Thursday, August 22, 2019

প্রথমতঃ



বাবার কথা মনে পড়লেই একটা গন্ধ নাকে আসে অবিকল ... সদ্য জ্বালানো উইলস ফ্লেকের গন্ধ, আমি চিনি  ... আবছা একটা ছবি ভেসে ওঠে - বাইরের পেশেন্ট দেখার ঘরের কাঠের চেয়ার, জানলার ঠিক ধারেই, বাবা মুখের সামনে লাইব্রেরী থেকে আনা একটা বই ধরে আছেন ... মুখ দেখা যাচ্ছে না, শুধু রেক্সিনের বাঁধাইয়ের আড়াল থেকে এক-একটা রিং উড়ে উড়ে জানলা দিয়ে বেরিয়ে মেঘ হয়ে যাচ্ছে ...

বাবা প্রায় সারা-জীবন চেন-স্মোকার ছিলেন ! মানে সত্যিকারের চেন, একটা নেভার আগে সেইটার আগুনে আরেকটা জ্বালানো চেন ... দিনে বোধহয় দেড় কি দু-প্যাকেট আরামসে উড়ে যেতো ! আমাদের বাড়ির প্রত্যেকটা ক্ষয়ে যাওয়া কড়ি-বরগা এমন কি পুরোনো পর্দার ভাঁজে ভাঁজে শুঁকলে হয়তো এখনো হাল্কা সুবাস পাওয়া দুষ্কর নয় ... ন্যাপথালিনের গন্ধঅলা পুরোনো শার্ট আর আমাদের সবকটা মশারি-র অগুন্তি ফুটো-ও তার সাক্ষী ... সেই যেমন হেনরি ফন্ডা লিখেছিলেন, 'I have been close to Bette Davis for thirty eight years, ... and I have the cigarette burns to prove it" ...

অনেক ভেবে মনে হচ্ছে খুব ছোটোবেলায় ক্যাপস্ট্যান খেতে দেখেছি, আর চার্মস ... আর ইস্কুলের শেষদিক থেকে উইলস ... মাসের শুরুতে এক-দু প্যাকেট নেভি কাট, বাকিটা ফ্লেক না হয় গোল্ড ফ্লেক ... মাঝে এদিক-ওদিক যে যাননি এমন নয়, এই যেমন আমি যখন থার্ড ইয়ারে পড়ি, হঠাৎ একদিন দেখি বাইরের ঘরের টেবিলে একটা স্পেশালের প্যাকেট ... খুব ধন্ধে পড়ে গেলাম ... জিগ্যেস-ও করতে পারছি না, "এটা তোমার?" ... আবার বিনা বাক্যব্যায়ে একটা আস্ত প্যাকেট হাত-ছাড়া হবে এ-ও মানা যাচ্ছে না! বোধহয় এইসব সাত-পাঁচ ভাবতে ভাবতে হাঁ করে প্যাকেট-টার দিকেই তাকিয়ে ছিলাম ... বাবা মুখ থেকে বই-টা সরিয়ে বললেন, "স্পেশাল কিন্তু তামাকে কাঠ-কয়লা মেশায়, বরং ফ্লেক ভালো ... " ... বলাই বাহুল্য, আমি সে সদুপদেশ শিরোধার্য করে টুক করে কেটে পড়া ছাড়া সেই মুহূর্তে আর কিছু ভেবে পাইনি ...

এইখানে বলে রাখা ভালো, আমি কিন্তু এই মুহূর্তে নন-স্মোকার, অন্ততঃ এই লেখাটা শেষ করা অব্দি তো বটেই ...

আর সত্যি বলতে কে যে ধরিয়েছিলো, সেইটা একটু আবছা ... তবে দিব্যি মনে আছে, যোগেশ-দার কোচিং ক্লাসের পাশেই ছিলো "আবার বৈঠক" মাঠ ... ক্লাস শুরুর আগে এক দল যেতো (তাঁদের আর নাম করে লজ্জা দিচ্ছি না), আমিও যেতাম সঙ্গে সঙ্গে ... তা সে বয়সে বন্ধুরা ঝাঁপ মারতে বললেও মেরে দিতাম, একটা নেশা আর এমন কি?

