Thursday, November 23, 2017

না-মানুষী ছানাপোনা



ঈশ্বরের ন-লক্ষ কোটি নামের মতন আমারও ন-লক্ষ কোটি অ্যাকাউন্ট আর কাছাকাছি সংখ্যার পাসওয়ার্ড আছে, তো কাল সকালে সেরকম একটা গোলমেলে পাসওয়ার্ড খুঁড়ে বের করতে গিয়ে দেখি সিক্রেট কোশ্চেন উত্তর দিতে বলছে, মনে মনে ঘাবড়ে গেলাম, গোপন কথাটি কি রয়েছে গোপনে? তারপর দেখলাম প্রশ্নটা খুব-ই সহজ, 'তোমার প্রথম পুষ্যির নাম কি?' ... চট করে উত্তর দিলাম, আর দিতে দিতে মনে অনেক অনেক তুলতুলে নরম স্মৃতি ভেসে উঠলো - এই লেখাটা সেই তুলতুলেদের জন্য ! 

... ভজার গল্প ...

আমার প্রথম পুষ্যি, একটি মিষ্টি মেনি বেড়াল এবং আমার এক খুব কাছের বন্ধুর ডাকনাম এক-ই, 'ভজা' ! ভজা-কে আমার পাশের বাড়ির দুই দাদা কুড়িয়ে এনেছিলো কাক-চিলের ঠোক্কর খাওয়ার হাত থেকে - তখন অতো হুলো-মেনি জ্ঞান হয়নি, ওইটুকু ছোট্ট, চোখ না মেলা, প্রায় মুমুর্ষু ছানাটাকে কিছু একটা ডাকতে হয়, তাই নাম দেওয়া হলো 'ভজা' ! দিন কয়েকের মধ্যে দেখা গেলো, রোজ চেলপার্ক কালির ড্রপারে করে ফোঁটা ফোঁটা দুধ খাইয়ে খাইয়ে ভজা অল্প অল্প দৌড়ে বেড়াচ্ছে, আর ঘর ঝাঁট দেওয়ার সময় এসে লাফিয়ে ফুলঝাড়ুর ফুল-টিকে প্রবল বিক্রমে আক্রমণ করছে ! আমি এদিক ভজার পুরুষকার দেখে একটা হাল্কা গর্ব অনুভব করবো কিনা ভাবছি, একদিন মা বললেন, এটা তো মেনি, ওর নাম ভজা কেনো?

সে প্রশ্নের উত্তর আর হয়নি, আসলে সেই অপাপবিদ্ধ বয়সে অতো হুলো-মেনি বুঝতাম না ! বোঝার পর কিছু সাঙ্ঘাতিক নাম ভেবেছিলাম, বিন্ধ্যবাসিনী কিম্বা কুসুমকুমারী ... কিন্তু ভজা, ভজা-ই রয়ে গেলো ! আমাদের বাড়িতে চিরকাল-ই প্রচুর বেড়াল, যেকোনো সময়ে অন্ধকার কোণে বা বেঞ্চির তলায় হাত ঢোকালেই তা দিব্যি টের পাওয়া যায় ! তবে ওই মধ্যযুগের বাংলার মতন, মাৎস্যন্যায় চলছিলো - ভজা এসে অচিরেই ঝগড়া-ঝাঁটি-হুলুস্থুলু করে নিজের রাজপাট স্থাপন করে বসলো।

তিনি ঘুমোতেন আমার খাটে, ঘুম থেকে উঠে আড়মোড়া ভেঙে সোজা চলে যেতেন বাবার চেম্বারের একটা সিংহাসন দখল করতে, যতক্ষণ না অনেক পেশেন্ট এসে তাকে গদিচ্যুত করছে - সেখান থেকে মায়ের রান্নাঘরে খানিক ম্যাওম্যাও করে, অল্প আদর ও ব্রেকফাস্ট খেয়ে আবার ঘুম-লাঞ্চ-ঘুম-ডিনার-ঘুম আর রাত্রে অল্প এদিক-ওদিক ঘুরে ইন্টুমিন্টু !

এখানে বলে রাখি, বেড়ালদের সমাজ বড়োই প্রগতিশীল, তেনারা মুক্ত সম্পর্ক, এবং ততোধিক মুক্ত যৌনতায় বিশ্বাসী, কিন্তু আনুগত্যও জানে ! আমাদের মধ্যবিত্ত মোনোগ্যামিস্ট সমাজে থেকেও সেটা যে পালটায়নি, এজন্য তাদের বিশেষ সাধুবাদ প্রাপ্য ...

যা হোক, কয়েক বছর পরের কথা, একদিন সকালে ঘুম ভাঙলো মায়ের ফোনে, শুনলাম ভজার নাকি ছোট্ট-ছোট্ট কয়েকটা ছানা হয়েছে ! আমি হোস্টেল ঘুরে যাকেই বলছি, ভজার বাচ্চা হয়েছে, সেই দেখি কিঞ্চিৎ সন্দেহের চোখে তাকায়, তারপর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে কেটে পড়ে ... শেষমেশ এক জুনিয়র বললো, যাই তাহলে একটা ট্রিট চেয়ে আসি গে, বুঝলাম 'নেমসেক' হওয়ার বিড়ম্বনা একা গোগোল-ই ভোগ করেনি ...

ভজা আর নেই, অনেকদিন আগে বেড়ালদের স্বর্গে চলে গেছে (অবিশ্যি মানুষ ছাড়া আর কোনো প্রাণীর নরক হয় বলে আমি বিশ্বাস করিনা) ... তবে ভজার বংশধরদের এখনো দেখতে পাবেন আমাদের একশো আটাত্তর নম্বরে গেলে ! তবে তাদের নামগুলো অনেক ভেবেচিন্তে রাখা, ন্যাড়া এবং বেলতলা আর কি? ভজার ছেলের নাম ছিলো চ্যাটকা, আমাদের আদরে সে বেশ সুন্দর বড়োসড়ো হয়েছিলো - চ্যাটকার সাইজ দেখলে ছোটো বাচ্চারা অনেক সময় জিগ্যেস করতো ও-কি সত্যি বিড়াল? চ্যাটকার টিন-এজ পেরোতে না পেরোতেই এক গার্লফ্রেণ্ড হয়, সে-ও চ্যাটকার সাথে এসে আমাদের বাড়িতেই আশ্রয় নেয়, তার নাম বান্ধবী ... চ্যাটকা-বান্ধবী সুখী দম্পতির মতো থাকতো -  তাদের যথাসময়ে দুই ছেলে হয়, হলদিরাম এবং জয়পতাকা ! হলদিরামের নাম ব্যাখ্যা করার দরকার নেই, জয়পতাকার নাম তার চির-উন্নত নেজটিকে দেখেই রাখা হয়েছিলো ...

হলদিরাম ও জয়পতাকা 

এখন তারাও অনেক বড়ো, তাদের-ও ছানারা এখন দাপিয়ে বেড়াচ্ছে আমাদের উঠোনে, কলতলায়, রান্নাঘরে, তবে দুঃখের কথা তাদের নাম রাখার লোক আর সে বাড়িতে নেই ...

... ঘঞ্চুর গল্প ...

আমি তখন আই-এস-আইতে পড়ি, সম্ভবতঃ ফাইনাল ইয়ার, একদিন বাবুদার দোকানে চা খেতে গিয়ে দেখি একটা অতিছোটো বেড়াল জিএলটি রোডের ধারে কুঁকড়ে শুয়ে আছে, কাকেরা গোল করে ঘিরে ধরে আছে তাকে ... দেখে ভারি মায়া হলো, লক্ষ্মণদার দোকান থেকে একটা বড়োসড়ো পেপ্সির ক্রেট নিয়ে তাতে ছানাকে পুরে হোস্টেলের ঘরে নিয়ে এলাম, সঙ্গে সঙ্গে জুটে গেলো একদল জুনিয়র, অনীশ, জেজেয়ার ... মুহুর্তের মধ্যে দুধ, মিল্ক পাউডার, ড্রপার নিয়ে সবাই যারপরনাই চেষ্টা করতে লাগলো তাকে কোনোরকমে শ্রুশুষা করে বাঁচাতে  ...

কিন্তু ভবি ভোলবার নয়, সে বেল্লিছানা এক-পা এক-পা হেঁটে দুধের বাটির কাছে যায়, গন্ধ শোঁকে আর পালায় ... জেজে বললো এক গামলা দুধে একটা ফোঁটা হুইস্কি ফেলতে, পোষা হলেই কি আর হেরিডিটি বলে কিছু নেই? আমিও অবাক হয়ে দেখলাম, সেই খুদে বেড়াল একটা ফোঁটার ম্যাজিকে এক গামলা মুহুর্তে নিঃশেষ করে ফেললে ... আমার নতুন ছানার নাম রাখলাম ঘঞ্চু !

ঘঞ্চু ও আমি 

ঘঞ্চুর অ্যাক্রোব্যাটিক্স 


যারা পশুপাখি পুষেছেন, তাঁরা জানেন পশুপ্রেমিক থেকে প্রেমিক হওয়ার রাস্তাটি একটি আশ্চর্য শর্টকাট - কাজেই অচিরেই ঘঞ্চু গোটা হোস্টেলের মোস্ট ওয়ান্টেড সেলিব্রিটি হয়ে গেলো ! এমন সব লোকজন যাঁদের সাথে গত চার বছরে কথা হয়নি, আগামি চল্লিশেও হওয়ার আশঙ্কা নেই, যাঁরা জীবনের ওই কয়েকটি বসন্তমাস ছাড়া কোনোদিন জান্তব ভালোবাসায় উদ্বেল হননি - তারাঁও, বা বলা ভালো তাঁরাই, অজ্ঞাত* এক টানে আমার ঘরে এসে ঘাঁটি গাড়লেন ... আর আমি প্রাণ হাতে করে ঘাঁটি গাড়লাম  তাপসদার চায়ের দোকানে !

সেই এক সময় ছিলো বটে, সকালবেলা ক্লাসে যাওয়ার আগে আমন্ত্রণ নামে বনহুগলীর পাইস হোটেল থেকে বাবলুদা দিতো দু-পিস হাফ-ভাজা ভালো মাছের টুকরো, ঘঞ্চুর লাঞ্চ-ডিনারের জন্য ... এক জুনিয়র ছিলো প্রিয়ম, সে বাড়ি থেকে একদিন নিয়ে এলো এক বড়ো বয়াম ভর্তি কেক-বিস্কুটের টুকরো ! আর একটা স্পঞ্জের খেলনা বেড়াল, ঘঞ্চুর গুহায় রাখার জন্য !!

ঘঞ্চু আর নেই, কেন নেই সে-ও এক যন্ত্রণার গল্প, যা করার ক্ষমতা নেই ... তবে ওর স্মৃতিটুকু রয়ে গেছে, এই দু-একটা ছবি, সেই স্পঞ্জের খেলনা, আমার পুরনো ডায়রির ছেঁড়া স্পঞ্জের কভারের মধ্যে ...

আর যা রয়ে গেছে তার নাম বন্ধুতা !

ঘঞ্চুর অল্প বয়সে রাস্তায় কিছুদিন কাটিয়ে অনেক অনেক কৃমি হয়েছিলো ! প্রত্যেক সপ্তাহে ওকে একটা কাঁথায় জড়িয়ে ছুটতাম সিঁথির মোড়ের কাছে এক ভেটেরিনারি ডাক্তারের চেম্বারে ... একটা দিন, অপারেশানের তখনও দেরি ... হঠাৎ একদিন সন্ধ্যে থেকে ঘঞ্চুর একের পর এক ফিট হতে আরম্ভ হলো, দেখলাম চোখের সামনে নেতিয়ে পড়লো আমার হাতের উপর, যেন আর্ধেক ঘুম, আর্ধেক জাগা অবস্থায় ঘঞ্চু প্রাণপণ লড়ে যাচ্ছে একফোঁটা জীবনীশক্তি দিয়ে ... সেই সারা-রাত ঘুমোইনি আমি, খাটের পাশে বসেছিলাম এই বিশ্বাসে যে আমার চোখের সামনে কিছুতেই চলে যাবে না ...

ভোর-রাত্রে যখন চোখ লেগে এসেছে, হঠাৎ শুনি দরজায় কড়া নাড়া, আমার বন্ধু শ্রীরামপুর থেকে সেই ভোরে যখন বাস চলে না, নৌকো ছাড়ে না ... সাইকেল নিয়ে এসেছে ঘঞ্চুকে নিয়ে ডাক্তারের কাছে যাবে বলে !

একটু, একটু করে ওষুধ দিয়ে, একটা অপারেশানের পর সেযাত্রা ঘঞ্চু বেঁচে যায় - আর ২০০৮ সালে আমাদের  গোটা ব্যাচের সাথে একটা বেড়াল-ও রীতিমত হাতে-বানানো উপহার আর কার্ড-শুদ্ধু ফেয়ার-ওয়েল পায়, আই-এস-আই-এর ইতিহাসে না-মানুষের আলতো আঁচড় বোধকরি সেই প্রথম !


.. মেচকুবাবুর গল্প  .. 


আমি যখন বেশ ছোটো ছিলাম, একদিন বাবাকে অফিস থেকে ফেরার সময় ঠিক বাড়ির সামনের গলিতে একটা কুকুর কামড়ে দেয় ! সেটা দেখে কিনা ঠিক জানিনা, তবে সেই থেকে আমার কুকুর দেখলেই প্রচন্ড ভয় করতো, মানে হাত-পা পেটের মধ্যে সেঁধিয়ে যাওয়া ভয় ! ভালোবাসতাম কিন্তু তাও ভয় - প্রসঙ্গতঃ বলি, যাঁরা বলেন ভালোবাসা আর ভয় ডিসজয়েন্ট সেট, তাঁরা হয় সেট থিয়োরি জানেন না নইলে প্রেমে পড়েননি ঠিক করে !

যা হোক, অনেক অনেক বড়ো বয়েস অব্দি মা নয় বাবা কাউকে বলতাম  আমাকে গলির মুখটা অব্দি এগিয়ে দিয়ে আসতে ! অনেকদিন বাড়ি ফেরার সময় দেখতাম গলির মুখটায় কুকুর-দম্পতি ভাব-ভালোবাসা করছেন - সেদিন সাত পাড়া ঘুরে পেছনের এঁদো গলি টপকে বাড়ি দিরতাম যাতে ওদের কু-নজরে না পড়ি ! একবার মনে আছে তাঁদের একজনের তাড়া খেয়ে মুড়ি-চানাচুর-তেলেভাজা সব রাস্তায় ফেলে এইসান দৌড় দিয়েছিলাম যে পরের ক'দিন সেই খেয়ে পাড়ার নেড়িদের চেহারা ভালো হয়ে গেছিলো ! আমেরিকা এসে দেখলাম যাক আর যাই হোক, রাস্তায় নেড়ি তাড়া করার ভয় নেই, গলির মুখে গুলি খেলেও খেতে পারি কিন্তু কুকুরের কামড় নয় !

কিন্তু বিধি বাম, যে দিদির বাড়ি সু্যোগ পেলেই ছুটে যাই, তাঁর পুষ্যি এক এইয়া চকোলেট ল্যাব - সে বেচারি ভালোবাসার কাঙাল, কাউকে দেখলেই ভাবে এই তো আরেকটা মানুষ, অর্থাৎ আরেকটু আদর - আর বেচারা ভিতুর ডিম আমার জায়গা হয় ব্যাল্কনির ওপারে, কাঁচের আড়ালে !

ঠিক এই সময় আমাদের জীবনে একদিন এসে থ্যাপ পরে বসে পড়লো মেচকু, রাজা ম্যাক্সওয়েল চৌধুরী !

