি জ্বলজ্বলে আউটলায়ার !

যাইহোক, উজুর প্রথম কেরামতি দেখতে পেলাম ফার্স্ট ইয়ারে - পিসি (না উনি নন, আরেকজন) ক্লাসে অ্যাসাইনমেন্ট দিয়েছেন স্টক মার্কেটের দৈনিক ওঠানামার মধ্যে কিছু একটা প্যাটার্ন খুঁজতে হবে - আর ডেটা জোগাড় করতে হবে রোজকার খবরের কাগজের 'শেয়ার বাজার' এর ছোট্ট একচিলতে ব্লক থেকে। এদিকে আমাদের বেশীরভাগ-ই আজন্ম ক্যাবলা, স্টক কাকে বলে তাই জানিনা, হঠাৎ মেসের সামনে কাগজ নিয়ে টানাটানি পড়ে গেলো ... দেখা গেলো বেশীর ভাগ-ই ল্যাদখোর, বোম্বে কি বড়োজোর ভারতের দু-একটা ইন্ডেক্স দেখেই ক্ষান্ত, রোজ সকালে কাগজ দেখে দুটো নাম্বার টুকে নেয়, আগের দিনের থেকে বেড়েছে (+১), না কমেছে (-১)... একটি ছেলে আবার হাফ-আমেরিকান-ডিজনিল্যান্ড-মায়ামি-ফেরত, সে সিধে নিউ ইয়র্কের নাম্বার টোকে ... (সব ডেটা-ই ডেটা, কিন্তু ডাও জোন্সের ডেটার গ্ল্যামার একটু বেশী) ... উজু কিন্তু এই হট্টগোলে অবিচলিত, কাগজের দিকে ফিরেও তাকায় না, কিছুই টোকে না ... যাহোক, মাস খানেক পরে অ্যাসাইনমেন্ট জমা দেওয়ার দিন - সবাই বীরবিক্রমে অনেক কিছু করে সাজিয়ে এনেছে প্রেডিকশনের ডালি, উজুও দিব্যি খাতা জমা দিলো, নম্বর-ও পেলো ... ক্লাসের পরে জিগ্যেস করলাম, কিরে ডেটা কোথায় পেলি? উজু নির্বিকার মুখে উত্তর দিলো, আরে প্লাস ওয়ান আর মাইনাস ওয়ান তো? মনে মনে র‍্যান্ডম নাম্বার ভেবে বসিয়ে দিয়েছি !

এই প্যানডেমিকের বাজারে ভেবে দেখেছি, ওইটেই আসল সত্য, কে যে কোথায় আপন মনের মাধুরী মিশিয়ে ডেটা জেনারেট করে যাচ্ছে কেউ জানে না, আমরা মিয়ার মর্টালস অ্যানালাইজ করে উলটে দিচ্ছি !

বছর দুয়েক পরের ব্যাপার, হোস্টেলে দাবা টুর্নামেন্ট ! সবাই হঠাৎ বিশ্বনাথন আনন্দ না হোক দিব্যেন্দু বড়ুয়া হয়ে গেছে। আমি এদিকে ঘোড়া যে আড়াই ঘর লাফায় সেই মনে রাখতেই হিমশিম খাই, ওদিকে লোকে কাকে দিয়ে শুরু করে কাকে খাবে এইসব ভেবে প্যাঁচ কষে চা খেতে খেতে ... যথারীতি উজু এসবের মধ্যে নেই ... তাও একদিন হঠাৎ দেখি, উজুর ঘরে দাবার আড্ডা, আমাদের পাড়ার কাসপারভ-কে রীতিমত চাপে ফেলে উজু লড়ছে ! হাড্ডাহাড্ডি ম্যাচ শেষ হওয়ার পরে জিগালাম, তুই যে বললি দাবা খেলতে পারিস না? উজু বলেছিলো সত্যি-ই পারে না, সারা ম্যাচ সিমেট্রিক চাল চেলে গেছে, ওদিকে সাদা সৈন্য এগোলে, উজুও এগোয়, ওদিকের গজ গড়াগড়ি দিলে এদিকে ওর গজ-ও গড়িয়ে যায় ... বললে পেত্যয় যাবেন না, সেই বিচিত্র ম্যাচ উজু আরেকটু হলেই জিতেও যেতো !

সেই বছরটাই ছিলো আতঙ্কের থার্ড ইয়ার ! কম্প্রিহেন্সিভ নামে এক ভয়ানক পরীক্ষা, মানে তিন বছরের সব সিলেবাস ঘেঁটে একটা বিভীষিকাময় কক্টেল ... সব পরীক্ষার আগে এক হপ্তা পড়ে পাস করে যাই, হঠাৎ এই মক-রাক্ষসের সামনে এসে আমাদের তখন কাপড়ে-চোপড়ে অবস্থা ! উজুর ঘরে এই সময় একদিন হানা দিলাম, দেখি ছেলে তিন বছরের খাতা-ফাতা ফেলে দিয়ে চাপ নিয়ে পিরিওডিক টেবল গাঁতাচ্ছে... (বলাই বাহুল্য আই-এস-আই-এর তিন বছরে যতোই খট্টাং পুরাণ থাকুক না কেন, আফবাও প্রিন্সিপল ছিলো না) ... কিন্তু উজু গাঁতাচ্ছিলো কেন? না একদিন সকালে উঠে মনে হয়েছে কোন এলিমেন্টের কতো অ্যাটমিক নাম্বার মনে নেই ... কোথা থেকে কি হোলো জানিনা, সন্ধ্যের মধ্যে দেখি গোটা হোস্টেলে সবাই কম্প্রি কাটিয়ে পিরিওডিক টেবিল আওড়াচ্ছে !