আর ভালো-ও কি কিছু শিখিনি? যেমন ত্যাগ ও তিতিক্ষা ... স্পষ্ট মনে আছে ক্লাস এইটে যখন পড়ি, ফ্লেকের একটা সিগারেটের দাম ছিলো এক টাকা ... মানে সিঁথির মোড় থেকে ইস্কুলের অটো-ভাড়ার একের তিন ... সেই যে হেঁটে হেঁটে অভ্যেস করে ফেললাম, পরে কতো হেঁটেছি কলকাতার রাস্তায়, কখনো ভালোবাসার হাত ধরে, কখন-ও ঘেন্নার কলার চেপে ... একটুও কষ্ট হয়নি কিন্তু ...

সহ্যশক্তি-ও ... বাবা তখন কাশি সেরে উঠেছেন, আমিও এদিকে একে নতুন বিড়িখোর তায় আবার পাড়ার ভালো ছেলে ... প্রকাশ্যে তাম্বাকু-হাতে ধরা পড়ার ভয় দুইজনার-ই ... আমি একদিন সেন্টার সিঁথির একটা গলির-গলি তস্য গলিতে লুকিয়ে মনের আনন্দে সুখটান দিচ্ছি ... হঠাৎ দেখি বাবা-ও সেই গলিতেই মাছের বাজারের থলে হাতে গুটিগুটি আসছেন ... সেই যে ঘাবড়ে গিয়ে বিড়িসুদ্ধু হাত পকেটে পুরে দৌড় দিয়েছিলাম, একটি ছোট্ট ফোস্কাচিহ্ন এখনো সেই ইতিহাস জানে ...

তারপর থেকে যে কতোশতবার কেস খেয়েছি, সে লিখতে বসলে ট্র্যাজিক একটি মহাকাব্য হয়ে যাবে ... তা-ও দু-তিনটে ছড়ানোর গল্প না বলে পারছি না ...

এক, কোচিং-ফেরতা বন্ধুকে বললাম ক্লোর-মিন্ট খাবি? সে আঁতকে উঠে বললো ওরে বাবা, ক্লোর মিন্ট খেয়ে বাড়ি ঢুকলেই ভাববে নিশ্চয়ই বিড়ির গন্ধ ঢাকার জন্য মেন্থল খেয়ে এসেছি ... সিগারেট খেয়ে ক্যালানি খেলে না হয় সহ্য করা যায় - মিন্ট খেয়ে এই দামড়া বয়সে মায়ের প্যাঁদানি পোষায় না ...

দুই-টা আমার-ই ... আপাদমস্তক ক্লিন ইমেজ মেইন্টেন করে চলেছি বাড়িতে, সে যেন সাক্ষাৎ  ডেটল জলে ধোয়া বিবেকানন্দ ... হঠাৎ মা একদিন জামা কাচতে দিতে গিয়ে বললেন, তুই যে বলিস স্মোক করিস না, তা জামার পকেটে এতো তামাকের গুঁড়ো কেন? ... আমি অম্লানবদনে জবাব দিয়েছিলাম, হোস্টেল বড়ো নিষ্ঠুর জায়গা, সিনিয়র-দাদার আমাকে দিয়েই সিগারেট কিনতে পাঠায়, আমি পকেটে করে নিয়ে আসি ... আসা-যাওয়ার রাস্তায় অল্প খসে খসে পড়েছে ...

এই ঘটনার কদিন পরের কথা, আমি আর রাজা আই-এস-আইএর পেছনের একটা বাস্কেটবল কোর্টে বসে গ্যাঁজাচ্ছি ... (এইখানে বলা উচিৎ, এই প্রলেতারিয়াত কোর্টে কোনোদিন-ও বড়োলোকী বাস্কেটবল বা অন্য কিছুই খেলা হয়নি, খালি আমি ভালোবেসে একটি গাঁজার চারা পুঁতেছিলেম কোর্টের এক কোণে আর একটা ছাগল সেটা এক পড়ন্ত বিকেলে খেয়ে খুব আনন্দ পেয়েছিলো) ... তো গ্যাঁজাতে গ্যাঁজাতে হঠাৎ গুণ্ডার ফোন, আব্বে তোর বাবা-মা তোর রুমে ঢুকে পড়েছে ...