পার্ডুতে পড়ি দুজনেই তখন - একদিন আমার গিন্নি কাছের এক শেল্টার থেকে ফিরে বললেন, একটা খুব জাম্পি ডগি দেখে এসেছি, চল কাল আবার যাই ... আবার গেলাম, খুব ভয়ে আছি, একজন ভলান্টিয়ার এসে হাতে একটা লিশ দিয়ে বললেন, নাও হাঁটাও ... হাঁটতে শুরু করতেই বুঝলাম, এইটুকু ছোট্ট একটা ছানাকে ভয় পাওয়া অসম্ভব, আর তার থেকেও বড়ো কথা, বেচারা আমার থেকেও ভীতু, আর আমার অকারণ ভয়ের থেকেও অনেক অনেক বড়ো ভয় সে রোজ দেখে, শেল্টারের ছোট্ট খাঁচায় ! সেদিন হাঁটা শেষ করে সেই ছানাটিকে আর ফেরত দিতে পারিনি, দিলে দুঃখে সেদিন-ই মারা যেতাম ... ২০১২-র পয়লা সেপ্টেম্বর আমাদের সাথে হইহই করে চলে এলো ম্যাক্স !


খতর-নাক?


ম্যাক্সের নাম ম্যাক্স-ই ছিলো, আর কিছুই জানিনা আমরা - কে ওকে কোথায় ফেলে পালিয়ে গেছিলো, কত-ই বা বয়েস, কাদের সাথে বড়ো হয়েছে, কিছুই না ! তাতে অবশ্য কি-ই বা যায় আসে? ম্যাক্স এখন পুরোপুরি বাঙালি একটি লেদু কুকুর ! সকালে হাই তুলে আড়মোড়া ভেঙে উঠে বাইরে অল্প হাঁটে, বাড়ি ফিরে সোফায় বসে সারাদিন বাইরে দেখে আর বিভিন্ন সুরে রাগ-রাগিনী গায় ! আর মাঝে মাঝে এসে ঝাঁপিয়ে উঠে পড়ে কোলে, তার আদর চাই যখন, বাকি পৃথিবী অল্প হল্ট করে দাঁড়িয়ে যায় ...

সূর্য তাকেই দেখতে চায় 

আমি চেয়ে চেয়ে দেখি সারাদিন



এই লেখা যখন লিখছি, ম্যাক্স আমার পাশে সোফায় গোল হয়ে শুয়ে নাক ডাকাচ্ছে ... এখন থ্যাঙ্কসগিভিং-এর ছুটি, আমরাও সারাদিন বাড়ি, আজ খুব আনন্দ !

পাঁচ-বছর হয়ে গেলো, এখনও যখন সকালে অফিস যাই, কোথাও একটা একটু কষ্ট হয় বাড়িতে রেখে যেতে, আর যখন-ই ফিরি, সে পাঁচ মিনিট হোক বা পাঁচ ঘন্টা, দৌড়ে এসে লাফায় যখন, সত্যি মনে হয় আমরা মানুষরা, কুকুরদের ডিজার্ভ-ই করি না, এই স্বার্থশূন্য ভালোবাসা পাওয়ার যোগ্যতা আমাদের নেই ...

মেচকুবাবুর মানুষ বন্ধু অজস্র, আমাদের সব বন্ধু-বান্ধব-জুনিয়র এমনকি আত্মীয়রাও, সে গুনে শেষ করা যায় না এমন ! আর আমি-ই প্রথম হলেও, আমি-ই শেষ ব্যাক্তি নই যে মেচকুর প্রেমে পড়ে কুকুরের ভয় কাটিয়েছে, সে লিস্টিও বেশ লম্বা !

তবে ওর কুকুর বন্ধু মাত্র একটা কি দুটোই ! স্বজাতিদের একটুও সহ্য করতে পারে না ম্যাক্স - তাদের সাথে আলাপ করার থেকে তাদের খেয়ে ডিনার করার ইচ্ছেই কিঞ্চিৎ অধিক মনে হয় আমাদের ! ওর একমাত্র বন্ধু, মাটলি-ও এখন অনেক দূরে থাকে, বচ্ছরে একবার কি দুবার বড়োজোর দেখা হয় - সে আরেক ভারী মিষ্টি কুকুর ! তাঁর জীবনের ফিলোসফি মেচকুর ঠিক উলটো, কুকুর-মানুষ-বাচ্চা মানুষ সবাইকেই সে ভালোবাসা বিলিয়ে বেড়ায় !মাটলি মানুষ হলে বৈষ্ণব হতো, মেচকু শুধুই স্নব !

এই পারে আমি আর ওই পারে তুমি

মন দিলো না বঁধু 

একসময় এই নিয়ে ভারী বিব্রত থাকতাম, তারপর একদিন নিজেদের-ই মনে হলো, যা করছে বেশ করছে ! আমার চারপাশে যদি এই সামাজিক ভদ্রতার মশারিটা না টাঙ্গানো থাকতো, আমি-ই যে কত লোককে আঁচড়ে-কামড়ে-চোদ্দ-গুষ্টি-উদ্ধার-করে দিয়ে আসতাম, তার কি কোনো ঠিক আছে?



Saturday, October 21, 2017

মিমিক্রি


স্টেজে ওঠার সময় একবার টুক করে পকেট থেকে একটা লজেন্স বের করে মুখে দিলো সুমন, একটা জলের বোতল সঙ্গে থাকে, তা-ও গলাটা আর্দ্র না থাকলে পারফরম্যান্সে তার ছাপ টের পাওয়া যায়। এটা অবিশ্যি একটা দক্ষিণ কলকাতার মাঝারি সাইজের একটা বার - শুক্রবার সন্ধ্যে তাই এই সন্ধ্যে সাতটাতেই বেশ লোক হয়েছে। অবশ্য সবাই যে সুমনের স্ট্যান্ড-আপ কমেডির ফার্স্ট শো শুনতে এসেছে তা নয়, অনেকেই দূরে দূরে বসেছে, আর্ধেক উৎসাহ আর আর্ধেক বিরক্তি নিয়ে - তবে স্টেজের সামনে বেশ কয়েকটা চেনামুখ, পুরনো বন্ধুবান্ধব - অফিস কলিগ, উৎসুক হয়ে অপেক্ষা করছে।

সত্যি বলতে এই জনা-কয়েক ফ্যানদের উপর ভরসা করেই পাকা চাকরিটা দুম করে ছেড়ে দেওয়ার কথা ভাবছে সুমন । তার সেন্স অব হিউমার মোটামুটি ভালোই, সামান্য কথাকে ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে 'পান' করার অভ্যেসটাও এক্কেবারে ছোট্টবেলার থেকেই আছে, তবে তার আসল দক্ষতা লোকের গলা এবং আদব-কায়দা অর্থাৎ ম্যানারিজম নকল করা। ইস্কুল-কলেজে পড়ার সময় টিফিন বা ক্লাসের মাঝখানে বন্ধুরা ঘিরে ধরতো, 'একবার এস্কেজি-টু করে দ্যাখা, একবার হেডু যে মর্নিং প্রেয়ারে লেকচারটা দেয় সেটা কর !' ... কলেজে বেঞ্চের উপর বসেও একের পর এক প্রোফেসারদের নকল করে দেখাতো, একজন 'স'-কে 'শ'-বলতেন, একজন ছিলেন গায়ক, তার গম্ভীর ব্যারিটোন নকল করে 'আলফা-বেইটা-গ্যামা' বললেই হেসে গড়িয়ে পড়তো বন্ধুরা ... একটু নকল, আর একটু কল্পনা করে আজগুবি কিছু কথা জুড়ে দিলেই হলো ! সমস্ত পার্টির মধ্যমণি হয়ে থাকতে, আর লোককে এই প্রাণখোলা হাসি হাসাতে সে-ও কম উপভোগ করতো না ...

চাকরি ছেড়ে দেওয়ার আইডিয়াটাও এইভাবেই এলো ! মাস ছয়েক আগের কথা, অফিসের রিট্রিট হচ্ছে এক চা-বাগানের এস্টেটে ! শেষদিন খাওয়া-দাওয়ার পর সবাই ধরে বসলো, আজকে সুমনকে পারফর্ম করতেই হবে ! অল্প নেশা করেছিলো বলে হয়তো ইনহিবিশন-টাও কম ছিলো সেদিন, সুমন-ও রাজি হয়ে গেলো এককথায় ! নকল করার লোক-ও হাতের গোড়ায়, বস ছিলেন এক গোমড়া-মুখো ওড়িয়া লোক, মিস্টার উপাধ্যায় - বিদেশে বছরকয়েক থাকার ফলে তার উচ্চারণে আর হাবেভাবে স্পষ্ট আমেরিকান ছাপ .. সুমনের তার উপর অল্প রাগ-ও যে ছিলো না তা নয় ! ঘন্টাখানেক চলার পর যখন শেষ করলো, সেই বস এসে জড়িয়ে ধরে বললেন, অনেকদিন পর পেটফাটা হাসি হেসেছেন তিনি !

আজকে সুমন নকল করবে ঠিক করেছে তিনজন মোটামুটি নাম-করা সেলিব্রিটির, একজন বয়স্ক পলিটিশিয়ান, একজন হিন্দি সিনেমার হিরো আর একজন নামকরা খেলোয়াড় !

নকল করতে গেলে যে খুব ভালো পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা লাগে তা সুমনের আছে, সহজেই ধরে ফেলতে পারে কার বৈশিষ্ট্য কোনটা, এই যেমন পলিটিশিয়ান-টি বাংলা টোনে আশ্চর্য ইংরেজি বলেন, আর থেকে 'ইয়ে','মানে','ধ্যাত্তেরি' ঢুকে যায় স্পিচে ... আর খেলোয়াড়টির-ও তাই, এই কেরিয়ারের মধ্যগগনেও তার গলায় কৈশোর যায়নি, আর টিভি খুললেই যার বিজ্ঞাপন দেখা যায়, তার মুখে সংলাপ বসানো কি এমন কাজ ? সবথেকে সোজা মনে হয় হিন্দি সিনেমার হিরোটিকে নকল করতে, তাঁর পিলে-চমকানো ডায়লগবাজি আর কৃত্রিম-ব্যারিটোন গলা বোধহয় সুমন-ও আর কোত্থাও শোনেনি !

ফার্স্ট শোয়েই জ্যাকপট ! এতো মুহুর্মুহু হাততালি আর হাসির হররা কখনো শোনেনি আগে ! এ এক অদ্ভুত উত্তেজনা - তিনের জায়গায় চা-পাঁচটা ক্যারিকেচার করে দেখালো সুমন, একবার প্রাইম মিনিস্টারের সম্ভাষণ-ও নকল করতে ছাড়লো না - শেষ করার সময় দেখলো লোকে নিজের টেবিল ছেড়ে স্টেজের পাশে গোল হয়ে দাঁড়িয়ে, জীবনে প্রথমবার স্ট্যান্ডিং ওভেশান নিতে নিতে সুমন ঠিক করলো চাকরিটা ছেড়েই দেবে, এটাই আজ থেকে তাঁর জীবন ও জীবিকা !

-----------------

শহরের আশেপাশের বার অনেক, স্ট্যান্ড আপ কমেডির বাজার-ও বেশ উঠতির দিকে এখন, তাই সুমনের প্রথম প্রথম কাজ পেতে সমস্যাই হলো না।  আজকাল সে একটা নোটবুক নিয়ে ঘোরে, নতুন কোনো লাইন মাথায় এলে লিখে রাখে, রাস্তাঘাটে ইন্টারেস্টিং ক্যারেকটার দেখলেও নোট করে নেয় আর ঘন্টার পর ঘন্টা এ-চ্যানেল ও-চ্যানেল ঘুরিয়ে টিভি দ্যাখে, সারাক্ষণ-ই কেউ না কেউ কথা বলছেন ... কার ক্যারিকেচার করা যায় নোট নিতে থাকে সুমন !

অল্প অল্প নাম হলেও সুমনের একটা দুঃখ রয়েই গেছে, ওই শুক্রবারের সন্ধ্যের বারের বাইরে তাকে কেউ বড়ো একটা চেনে না ! কাফে-তে গিয়ে বসলে কেউ অটোগ্রাফ চায় না, রাস্তাঘাটে পাবলিক ট্রান্সপোর্টেও কেউ তাকে দেখে ফিসফিস করে সঙ্গীকে বলেনা, 'ঐ লোকটাকে চিনিস?'। সুমনের বদ্ধমূল ধারণা এই মিলেনিয়ামে সত্যি বিখ্যাত হতে গেলে টিভিতে মুখ দেখানো বা ইন্টারনেটে ভাইরাল হওয়া ছাড়া উপায় নেই ...

সুযোগটাও এসে গেলো দিন কয়েকের মধ্যেই ! ইস্কুলের এক বন্ধু বিপ্লব আজকাল টেলিফিল্ম-টিল্ম করে হাত পাকাচ্ছে, সেই এক চ্যানেলের সাথে যোগাযোগ করিয়ে দিলো, ম্যানেজার বিপ্লবের মেসোমশাই, জয়দেব বর্মণ। চুক্তি হলো, সুমনের পারফর্ম্যান্স ইন্টারনেটের মাধ্যমে সম্প্রচার করবে তারা, সরাসরি বার থেকেই, আপাততঃ একটাই শোয়ের বায়না, পাবলিক খেলে আরো ভাবা যাবে ...

সময় এগিয়ে আসছে, সুমন-ও নতুন নতুন ক্যারিকেচার খুঁজছে, এক ঘন্টার শো - অতএব, অনেকগুলো চাই আর সবার জন্য ছোট্ট ছোট্ট গল্প ... এই শো-টার জন্য নতুন কিছু চাই-ই চাই, আর সেই এক-ই জোক, এক-ই ক্যারিকেচার করে চলবে না !

আইডিয়াটা এলো টিভির চ্যানেল ঘোরাতে ঘোরাতেই, হঠাৎ একটা চ্যানেল-এ এসে একটা অতিপরিচিত গলার আওয়াজ শুনে থমকে গেলো সুমন। এ তো সেই ছোটোবেলার বিখ্যাত ম্যাজিশিয়ান, তার কত শো দেখেছে মহাজাতি সদনে, এমনকি টিভিতেও বাচ্চা-বড়ো সবরকমের প্রোগ্রামে আসতেন তিনি। সুমনের মনে হতো সত্যি জাদু !  এই তাকে হাতে-পায়ে শেকল বেঁধে বাক্সবন্দি করে তাকে সাগরে ফেলে দেওয়া হচ্ছে, তিনি ঠিক কোথাথেকে অক্ষত শরীরে উদয় হচ্ছেন, একবার স্টেজে দেখেছে তাকে চোখে রুমাল বেঁধে দেওয়া, আর হাতে চক - দর্শকদের থেকে একজন উঠে একটা ব্ল্যাকবোর্ডে কিছু ফরমুলা লিখছে, আর পাশেই চোখ বাঁধা অবস্থাতেই যাদুকর মল্লিক অন্য ব্ল্যাকবোর্ডে হুবহু লিখে যাচ্ছেন সে-ই এক-ই ফর্মুলা ! সুমন-ও হাত তুলে ভলান্টিয়ার করেছিলো সেইদিন, খুব শক্ত একটা অ্যালজেব্রার ফর্মুলা লিখতে গিয়ে দেখলো, এ প্লাস বি হোল স্কোয়ার ছাড়া কিস্যু মাথায় আসছে না !

এখন অবশ্য মল্লিকের অনেক বয়েস, ম্যাজিক শো-ও সুমন শেষ কবে দেখেছে মনে নেই , এখন  কোনো একটা চ্যানেলে এসে তিনি তাঁর সেই অননুকরণীয় গলায় বলছেন, 'এই কলকাতা শহর থেকে দুষ্টু লোকগুলোকে সব ভ্যানিশ করে দেবো' ... সুমন শুনতে শুনতেই ঠিক করে ফেললো তাঁর নতুন ক্যারিকেচার -  এক ম্যাজিশিয়ান - যাঁর সব ম্যাজিক-ই ফেল করে !!

যথারীতি এবারের শো-ও খুব হিট, প্রত্যেকটা স্কেচের পরে সুমন-কে পাক্কা তিরিশ সেকেন্ড অপেক্ষা করতে হয়েছে  শুধু হাততালি থামাতে! শেষ হওয়ার পরে বাইরে বেরিয়ে এলো সুমন - একটা সিগারেট ধরাতে গিয়ে দেখলো পকেটে লাইটারটা নেই, অথচ এই একটু আগেই ...