আনন্দের কথা আমরা কেউ-ই সে যাত্রা ফেল করিনি! তবে এখনো খুব চাপের মধ্যে মাঝে মাঝে মনে হয় বেরিলিয়মের কনফিগারেশন-টা ঝালিয়ে নিলে হয়তো আর অ্যাসিম্পটোটিক্স আদৌ চাপের মনে হবে না ...

ও হ্যাঁ, আরেকটা কথাও বলে রাখি, উজু আমাদের ক্লাসে বলে দেওয়া কোনো টেক্সট-ই পড়তো না, ও জোগাড় করে আনতো সেই সাবজেক্টের রাশিয়ান কোনো লেখকের বই ! শুধু সেইগুলোই পড়তো নিজের মনে ... আর পরীক্ষার হলে যেখানে লোকে মুন্ডুমাথা যতেক পারি ততেক লিখি করে যাচ্ছে, উজু প্রথমে পেন্সিলে লিখে রাফ কপি বানাতো, তারপরে সেই লেখার উপরে পেন বুলিয়ে বুলিয়ে ফেয়ার ... জীবনে সব প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করা আসলে যে মূর্খামি সেটাও সেই থেকেই শিখেছি - স্বীকার করতে বাধা নেই ...


আই-এস-আই আস্তে আস্তে শেষ হয়ে আসছে, লোকজনের ধুম লেগেছে জি-আর-ই পরীক্ষার, সাউথ উইঙ্গের আকাশে-বাতাসে বিচিত্র সব ইংরেজি শব্দ শোনা যাচ্ছে, যে সব বাংলা মিডিয়ামের ছেলে অ-আ পড়েই আলফা-বেটা করতে শিখেছে, তারাও হাত ধুয়ে হাসি-হাসি মুখে বলছে দ্যাখ কেমন অ্যাবলিউশন করে এলাম ... উজুও জি-আর-ই দেবে, ডেট এগিয়ে আসছে, কিন্তু উজু স্বভাবতই নির্বিকার !

কালক্রমে দিন এলো - এদিকে সেইদিনেই আবার তাসা*-র ক্লাসে হোম-ওয়ার্ক জমা দেওয়ার শেষ দিন ! খুব-ই জটিল পরিস্থতি ... আর সেই অ্যাসাইনমেন্ট-ও এতোই লম্বা, যে টুকতে গেলেও দু-রাত লেগে যাবে !

উজু সকালে উঠে বললো, আজকে অনেক কাজ, কাজেই অতো ওয়ার্ড পড়ছিনা, খালি ব্যারনের বইয়ের সামনে একটা high frequency wordlist আছে, শ-তিনেক শব্দ, সেইটে গাঁতিয়ে চলে যাচ্ছি ! আমি বললাম শব্দগুলো গাঁতাবি, শব্দগুলোর মানে গাঁতাবি না? উজু অবাক ! শব্দ-ও জানবো, আবার তার মানেও জানতে হবে?

এমনি আম-আদমি হলে রণে ভঙ্গ দিয়ে লেপমুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়তো ... উজু কিন্তু অকুতোভয়, পরীক্ষা তো দিতে গেলোই, তাসার অ্যাসাইনমেন্ট-ও জমা দিয়ে এলো !

এসে বললো এই তো প্রথম পাতায় দুটো অঙ্ক করলাম, তারপর ভাবলাম এতো পাতলা খাতা জমা দিলে অনেক বকাঝকা খাওয়ার চান্স, এদিকে দেরী হয়ে যাচ্ছে ... তাই ব্রেকফাস্টের পরেই মেসে গেলাম, দেখলাম একটা ভাঙা চেয়ারের উপর ফার্স্ট ইয়ারের কারুর কি একটা সাবজেক্টের নোটের খাতা পড়ে আছে, সেইটাই নিয়ে মাঝখান থেকে এক দিস্তে পাতা ছিঁড়ে আমার ওই একটা পাতার সাথে স্টেপ্ল করে জমা দিয়ে এলাম ... মোটাসোটা দিস্তে দেখে তাসা-ও খুশি, পরে পাতা উল্টোলে শাপ-শাপান্ত করেছেন নির্ঘাত, কিন্তু ততোক্ষণে উজু উড়ে গেছে !

মাঝে মাঝেই নাক-উঁচু জার্নালে দুরুদুরু বক্ষে পেপার সাবমিট করার আগে বেশ টেনশন হয়, তারপর এই গল্পটা মনে পড়লে ভাবি ... আসলে চোতাটা বেশ মোটাসোটা কিনা সেইটাই তো লোকে দেখে, কাজেই ভয়ের কারণ নেই !