ঘরে ফিরে দেখেছিলাম, মা সব গুছিয়ে রেখেছেন ... এমনকি সিগারেটের প্যাকেটগুলো পর্যন্ত একজায়গায় জড়ো করে রাখা ... বাবা গম্ভীর হয়ে বললেন, খাবে খাও, আমাকে দেখে তো শিখবে না, দরজা বন্ধ করে খেয়ো না, কার্বন মনোক্সাইড ইজ আ ডেডলি সাবস্ট্যান্স ... (সেই থেকে, সুধী পাঠক, এখন-ও বন্ধ ঘরে খাই না, অন্ততঃ বারান্দায় যাই) ...

ভেবেছিলাম মার খাবো, কিন্তু খাইনি ... খাইনি বলেই হয়তো গভীর অনুশোচনা হয়েছিলো সেদিন ... হয়তো ছেড়েই দিতাম, কিন্তু কি করবো, একে তো প্রেমের ফাঁদ পাতা ভুবনে, তার উপর অসৎসঙ্গে রোজরোজ স্বর্গবাস ... মার্ক টোয়েন না কে যেন সেই বলে গেছিলেন না, সিগারেট ছেড়ে দেওয়া খুব সোজা, আমি নিজেই কয়েকশো বার ছেড়েছি ...

তবে কি জানেন ... ছেড়ে দেওয়ার পরেপরেই বড্ডো মিস করি  ... মনে হয় যেন আমাদের পোকায় কাটা জীবনের ছোট্ট-ছোট্ট ফাঁক-ফোঁকর গুলো কি সুন্দর ভরে যেতো সিগারেটের ধোঁয়ায় ... সেই ফাঁকগুলো বিশাল বড়ো মনে হয় ...

মনে পড়ে ফিফথ ইয়ারের কথা, রাত্রে খাওয়ার পর একটা নেভি কাট ধরাতাম এক বান্ধবীর সাথে, কাউন্টারে খেতাম   ... খানিকক্ষণ যে সেই অছিলায় বসে থাকতাম অন্নপূর্ণা কেবিনের ছোট্ট টেবিল-টায় ... সেই মুহূর্ত-টা, সেই একটা নির্জন, নিস্তব্ধ মিনিট ... আমি কিন্তু সত্যি বিশ্বাস করতাম, চা, কফি আর ব্যর্থ প্রেমের প্রকৃত স্বাদ স্মোকার ছাড়া আর কেউ-ই জানেন না ...

এখন মাঝে মাঝে মনে হয় আমাদের সেই প্যারেন্থেটিক্যাল স্পেসগুলো দখল করে নিয়েছে কেউ... যেন পাহাড়ে উঠছি তো উঠছি, সামনে অনেকটা আঁকা-বাঁকা পথ ... এক-একটা ওভারলুকিং পয়েন্ট এলে তিন বন্ধু দাঁড়াবো সেই বিশালত্বের সামনে ... কিন্তু কতোক্ষণ লম্বা সে মুহূর্ত? একটা সিগারেট তিনজনের ঠোঁটে ঘুরে ঘুরে শেষ হতে যতক্ষণ লাগে ঠিক ততোক্ষণ ... বছর কয়েক আগে একদিন হঠাৎ বুঝতে পারলাম, আমাদের সেই সময়ের ইউনিট এখন অচল, সৌন্দর্যের সামনে মুগ্ধ হওয়ার সময় বাঁধা এখন সেলফি-তে ...

কতো বন্ধু ছিলো জীবনে ... সিগারেটের বন্ধু ... অফিস-চত্ত্বরে এক কোণায় একটা ঘুপচি জায়গা বরাদ্দ বিড়িখোরদের জন্য, সেইখানে গিয়ে রোজ দেখা হতো কয়েকটা লোকের সঙ্গে ... মুখ লুকিয়ে চুপিচুপি এসেছে কাজের ফাঁকে ... তাদের সাথে যে কত সন্ধ্যে কেটে গেলো মেরিন ড্রাইভে, লাস্ট লোকালে আর কাফে মন্ডেগায় সে কথা-ও কি আর বলে শেষ করা যাবে?


যাই হোক, কি যে লিখবো বলে শুরু করেছিলাম আর কি লিখলাম কে জানে ... বিশ্বাস করুন এইটা কোনোভাবেই তামাকু সেবনের উপকারিতা প্রবন্ধ নয় ... একচুল-ও নয় ... বিশ্বাস না হলে বলুন, আমার সামনেই একটা দেশ থেকে আনা প্যাকেট ... তার উপরের পচা-গলা মাড়ি আর বুকের টিউবের ছবি দেখলে আঁতকে উঠবেন না এমন বীর পেড্রো ভূভারতে নেই ...

