Monday, April 15, 2019

আমার কথা


আমার সব লেখাই আত্মজৈবনিক - যেন হঠাৎ হঠাৎ মনে পড়ে যাওয়া এক-একটা ছোট্ট চিরকুট, সাদা শার্টে একটা ছোট্ট পুরোনো দাগ যেটা ধুয়ে ধুয়েও কি করে যেন রয়ে গেছে, তাই আলাদা করে আমার কথা লিখতে বসে বড্ড গোলমাল লাগছে! আসলে কিসের পরে কি ছিলো জানিনা, শুরুতে কি ছিলো? জল না আগুন? না অন্ধকার? শেষে কি আলো থাকবে? এসব বোধহয় আমাদের সিলেবাসে ছিলো না !


সিলেবাসে কী ছিলো তবে? ছিলো একটা রঙচটা নাইলনের বাজারের থলে – আজ-ও সেটা উল্টোলেই একটা দুটো পেয়াঁজের খোসা কোত্থেকে ঠিক বেরিয়ে পড়বে, সেইরকম কতগুলো জিনিষ কেমন করে যেন আলগা হয়ে লেগে থাকে আমাদের সাথে, কবে এসেছিলো জানিনা, আবার কোনদিন ঝাড়তে গিয়ে বেরিয়েও যাবে, এই দু-একটা স্মৃতি সেই দু-একটা উড়ে যাওয়া কুটো !


ছোটবেলার কথা ভাবলেই মনে পড়ে লোডশেডিং – বিষ্যুদবার সাতটা পয়ঁতাল্লিশে শুরু হতো চিত্রহার,ঠিক আট-টায় কারেন্ট চলে যেতো ! অন্ধকার বারান্দায় দুই ভাই-বোন বসে গলা ছেড়ে গাইতাম, “আলো আমার আলো ওগো, আলো জীবন ভরা” ... লন্ঠণ জ্বালিয়ে দিয়ে যেতেন মা, আর আমাদের আকুল আলোর ডাকে কুপির শিস উঠতো উপর দিকে কেঁপে-কেঁপে, সে ডাক শুনে আলো-ও কি ক্রমে আসতো সে ছোট্ট ঘরে?

মনে নেই, তবে জল আসতো খুব ! মা বলতেন যেদিন আমি জন্মেছিলাম, সেদিন নাকি ওরকম ঝমঝম করে বৃষ্টি – শম্ভুকাকু দৌড়ে ট্যাক্সি ডেকে আনতে গেছেন, আর জমা জলের মধ্যে বাবা মা-কে চ্যাংদোলা করে নিয়ে চলেছেন আমাকে আনতে ... সেই থেকে বৃষ্টিকে চিনি আমি! বৃষ্টি হলেই আগে গলি, তারপর বাথরুম-পায়খানা, আস্তে আস্তে বারান্দা দিয়ে জল আসতো হুহু করে - আমাদের মাঝের ঘরের খাটের পায়ার নীচে দুটো থান ইঁট থাকতো সম্বচ্ছর, আমি ভাবতাম আরেকটু জল ঢুকলেই নিশ্চয়ই খাটে বসে ছিপ দিয়ে মাছ ধরা যাবে ! বাবা বলতো কেমন ছোটবেলায় গামছা দিয়ে মাছ ধরেছে বন্যার জলে (অবশ্যই সেসব আমার জন্মের বহু আগে),আর মা-কে দেখতাম সেই জলের মধ্যে হাঁটুর উপর কাপড় তুলে বালতি বালতি জল ঘরে তুলে রাখছে, আর গলায় তাঁর দীর্ঘদেহী ঈশ্বরের কোনো একটা বর্ষার গান ! দুপুর পড়লে ডাকতে আসতো বুবলাই, এ-পাড়া,ও-পাড়া ঘুরে এসে বলতাম কোথায় কত জল কদ্দূর ছাড়িয়েছে ! সেই জল-গান-গীতবিতানের সংসারে অভাব ছিলো, দৈন্য ছিলো না !