'দেশলাই ভ্যানিশ?'
গলাটা শুনে চমকে গেলো সুমন, অনতিদূরে দাঁড়িয়ে আছেন যাদুকর মল্লিক, তার আঙ্গুলের ফাঁকেও একটা জ্বলন্ত সিগারেট ! এগিয়ে এসে সুমনের সিগারেট-টা ধরিয়ে দিতে দিতে বললেন,
'আপনার তো সেন্স অব হিউমার মন্দ না, গল্প বলার কায়দা-ও ভালো, তাহলে এই আমাদের মতন বৃদ্ধ, বাতিল লোকেদের ভেঙিয়ে পয়সা উপার্জন করতে হচ্ছে কেন?'
সুমন বলার চেষ্টা করলো, 'ইমিটেশান ইজ দ্য বেস্ট ফ্ল্যাটারি', মল্লিক কান করলেন না। হাতের সিগারেটটা পাশের নালায় নিক্ষেপ করে চলে যেতে যেতে বললেন, 'ভাঁড়ামি করে লোক হাসাচ্ছেন, হাসান, আমার আপত্তি করায় কিছু যায় আসে না, কাজটা কিন্তু তা-ও ভালো করলেন না' ।



সারা শরীর যেন লজ্জায় রাগে অবশ হয়ে এলো সুমনের, কোনো রকমে একটা ট্যাক্সি ডেকে বাড়ি ফিরে এলো যখন মনে হলো অল্প জ্বর এসে গেছে ইতিমধ্যে, একটা প্যারাসিটামল খেয়ে শুয়ে পড়তে পড়তে সে ঠিক করলো যাই হোক না কেনো, আর কোনোদিন ঐন্দ্রজালিক মল্লিকের ক্যারিকেচার নয়।

পরদিন ঘুম ভাঙলো জয়দেব-বাবুর ফোনে, সুমনের শোয়ের ভিডিও ইতিমধ্যে ভাইরাল হয়ে গেছে ! ইউটিউবে হাজার কুড়িবার লোকে দেখে ফেলেছে এই অল্প সময়ের মধ্যে ! সুমন ভাবলো একবার বলে দেখবে ভিডিও-টা সরিয়ে নেওয়ার কথা, তারপর ভাবলো হাতের তীর, মুখের কথা - একবার যা বেরিয়ে গেছে আর কি ফেরানো যায়?

পরের শোয়ের আগে আর-ও সপ্তাহ হয়েক সময় চেয়ে নিলো সুমন, জয়দেব-বাবু যদিও অধৈর্য্য হয়ে উঠেছেন ক্রমশঃ, কিন্তু সুমনকে নতুন ক্যারেকটার ভাবতেই হবে ! ম্যাজিশিয়ানের শেষ কথাগুলো কোথাও যেন একটা কাঁটার মতন ফুটে আছে । এর মধ্যে তার নাম-ও হয়েছে বেশ খানিকটা, একদিন মলে জামা কিনতে গিয়ে ক্যাশিয়ার তাকে দেখেই চিনতে পেরে খানিকটা এক্সট্রা খাতির করলেন - এমনকি পাড়ার সে কাফেটায় গত এক বছর ধরে যাচ্ছে সুমন, তার ব্যারিস্তাও আজকাল সুমনের জন্য কাফের এককোণে একটা কাউচ রিজার্ভ করে রাখছে, সুমন জানে এইভাবে একটু একটু করেই খ্যাতি আসে !

ক্যাফে-তে বসেই মাথায় এলো পরের ক্যারিকেচারের আইডিয়া, তার ছেলেবেলার ইস্কুলের মহারাজ, নাম ছিলো অজপানন্দ - মুখে সারাক্ষণ অনাবিল হাসি লেগে থাকতো বলে দুষ্টু বাচ্চারা নাম দিয়েছিলো অযথানন্দ ! এখন তিনি বেশ নাম-টাম করেছেন, টিভির চ্যানেলে এসে গান-টান করেন, টক-শোতেও এসে মানুষের সঙ্গে ফোনে কথা-টথা বলে শান্তির উপায় বাতলে দেন ! অযথানন্দকে নকল করাও ভারি সহজ, তাঁর ভাবভঙ্গি-গলার স্বর সব-ই যে বেশ মেয়েলি ! এফিমিনেট পুরুষ-মানুষের নকল করা যতই রাজনৈতিক-ভাবে অশুদ্ধ হোক, লোকে যে দেদার হাসে সে সুমনের জানা !

দিন চারেক পরে শো শুরু হলো সুমনের, শুরুতেই অযথানন্দ-কে নিয়ে একটা আনকোরা নতুন স্কিট ! কাল্পনিক কথোপকথন - একদিকে অযথানন্দ, আরেকদিকে পলিটিশিয়ান চক্কোত্তি !

কিন্তু এ কি? আজকে তো কই হাসির হররা উঠছে না, স্টেজের সামনের দিকে অল্প আলোয় পুরোনো বন্ধুদের মুখ চোখে পড়ছে, তারা-ও কেমন যেন অবাক হয়ে তাকিয়ে সুমনের দিকে ! এই স্কেচ তার সেরাগুলোর মধ্যে একটা, তা হলে?

মাইকে হঠাৎ একটা বিশ্রী জোরে ফিডব্যাকে সম্বিত ফিরে এলো সুমনের, তাতেই ব্যাপারটা দিনের আলোর মতন স্পষ্ট বুঝতে পারলো সে- মাইকে যে গলা শোনা যাচ্ছে সুমনের সেটা অযথানন্দ-ও না, পলিটিশিয়ান চক্কোত্তিও না ... সেটা একটা অচেনা অদ্ভুত গলা ! নাঃ, একটা নয়, একের পর এক বিভিন্ন গলা, কোনোটা ভারি, কোনোটা মিহি, কোনোটা অত্যন্ত কর্কশ  - এবং আশ্চর্য ব্যাপার, গোটা ব্যাপারটা হয়ে চলেছে সুমনের ইচ্ছের কোনোরকম তোয়াক্কা না করে ! পুরোনো স্যাটেলাইট রেডিও-র মতন, কখন যে কি সিগ্ন্যাল ধরে চলেছে, সুমন-ও জানে না !


এক ঘন্টার শো ছিলো। হল যখন প্রায় ফাঁকা, সুমন দেখলো মিনিট কুড়িও পেরোয়নি ! রাস্তায় বেরিয়ে আজ আর ট্যাক্সি নয়, এক ঘন্টার রাস্তা হেঁটেই ফিরলো সুমন। তার মাথায় কি চলছে সে নিজেও জানেনা, রাস্তায় বার দুয়েক চাপা পড়তে পড়তে বেঁচেছে আজকে - একবার মোড়ের মাথায় গুমটিটায় দাঁড়িয়ে এক প্যাকেট সিগারেট কিনতে গিয়ে দেখলো, অবিকল মহিলার গলা বেরিয়ে এলো ভেতর থেকে ! দোকানদার চেনা লোক, এক-গাল হাসলো, সুমন আবার তাঁকে কিছু বলতে গেলো, গলা থেকে কিছু যান্ত্রিক আওয়াজ বেরিয়ে এলো !

ঘরে ফিরে দরজা বন্ধ করে একগ্লাস ঠান্ডা জল ঢকঢক করে খেয়ে একটু যেন ধাতস্থ হলো সুমন ! একবার নিজের গালে একটা চড় মারলো, বাথ্রুমে গিয়ে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে দেখলো কোথাও কোনো অস্বাভাবিক চিহ্ন ফুটছে কিনা, গলার কাছেও কিছু নেই - সম্পূর্ণ সুস্থ একটা লোক আয়নার ওপাশে দাঁড়িয়ে ! খালি তার চোখে-মুখে অপার্থিব ভয়ের ছাপ !

সুমনের মনে হলো সে পাগল হয়ে যাচ্ছে, পৃথিবীটা যেন দুলছে তার -  ইচ্ছে হলো প্রচন্ড জোরে একটা চিৎকার করে ওঠে - আর অবাক হয়ে দেখলো তার সমস্ত প্রাণশক্তি নিঙড়ে বের করা আর্তনাদটা গলা দিয়ে বেরলো ঠিক একটা পোষা টেরিয়ারের রাগী গর্জনের মতন ! ...

--

অনেক রাতের দিকে জ্ঞান ফিরলো বিপ্লবের ডাকাডাকিতে !
দরজা ভেঙে ঢুকে দমকল তাঁকে যখন সংজ্ঞাহীন অবস্থায় উদ্ধার করে, সুমন বাথ্রুমের মেঝেতে গলা আঁকড়ে পড়েছিলো ! পাশের বাড়ির বয়স্ক ডাক্তার চৌধুরী রাতের শেষ পেগটা ব্যালকনিতে বসে আরাম করে খান, আজ পাশের ফ্ল্যাট থেকে একের পর কুকুর-বিড়ালের পরিত্রাহি আর্তনাদ শুনে ভয় পেয়ে পুলিশকে ফোন করেন তিনি-ই!
বিপ্লব-ও শোয়ের সময় ছিলো, কিছু একটা অদ্ভুত ব্যাপার হচ্ছে দেখে রাত্রে বন্ধুকে অনেকগুলো ফোন করেও না পেয়ে একটা ট্যাক্সি ধরে চলে আসে সুমনের ফ্ল্যাটে !
বিপ্লবের ডাকে সাড়া দিতে দিতে সেই আবছা-অবচেতনের মধ্যেও সুমন বুঝলো, তার গলা দিয়ে যে আওয়াজ বেরোচ্ছে সেটা তার-ই, নিজের চেনা গলা !

--

বিপ্লবের মেসোমশাই অনেকবার অনুরোধ করেছিলেন, আর কয়েকটা শো করতে - একটা একটু গন্ডগোল তো কি হয়েছে? সুমনের সেই প্রথম শোয়ের ভিডিও এতদিনে দশ লক্ষ লোক দেখেছেন ! জয়দেব-বাবুর বাকি সব প্রোডাকশন মিলিয়েও এতো লোক হবে না ...

সুমন এখন আর স্ট্যান্ড-আপ করে না ! পুরনো চাকরিটা পেতেও তেমন বেগ পেতে হয়নি, বস উপাধ্যায় তাকে এককথায় আগের পোজিশান-টাই ফিরিয়ে দিলেন, এরকম একজন সেলিব্রিটি থাকলে টিমের সবদিক থেকেই ভালো, কোম্পানির ভিজিবিলিটি-ও বাড়ে, আজকাল তো লোকে চাকরির পাশাপাশি কতকিছুই না করছে !

তবুও সুমন আর স্ট্যান্ড-আপ করে না, বন্ধুদের পার্টিতেও না - সে বই পড়ে পড়ে ম্যাজিক শিখছে ! আয়নার সামনে বসে বসে একমনে পামিং আর পাসিং করতে করতে সময়টা দিব্যি কেটে যায়! বিপ্লবকে বলেছে জাদুকর মল্লিকের নাম্বারটা যদি এনে দিতে পারে - স্টেজে উঠুক না উঠুক, একটা কয়েন ভ্যানিশ করা শিখতে পারলেও অনেক !



পুনশ্চঃ  আমি গত কয়েকদিন ধরে টানা 'গল্প ১০১' পড়ছি, কেন ঠিক জানিনা ! হয়তো হঠাৎ ছোটোবেলা ফিরে পাওয়ার ইচ্ছে - সেই যখন পড়ার বইয়ের তলায় গোগ্রাসে গিলতাম 'এবারো বারো', 'আবার বারো'-র গল্পগুলো ... আমার এই গল্পটা সেই সব  আশ্চর্য গল্পের স্রষ্টা সত্যজিত রায়ের প্রতি সামান্য এবং অতিশয় অক্ষম একটা ট্রিবিউট !

Thursday, October 12, 2017

টুকি !



আমাদের মতন অ্যাকাডেমিকদের জীবনের একটা বড়ো সময় কাটে ক্লাসঘরে, আর ছোটো থেকে বড়ো হওয়া মানে আসলে প্রবল সংগ্রাম করে কোনোমতে টেবিলের একদিক থেকে আরেকদিকে এসে বসা - আজ থেকে দশ বছর আগের এই দিনে হয়তো কোথাও কাঁপতে কাঁপতে পরীক্ষা দিচ্ছিলাম, আজ হয়তো হাই তুলতে তুলতে গার্ড দিতে দিতে ভাবছি সময়টা কোথায় কেটে গেলো, টের-ই পেলুম না ... ভাবতে ভাবতে মনে পড়লো ছোটোবেলার সেই পরীক্ষার দিনগুলোর কথা - জীবনে সব থেকে ভয়ের দুটো শব্দ, হাপিয়ার্লি আর অ্যানুয়াল ... আর মনে পড়লো সেইসব দুর্যোগের দিনে কিছু অসাধারণ সাহস এবং তার চাইতেও অসাধারণ উদ্ভাবনী শক্তির গপ্পো ...

বলাই বাহুল্য, সব চরিত্র কাল্পনিক ... এবং সব ঘটনাও কাল্পনিক, আর তা ছাড়া আমার বয়ানে টুকলি বা হলে-ম্যানেজ করার গপ্পো মানে গাভাস্করের টি-টোয়েন্টির কমেন্টারি, মাঠে নামলে কি ছড়াতাম কেউ জানে না, তা-ও ... বলতে কি আছে?

ইস্কুলে পড়ার সময়ে দেখতাম পরীক্ষার গার্ড দুই প্রজাতির হয়, প্রথম প্রজাতি মহা ঘোড়েল, হলে টুকলি ধরায় সাক্ষাৎ শার্লক, চোখে কালা চশমা পরে টহল দেন যাতে কার উপর শনি দৃষ্টি পড়ছে বোঝা দায় হয়, হিসু করতে গেলে পিছু নিয়ে টয়লেট অব্দিও যেতে থামেন না, আর ধরা পড়লে হয়ে গেলো ... সে ট্রমা আর ইহজীবনে কাটার নয় ... আরেক দল, নির্বিবাদী, সাতে-পাঁচে নেই, উদাস মুখে খাতা বিলোন, ব্যাজার মুখে বসে থাকেন, বড্ড টোকাটুকি হলে মৃদু গলায় বলবেন, 'এই তোমরা একটু আস্তে গোলমাল করো, পাশের ঘরেও পরীক্ষা হচ্ছে' ... দুঃখের (মতান্তরে আনন্দের) বিষয় আমাদের ইস্কুলে প্রথম ক্যাটেগরির অনেক স্যার ছিলেন, কেউ কেউ হলে ঢুকলে চোতা করুন না করুন, মনে ঘাড় ঘোরানোর চিন্তা এলেও কেমন যেন শিরশিরিনি হতো ... বাধ্য হয়েই বাঙালী শাবক অল্প কল্পনাপ্রবণ হয়ে পড়তো ...

ইতিহাস পড়তে গিয়ে দেখতাম, পাতায় পাতায় গাদা গাদা নাম আর কোটেশান ...  এই রোমিলা থাপার মহেঞ্জোদাড়ো নিয়ে কি বললেন, তো তারপরেই ব্যাশাম-সাহেবের কবিতার মতন উক্তি ... সেসব গাঁত করতে গিয়ে সত্যি বলতে যতো ঐতিহাসিকদের নাম শিখেছিলাম, অতো অঙ্কবিদকে এখনো চিনি কিনা সন্দেহ ... আর ইতিহাস একে ভারী রোম্যান্টিক সাবজেক্ট, তায় মাটির মতো নমনীয়, শেপ-শিফটার ... এই বয়সে এসে বুঝি ইতিহাস শুধুই বিজয়ীর গল্প, বিজিতের নয় ...