পড়েছিলাম সমরেশ মজুমদারের একসময় সিগারেট খাওয়া বারণ হয়ে যায় - কিন্তু ঐটি ছাড়া লেখা কিছুতেই আসতো না ... ভদ্রলোক তার ছোট্ট বন্ধ ঘরে বাঁ হাতে ধরে থাকতেন একটি জ্বলন্ত সিগারেট, ডান হাতে লিখে চলতেন একের পর এক গল্প, উপন্যাস ...

সেই অবস্থা আমার যে হয়েছে তা নয়, তবে হ্যাঁ, মাঝে মাঝে সেই বন্ধুগুলোর সাথে দেখা হয়, আড্ডা মারতে মারতে আমরা ঠিক করি, একদিন আশি পেরোবো আমরা একসাথে, সেইদিন সব তল্পি-তল্পা নিয়ে একটা সমুদ্রের ধারে ছোট্ট কুঁড়েঘরে গিয়ে উঠবো সবাই মিলে, আমাদের সঙ্গে থাকবে শুধু দারুণ কয়েকটা বই, দু-একটা পুরোনো ডায়রি ... আর অনেক অনেক আনফিল্টারড চারমিনার ...




Thursday, July 4, 2019

আধার রাতের বন্দী

আজকের বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডে একটি খবর বেরিয়েছেঃ মুম্বই পোর্ট ট্রাস্টের জনৈক কর্মী, রমেশ কুহাড়, তার স্যালারি অ্যাকাউন্টের সাথে আধার লিঙ্ক করতে অস্বীকার করেন ... এবং দীর্ঘ আইনি যুদ্ধের পরে এবং তিরিশ মাস বেতন না পাওয়ার পরে, শেষমেশ কোর্ট তার পক্ষে রায় দিয়েছেন ... এবং একটি ঐতিহাসিক উক্তি-ও করেছেন, বলেছেন, "Even one dissenter has a right to oppose a government order" ... হয়তো এইটাও বলে রাখা ভালো যে, রমেশ কুহাড়, পোর্ট ট্রাস্টের ৮০০ কর্মীর মধ্যে একমাত্র ব্যতিক্রম ...
বলাই বাহুল্য, তিরিশ তো দূরস্থান, তিন মাস বেতন না পেলেই আমার মতন লোকের ঘটি-বাটি বেচে রাস্তায় দাঁড়ানোর কথা ... কাজেই এই ধরনের সাহস দূর থেকে দেখে স্যালুট করা ছাড়া উপায় দেখছি না ... তবে এই ঘটনা থেকে নিজের আধার-অভিযানের দু-টুকরো গল্প মনে পড়ে গেলো, আদৌ একরকম নয়, তাও বলার লোভ সামলাতে পারছি না ...
ছোটবেলায় দেখতাম পুজোর ঠিক পরেপরেই বাড়িতে বাবার বন্ধু আর আত্মীয়-দের হাতে লেখা ছোটো ছোটো চিঠি আসতো, কখনো পোস্টকার্ড, কখনো ইনল্যান্ড লেটার ... আমরাও সোৎসাহে সেসব চিঠি পড়ে উত্তর দিতাম ... 'আমরা সকলে কুশল, তোমরা?" ... তা এই ফেসবুকের যুগে সেসবের পাট তো চুকেছে, তবুও প্রত্যেক বছর একটি চিঠি আমরা পাই, স্টেট ব্যাঙ্ক গরম-কালের মাঝামাঝি একটি চিঠি দেয়, প্রথমে মিষ্টি করে বলে তারা গ্রাহকদের চিনতে চায়, শেষে বলে "কই হে, আধার কই?"
আমি রমেশ কুহাড় নই এবং খুব-ই ভীরুপ্রকৃতি, কাজেই প্রথমে গিয়ে বললাম, আজ্ঞে আমার উপায়-ও নেই এবং সত্যি বলতে এতোখানি না চিনলেও চলে যাবে, সেসব তারা কানে তুললেন না ... এবং মায়ের শঙ্কাকূল মুখখানা দেখে ভাবলাম নিয়ম চুলোয় যাক, গোরু-ছাগলের কার্ড আছে, আমি আর কি দোষ করলাম ...