মুখচোরা লোক ছিলাম, এবং ক্যাবলা-ও ! যে ইস্কুলে পড়তাম তার নাম বরাহনগর মিশন, তার নামকরণের সার্থকতা বলে রচনা এলে লিখতাম, যে আমার জলের বোতলের ঢাকনা খুলে ফুটবল খেলতো বন্ধুরা, চাইলে মার জুটতো কপালে ! এক-একদিন মেরে আবার আমার নামে নালিশ, এবং ফল, আবার মার ! ক্লাসে সবাই হাসছে, ওর-ই মধ্যে দু-একজনকে দেখতাম করুণা-অনুকম্পা নিয়ে দেখছে আমার দিকে ! যেভাবে মানুষ দূর থেকে বিচ্ছেদ দেখে, অসুখ দেখে ... আমার ডাকনাম-ও ছিলো “ভোমরা পাঁঠা” – সে-ও সার্থক, সত্যি !

একদিন দুম করে সব পালটে গেলো, কেউ হয়তো গল্পের প্লট ভুলে গিয়ে অন্য কিছু একটা লিখতে শুরু করে দিয়েছিলো কে জানে? যে ছেলেটা ভয় পেতো ইস্কুলের  বাস দেখলে, সেই গোটা দু-বছর কামাই না করে রোজ হাজিরা দিয়েছে, তার বন্ধুদের সাথে একটা দিন-ও হারাতে চায় না বলে ! হেডস্যারের বেত পিঠে ভেঙেছে তার, সে    তবুও মারের মুখে নাম বলে দেয়নি তার বন্ধুদের ...
সেই বন্ধুরাই চিনিয়েছে লুকোনো আগুন – ছুটির বৈঠকের মাঠে, একটা ফ্লেক তখন এক-টাকা, এক-একদিন সিঁথির মোড় থেকে অটো না ধরে হেঁটে চলে যেতাম, আর ফেরার পথে হাঁস-পদ্ম-আঁকা ব্যাজ-টা পকেটে লুকিয়ে ঢুকে যেতাম সরু সরু শেষ না হওয়া গলিতে ... সেইভাবেই একদিন প্রেম চিনলাম, কবিতা চিনলাম ! সদ্য বিকেলের আড় ভাঙার সময় গলিতে-গলিতে ফিসফাস, হয়তো কোচিং ক্লাসের পথ ভুল করলো একটা সাইকেল! আমার সাইকেল ছিলো না, শেষের কবিতা ছিলো ...  অবশ্য সেসব কবিতার দিন নয় !

এসব খেলনা আগুন একসময় নিভে যায়, হয়তো চাপা থাকেও বা, গভীর অসুখের মতন, কে জানে !
ইস্কুল আর কোচিং শেষ হয়ে গেলো একদিন, নতুন ঠিকানা হয়ে গেলো কলকাতা – ১০৩ ! নরেন্দ্রপুরের ভোর হয় আলো ফোটার আগে, ধড়মড়িয়ে ঘুম ভেঙে উঠে দেখতাম আমার খাট-জোড়া বই, আমি দেওয়ালে পা-তুলে কি করে যেন দিব্যি ঘুমিয়ে গেছি ! অনি ছিলো আড়াআড়ি খাট-টায়, আর পাশের খাটে সৌম্য ! চোখ মেলেই দেখি সবাই দৌড়চ্ছে – সামনে জয়েন্ট (না এই জয়েন্ট সেই প্রসাদতূল্য জয়েন্ট না, যাঁর পেছনে দৌড়লে দোষ লাগে না) ...তার মধ্যে একদিন পরীক্ষার আগে অনি এসে বললো, “বুঝলি হাবু, জীবনে যদি দুটো অপশনের মধ্যে একটা হয় ঘুম দেওয়া, তা’লে সবসময় সেইটা টিক করিস’ ... বলে দুম করে নোটস, টেক্সট্‌, ডিপিসি, এস-এন-দে, সিমপ্লার, হার্ডার, আইআইটি, অ্যাংজাইটি এই তাবৎ বিশ্বচরাচরের উপর বিদ্রোহ ঘোষণা করে ঘুমিয়ে পড়লো অনি ... এখনো এক-একদিন ঘাড়ের উপর অ্যাটলাসের বোঝাটা বড়ো ভারী লাগে, তখন সেই অনির দেওয়া উপদেশ মনে করে ঘুমে ক্লিক করে দিই ...