যা হোক, ইতিহাস পরীক্ষা চলছে, এক বন্ধু নীলু অনেক টেনে হিঁচড়ে সিন্ধু সভ্যতা-টভ্যতা নিয়ে অনেক কান্নাকাটি করে দেখলো, একটাও কোট মনে পড়ছে না, এমন কি লোকের নাম-ও না (সেই যুগে উড়ুক্কু কুমীর-ওয়ালা সিনেমাও বেরোয়নি) ... কিং করিষ্যামি? কি বুদ্ধি এলো, পাশে পরীক্ষা দিচ্ছিলো একটা ক্লাস ফাইভের বাচ্চা, তাকে জিজ্ঞেস করলো, 'এই তো বাবার নাম কি?' নিরীহ ব্যাঙ্ক বাবু জানতেও পারলেন না, কতো গম্ভীর-জ্ঞানমারানি উক্তি সেদিন তাঁর নামের সাথে জুড়ে গেলো ... অবিশ্যি আমাদের দ্যাশের ইতিহাসে পুষ্পক রথ এসে হরপ্পার খানা-খন্দরে পার্ক করতে শুরু করেছে এখন, সে তুলনায় এ আর কি এমন ...

নাইন-টেনের সিলেবাস সেদিক থেকে বেশ সোজা, স্বাধীনতা আন্দোলন, বই না হয় পড়িনি, কিন্তু সিনেমা দেখেচি, টিভিতে দুর্দান্ত সিরিয়াল দেখেচি 'দেশ আমার দেশ', আমায় কে ঠেকায়? কিন্তু প্রশ্ন-ও তেমন বিটকেল, পাঁচ নম্বরের টীকা লেখো, 'তিনকাঠিয়া ব্যবস্থা কি?' মনে অনেক কাঠির কথা আসে, সে কি আর লেখা যায়? একবার টেস্টে এলো নব্যবঙ্গ আন্দোলন ... তা আন্দোলন হবে, দু-চারটে বডি পড়বে না, সে কি হয়? ডিরোজিও বোধহয় সেই শীতে কবরে কয়েকবার এপাশ-ওপাশ করেছিলেন ...

এক দিদির মুখে (কলমে বলা ভালো) এই নিয়ে একটা গল্প শুনেছিলাম, তাদের প্রশ্ন এসেছিলো থিওসফিক্যাল সোসাইটি ... পাশে খোঁচা মেরে জানা গেছে শুধু দুটো নাম, অ্যানি বেসান্ত আর তিলক, ব্যাস ওইটুকুই ... বললাম না কল্পনাশক্তি? সে উত্তর শুরু করলো 'থিওসফিক্যাল সোসাইটি শুরু করায় তিলক ও অ্যানি বেসান্তের ভূমিকা অপরিসীম', মাঝে অনেক কিছু হাবিজাবি, সাহেবদের ক্যালানি, কিছু বন্দেমাতরম, কিছু ডান্ডী মার্চ ঢুকিয়ে পাতা ভরিয়ে শেষে মহার্ঘ উক্তি, 'এইভাবে থিওসফিক্যাল সোসাইটির মধ্যে দিয়ে অ্যানি বেসান্ত ও তিলকের খুব ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে ওঠে' ...

ইতিহাস অবিশ্যি আমার সত্যি বলতে দারুণ লাগতো (এখনো লাগে) - ভয় পেতাম লাইফ সায়েন্স, কোচিং ক্লাস থেকে দিস্তে দিস্তে নোটস নিয়ে আসতাম, প্রকট ও প্রছন্ন বৈশিষ্ট্য কারে কয়? (উঃ প্রকট আমি ক্যাবলা, প্রছন্ন আমি অত্যন্ত হিংস্র), কানের ককলিয়ার কটা প্যাঁচ থাকে? (উঃ ২ পূর্ণ ৩/৪, গাঁত দেখেচো?) ... মুখস্ত করতে করতে চোখে জল এসে যেতো, তাও নিস্তার নেই ... এতো সব গেঁতে গিয়ে প্রশ্ন এলো, মেন্ডেল-সাহেব কেনো মটর গাছ নিয়ে পেয়াঁজি করেছিলেন? এবং নাঃ, তাঁর গীর্জার পাশে মটরের ক্ষেত ছিল লিখলে শুন্য পাবেন !

এর মাঝে ক্লাস সেভেন-এইটে অল্পদিনের জন্য আতঙ্ক ছড়িয়ে চলে গেছে সংস্কৃত - আমাদের হিন্দি-ফ্রেঞ্চ বা জর্মন এর ব্যাপার ছিলো না, বটুকদা পান খেতে খেতে এসে বেত দিয়ে তশরিফ লাল করে চলে যেতেন, তাতেও অবশ্য কাজ হতো বলা যায় না ... এক বন্ধু খেলার কথা ভাবছিলো, অতো খেয়াল করেনি কি হচ্ছে ক্লাসে, দেবনাগরী হরফ দেখে হিন্দি-র কিছু একটা জটিল ব্যাপার ধরে নিয়ে পরীক্ষার খাতায় ট্রান্সলেশন করে এসেছিলো, 'অযোধ্যাং মেঃ দশরথং নামশ্চ একং রাজন থাঃ' ... হয়তো সে এখনো দুঃস্বপ্নে শব্দরূপ আর অনুস্বার-বিসর্গ দ্যাখে !

স্কুল পেরোতেই দেখলাম  সবাই মিলে হুড়ো তুলে এমন অঙ্ক-ফিজিক্স-বায়োলজি করে যে বেচারা বাংলা-ইংরিজি ফাঁকি পড়ে যায় ... মাধ্যমিকে লোকে তা-ও যা পড়তো একটু নম্বরের লোভে, উঃমাঃ আর জয়েন্ট ফয়েন্ট এসে তার বাজার এক্কেবারেই মেরে দিয়ে গেলো ... টুয়েলভের সিলেবাসে শরৎবাবুর গল্প ছিলো, 'মহেশ', ভারী কষ্টের ... আমিও চোখ মুছতে মুছতে পাতা দুয়েক লিখে ঠাহর করলাম, গরুর নাম মহেশ না গফুর কিছুতেই মনে পড়ছে না, গল্পটা সেই ছোটোবেলার পরে আর পড়িনি ... শেষমেশ লিখে এলাম, 'গল্পের শেষে এক করুণ বিয়োগের সুর বাজে, আর সেই সুরে গফুর আর মহেশ, গরু আর মানুষ, কোথায় যে মিশে যায় বোঝা যায় না ... '

এদিকে অল্পদিন পরেই জয়েন্ট, তবে এক রামে রক্ষা নেই, লক্ষ্মণ দোসর, তাই আমি উজিয়ে শহরের অন্য প্রান্তে গিয়ে মক-টেস্ট দিয়ে বেড়াই। তো এরম এক মক-টেস্ট দেওয়ার আগে এক প্রাণের বন্ধু, (ধরে নেওয়া যাক তার নাম শিবু) সে-ও আমার মত দুর্ভাগা, বললো বায়োলজি আর অঙ্কটা একটু হেল্প করে দিলে সেও বাবার ক্যাল থেকে বেঁচে যায়, আমার-ও কপালে মহামায়াতলার দোকানের এগরোল নাচছে ...

তো পরীক্ষা শুরু, দুটো হাফ, মাঝে টিফিন ব্রেক - ইনভিজিলেটার আসছে, এদিক-ওদিক দেখে চা নয় বিড়ি খেতে কেটে পড়ছে আর  আমি মাঝে মাঝে কনুইয়ের গুঁতো খেয়ে রিলে করে যাচ্ছি, হঠাৎ শুনি আরেকটা মৃদু গুঞ্জন ঠিক ইকোর মতন কানে আসছে ! তাকিয়ে দেখি মহানুভব শিবু আমার থেকে জ্ঞান আহরণ করে থেমে থাকছে না, জনকল্যাণে সবার মধ্যে ছড়িয়ে দিচ্ছে । তা উদ্দেশ্য মন্দ নয়, কিন্তু বিধি বাম, কানে অল্প খাটো ... তাই যা দাঁড়াচ্ছে তা এক অসামান্য চীনে-ফিসফাস, এই যেমন ... প্রশ্ন একটি endangered species-এর নাম লিখ, শিবুকে স্পষ্ট বললাম ওয়ান-হর্ণড রাইনোসেরস, দু-সেকেন্ড পরে শুনলাম পিছনে রিলে হচ্চে ওয়ান-হর্ণড ডাইনোসরাস ... ভেবে দেখলাম প্রতিবাদ করে লাভ নেই - endangered আর extinct এর মধ্যে ফারাক-ই বা কতটুকু?



অঙ্ক পরীক্ষা চুপচাপ কাটিয়ে দিলাম, হল থেকে বেরিয়ে শিবু একগাল হেসে বললো, ওই কি একটা অঙ্কে দেখলাম প্রত্যেক লাইনে একটা চাউমিন সিম্বল দিয়ে গেলি, আমি ওইটা কাটিয়ে বাকিটা হুবহু মেরে দিয়েছি ... (বাসে উঠে বাড়ি ফিরতে ফিরতে বুঝেছিলাম, চাউমিন সিম্বল আসলে ইন্টিগ্রেশানের লম্বাটে S! )


(প্রসঙ্গতঃ, শিবু এখন একজন সফল ডাক্তার, আমাদের নিশ্চয়ই কোনোদিন দেখা হবে, হয় এপারে, নয় ওপারে, নয়তো আসা-যাওয়ার ঠিক মাঝে) ...


আই-এস-আইতে তো এমনিতেই ক্রিয়েটিভিটির চাষ, উত্তর-ও সব আসতো বাঘা বাঘা - তবে সেসব গপ্পো ফেঁদে বসলে এই বুড়ো বয়সে ভাত-কাপড়ে মারা পড়ার সমূহ সম্ভাবনা, তাও গোটা দুয়েক না করে থাকা যাচ্ছে না, করেই ফেলি ...

আমাদের পরের ব্যাচ, পড়ানো হয়েছে স্পুরিয়াস কোরিলেশান, মানে আপাত সম্পর্কহীন দুটো জিনিষের একটা বাড়লে অন্যটাও বাড়ে, আসলে হয়তো ভেতরে অন্য কেউ কলকাঠি নাড়ছে - চাদ্দিকে এর মেলাই উদাহরণ, এই যেমন আপনার মাইনেও বাড়ছে আর পাল্লা দিয়ে ব্লাড প্রেশার, হয়তো দেখা যাবে, মাইনে বাড়ছে বয়সের সাথে, রক্তচাপ-ও তাই ... আবার কিছু মাথামুন্ডু নেই এমন জিনিষেও কোরিলেশান বেশি হতেই পারে, Zআনতি পার না ... (অত্যুৎসাহীদের জন্য একগাদা উদাহরণ রইলো এখানে) ... যা হোক, তা মিড-সেমেস্টার প্রশ্ন এসেছে, 'মানুষের উচ্চতাও যেমনি বাড়ছে, মাথার চুলের ঘনত্ব তেমনি কমছে ... ক্যায়সে?' আমার এক প্রিয় জুনিয়র দুর্ধর্ষ উত্তর লিখে এলো, 'লম্বা লোকের টাক সূর্যের অনেকটাই কাছে, সেখানে গরম বেশী, খুব ঘাম ... ঘেমো টাকে অল্প চুল যদি না-ই পড়লো, তা'লে আর ঘেমে লাভ কি?' (বলাই বাহুল্য, বোরিং লোক হলে আপনি ভাবতেই পারেন, না আসলে হয়তো হাইট আর জেন্ডার সম্পৃক্ত, কিন্তু তাতে কার কি?)

দুই, আমাদের অনেক অনেক পরের ব্যাচের এক ছাওয়াল, দেখি মনের কষ্টে ঘুরে বেড়াচ্ছে, গাদা ব্যাক পেয়ে অল্প ফুস অবস্থা, তাকে বললাম এতো শক্ত শক্ত কোর্সগুলো বেছে বেছে কেউ নেয়? সে রেগে গিয়ে বললো ,"কি করবো, যার থেকে টুকি সে ব্যাটাও ঐগুলোই নিয়েছে !"

বিদেশে এসে অবশ্য আর টোকাটুকি খুব দেখি না, হয় লোকে টোকে না, বা এত বুদ্ধি করে ম্যানেজ করে যে চট করে দেখা মেলে না ... এখানে টুকলি-কে আর লোকে হল-কালেকশন বলে গ্লোরিফাই-ও করে না, সোজা বলে চিটিং ... আর ধরা পড়লে ওইখানেই গর্ত খুঁড়ে ঢুকে পড়াই বোধহয় সবথেকে ভালো, বেরিয়ে বাকী জীবনে আর কিছু করার চান্স প্রায় নেই বললেই চলে ...

তবে টুকলি তো সারাদিন-ই চোখে পড়ে, ফেসবুকে-হোয়াটস-অ্যাপে ... কপি-পেস্ট করে পানু জোকস থেকে শুরু করে বিবেকানন্দ-র বাণী, সিনেমার খিল্লি, দেশাত্মবোধক টোটকা সব-ই ভেসে বেড়াচ্ছে নিরন্তর ... সেই শিকলি-গাঁথার মতোন, কোনো এক খচড়া লোক কোনো এক স্টেপ লেখকের নামটা টুক করে মুছে লিখে দ্যান, #copied অথবা আরো এক কাঠি সরেস, ভুল বানানে লেখা থাকে #সংগ্রহীত !!

'গঙ্গা তুমি-কোথা হইতে আসিতেছো?'
Ctrl-C র জটা হইতে
'গঙ্গা, তুমি কোথায় যাও?'
Ctrl-V -র পদতলে


যে বয়সে করলেও করা যেতো, পারিনি ... মিথ্যে বলবো না, সেই যৌবনের উপবনে বার দুয়েক চোতাও বানিয়েছিলাম ... বানাতে বানাতে দেখলাম দিব্যি পড়া হয়ে গেলো, আর নিয়ে যাওয়ার দরকার পড়লো না ... এখন এই বার্ধক্যের বারাণসীতে অনেক প্রশ্ন আসে সামনে, জীবনের পরীক্ষার হলের এপাশে বসে বসে ঘেমে যাই কলারের তলায়, এদিক-ওদিক তাকিয়ে দেখি গার্ডও নেই, বন্ধুরাও পাশ-টাশ দিয়ে অফিসের বড়োবাবু হয়ে বসে আছে ... এদিকে দশ নম্বরের প্রশ্ন, না পারলেই লেটার মিস ...

সেই ভয়েই গ্যাঁজাখুড়ি দিয়ে দিয়ে পাতা ভর্তি গল্প লিখে যাই আজকাল, সময় ফুরিয়ে গেলে খাতা জমা দিয়ে যেতে যেতে বলে দেবো, "যা পেরেছি লিখে দিয়েছি, এর বেশী আর কিছু জানিনা স্যার" !!




Thursday, September 28, 2017

রাঙিয়ে দিয়ে যাও



একটা সময় ছিলো, আমাদের বয়েস তখন একক ছেড়ে দশকের ঘরে পৌঁছয়নি, এই চতুর্থী-পঞ্চমীতেও রাস্তাঘাটে নিরাপদে বেরোনো যেত, এমনকি সামনের রায়পাড়ার মাঠে ষষ্ঠীর দিনও দেখেছি প্যাণ্ডেলের বাঁশে কাপড় পরানো হচ্ছে আর সেই ফাঁক দিয়ে দেখা যাচ্ছে এক চিলতে প্রতিমা, তার হাত খালি আর মুখের সামনে তেরপল টাঙানো ... মা বলতেন, 'এই তো মা একটু ঘুমোচ্ছেন, অনেকটা জার্নি করে এসেছেন কিনা !' আর বেশ মনে পড়ে, জ্ঞান হওয়া ইস্তক সপ্তমীর রাতটা বাঁধা ছিলো হোল-নাইট ঠাকুর দেখা্র জন্যে, আর আমি ষষ্ঠী থেকেই রাতবিরেতে উঠে মাকে ঘুম ভাঙ্গিয়ে জিজ্ঞেস করতাম, 'সপ্তমী কি এসে গেছে?'

আমাদের সেই ছোট্টবেলায় পুজো শুরু হতো একটা অদ্ভুত রিচুয়াল দিয়ে, বাবা সকাল হতে না হতেই ঝাঁপিয়ে পড়ে বলতেন এই লাইন টানা খাতায় একশো বার শ্রী শ্রী দুর্গা সহায় লেখো ... সে এক দুঃসহ যাতনা !

