Tuesday, May 4, 2021

অসংখ্য সমুদ্র বয়ে যাচ্ছে


‘‘অসংখ্য সমুদ্র বয়ে যাচ্ছে।
সময়ের স্রোত
এবং কেই বা বিখ্যাত হতে চায় এবং অটোগ্রাফ সই করতে চায়
সিনেমা স্টারদের মত…
…আমি জানতে চাই আমার মৃত্যুর পর কী হবে…’

(অ্যালেন গীনসবার্গ, ‘ছবির দেশে কবিতার দেশে’ বই থেকে।)


“আজ সন্ধ্যায় ডরথি নর্মানের পার্টিতে অনেকের সঙ্গে আলাপ হলো। প্রথমে উল্লেখ্য অ্যালান গিন্সবার্গ। তোমার মুখে যার নাম শুনেছি, কিন্তু যার লেখা আমি কিছুই পড়িনি। সম্ভ্রান্ত ককটেল-পার্টিতে একটা গলাখোলা লাল শার্ট গায়ে দিয়ে এসেছে (স্পষ্টতই আমার কবিতা পড়েনি); ভারি সুশ্রী দেখতে, আমি দেখামাত্র ভালোবেসে ফেলেছি, ছেলেটিকে দেখে তোমার কথা বড্ড মনে পড়ছিলো। বললে—আমেরিকার পাঁচজন শ্রেষ্ঠ কবি শীঘ্রই ভারতবর্ষ আক্রমণ করতে চলেছে : কেরুয়াক, গিন্সবার্গ, আরো কে-কে! ‘সুসভ্য ভারতীয়দের বিস্মৃত সোমরসে দীক্ষাদান এদের মহান ব্রত। আমি বললুম ‘সোম’ বোধহয় ফরাশি বা ইতালীয় ওয়াইনের মত নিরীহ দ্রাক্ষারস মাত্র ছিলো, কিন্তু হাক্সলি এদের মগজে যে-ভূত ঢুকিয়েছেন তা তাড়ানো আমার মত ওঝার কর্ম নয়। এরা বিবিধ নেশার চর্চা করে থাকে—গাঁজা, সিদ্ধি, চরস ইত্যাদি, তুরীয় অবস্থায় কবিতা লেখে, সামাজিক রীতিনীতিকে পদদলিত করে—অথচ, এই সমস্ত অতি পুরোনো অতি মলিন অতি ব্যবহৃত মুদ্রাদোষ সত্ত্বেও গি্নসবার্গকে আমি অস্বীকার করতে পারলুম না, আমার মনে হলো লোকটা সত্যি কিছু খুঁজছে, খুঁজে বেড়াচ্ছে, আর দশজনের মতো নয় সে, ভিতরে এক ফোঁটা আগুন জ্বলছে। আমি আবেগের বশে কাল রাত্রে তাকে খেতে বলে দিয়েছি, একজন বন্ধু নিয়ে আসবে বলেছে —কী অবস্থায় আসবে, আস্ত দল নিয়েই চড়াও হবে কিনা—এ-সব ভেবে এখন একটু উদবিগ্ন বোধ করছি, কিন্তু ছেলেটির চেহারা স্মরণ করে অনুতপ্ত হতে পারছি না”
বুদ্ধদেব বসু-র চিঠি জ্যোতিকে, ১৯/৩/৬১।

ছোটোবেলায় সুভাষ-স্যার ইংরেজি কবিতা পড়াতে পড়াতেই হঠাৎ একদিন বলেছিলেন অ্যালেন গিন্সবার্গ নামে একজন বিখ্যাত মার্কিন কবি ছিলেন, তাঁকে নাকি কোনো এক কবিতার আসরে একজন দর্শক কবিতার অর্থ বুঝিয়ে দিতে বললে গিনসবার্গ তার উত্তরে ধীরে ধীরে খুলে ফেলেন তার পরনের শেষ সুতোটুকুও। গল্পটা শেষ করে সুভাষ-দা বলেছিলেন, ‘কবিতা বুঝবার নয়, বাজবার’।

লরেন্স লিপটন আর আনাই নিনের বিবরণীতে সেই দিনের কথা ধরা আছে সুন্দরভাবে - সময়ঃ সন ১৯৫৭। কবিতা পড়তে স্টেজে উঠেছেন অ্যালেন, একজন হেকলার চেঁচিয়ে বল্লে “Come and stand here, stand naked before the people, I dare you! The poet is always naked before the world.” … উত্তরে অ্যালেন খুলে ফেলেন পরিধেয় সবকিছু।