ওহ, আরেকটা বিশাল ক্ষতি-ও এইসময় হলো, সে-ও অনির দোষ, বাবরের প্রার্থনা পড়লাম একদিন, আর একদিন পড়লাম টিউটোরিয়াল কবিতাটাও ... এক-একদিন স্বপ্নে দেখতাম সেই গভীর অসুখের মতন আগুনগুলো ফিরে এসেছে আমার গাছ-ঢাকা বারান্দায়, আর তাদের আমি ছোট্ট চিঠিতে লিখে দিচ্ছি, “যতটুকু দেখে গেলে ততটুকু নয়, ভালোবাসা থেমে আছে, আমার-ও আমূল অন্ধকারে” ...

আমূল অন্ধকার দেখেছি দু-চোখ ভরে, আই-এস-আই-তে ! হয়তো আলো দেখেছি তার থেকেও কিছু বেশী ... একদিন রাত্রে জেগে উঠে দেখলাম দিব্যি পদ্মপানার মতো পুকুরের জলে ভাসছি, পাশে যেটা পচা নারকেল মনে হচ্ছে সেটা আরেক বন্ধুর টাক-মাথা, পাড়ে দাঁড়িয়ে দারোয়ান-রা হল্লা করছে ... সেই পুকুরের পাড়েই একরাতে একজনকে মনে হয়েছিলো দুর্বোধ্য একটা স্বপ্ন ... পরের দিন তার সাথে সারা রাত তাড়া করেও একফালি চাঁদকে ধরতে পারিনি আমরা ... সে দুম করে একদিন চলে গেলো (সবাই যেমন যায়), সেদিন জানলাম প্রেম অনেকটা ভূতের মতন ... আছে বলে বিশ্বাস হয়না, কিন্তু অন্ধকারে চেনা রাস্তায় তাও একা হাঁটতে ভয় হয় ...

তারপর?


তারপরের কথা ভাবতে গেলে স্মৃতি বিদ্রোহ করে উঠছে - হুহু করে অনেক-কিছু যেন ভূতগ্রস্ত মানুষের মতো দৌড়ে চলে যাচ্ছে, তাঁদের আমার কথা শোনার সময় নেই ! অর্ধেক পৃথিবী দূরে স্বেচ্ছায় চলে এলাম একদিন, পড়তে না পালাতে জানি না ... হয়তো সেই অবুঝ বয়স বুঝতো না এসব জটিল হিসেব !

এক বর্ষার দিনে শুধু বাড়ি ফিরতে গিয়ে দেখি সেই ইঁটগুলো আর নেই -- গলির মধ্যে জল পাড়িয়ে ঢুকতে গিয়ে কেডস ভিজে যাবে বলে এক শ্রাবণে ভিজে ভিজে বাবা যে ইঁটগুলো পেতে রেখেছিলেন আমার আজন্ম বর্ষাকালে ... সেই প্রকান্ড মহীরুহ তার ডালপালা, তার শেকড়, তার কোটরে বাস করা তক্ষক, তার বর্ষার জলে পাতা ইঁট – সব নিয়ে একদিন চলে গেছেন কোনো একটা দৃশ্যের ওপারে ...
বাবা যেদিন চলে গেলেন, সেইদিন-টা মাঝে মাঝে ফিরে আসে ... এক সপ্তাহ পরে বিয়ে, সকালে অনেক-কে নতুন খোলা ইমেল-আইডি থেকে জানিয়েছি সে খবর ! দরজায় দরজায় শিকলি টানাচ্ছি, ‘এসো সুসংবাদ এসো’ ... অসুস্থ বাবা হুইলচেয়ার থেকে পাড়ার প্রদ্যুম্ন-কাকুকে ডেকে বলছেন, “উনিশে আসিস !” এমন সময় কে যেন এসে একটা বিরাট কালো যবনিকা টেনে দিলো সেই নাটকের উপর, চুপিচুপি অডিয়েন্স-কে ডেকে বলে দিলো, সরি এটা আসলে ট্রাজেডি ... এরপরের গান গুলো অন্ধকারের গান, তবে হাততালি দিতে মানা নেই  ...

অথবা আলো, চোখ-ধাঁধানো চুল্লির শিখা, একটা কমলা রঙের আগুনের গোলা দেখেছিলাম সেদিন, বিশাল তার আকার, পাক খেতে খেতে শুন্যে উঠে যাচ্ছে মায়ের কপাল থেকে, “দিবি সূর্যসহস্রস্য ভবেদ্যুগপদুত্থিতা” ...