তবে এর উদ্দেশ্য কিন্তু হাতের লেখা প্র্যাক্টিশ নয়, সে তো আপনি চাইলেই পি আচার্যের রচনা লিখতে পারতেন, বা আনন্দবাজার থেকে গৌতম ভটচাযের দাদাইস্ট পেইন্টিং-ও অক্লেশে টুকে দিতে পারতেন...  কিন্তু নাহ, ওই একটাই বাক্য, সেই যাত্রাপথের "মা খু চিহল ও পঞ্জম হস্তম" এর মতন ... বড়ো হয়ে বুঝতাম ওটার আসল উদ্দেশ্য দিনের পর দিন একঘেয়ে কাজ করে যাওয়ার নেট প্র্যাক্টিশ - ব্যাঙ্কে কাজ করতে গিয়ে দিনের পর দিন একটা পাওয়ারপয়েন্টে ভুষিমাল-টু-ডেসিমাল করতে গিয়ে দেখেছি, খুব কাজে দেয় ...

পুজোর উপহার পেতাম চারটে জিনিষ, নতুন জামা-প্যান্ট-জাঙ্গিয়া, নতুন একজোড়া জুতো এবং সেটা পড়ে ফোস্কা পড়বেই তাই একপাতা ব্যান্ড-এড আর একটা খেলনা ক্যাপ পিস্তল। সেই পিস্তল ছিলো আমার সবসময়ের সঙ্গী, পুজোর ভিড়ে ঘামতে ঘামতে, পায়ের পাতা বাঁচাতে বাঁচাতে কল্পনা করতাম একটা বিশাল দৈত্যাকৃতি টেরোড্যাক্টিল এসে মহম্মদ-আলির মাঠে নেমেছে আর আমি একা অকুতোভয় যোদ্ধা, হাতে একটি উদ্যত ক্যাপ পিস্তল ...

এইসব আগডুম-বাগডুম ভাবতাম বলেই কিনা ঠিক জানিনা, থেকে থেকেই ছড়িয়ে মাঠ ময়দান করতাম। স্পষ্ট মনে পড়ে বাবার সাথে ঠাকুর দেখতে বেরিয়েছি, হঠাৎ রাস্তায় দেখা বাবার অফিস-কলিগ আর তাঁর মেয়ে, আমার-ই বয়সী। যদিও আমি নেহাত-ই শিশু এবং সে বয়সে ছক বলতে শুধুই এক্কা-দোক্কা বা লুডো, তা-ও ভদ্দরলোকের মতন পিস্তল কোমরে গুঁজে, হাত বাড়িয়ে জিজ্ঞেস করলাম, 'তোমার নাম কি?' মেয়েটি ফিক করে হেসে উত্তর দিলো, 'এমা তোমার প্যান্টের চেন খোলা' ... দামড়া বয়সে তার সাথে আরেকবার দেখা হয়েছিলো, বাবার চেম্বারে, আমি চিনতে পারিনি, সে-ও না, বাবাই পরিচয় করিয়ে দেন, 'সেই যে তোকে বলেছিলো, তোর পোস্টাপিস খোলা'?

দোষটা আসলে আমার-ই, ক্যাপ হাতে পেয়ে বীররস একটু বেশী-ই বেড়ে গেছিলো হবে, আমার বাবা আবার খেলনা-বন্দুক জিনিষটাকে অত্যন্ত অপছন্দ করতেন, তাঁর ধারণা ছিলো মানুষের মধ্যে হিংস্রতা জাগায় এমন জিনিষ আর যাই হোক বাচ্চার খেলার জিনিষ হতেই পারে না। এখন মাঝে মাঝে চারদিকে দেখে মনে হয়, এটাই যদি আর-ও দু-একটা লোক ভাবতো, মন্দ হতো না ...

ঠাকুর দেখতে বেরোনোর আগে আমাদের পকেটে একটা চিরকুটে নাম ঠিকানা লিখে দেওয়া হতো, হারিয়ে গেলে এবং গাঁত উলটে বাড়ির ঠিকানা ভুলে গেলে যাতে কেউ বমাল ফেরত দিয়ে যান তার ব্যবস্থা ... বাবা নির্ঘাৎ জানতেন যে আমার হারানোর ষোলো-আনা ইচ্ছে - তার অবিশ্যি দুটো জায়েজ কারণও ছিলো -- এক, গোপাল ভাঁড়ের গল্পে পড়েছি, গোপালের ছেলে মেলায় হারিয়ে গিয়ে তারস্বরে 'গোপাল, অ্যাই গোপাল' বলে চিল্লামিল্লি জুড়ে দিয়েছে, গোপাল এসে কান মুলে ধরতে তার অকাট্য যুক্তি, 'বাবা, বাবা' ডাকলে তো সবাই ছুটে আসবে, আসল বাবা বুঝবে ক্যামনে? সেই অপাপবিদ্ধ বয়সে মনে হতো আমার দোর্দন্ডপ্রতাপ বাপকে নাম ধরে ডাকার সুযোগ এই একটাই - সন্তোষ মিত্রর লাইনে হাল্কা করে হাওয়ায় মিশে যাওয়া ... (বলাই বাহুল্য সব সদিচ্ছা পূর্ণ হয় না! হাজারোঁ খোয়াইশের অ্যায়সে-কি-ত্যায়সে)

আর দুই, ওই যে মাইকে ডাকে, 'পাইকপাড়া থেকে এসেছেন পিন্টু প্রামাণিক, আপনি যেখানেই থাকুন আমাদের অনুসন্ধান অফিসে এসে সত্বর বডি ফেলে দিন' ... বড়ো শখ ছিলো ওর'ম একটা জমায়েতে আমার নামটাও দিকে-দিগন্তরে ছড়াবে অশ্লীল এস-এম-এসের মতন ... এই ইচ্ছেটি পূর্ণ হয়েছিলো, কিন্তু সে আরেক লজ্জার কাহিনী !

বম্বে থেকে কলকাতা এসেছি কাউকে না জানিয়ে - পুজোর কলকাতা এ প্যান্ডেল থেকে ও প্যান্ডেলে আছড়ে পড়ছে আর আমিও জোয়ারের বিষ্ঠার মতন ভেসে চলেছি। পুজোর বাজারে একা একা, উদ্দেশ্যহীন ঘোরার ভারি মজা  - প্যান্ডেলে ঢোকার দায় নেই, অসুরের জ্যাবোরান্ডি চুল দেখে হিংসে হওয়ার ভয় নেই - খালি এ রাস্তা থেকে ও রাস্তা, উত্তর কলকাতার অলি-গলি-পাকস্থলী চষে এই উন্মত্ত ভিড়কে মুগ্ধ হয়ে দেখে যাওয়া ... হঠাৎ দেখি সামনে এক পরিচিত দিদি দু হাত তুলে ছুটে এসে পাকড়াও করে বললেন, 'একা একা ঘুরছিস কেন? চল আমাদের সাথে' ... স্নেহ ভারী বিষম বস্তু, বিশেষ করে পাইকিরি রেটে এলে... একটু এদিক ওদিক দেখলাম, এই তো বাঁশ উঠেছে, পাল ছুটেছে, আমিও টুক করে গলে বেরিয়ে পড়লাম রাস্তায়, দৌড়ে বাগবাজারের মোড়-ও পেরোইনি, দৈববাণীর মতন মাইকে পষ্ট শুনলাম সেই অমোঘ, অমায়িক গলা, 'অনুসন্ধান অফিসে আপনার জন্য বসে আছেন ... '

সেটাই আমার শেষ কলকাতায় পুজো, এখন যার অস্তিত্ব শুধুই বন্ধুদের গল্পে, ছবিতে - এই অর্ধেক পৃথিবী দূরেও অবশ্য পুজো হয়, যেখানে বাঙালী কলোনি রীতিমত বর্ধিষ্ণু, সেখানে ঘটা করে - ইন্ডিয়ানার গ্রামে থাকার সময় দেখেছি, তিনটে আশেপাশের রাজ্য জুড়ে বিশাল ট্রাই-স্টেট পুজো, তার কর্মযজ্ঞ কলকাতাকে লজ্জা দেবে ... আর তার আড়ালে ইউনিভার্সিটি টাউনে হয় বাচ্চাদের অনাড়ম্বর ঘরোয়া আড্ডা-পুজো ।

পার্ডুতে দেখতাম একা হাতে অলোক-দা, তৃপ্তি বৌদি আমাদের কয়েকপিস এনথু কাটলেট পাবলিক-কে নিয়ে একটা গোটা পুজো নামিয়ে দিতেন । সেই জনাকয়েক লোক - তারাই প্যান্ডেলে পেরেক ঠুকছে, সাতসকালে এসে খিচুড়িতে খুন্তি নাড়ছে, ময়দা ঠেসছে, দুপুরে আবার তারাই কুইজমাস্টার, বিকেলে গলায় ক্যামেরা ঝুলিয়ে খচাখচ ক্যান্ডিড মোমেন্টস-ও তারাঁই ধরবেন, অল্প ধুনুচি নাচেও কোমর দোলাতে ভরসাও এয়াঁরাই ... সবাই চলে যাওয়ার পরেও বন্ধুরা কয়েকজন থেকে যেতাম জঞ্জাল ্ফেলতে, গোটা চার্চ ভ্যাকুয়াম করে, দুগগা ঠাকুরকে ইউ-হল-এ করে আবার গ্যারেজ-কৈলাসে ফেরত নিয়ে যেতে যেতে সেই বিলেটেড বিজয়াতেও মনটা ভারি খারাপ করে আসতো ... নাস্তিক আমি সবার অলক্ষ্যে টুক করে মূর্তির পা-টা ছুয়েঁ বলতাম, 'আসছে বছর আবার এসো' ...

চ্যাপেল হিলে থাকার সময় দেখেছি একদল বাচ্চা সারা-রাত জেগে কি অমানুষিক পরিশ্রম করে সাজিয়ে তুলেছে একটা ছোট্ট অ্যাপার্ট্মেন্টের মধ্যে একটা আস্ত প্যান্ডেলের কারুকাজ... সারা রাত ধরে রান্নাবাটি খেলা, মাঝে গান আর আড্ডা, তাঁর আওয়াজ কানে লেগে আছে, থাকবে ...



(উপরে দুর্গা-ডুডল, ভালো করে দেখুন, প্রতিটা রেখাই আসলে লেখা, এঁকেছিলো সোহিনী, আর নীচে রঙিন কাগজের পুষ্পাঞ্জলি, র‍্যালে আর চ্যাপেল হিলের বাচ্চাদের সারা-রাত জেগে তৈরী করা সাজ) 

গান-বাজনার কথায় মনে এলো আমাদের প্রবাসী কলচর-বিলাস, সন্ধ্যেবেলায় একটা মাইক জোগাড় করে বসে যেতাম সবাই । একদল কুঁচোকাঁচা উঠে নাচতো, গাইতো, আধো গলায় 'এসেচে শরত, হিমের পরশ' - সদ্য ফোটা উচ্চারণের বাংলা শুনে কান জুড়িয়ে যেতো ... এক দিদি ছিলেন, যারপরনাই অনুরোধের পর বসতেন আধুনিক গানের খাতা খুলে, একের পর এক গেয়ে যেতেন। তিনি গেয়েছিলেন 'কথা দাও ভুলবে না গো', সত্যিই ভুলতে চেয়েও পারিনি ... আমি ছিলাম শ্রুতিনাটক-আবৃত্তির টিম-এ, এক এক বছর খুব উৎসাহ নিয়ে স্ক্রিপ্ট লিখতাম, আর না হলে ছাই ফেলতে ভাঙা কুলো চেনা কবিতা, জয় গোঁসাই আছেন কি করতে...

'আমি যখন ছোটো ছিলাম,
           খেলতে যেতাম মেঘের দলে,
আর কিছু তো গাঁত করিনি,
            'মেঘবালিকা'-ই হোক তাহলে?'

একটা জিনিষ কিন্তু পেয়ারাবাগান টু পেন্সিলভ্যানিয়া কোত্থাও পালটায় না - পড়তে পড়তে আড়চোখে দেখতাম কেউ হাই তুলছে, কেউ ঘড়ি দেখছে আর সিলিং, আর বাকিরা কর্তাব্যক্তি, কবিতাপাঠের ব্যাকগ্রাউন্ডে তুমুল পায়চারি করে যাচ্ছেন, পাঁঠার ট্রে-টা আসতে আসতে যদি ক্যালোরি ও পাপ দুটোই ঝরে যায় ...  দু-একবার এই মওকায় নিজের লেখা ন্যাকা কবিতা শ্রীজাতর বলে ঝেড়েও দিয়েছি নির্লজ্জের মতোঃ

প্যান্ডেল আজ জ্বালেনি কেউ আলো
           বাঁশ দাঁড়িয়ে, ছোট্ট-সরু-বাঁকা ...
প্রেম জোটেনি এবার পুজোর ভিড়েও
           পথ ও আমি, শুনশান আর ফাঁকা ...

এবারে যেন একটু বেশি-ই মন কেমন - আসলে আমাদের এই ভূষুন্ডির মাঠে পুজোর জলুষ একটু কম, পোস্ট-ইলেকশনে সিপিএমের মতন, সবাই জানে সে আছে, ঘনঘন মিটিং হচ্ছে, প্ল্যান হচ্ছে, তবু আমাদের মতন কিছু নিবেদিতপ্রাণ পুজো-ফ্যান ছাড়া বেগার খাটার লোক পাওয়া দুষ্কর ... পুজোর দিনগুলো তাই চুপচাপ কেটে যায়, ক্লাসে পড়ানোর ফাঁকে অগুন্তি মেসেজ আসে, উজ্জ্বল শাড়ির ছবিতে আর কাঁপা হাতের ভিডিও-তে ভরে যায় ফেসবুকের দেওয়াল... তার মাঝে মাঝে কয়েকটা আবার আমার-ই মতন লোকের, সত্যি পুজোর রেশ নেই, তাই পুরোনো অ্যালবামটাই বারবার উলটে পালটে ধুলো ঝেড়ে দেখা, তাও সব আস্তে আস্তে ঝাপসা হয়ে আসে ...

দু-এক টুকরো তবু জানি মুছবে না -  মুছবেন না সিংজী, সেই বৃদ্ধ ট্যাক্সিচালক, বাবার পেশেন্ট ছিলেন, জোর করে ঠাকুর দেখাতে নিয়ে যেতেন ... বেচারির প্রস্টেট-এর সমস্যা ছিলো, পুজোর বাজারে যেখানে সেখানে পাগড়ি পরে হিসু করতে বসলে যে মার খেতে হতো, সে নিজের চোখে দেখা ... তা-ও, আসতেন, প্রত্যেকবার, রাত্রে দেখতে পেতেন না যখন, দিনের বেলায় আসতেন তার পক্ষীরাজ নিয়ে... আলোর কারিকুরি কিস্যু দেখা যেতো না, তাও লাইটিং-এর কঙ্কালের দিকে তাকিয়ে মনে মনে ভেবে নিতাম মারাদোনার গোল, মাদার টেরেজার বলিরেখা ভরা মুখ, সৌরভের সেঞ্চুরি ... লাল-নীল টুনি গুলো একে-একে জ্বলছে-নিবছে ...

আর একটা আশ্চর্য পুজোর সন্ধ্যে মাঝে মাঝে ফিরে আসে - ২০০৮, মাস্টারস-এর ফাইনাল ইয়ার, সপ্তমীর দিন এক বন্ধুর ফোন এলো, বললো ভিড়ে আর আওয়াজে পাগল পাগল লাগছে, চ' একটা নিরিবিলি জায়গায় বসে আড্ডা মারি - চলে এলাম নন্দন চত্ত্বরে, শুনশান ফাঁকা এলাকা, এমনি দিনেও যেসব ঝোলা-চপ্পল-শোভিত আঁতেল মিছিল দেখা যায়, সেও নেই, কড়ে আঙ্গুল ধরে থাকা প্রেমিক-প্রেমিকারাও না ... খালি একটা এগরোল-চাউমিনের দোকানে টিমটিম করে আলো জ্বলছে আর কয়েকটা লোক ফতুয়া পরে হাত নেড়ে নেড়ে তর্ক করছে ...