প্রায় এক দশক পরে অ্যালেন নিজে যা লিখেছিলেন সেটা খানিকটা এইরকম - ‘এমন একটা গুজব খুব চলে যে কলেজের পারফরমেন্সে আমি প্রায়-ই জামাকাপড় খুলে নগ্ন হয়ে যাই, কিন্তু দুর্ভাগ্যের কথা শেষ দশ বছর কোনো পাবলিক রিডিঙেই নগ্ন হওয়া হয়নি আমার। সেই শেষ একবার ১৯৫৭ সালে একটা ঘটনা ঘটেছিলো, যেটাকে অ্যানেকডোট হিসেবে বারবার বলা হয়। সেইদিন একটা প্রাইভেট রিডিং হচ্ছে একটি বাড়ীতে, গ্রেগরি করসো কবিতা পড়ছেন (সেই গ্রেগরি করসো, সুনীলের বর্ণনায় “অতিশয় বিশুদ্ধ ধরনের কবি, এবং একেবারেই পাগলাটে ধরনের মানুষ”, যিনি সুনীলের কাছ থেকে পঞ্চাশ ডলার ঝেড়ে দিয়েও জুয়া খেলে অনেক টাকা জিতে এসে আবার ফেরত দেন পাই-টু-পাই।) সেইদিন করসো পড়ছে নিজের লেখা কবিতা “Power”, হঠাৎ এক লাল-চুলো হলিউডি রিপোর্টার চেঁচিয়ে জিগ্যেস করলো “Whatter you guys tryana prove?”, আমি বোধহয় কিছু না ভেবেই স্বতঃস্ফূর্ত জবাব দিয়ে দি,
- “Nakedness!”
লালচুলো আবার চেঁচায়,
- “Whadya mean nakedness?”
আমি নিঃশব্দে পরনের সবকিছু খুলে ফেলি আস্তে আস্তে, তারপর আবার পরেও নিই, নিঃশব্দে। আমার ঠিক পাশে দাঁড়িয়ে করসো তখন পড়ে যাচ্ছে তাঁর সেই দীর্ঘ কবিতা “পাওয়ার”।“
পরে জেনেছি, নগ্নতাকে গিন্সবার্গ বরণ করে নিয়েছিলেন জীবনবোধ হিসেবে, আক্ষরিক অর্থেও যেমন কবিতায়-শিল্পেও ঠিক তেমন-ই। লিখেছিলেন, “Scribble down your nakedness. Be prepared to stand naked because most often it is this nakedness of the soul that the reader finds most interesting”। সত্যিই তো, নিজেকে সম্পূর্ণ উন্মোচন না করলে সত্যিই কি পড়া যায় প্রত্যেকটি বলিরেখা? পুরোপুরি সৎ হওয়া যায় শিল্পের কাছে?
গিনসবার্গ সত্যিসত্যিই বিশ্বাস করতেন, “Candor ends paranoia”!
শোনা যায়, হেনরি কিসিঙ্গার-কেও নাকি তিনি প্রস্তাব দেন তাঁর সাথে একসাথে নগ্ন হওয়ার শুধুমাত্র প্রকৃত সৎ আলোচনার স্বার্থে (বলাই বাহুল্য কিসিংগার সে প্রস্তাবে সাড়া দেননি)।
ওনার কবিতা তো বহুপঠিত, বহচর্চিত। সেসব আর দিয়ে ভারাক্রান্ত করবো না, তবে সুনীল গাঙ্গুলীকে লেখা একটি চিঠির অংশ হবহু তুলে দিলাম নীচে। ওঁরা বেঁচে থাকলে হয়তো আজ-ও এটা অপ্রাসঙ্গিক হতো না, যেমন অপ্রাসঙ্গিক হবে না কবিতা, কোনওদিন-ই কোনো রাষ্ট্রযন্ত্রের ভয়ে।
““What should be my stand.” Mine is, just tell the truth of what you feel (as far as it is socially safe—you don't want to be crucified)—including my confessions, resentments, enthusiasms. In other words, “what should be” leads one astray. But one’s real feelings are rarely what they should be. All you can really express well is what your real, actual, private (not should be) feelings actually are. Leave the “should be” perfections to the creeps who are robots, Marxist or Jai Hind style. Yr aversion to the Chauvinism and shouting are really quite normal sensible reactions. I got hysterical when I discovered that the one Chinese restaurant in allahabad had changed to Hindu menu after informal “suggestions” by local politicians. A poet's war work is to stay human, it's an old attitude taken for granted by now in Europe. Also its a great oppurtunity to see how really evil people can be. That's why I like Céline's writing-he makes a big picaresque comedy out of the french war hysteria, World War I. Don't flip out & get drunk-just keep writing yours own silly poetry & publish yr own magazine.
Or Dont Publish. Fuck it. The joy will be writing something for real,--
God is listening remember. ... Write for an audience of Martians.”

রাষ্ট্রযন্ত্রকে, এস্টাব্লিশমেন্ট-কে আজীবন মধ্যাঙ্গুষ্ঠ দেখানো অ্যালেন গীনসবার্গের আজ, পাঁচ-ই এপ্রিল, মৃত্যুদিন। আর কিছু মনে থাক না থাক, এই আতঙ্কের দিনগুলিতে ওঁর একটা কথা লিখে রাখুন দেওয়ালে, চৌকাঠে, লুকোনো ডায়রিতে, পারলে নিজেকে নিজেই বলুন -
"Candor ends paranoia"।

(সঙ্গের ছবিটিঃ বব ডিলান এবং অ্যালেন গিনসবার্গ, বন্ধু জ্যাক কেরুয়াকের সমাধিতে বসে পড়ে শোনাচ্ছেন “মেক্সিকো সিটি ব্লুজ”-এর কবিতা।)

পুনশ্চঃ গিনসবার্গের চিঠিটি 'সুনীলকে লেখা চিঠি' বই থেকে তুললাম, বানান (অ)বিকৃত রেখেই।

করসোর কবিতাপাঠঃ https://www.youtube.com/watch?v=GhZchqsN69o