সেই অসহ্য আলো-সেই অবিনাশী অন্ধকারের দিনে আমার পাশে একজন ছিলো, বন্ধুর মতন ! গভীর খাদের পাশে লতাগুল্মের মতন একটা ঠিকানা, জ্বরের কপালে একটা ঠান্ডা হাত ... আগুনের চারদিকে প্রদক্ষিণ আমাদের আর হয়ে ওঠেনি, কিন্তু সে অদাহ্য-অক্লেদ্য মঙ্গলময় আগুন যে আমাদের ঘিরে থেকেছে তা বুঝেছি জীবন দিয়ে !

সেই অবুঝ, উচ্ছ্বল, জেদী মেয়েটি এখনো আছে এই ধ্বংসস্তুপের পাশে, আর আছে একটা ছোট্ট কুকুর-ছানা, সে গভীর রাত্রে আমাদের মাঝখানে এসে নাক গুঁজে শুয়ে পড়ে ...তখন চোখ বুজলে মনে হয় আমার দেশে বিকেল নামছে, আর একটা অল্প ঠান্ডা হাওয়া দিচ্ছে থেকে থেকে, কাছেই কোথাও বৃষ্টি হচ্ছে বুঝতে পারি !

আমাদের এক জোড়া দগ্ধ চোখ সেই রাত্রিনদীর অন্ধকারে তখন বৃষ্টির অপেক্ষা করতে থাকে !

উঁচু-নিচু জ্যোৎস্না


এইসব অবসন্ন, স্বপ্নতাড়িত দিনরাতগুলোয় হঠাৎ হঠাৎ মনে হয় বোবা হয়ে যাচ্ছি, তখন ইচ্ছে করে চিৎকার করতে, বা কম্বল গায়ে হুট করে বেরিয়ে যেতে খোলা মাঠে শিশিরের তলায় ... যেখানে কোনো এক পার্কের কোণে একচিলতে বারোয়ারী আগুন জ্বলছে, আর একজন লোক সেই নিশুতি রাতে শুকনো পাতার স্তুপে একটা চিঠি খুঁজছে খালি
এইসব রাত্রে অবিকল শুনতে পাই, রান্নাঘর থেকে গানের কলি ভেসে আসছে (সুরটা লাগছে ঠিক-ই, কিন্তু কথাগুলো শেখা হয়নি এখনো), সেইসব হলুদ-মাখা আঁচল আর সিগারেটের গন্ধ বড্ডো দুঃসহ লাগে সেসময় ...
তখন আমি ভাস্কর চক্রবর্তীর কাছে গিয়ে বসি ... মনে হয় যেন এই পরিত্যক্ত রাত্রির মতো তার কবিতা দুই বিশাল ডানা দিয়ে ঢেকে রাখছে আমাকে। যেন প্রবল বৃষ্টির রাতে ক্ষয়ে যেতে যেতে, গলে যেতে যেতে ঘরে ফেরা হবে কিনা জানিনা আমি, অথচ বহুদূরে যেন চেনা একটা মোমবাতির হলদে আলো দেখতে পাই ...

“তোমাকে অজ্ঞাত দেশে দেখি প্রায়
একটি নির্জন ছাতে দাঁড়িয়ে রয়েছো ।
সব কথা
শেষ হয়ে গেছে ।
আর কোনো কথা নেই – স্বপ্ন নেই –
শুধু কিছু দিন আর রাত্রি পড়ে আছে।“

ভাস্কর লিখেছিলেন ‘শেষ নেই এমন এক পাহাড়ে অনবরত চড়তে থাকার সঙ্গে কবিতা লেখার তুলনা করা যায় কিছুটা’...
সেই বোবাপাহাড়ের ঠিক তলায় দাঁড়িয়ে আমি, সিসিফাসের উত্তরাধিকার বহন করে চলেছি যেন, তবু বিশ্বাস করি এরপরের স্টপেই আলো-ভরা উপত্যকা আসছে একটা, আর অনেক চিঠি হাতে সেখানে আমার জন্য নিশ্চয়ই একটা আস্ত ডাকবাক্স বানিয়ে রেখেছেন একজন রুপোলি চুলের নিঃসঙ্গ মানুষ।