আমি আর আমার বন্ধু যে গাছের তলায় বসে একের পর এক সিগারেট ধ্বংস করছিলাম, তার সামনের গাছ তলাটায় এক মহিলা বসেছিলেন - উস্কোখুস্কো চুল, কাঁধে একটা ঝোলা থেকে একটা একটা করে লেখা পাতা বের করছেন, উল্টেপাল্টে দেখে আবার ঢুকিয়ে রাখছেন ভিতরে, একটা সিগারেট বোধহয় চেয়ে এনেছিলেন, আর্ধেকটা খেয়ে বাকিটা আবার প্যাকেটে ঢুকিয়ে রেখে দিলেন সযত্নে, কেউ দূর থেকে বললো 'পাগলিটা আবার এসচে' ...

কিন্তু আমি দেখলাম তার মুখে চোখে কি অনাবিল, অনর্গল, অবৈধ একটা আনন্দ, যার তল পাওয়া যায় না ... যেন একটা বেয়াড়া প্রশ্নকে ধাওয়া করে করে সারা জীবন শুকতলার মতন ক্ষয়ে ক্ষয়ে এসে তিনি পৌঁছেছেন এই নির্জন গাছতলায় - আর ওদিকে যখন শহরটা একটা বিশাল যন্ত্রদানবের মতন নিজেকে ছেঁচড়ে ছেঁচড়ে টেনে নিয়ে যাচ্ছে একটা থেকে আরেকটা ঝিলমিল আলোর চারপাশে, আজ সেই উত্তরটা তিনি পেয়েছেন কল্পনায় ...

 ... আমার ফোনে এদিকে লাগাতার টুংটাং করে এস-এম-এস বেজেই যাচ্ছে, 'কিরে কখন আসবি?' -

আজ যদি আবার ফিরে যেতাম পুজোর কলকাতায়, ভিড়ের বাইরে খুঁজে বের করতাম তাঁকে... আর জিজ্ঞেস করতাম, "তাঁরও কি পুজো হারিয়ে গেছে হাত ফস্কে, আমার মতন?"




Tuesday, September 19, 2017

১৭-ই সেপ্টেম্বর



আমাদের এই অঙ্কের লাইনে অনেক ওপেন প্রব্লেম আছে, মানে এমন অদ্ভুত অঙ্ক, যার উত্তর আগেই বলা আছে, কিন্তু কি করে অঙ্কটা কষতে হবে কেউ জানে না ... তো আমার জীবনেও ওই লার্ভা থেকে পিউপা হওয়ার মাঝখানটা ভর্তি ছিলো এরম গাদা গাদা প্রশ্নে ... ওপেন প্রবলেম! না না বারমুডা অথবা তজ্জনিত ট্রায়াঙ্গল নয়, ঈস্টার দ্বীপপুঞ্জ বা লক নেসের জলোসরাস-ও নয়, একদম পাতি ছাপোষা শহরতলির বাঙলা মিডিয়াম প্রব্লেম, এই যেমন  ধরুন, ১) আসল দুলাল চন্দ্র ভড় কে? (R) চিহ্ন না পুরো নাম? ২) আসল বেণীমাধব শীল বা আদি-তম শ্রীভৃগুই বা কারা? ৩) আর সন্তান দল প্ল্যাটফর্মের দেওয়ালে দেওয়ালে রাম নারায়ণ রাম লিখতে লিখতেই বা কিকরে জানলেন নেতাজী এবার ল্যাদ কাটিয়ে রিটার্ন টিকিটটা বুক করলেন কবে ?

কিন্তু সবথেকে আশ্চর্য লাগতো এইটা দেখে যে বাকি সব পুজো-পার্বণ এদিক-ওদিক গড়াগড়ি খায়, কিন্তু ওই এক বিশ্বকর্মা পুজো নট-নড়নচড়ন, ফি বচ্ছর ১৭-ই সেপ্টেম্বর বাঁধা ... সেই দমদম জংশনের প্ল্যাটফর্মে যেমন সদর্পে ঘোষণা থাকতো, 'সব জ্যোতিষী বারবার, অমৃতলাল একবার!' ... (বলাই বাহুল্য, অমৃতলালের কেরিয়ার নিয়ে সেই থেকে কিছুটা সংশয় এযাবৎ রয়েই গেছে) ... তো এবারের গল্প আমাদের সেই  'নিষ্পাপ' ছোটোবেলার একমাত্র ফিক্সড পয়েন্ট নিয়ে, যার নাম ১৭-ই সেপ্টেম্বরের আকাশ, ধারকাছ দিয়ে গেলে সাবধান, এই বয়সে ভোঁকাট্টা হলে দায়িত্ব কিন্তু কর্তৃপক্ষের নয় ...


তো বিশ্বকর্মা পুজোর দিনটা কিন্তু আসলে সিজন ফিনালে, মেগা-ফাইনাল, যাঁকে বলে পাঁচ সেটের হাড্ডাহাড্ডী নাদাল-ফেডেরার ... এক মাস আগে থেকে চলতো মাঞ্জা দেওয়া, ভাতের মাড়ের সাথে কাঁচের গুঁড়ো, সাগু, শিরিষ মিশিয়ে সুতোয় প্রলেপ - আর মাঞ্জার ধার নিয়ে নিউটনের একটা সূত্র আছে, যত আজগুবি লজ্জাঘেন্নার-মাথা-খাওয়া জিনিষ সে মাঞ্জায় গেছে - ততই তার ধার ... বন্ধুরা সব বাসে যেতে যেতে রোমহর্ষক গল্প শোনাতো, কে পচা ডিম দিয়ে মাঞ্জা দেবে বলে ডিম পচিয়ে শহীদ হয়েছে, কে আবার কাঁচের গুঁড়োর জন্য দিদিদের কিছু চুড়ি কুরবান করতে গিয়ে নিজেই কুরবান হয়ে গেছে, এক পাড়াকাকু ছিলেন মাঞ্জা-স্পেশালিস্ট, তাঁর মাঞ্জা-ফর্মুলার রহস্য কে-এফ-সি-র চিকেনের মতো, কেউ জানে না কি দেয়, বদলোকে বলতো কুকুরের এবং মানুষের সম্মিলিত ইয়ে থাকে তবে পূতীগন্ধময় লাটাই ছাড়া তার প্রূফ দেখিনি কখনো-- মাঝ আকাশে তাঁর ঘুড়িটি যখন বে-রেহমি-সে আগে বাড়তো আশেপাশের ছাদে সমবেত আর্তনাদ শোনাও এক অভিজ্ঞতা বটে !

বহুযুগ পরে ট্যারান্টিনোর কিল-বিল দেখছি, একটা সিনে জাপানী সন্নিসী উমা-দিকে তরোয়াল দিয়ে বললেন, 'If on your journey, you should encounter God, God will be cut' -  মনে হলো আমাদের পাড়াকাকুর মাঞ্জা নিশ্চয়ই ট্যারান্টিনোর ঘুড়িও কেটেছিলো ...

সব গল্পেই একটা খিঁচুটে ভিলেন থাকে, আমাদের ঘুড়ির গল্পে ছিলেন পাড়ার এক দাদু*,  নাম ধরা যাক সদার বাবা গদা, নিয়মিত খেলা ভন্ডুল করে দেওয়ায় পাড়ায় তাঁর আদরের নাম ছিলো বাল ঠাকরে ... তিনি বাচ্চাকাচ্চাদের ছাদে দেখলেই পরিত্রাহি চিৎকার করতেন আর অমনি আদেশ হতো সুড়সুড় করে নেমে আসার ... এতেও ছাদময় ঘুড়ির দৌরাত্ম্য না কমায় তিনি একবার সভা ডেকে বানিয়ে বানিয়ে ভয়ানক গল্প বলতে লাগলেন, কাকে দেখা গেছে কার্নিশ বেয়ে হাঁটতে, কে লগা নিয়ে হাইওয়েতে স্পিড লিমিট ক্রস করে দৌড়চ্ছিলো ইত্যাদি ...  অল্পেতেই কাজ হলো, অবিলম্বে ব্যান হলো আমাদের ছাদে যাওয়া ... বেরিয়ে দেখি সদাকাকু গম্ভীর মুখে বললেন, বাবার এই কাঠি করার হ্যাবিট-টা আর গেলো না ...

অবিশ্যি সত্যি বলতে গেলেও আমার যে কিছু উন্নতি হতো এমন নয়, মাঞ্জা-টাঞ্জা দেওয়া তো দূর, ঘুড়িও যে খুব একা-একাই দারুণ ওড়াতে পারতাম এমন দাবী করলে পাড়ার বন্ধুরা এসে চাঁটি মারবে। তবে গ্যলারি যদি খ্যালার-ই অঙ্গ হয়, তাহলে আমিও একটা প্রত্যঙ্গ তো বটেই ... মিলেনিয়াল-রা জানে কিনা জানিনা, তবে ঘুড়ি যখন ওড়াতে হয়, ছাদ থাকলে ছাদ থেকে সুতো ধরে তলায় ঝুলিয়ে প্রবল একটা হ্যাঁচকা-টর্ক, না থাকলে খোলা মাঠে এক অভাগা এক যোজন দূরে দুহাত তুলে ঘুড়ি ধরে দাঁড়াবেন আর পেশাদার উড়িয়ের কাজ মওকা বুঝে হ্যাঁচকা-টান ... ছেলেবেলার সেই মাঠে সব্বাই পেশাদার, যে একটি ছেলে এপ্রান্ত থেকে ও-প্রান্ত ছুটে ছুটে সবার ঘুড়ি প্রাণপণে ঠেলছে উপরে সেই ক্যাবলা ছানাটিই আমি ...

যৌবনের শুরুতে এক বান্ধবীকে প্রাণপণ ইম্প্রেস করতে চেয়ে বলেছিলাম, 'না ওড়াতে জানিনা, কিন্তু ঘুড়ি কেন ওড়ে সেই মেকানিক্স টা জানি' ... ফিজিক্স-এ যে আমার ফুটুরটি নেহাত-ই ডুম, সেই সন্ধ্যেয় প্রথম বুঝি ...




আর বুঝি, গল্প কেন সত্যি হয় না ... বললাম না, নেহাত-ই নিষ্পাপ এবং ক্যাবলা ছেলেবেলা ছিলো আমার - যা পড়তাম সব ভাবতাম সত্যি ! সেবার পুজোবার্ষিকীতে শীর্ষেন্দুর একটা গল্প পড়লামঃ একজন লোক, যাঁর জীবনে ভারি কষ্ট - তিনি রোজ ঘুড়ি ওড়ান আর রোজ একটা করে আজগুবি আদেশ পেতে থাকেন ঘুড়ির গায়ে লেখা, কোনোদিন বলে বসের মাথায় ঘোল ঢালতে, কোনোদিন বলে ঝাঁপ মারতে তিনতলা থেকে ... ও মা, গল্পের শেষে দেখা যাবে, যা যা করেছেন সবেতেই খুব উপকার হয়েছে তাঁর - বসের টাকে চুল, মাজার ব্যথা গন এবং লাইফ ঝিঙ্গালালা ... তো আমার খুব ফ্যান্টাসি হতো, একদিন নিশ্চয়ই মাঠে নেমে আসা শেষ ঘুড়িটা যখন কুড়িয়ে পাবো, আকাশের কোনো এক বন্ধু কিছু পাঠাবে লিখে? হয়তো বলে দেবে কি করলে আর টিফিনে জলের বোতল চুরি হবে না, বা বন্ধুরা আর খ্যাপাবে না ... কিন্তু নাঃ, সে ঘুড়ি আর আসে না ... তারপর একদিন ভেবে দেখলাম, ইনকামিং যখন নেই, আউটগোয়িং-ই সই ... পাড়াকাকুকে বলে বিশাল দো-ত্তে ঘুড়ির ওপর স্কেচপেনে লিখে রাখতাম মহার্ঘ সব সদুপদেশ, কোনোটা গভীর জীবন-দর্শন, কোনও কোনোটা আবার নিতান্তই ছাপোষা, যেমন "এক মাস নখ কাটবেন না", কিংবা "আজ চান করার সময় একটু শ্যাম্পু খেয়ে দেখুন" ইত্যাদি ...

"বোম-মারা" বলে বিকট আওয়াজ হতো কাটা পড়ার সময়, আর বহুদূরে ঘুড়িগুলো হারিয়ে যাওয়ার সময় চেয়ে চেয়ে দেখতাম কোথায় পড়ছে ...

আজ বাড়ি ফেরার সময় একবার আকাশের দিকে তাকালাম, নাঃ, তাদের একটাও অতলান্তিক ক্রস করেনি দেখছি ...

Wednesday, September 6, 2017

“ফসল কাটা মাঠে এখন সদ্যকৃত বধ্যভূমি”

আমি লোরকা-র কথা প্রথম পড়ি শুভঙ্করকে লেখা নন্দিনীর চিঠি-তে, “নতুন কবিতা কিছু লিখেছো কি?
লোরকা পড়ছো খুব? বেশি পড়ো, কম সিগারেট খাও” ... (কথোপকথন ৩)

দিন-কয়েক পরে একটা বাংলায় অনুবাদ করা বই পেয়ে যাই কলেজ স্ট্রীটে, পড়তে পড়তে প্রেমে পড়ে যাই নিজের অজান্তে – কি অদ্ভুত ম্যাজিকে লোরকার কবিতার প্রাগৈতিহাসিক আন্দালুশিয়া হয়ে যায় আমার-ই ভিটেমাটি - তার বইয়ের পাতায় কান পাতলে শুনতে পাই ফ্ল্যামেঙ্কো-র ছন্দ, টের পাই অবিকল শরীরের উত্তাপ আর মরা বাতাসে ফিসফাস করে বয়ে চলে ‘সনেটস অফ ডার্ক লভ’-এর অস্ফুট গোঙানি আর জমে-থাকা চিৎকার ... অনন্ত কুয়োর তলা থেকে উঠে আসা শব্দের মতো।

মাত্র আটত্রিশ বছর বয়সে, ১৯শে আগস্ট, ১৯৩৬, খুন করা হয় লোরকা-কে, গ্রানাডা-র তখতে তখন উগ্র-জাতীয়তাবাদী ফ্যালাঞ্জিস্ট গুন্ডাবাহিনী, আর লোরকা? সোশ্যালিস্ট, স্পষ্টবক্তা, মুক্তচিন্তক, তায় সমকামী, ফ্যাসিস্ত রাষ্ট্রযন্ত্রের সাক্ষাৎ জুজু [১]

তিরিশ-তিরিশটা বছর লেগেছিলো (১৯৭০ অব্দি [২]) শুধু এই কথাটুকু প্রকাশ্যে স্বীকার করতে যে লোরকার খুন ব্যক্তিগত দ্বন্দ্বে-ঈর্ষায় নয়, হয়েছিলো একটি রাষ্ট্রশক্তির হাতে – তাঁর বধ্যভূমি আজ-ও নিশানাহীন ...

লোরকা জানতেন, লোরকা-রা যেমন জানেন, মৃত্যুর অনেক আগেই আর তিনি যেন মিশে যান মার্কেসের সান্তিয়াগো নাসারের সাথে, হত্যার আগেই ঘাতকের ছুরি থেকে ঝরতে থাকে রক্ত, ‘Fable and round of three friends’ এ ভেসে আসে –

“Then I realized I had been murdered.
They looked for me in cafes, cemeteries and churches
.... but they did not find me.
They never found me?
No. They never found me.”

১৯৩৬-এ হত্যা, ১৯৫৩ অব্দি সমস্ত লেখার উপর নিষেধাজ্ঞা, ১৯৭৩-এ ফ্রানিসিস্কো ফ্র্যাঙ্কো মারা না যাওয়া অব্দি লোরকার মৃত্যু (অথবা জীবন) নিয়ে আলোচনা-ও ছিলো অবৈধ, ১৯৮৪-র আগে অব্দি পাওয়াই যায়নি তার ‘ডার্ক লভ’-এর সনেটগুচ্ছ, এখনো কেউ জানেনা শেষ খসড়া কোথায় – তবু লোরকা বেঁচে আছেন, থাকবেন, স্পেনের ফ্যাসিস্ত ফ্যলাঞ্জিস্ট গুন্ডার দল নেই ...