উজুর সাথে শেষ কথা হয়েছে বছর চার-পাঁচ আগে, কোনো একটা ফিজিক্সের কনফারেন্সে এসেছিলো বল্টিমোরে ... এক বন্ধুর সাথে দেখা, তারপর ফোন! উজু ফেসবুকে নেই, কাজেই এই লেখাটা পড়ে আমাকে ক্যালাতে আসবে, সেই ভয় পাওয়ার কারণ নেই, তা ছাড়া এমনিতেও ছেলেটা শান্ত !

এই লেখাটা লেখার আগেই খুঁজে বের করলাম উজু-কে, একটা রিকোয়েস্ট পাঠিয়ে গল্প লিখলাম ... এইসব আষাঢ়ে গপ্পের ছুতোয় একটা পুরোনো চেনা মুখে খুঁজে পেলে ক্ষতি কী?


-----


*আমার খুব-ই প্রিয় শিক্ষক, কান মুলে দিতে পারেন, তাই পুরো নাম লিখলাম না ...













Saturday, April 4, 2020

"ফলিবেই ফলিবে" ...


এই যে পাবলিক হেলথ-এর ' না জানা পাবলিক উদুম ডিপ লার্নিং আর কার্ভ ফিটিং করে রোজ সকাল-বিকেল দশটা কোভিড-১৯ ফোরকাস্টিং এর মডেল নামাচ্ছে, দৃশ্য দেখেই ইহজগত-কে টাটা করতে হবে মনে হচ্ছে !

যে দিকে জিনিষ যাচ্ছে তাতে অনিশ্চয়তা (আন্সার্টেনটি) কিছুদিন পরে উঠেই যাবে, রাস্তার মোড়ে মোড়ে দোকান হবে মাতৃ মেশিনলার্নিং স্টোরস কিংবা বগলার ব্যাকপ্রপ কর্ণার, উপরে সাইনবোর্ড ঝুলবে সব জ্যোতিষী বারবার, ডিপ লার্নিং একবার” ...

সে যাই হোক, এই প্যানডেমিক মডেলিং-এর হিড়িক দেখে একটা সদ্য-যৌবনের গল্প মনে পড়ে গেলো! আমার আই-এস-আই-এর প্রাণের বন্ধু মাতাল (ভালো নাম গোপন থাকুক) তখন বিবাহযোগ্য ব্যাচেলর। বাড়ির লোকেও স্বাভাবিক ভাবেই উন্মুখ উদবিগ্ন ... তা মাতালের মায়ের সাথে একদিন বাজারে পুরোনো বান্ধবীর দেখা, -কথা-সে-কথায় জানা গেলো সেই বান্ধবীর- একটি বিবাহযোগ্যা কন্যা আছে, এবং সে মডেলিং করে। মাতালের মা হাতে চাঁদ পেলেন, বললেন বাঃ আমার ছেলেও তো সারাদিন মডেলিং- করে ...

শোনা যায়, নির্দিষ্ট দিনে এরপর দুজনের দেখাও হয়েছিলো বাবা-মায়ের তত্ত্বাবধানে, কিন্তু মডেলার মডেলকে দেখতে না দেখতেই মডেলার মাতালের মা বলে ওঠেন, না রে বাবা তোর দ্বারা হবে না ...

আজকের এই মডেলার-দের যদিও সেরম কিচ্ছু বলতে চাই না একেবারেই, এটা নিছক-ই একটা গপ্পো!


পুনশ্চ ১ - কেউ ভুল বুঝবেন না, আমার মনে হয় ইন্টার-ডিসিপ্লিনারি কাজ না করলে এরকম সাংঘাতিক প্যান্ডেমিক রোখা সম্ভব নয়, অথবা পরের বারের জন্য প্রস্তুত হওয়াও খুব খুব শক্ত ... তবে একটা বীভৎস পাবলিক হেলথ ক্রাইসিসের আগাপাশতলা না বুঝে এই ঘোলা জলে একটি খ্যাপলা জাল রেডি রাখার চেষ্টা, অথবা নিজের দু-পহার কোডিং স্কিল শো-অফ করা যে কতখানি crass এবং বিপজ্জনক, সে বোধ কিছু ডেটা-চচ্চড়ির হলে ভারি খুশি হই এই আর কি!

হ্যাঁ, এই বাজারে বরং ডানিং-ক্রুগার এফেক্ট নিয়ে এট্টু পড়ে নিন (যার মোদ্দা কথা হচ্ছে যে লোকের নিজেদের বিদ্যে-বুদ্ধির দৌড়, তাদের নিজেদেরই সচরাচর বোধগম্য হয় না!

পুনশ্চ আমার সব গল্প- অতিরঞ্জিত (নাহয় নির্জলা আর্বান লিজেন্ড)এটাও ব্যতিক্রম নয়তবে একটু রঙ না চড়ালে জীবন বড়োই মান্ডেন ...