সত্যি বলতে, প্রথমবার পড়ে বিশ্বাস হয়নি, ভাবতে পারিনি একজন দুর্বল, রোম্যান্টিক, প্রেমের কবিকে জল্লাদবাহিনী টেনে দাঁড় করাচ্ছে ফায়ারিং স্কোয়াডের সামনে? একজন কবি-কে? কিসের ভয়?

আর আজ?


পুনশ্চঃ  একটু আগে এক বন্ধুর (অনির্বাণ) দেওয়ালে দেখলাম, আজ সুনীল-বাবুর জন্মদিন, তাই লোরকার স্মরণে তাঁর কবিতার একটু আর না দিয়ে থাকা গেলো না একেবারেই ..[৩]



কবি অত মানুষের মুখের দিকে চেয়ে খুঁজলেন একটি মানুষ
নারীদের মুখের দিকে চেয়ে খুঁজলেন একটি নারী
তিনি দু’জনকেই পেয়ে গেলেন
কবি আবার তাদের উদ্দেশ্যে মনে মনে বললেন,
বিপ্লব দীর্ঘজীবী হোক! মিলিত মানুষ ও
প্রত্যেক মানুষের নিজস্ব বিপ্লব!
প্রথম গুলিটি তাঁর কানের পাশ দিয়ে বেরিয়ে গেল-
যেমন যায়,
কবি নিঃশব্দে হাসলেন
দ্বিতীয় গুলিতেই তাঁর বুক ফুটো হয়ে গেল
কবি তবু অপরাজিতের মতন হাসলেন হা-হা শব্দে
তৃতীয় গুলি ভেদ করে গেল তাঁর কন্ঠ
কবি শান্ত ভাবে বললেন,
আমি মরবো না!
মিথ্যে কথা, কবিরা সব সময় সত্যদ্রষ্টা হয় না।
চতুর্থ গুলিতে বিদীর্ণ হয়ে গেল তাঁর কপাল
পঞ্চম গুলিতে মড় মড় করে উঠলো কাঠের খুঁটি
ষষ্ঠ গুলিতে কবির বুকের ওপর রাখা ডান হাত
ছিন্নভিন্ন হয়ে উড়ে গেল
কবি হুমড়ি খেয়ে পড়তে লাগলেন মাটিতে
জনতা ছুটে এলো কবির রক্ত গায়ে মাথায় মাখতে-
কবি কোনো উল্লাস-ধ্বনি বা হাহাকার কিছুই শুনতে পেলেন না
কবির রক্ত ঘিলু মজ্জা মাটিতে ছিট্‌কে পড়া মাত্রই
আকাশ থেকে বৃষ্টি নামলো দারুণ তোড়ে
শেষে নিশ্বাস পড়ার আগে কবির ঠোঁট একবার
নড়ে উঠলো কি উঠলো না
কেউ সেদিকে ভ্রূক্ষেপ করেনি।
আসলে, কবির শেষ মুহূর্তটি মোটামুটি আনন্দেই কাটলো
মাটিতে পড়ে থাকা ছিন্ন হাতের দিকে তাকিয়ে তিনি বলতে চাইলেন,
বলেছিলুম কিনা, আমার হাত শিকলে বাঁধা থাকবে না!

[১] Documents confirm fascists murdered Spanish poet Federico Garcia Lorca:  http://www.wsws.org/en/articles/2015/04/30/lorc-a30.html
[২] “Lorca and the Gay world”

Sunday, July 16, 2017

ট্রেনের গল্প



লীলা মজুমদার লিখেছিলেন, গল্প হয় ভূতের, নয় চোরের, নয় বাঘের নয় ট্রেনের ... তা আমার এ ইহজীবনে খাঁচার বাইরে বাঘ দেখার সৌভাগ্য হয়নি, আর শোনা সব বাঘের গল্পেই গরু আছে, কাজেই সেসব এখন মুলতুবি ...  তবে চোর আর ভূত দেখেছি গণ্ডা গন্ডা, আমাদের ওদিকে তো নাইটগার্ড বলে কিছু হয় না, সিঁধকাটা আর স্কন্ধকাটারাই দেখেশুনে রাখে। ওরাই ছাতে মাদুর পেতে ঘুমোয়, রাত্রে পাড়া টহল দেয়, ব্যানার্জীদের রকে বসে আড্ডা মারে, তিনপাত্তি খেলে - তবে হুট করে কাছে গেলেই তারা মিলিয়ে যায়, দু-একটা পোড়া বিড়ির টুকরো আর খালি ঠোঙা উড়ে বেড়ায় মৃদু বাতাসে ...

তা এই রকের আড্ডায় যা দারুণ সমস্ত গল্প শুনেছি, বলবো একদিন, একটু রাত্তির করে বেশ জমিয়ে বসে, একটা মোমবাতি জ্বালিয়ে ... তবে উত্তর কলকাতার ভুত তো, ভয়-টয়ের কারবারে নেই, বরং বেশীর ভাগই বেশ লাজুক এবং নিতান্ত ছাপোষা ... এই যেমন এক জেঠুমানুষ ছিলেন পাড়ায়, সাত্ত্বিক প্রকৃতির, মাঝে মাঝেই এসে গাঁটের ব্যাথার জন্য একদাগ আর্ণিকা আর আমাশার জন্যে অ্যালোজ নিয়ে যেতেন। বাবার কাছে শুনেছি জেঠ্যু সাধনোচিত ধামে পাকাপাকি চলে যাবার পরেও মাঝে মাঝে সকালে উদয় হতেন চেম্বারে, বাজারের লঙ্কা থেকে লাউ কেমন আগুন দাম বলে গজগজ করে দুই পুরিয়া ওষুধ নিয়ে চলে যেতেন ... অব্যেস তো, ডাই হার্ড ...

এই অব্দি পড়ে যদি ভেবেছেন যে ভর-সন্ধ্যায় ভুতের গল্প ফেঁদে বসেছি, ভুল করছেন ... এটা আসলে ট্রেনের গল্প । আমার বাবা নেশায় ছিলেন হোমিওপ্যাথ, পেশায় রেল-কর্মচারী - বছরে দু-দুটো পাশ পেতেন আর আমরা পুজোর ছুটি, শীতের ছুটি দেদার ঘুরে বেড়াতাম এদিক-ওদিক। প্রায়ই প্ল্যান শুরু হতো পুষ্কর লেক দিয়ে, শেষ হতো পাশের পাড়ায় পুরীর বীচে ... কখনো আবার হঠাৎ করে দেখতাম একগাদা কিচিরমিচির করা ফ্যামিলি নিয়ে চলেছি পাহাড়ে বা সমুদ্রে। ইস্কুল থেকে কলেজে উঠে তো আরো মজা, ফি বচ্ছর শিক্ষামূলক ভ্রমণ হয়, একজন অসহায় টিচার, আর একগাদা উচ্ছৃঙ্খল জনতা। আমাদের সেই ছোটো আর মাঝারি-বেলার সব গরমের ছুটি যদি একটা আঁতেল আর্ট ফিলিম হয়, তার ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক হবে শুধুই কু-ঝিক-ঝিক এবং ফাঁকে ফাঁকে 'চায়ে গ্রম চায়ে' ...

হাওড়া থেকে ট্রেন ছাড়তো বেশ রাত্তিরে, আর বাড়ি থেকে স্টেশন যাওয়াই এক ঝকমারি কান্ড, ধরুন যাবেন বেনারস, মেরে কেটে ষোলো-সতেরো ঘন্টা - তার জন্য খাবার প্যাক হবে চার দফা, লুচি-আলুর দমের সঙ্গে মিষ্টি, মাঝে মাঝে উসখুস করলে চানাচুর, দু-একটা ফল-টল তো এম্নি-ই চলে আসে। ঘুম থেকে যখন উঠতাম সকালে, আপার বার্থ থেকেই দেখতাম বাইরের মাঠের রঙ পালটে গেছে, সবুজ ফিকে হচ্ছে, আস্তে আস্তে ধূসর, মাঝে মাঝে সেই ভুষুন্ডির মাঠের ঠিক মধ্যিখানে একটা করে টেলিফোনের বা ইলেক্ট্রিসিটির টাওয়ার, বলা-নেই-কওয়া-নেই দু-একটা টানেল আসে হঠাৎ হঠাৎ করে... আর শহরতলি পেরোতে পেরোতে লেভেল ক্রসিং, ব্যস্ত মানুষ-গরুতে বিরক্তি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে আর আপনি তাদের টা-টা করতে করতে চললেন হলিডে হোমে ...

বাবার কল্যাণে ফার্স্ট ক্লাসে উঠতে পেতাম, দরজা দেওয়া আলাদা কেবিন, বাথরুম থেকে  দিরে এসে দেখবেন না উটকো লোকে উঠে জায়গা নিয়ে গেঁড়ে বসে আছে, তবে জার্নিও নেহাৎই অ্যাডভেঞ্চার-হীন, সে এসি টু-টায়ারে স্বামী ঘুটঘুটানন্দও উঠবেন না যোগসর্পের হাঁড়ি নিয়ে, সামনের বেঞ্চি থেকে জটায়ুও হঠাৎ বলে উঠবেন না , 'এখানে রোদের তেজ-ই আলাদা, সাধে কি আর লোকগুলো এতো পাওয়ারফুল?' ... দূরপাল্লার ট্রেনে রেলের ক্যান্টিন থেকে খাবার আনানো হতো, সেসব অখাইদ্য খাবার কিন্তু ওই থালা গুলোর ওপর হেব্বি লোভ ছিলো, সুন্দর খাপ কাটা-কাটা ...

দামড়া বয়সে বন্ধুদের সাথে যাওয়ার সময় তো গোটা ট্রেন জার্নি-ই পেটের উপর কুজ্ঝটিকা ! একবার ঠিক হলো, হাওড়া-টু-দিল্লী প্রত্যেকটা স্টেশনে পুরি-তরকারি খেয়ে বেস্ট পুরি ঠিক হবে ভোটাভুটি করে, আরেকবার ঠিক হলো কোথাকার ঝালমুড়িতে কত ঝাল না জানলে জীবনটাই বৃথা ... (এক দাদা আবার ঝালমুড়িতে ঝাল না পেয়ে আরেক আলুকাবলিওলা-র কাছে একটা কাঁচা লঙ্কা ধার চেয়েছিলো, বলেছিল ফেরার ট্রেনেও তো উনি-ই আবার উঠবেন, তখন না হয় একটা কাঁচা লঙ্কা ফেরত দিয়ে দেবে।)

সব গল্পেই একটা না একটা ভিলেন থাকলে জমে না, আমাদের ট্রেনের গল্পের ভয়ের মুখোস পরে থেকে থেকে হানা দিতো টিটিই-রা, খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে সবার হাতে টিকিট দেখে তবে ছাড়, একটু এদিক-ওদিক হলেই ... বাঘে ছুঁলে যদি আঠারো, পুলিশে ছুঁলে ছত্রিশ ... টিটিই ছুঁলে কত হয় তা যাঁরা টের পেয়েছেন সে হতভাগারাই জানেন ... এই যেমন আমি ...

আমাদের কলেজের সেকেন্ড ইয়ার, গোয়া যাওয়া হবে, এক্কেবারে শিক্ষামূলক ট্যুর ... যাওয়ার আগের দিন ভোররাত্রে জানা গেলো কোনো এক মহাপুরুষ গোটা কলেজের গ্রূপ টিকিট ঝেঁপে দিয়ে আম্বানি হয়ে গেছে ... এদিক আমাদের সমবেত পুচ্ছে হালকা করে হাম্পু ! কিন্তু সে নতুন জওয়ানির জোশ, একবার ছাড়া পেলে ধরা মুশকিল, ঠিক হলো ট্রেনে উঠে পড়া হবে, তারপর ম্যানেজ দেওয়া যাবে। সে যা জম্পেশ ট্রেন জার্নি হয়েছিলো, র‍্যামসে ব্রাদারকেও হার মানায়, দমবন্ধ সাস্পেন্সের মাঝে নতুন নতুন রিউমার, কেউ বলছে দুটো স্টেশন পরে রেল্পুলিশ দাঁড়িয়ে  হাতকড়া গুনছে, কিন্তু এতো বিশাল গ্যাং বলে হয়তো কোমরে দড়ি-ই নিয়তি, আশাবাদীরা খবর আনছে কোন সিনিয়রের বাবা নাকি কোন মিনিস্টারের খাস বন্ধুর পাশের ফ্ল্যাটেই পার্টি করে , গায়ে হাত দিলেই একটা ফোন, গোটা রেল কোম্পানি উঠে যাবে ... (শেষমেশ কি করে পৌঁছেছিলাম, ঠিক জানিনা, আজ-ও) ...

তবে এক মাঘে শীত যায় না, বিশেষ করে বাঙ্গালীর তো নয়-ই ... দিল্লী থেকে ট্রেনিং শেষে ফেরার দিন, বন্ধুরা জোরকদমে প্যাক করছে, আমি জানি আমার টিকিট পরের দিন, আমার বেস্ট ফ্রেন্ডের টিকি(ট)-ও আমার জিম্মায়, আজ রাত্রে বরং সাঁটিয়ে রাজিন্দর ধাবায় তন্দুরি খাওয়া যাক ... পরের দিন পূর্বা এক্সপ্রেস ধরতে যখন স্টেশানে পৌঁছলাম, পানু জিগ্যেস করলো, "টাইমটা ঠিক দেখেছিস তো? সাড়ে চারটে?" ... আমি পকেট থেকে টিকিট বের করে দেখি হ্যাঁ টাইম-এ ভুল হয়নি, ট্রেনটা একদিন আগেই ছেড়ে চলে গেছে । ভাগ্যি দুজনের পকেটে মিলিয়ে অল্প টাকা ছিলো, টিটি এসে জেনারেল ক্লাসে তুলে দিলো ... বাথ্রুমের পাশে, লোকে হিসি করছে আর মাঝে মাঝে দাঁড়িয়ে বিড়ি ফুঁকছে, আর দরজার বাইরে পা ঝুলিয়ে বাড়ি ফিরছি আমরা ...

ব্যাপারটা রোম্যান্টিক ভাবছেন? আদৌ না ... এই ধরুন যাচ্ছেন মনের আনন্দে গান গাইতে গাইতে, আগের কামরার ফ্যামিলির ডিনার শেষ হলো ... হঠাৎ বসে বসে দেখবেন একের পর এক মিসাইলের মতো এটোঁ পাতা আর প্লাস্টিক জানলা থেকে ধেয়ে আসছে আপনার দিকে, অনেক ডজ করে যাও বা সে পুষ্পবৃষ্টি এড়ালেন, শুরু হলো কুল্কুচি করা জলের বন্যা ... পানু ছেলেবেলায় যোগাসন আর জিম্ন্যাস্টিক, দুয়েই চ্যাম্পিয়ন ছিলো - হঠাৎ এক অপোগন্ড কুচো আর তার বাপ-মা সভয়ে দেখলো, রাতের অন্ধকারে পূর্বার জানলার শিকের বাইরে দিয়ে একটা ভয়াবহ রোদে পোড়া , দাড়িয়াল মুন্ডু, সে বাংলা-মেশানো হিন্দিতে শাসাচ্ছে ; ফির সে জানলা দিয়ে কচড়া ফেঁকলে তার গুষ্টি কি তুষ্টি ... আমার বিশ্বাস স্বচ্ছ ভারত অভিযানের প্রথম সেনানী সে-ই ... আমার বন্ধু পানু ...

আর ভয় ছিলো রেল-গার্ডদের, বিশেষ করে যদি বিড়ির নেশা থাকে, দরজার কাছে গিয়ে এক বন্ধু খাবে আর আরেকজন গার্ড দেবে দেখার জন্য কেউ আসছে কিনা ... কেউ কেউ আরেকটু কড়া বিপ্লবী, কাউকে কিছু না বলে ঢুকে পড়তো বাথ্রুমে ... এইরকম-ই একজন ছিলো মাতাল, মনের আনন্দে সিগারেটে শেষ টান টা দিয়ে যেই বেরোবে, দ্যাখে বাইরে রেলের গার্ড হাসি হাসি মুখে দাঁড়িয়ে। মাতলু-ও চুঁচড়োর খুনখার আদমি, হাত তুলে বললো, "কই সিগারেট কিধার? সার্চ কিজিয়ে ! " রেল গার্ড দেখলো বিপ্লবীর উত্তোলিত হাতের মুঠোয় শক্ত করে ধরা এক-প্যাকেট দেশলাই !

স্লিপার-ক্লাসে হরদম উঠতো নানারকমের খাবার-দাবার, আর উঠতো অনেক অনেক টিকিট-ছাড়া যাত্রী, এক কোণে টুক করে বসে পড়ে তাঁরা সমাধি লাভ করতেন - তারপর যাই জিগ্যেস করুন, "কোথায় যাবেন? সিট কোথায়? মামার বাড়ী পায়া হ্যায় ক্যায়া?" - সবের-ই উত্তর সেই এক, নির্বিকার নৈঃশব্দ ! সে এক তুমুল ক্যেওস ... হঠাৎ সবাই দেখলো ট্রেনের সব কামরায় হইচই, খালি মাঝে একটি আশ্চর্য মরূদ্যান ! জানা গেলো সেই কামরায় যাতায়াত করছেন আমাদের আরেক দাদা, যার অনেক অতিমানবিক ক্ষমতার মধ্যে একটি হচ্ছে যোজনগন্ধী পায়ের মোজা ... যেখানে তিনি শ্রীচরণকমল দুখানি ন্যস্ত করতেন, কয়েক মাইলের মধ্যে মশা-মাছিরাও টুপটাপ মরে ঝরে পড়তো আকাশ থেকে ... তারপর থেকে কতবার যে তিনি বিপদভঞ্জন হয়ে এসে দাঁড়িয়েছেন দুর্ভ্যেদ্য জঙ্গল থেকে দুরন্ত এক্সপ্রেস, শুনলে লোকনাথ বাবাও নতুন চাকরি খুঁজবেন ...

লিখতে লিখতেই অনেক ভাবলাম, নাঃ আমার শেষ দূরপাল্লার ট্রেনজার্নি সেই দিল্লী টু হাওড়া, বাথ্রুমের পাশে মেঝেতেই ... এদিক-ওদিক খুচরোগুলো বাদ দিলে ... আর মনে পড়লো, আমার সেই বন্ধুর এক ছাত্রের কথা ... তার বাবা-মাও আমাদের লাইনের, অঙ্ক কষে জীবন কাটিয়েছেন, ছেলেকেও সেইদিকেই ঠেলাঠেলি করতেন ... আমাদের ট্রেন-কাহিনী যখন লোকের মুখে মুখে ফিরছে, ছেলেটি সাহস পেয়ে বাবা-মা কে গিয়ে বললো, 'দেখেছো তো সারাজীবন গাঁতিয়ে অঙ্ক করলে কি দশা হয়? আমি বরং ফিজিক্সটাই মন দিয়ে পড়ি' ...


Saturday, March 11, 2017

রঙ-রুটের বাস



শিকড়-বাকড় প্রায় সব-ই ছিঁড়ে গেছে অনেকদিন হলো, তাও পলিটিক্স আর পপুলেশন বৃদ্ধির বাইরেও এককালে একটু-আধটু খবর রাখতাম, আর কিছু না হোক কবে কি পালা-পার্বণ হচ্ছে ্সেটা ঠিক জেনেই যেতাম - হঠাৎ আজ সকালে ফেসবুক  খুলে জানতে পারলাম দেশজুড়ে দোল হচ্ছে .. শুনেই এই প্যাচপেচে বৃষ্টির দিনে মনটা আরেকটু স্যাঁতসেঁতে হয়ে গেলো ...

এ পোড়া দ্যাশে ভাঙ-টাঙ পাওয়ার তো কোনো আশাই নেই, উদ্যমী দেশোয়ালি ভাই-বেরাদরদের দেখা পাওয়াও মির‍্যাকলের সমতূল্য, কাজে এক্কাপ কফি খেয়েই চোখ বুজে কল্পনা করে ফেললাম খানিক। পষ্ট দেখলাম চারদিকে রংজলে ভরা বেলুন ছুটছে কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের মতন, কিছু হনুমান রঙ মাখা ছেলেপিলে জামা কাপড় ফর্দাফাঁই করে হিংস্র উল্লাসে লাফাচ্ছে - আমার আবার ভায়োলেন্স পোষায় না, তাই মাঠের এককোণে একটা থান ইঁটে মাথা দিয়ে দিব্য নাক ডাকাচ্ছি ... আর পাশে কোনো এক সদ্য প্রেম সেরে ওঠা কিশোর, ভারি দুঃখের সাথে ধানাইপানাই করছে, সিদ্ধিলাভ মনে হচ্ছে আর বেশী দূরে নেই ...

অবিশ্যি ছোটোবেলায় দোল ব্যাপারটা আদৌ হোলি ছিলো না আমাদের বাড়িতে, বাবা-মা কচি বয়সেই ঘোষণা করে দিলেন, দোল মানে বড়োজোর গুরুজনদের পায়ে অল্প একটু এবং বিনিময়ে মাথায় আরো কম আবির - এবং বেসরকারী কারফিউ, রাস্তায় ওৎ পেতে কারা যেনো বসে আছে, বেরোলেই নর্দমার জলে চুবিয়ে বাড়ি পাঠাবে ... পরেরদিন স্কুলে গেলে দেখতাম এক ক্লাস পরিষ্কার করুণ মুখের মাঝে কয়েক জোড়া লাল-রঙা কান আর বিজয়ীর হাসি, টিচারের বকুনি খেয়ে চওড়া থেকে চওড়াতর হচ্ছে সেগুলো - সেই নিষ্পাপ নব্বুইয়ের সেইগুলোই ছিলো আসল প্রতিবিপ্লব ...

আমারও সহজেই সময় এসে গেলো, পাড়ায় মাঠের বন্ধুরা বললো - পরের দোলে আমায় বাঁদুরে রঙ মাখানোর দায়িত্ব গোটা জামরুলতলার। বাবা প্রথমে নর্দমার জলের ভয় দেখালেন, তারপর বুঝলেন মধ্যবিত্ত বাঙ্গালী আইসক্রিম, পেপসি সবতেই নর্দমার ভয় টেনে এনে ব্যাপারটাকে ধর্মঘটের মতোই অকেজো করে ফেলেছে, তারপর বললেন বেলুন মারলে লাগবে, তাতে বললাম তাহলে শুদ্ধু বড়োদের দিকেই ছুঁড়বো - শেষমেশ বললেন জোর করে সিদ্ধি-ভাঙ খাইয়ে দিতে পারে, বলেই বুঝলেন জোরটোর লাগবে না, সেসব দৈব প্রসাদের প্রতি জন্ম থেকেই আমার অবিচল ভক্তি ...

তারপর থেকেই দোলের মানে হুট করে পালটে গেলো - সেই সকালে মা একটা পুরোনো টিশার্ট বের করে দিতেন গজরগজর করতে করতে, আমরা কয়েকজন এপাড়া ওপাড়া ঘুরে দস্তুরমতন গোটা এলাকায় দোলের ধাত এবং জাত নিয়ে রিসার্চ করে বাড়ি ফিরতাম বেলা গড়িয়ে - বাবা তখন খ্যাপা টাইসনের মতন রিঙে পায়চারি করছেন, বাড়ি ঢুকলেই হুক-পুল-জ্যাব মেরে সোজা কলতলায় - আমার কুছ পরোয়া নেই, পরের দিন স্কুলে গিয়ে আমিও গল্প বলবো -- সাঁতরাপাড়ায় কেমন পাবলিকের চান করার জায়গাটায় রঙীন চৌবাচ্চা বানিয়েছিলো, মাম্পির বাবা কেমন বাড়ির বাগানে লুকিয়ে রেখেছিলেম পাড়ার নেড়ী-ন্যাড়াদের, রঙের থেকে বাঁচাতে - আর শেষে বলবো সেরাটা,  পেয়ারাবাগানের গলিতে আমার আর আমার বন্ধুর মাথায় ছাদ থেকে বালতিভর্তি জল ঢেলে দিলো একটি মেয়ে, "পালিয়ে যাওয়ার আগে একবার চোখাচুখি" - দোলের গল্পেও রঙ না চড়ালে আর কিসে চড়াবো, বলুন?

তবে নাঃ, সিদ্ধি-টিদ্ধি কেউ দিতো না, সেই কলেজে যাওয়া অব্দি দোল এক্কেবারে মাটিতেই কেটেছে ... কলেজে তো এলাহি ভরোসা, মেসের টেবিলে বিশাল বিশাল গামলায় মেসের কালিদা-বংশীদারাই বানিয়ে রাখতো অমৃতের শরবত, আ-হা ! তার বর্ণনা দেওয়ার ক্ষমতা এই খাগের কলমে অন্ততঃ নেই - তবে হ্যাঁ, যা যা ম্যাজিক দেখতাম ভোলবার নয় ...

এক দোর্দন্ডপ্রতাপ জুনিয়র ছিলো, জেজে, চট করে তার পা বা মাথা টলে না, হরলিক্স পার্টিতে হাফ-ছাদ যখন মৃদুমন্দ মলয় বাতাসে উড়ে বেড়ায় ইধার-উধার, জেজে তখন মন দিয়ে এটাসেটামিক্স করে বা নিপুণ দক্ষতায় পথভোলা পথিকদের পৌঁছে দেয় নিজ নিকেতনে ... একবার দোলের দুপুরবেলা, সেই জেজে, আমি, আরো কয়েক ঘোর পাপী বসে আছি মেসের মাঝখানে গোল করে, আর এক বন্ধু যাকে রাঙানোও যায়নি, ভাঙানোও যায়নি ... হঠাৎ সবাই বুঝলো কেউ-ই প্রায় ঘন্টাখানেক কোনো কথা বলছে না, খালি ফ্যাঁচফ্যাঁচ করে বেড়ালের মতন হেসেই চলেছে - থামার নাম নেই , আর সেই একজনের বদ্ধমূল ধারণা সবাই তার উপরেই হাসছে, কিন্তু কেন কেউ জানেনা... একটু পর জেজে প্রথম কথা বললো, 'বুঝলে, সিদ্ধি হচ্ছে অনেকটা ইথার তরঙ্গের মতন, যারা খেয়েছে সবাই কানেক্টে্‌ড, বাকিরা সিগন্যাল ধরার লোভে অ্যান্টেনা বাড়িয়ে আছে, কিন্তু ক্লিয়ার পিকচার আসছে না' ...

সেদিন বাড়ি ফেরার সময় ফাঁকা মিনিবাসে উঠে জেজে দুটো টিকিট চেয়েছিলো, কন্ডাক্টর অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকায় একটু পরে বলেছিলো, কেনো একটা আমার, একটা আমার ব্যাগের !

আমি দুপুরে বাড়ি ফেরার রিস্ক-ই নিইনি, সন্ধ্যেবেলায় হঠাৎ একটা ফোন আসে, এক পোটেনশিয়াল ছাত্রীর, অঙ্ক শিখতে চায়, তাদের বাড়ি গেছি, সন্দেশ-শরবৎ সাজিয়ে দিয়েছে, আমার এদিকে প্লেটে হাত দিয়েই মনে হলো অনেকদিন ক্যারম খেলা হয়নি, একটা গোলপানা কড়াপাকের মিষ্টিকে স্ট্রাইকার বানিয়ে একটা ইঞ্চি শট অনেকক্ষ্ণ ধরে মেপে যাচ্ছি - হঠাৎ পর্দার ওপার থেকে দয়ালু কাকিমার গলা ভেসে এলো, 'বেশী অঙ্ক-টঙ্ক করলে না এরকম হয়ে যায়, আমার মেয়েটাকে বরং ডাক্তারিটাই পড়িয়ো বুঝলে?' ...

আরেকবার দোলের সন্ধ্যেয় পূর্ণিমার চাঁদটাকে তাড়া করে করে ঘুরে বেড়িয়েছিলাম আমি আর এক বন্ধু মিলে, ঠিক করেছিলাম সেই রাত্তিরে গোটা উত্তর কলকাতার সবকটা চায়ের দোকান ঘুরে চা খেয়ে ঠিক করবো কার চা সবচাইতে ভালো - কোথায় কোথায় ঘুরেছিলাম সেটা আর মনে নেই, তবে সেরা চায়ের দোকানটা মনে আছে আবছা - একটা উঁচু রেললাইনের জমি, তার তলার একটা গুমটি ঘরে একটা দিদু চা বানায় কেরোসিনের স্টোভে ...

লিখতে-লিখতেই মনে পড়লো সেদিন সন্ধ্যেবেলাও ঠিক এমনি টিপটিপ বৃষ্টি পড়ছিলো সারাক্ষণ, ভিজতে ভিজতে একটু হাঁটা, আবার ছাঁট দেখলে দাঁড়িয়ে একটা সিগারেট ... বুড়ি দিদুর দোকানে কেউ আসেনি সেদিন ... অনেকক্ষ্ণ গল্প করেছিলাম ... বাড়ি ফিরে সেদিন আয়নায় দেখেছিলাম বৃষ্টিতে ভিজে রঙ আর নেশা দুটোই ফিকে হয়ে গেছে একদম ...

তারপর আর খেলিনি, নাঃ ... খুব বৈরাগ্য টাইপের এসে গেলো ... কোলাহল আর ভালো লাগতো না, ফাঁক পেলেই ছুটে শান্তিনিকেতন চলে যেতাম, বসন্তোৎসব মনে হতো স্বপ্নের মতো, সকালবেলায় "ওরে গৃহবাসী"-র সাথে গলা মেলাতে মেলাতে অবাক হয়ে দেখছি ফাগুন হাওয়ায় উড়ন্ত গুলাল, মনে মনে কোথাও ওই হলুদ-লালের দলে মিশে যেতে চাইছি আমিও, দলে ভিড়ে দুপুরবেলা যাচ্ছি কঙ্কালিতলার মাঠ, বিকেলের দিকে কি কোপাই ? ... হয়তো সে আর এক জন্মের কথা, ওই কোপাইয়ের মাঠেই হয়তো বসে আছি ... গলা বেয়ে গান উঠছে আজ, বন্ধুরা সারি সারি সাইকেল গাছের গায়ে ঠেস দিয়ে রেখেছে আর মাদল বাজছে জ্যোৎস্নার চরাচরে, সবাই নাচছে আগুনকে ঘিরে ...

কখনো ভাবতাম নাঃ, অনেক দূরে কোথাও অন্য কোনো দেশে যেন জন্মেছি আমি, বৃদ্ধ হয়েছি লেখার পিছনে ছুটে ছুটে... জানলা দিয়ে দেখতে পাচ্ছি বরফে ঢাকা ঝাউগাছের তলায় বাচ্চারা দৌড়ে বেড়াচ্ছে, আমি ধূমায়িত কফির কাপের পাশে টাইপরাইটারের সামনে পরের প্লটটা ভাবছি ...

যেন সেই স্বপ্নের মধ্যেই জেগে উঠলাম আজ, বাইরে এখনো সেই অঝোর বৃষ্টি, সেই ধূসর আকাশ, তার মাঝে খানিক শিল পড়লো যেনো টুপ্টাপ করে, গিন্নীমশাই কফির কাপে শিল ধরতে গিয়ে ঠান্ডা হাওয়ার ঝাপ্টা খেয়ে পালিয়ে এলেন, এখন আমার চারপেয়ে ছানা মেচকু সারা পাড়াকে কীর্তনগান শুনিয়ে তেনার কোলে শুয়ে নাক ডাকাচ্ছে আর স্বপ্নে খরগোশ আর কাঠবেড়ালী তাড়া করে যাচ্ছে প্রাণপণ .. লেখা শেষ করেই ওদের শোনাবো, তারপর দারুণ এককাপ চা আর সিঙ্গারা ! কে বলেছে আরকানসায় দোল আসে না?