কার্ড করাতে কষ্ট হয়েছে বলবো না, লাইনে দাঁড়িয়ে মশার কামড় খেয়ে ঘন্টা তিনেকের মধ্যে গালি আর ধাক্কা খেতে খেতে কোথায় সময় কেটে গেলো বুঝতেই পারলাম না... দন্ডমুন্ডের কর্তারা বলে দিলেন, চিঠি পাবেন বাড়ির ঠিকানায় ... তা চিঠি দেবো বলে দেয়নি এমন লোকের সংখ্যা জীবনে কিছু কম নেই আমার, তবু, বিশ্বাস করুন, যে উৎকন্ঠা নিয়ে আধারের চিঠির পথ চেয়ে রোজ বসে থেকেছি সেই দিনগুলোয়, তার এক শতাংশ আগ্রহ থাকলেও বাজারে যদুবাবুর এই বদনাম থাকতো না ...
সে চিঠি শেষমেশ আর এলো না (কোনো চিঠি-ই কি আর ঠিক ঠিকানায় পৌঁছয়?), তবে একদিন জানা গেলো, চিঠি নাকি হারিয়ে গেছে, তবে চিৎপুরের পোস্টাপিসে গেলে পাওয়া গেলেও যেতে পারে!
চিড়িয়ামোড় থেকে চিৎপুর ডাকঘর অল্প একটু হাঁটা, শীতকালে পনেরো মিনিট, বর্ষায় আধঘন্টা, আর অটোয় ইনফিনিটি ... কাজেই হাঁটা লাগালাম প্রাণ হাতে করে, যারা সে রাস্তা দেখেননি তাঁদের বলে রাখি, এই রাস্তায় ডাকঘর অব্দি গেলেই মরুতীর্থ হিংলাজের অভিজ্ঞতা হয়ে যায় - অটো-ছাগল-বালিভরা ট্রাক এবং কিছু সদ্যোজাত উন্নয়নের চিহ্ন পেরোলেই ডাকঘর দেখা যায় দিগন্তে ...
ডাকঘর-টি ভারী বিচিত্র, কিছুটা পরাবাস্তব বললেও ভুল হবে না - ঢুকে দেখা যায়, অনেকগুলো কাউণ্টার, সব-কটাই প্রায় বন্ধ, একটি টিমটিম করে খোলা, তার সামনে নোটিশ ঝুলছে, "এখানে গঙ্গাজল পাওয়া যায়" ... যে ভদ্রলোক বসে আছেন, তিনি এক্কেবারে মুজতবা আলীর গল্পের পাতা থেকে উঠে এসেছেন ... জিগ্যেস করলাম "দাদা চিঠি ফেরত গেছে, কোথায় পাবো?" দাদা বললেন, "ক'লিটার দেবো? একদম ফ্রেশ জল..." ...বুঝলাম আশা নেই ... তারপর দেখলাম একটি ছাগল আমার ঠিক পাশটাতে দাঁড়িয়ে আমার ঝোঝুল্যমান পাঞ্জাবীর পকেটের দিকে বিপজ্জনক ভাবে তাকিয়ে ... তাঁকেই জিগ্যেস করবো কিনা ভাবছি, ছাগলের মালিক ঘরের এক কোণ থেকে ছুটে এসে বললেন, তাঁর-ও এক-ই দশা, চিঠি খুঁজতে এয়েচেন আর পোস্টাপিসের বাইরে সাইকেল স্ট্যান্ড থাকলেও ছাগল রাখার জায়গা নেই, তাই ছাগল-কে গঙ্গাজলের কাউন্টারে দাঁড় করিয়ে তিনি ভেতরে চলে গেছেন, এবং হারানো চিঠির ব্ল্যাক-হোল-টিও আবিষ্কার করেছেন ...

সেই দাদার পেছন ব্ল্যাক হোলে গিয়ে দেখি এক মাঝবয়েসী কবিমানুষ উদাস হয়ে একঘর চিঠির বাক্সের মধ্যে নিজের মনে মান্না দের গান গাইছেন, আমাকে দেখে যারপরনাই আহ্লাদিত হলেন, বললেন আসে না তো আসে না, আজ দুজন এয়েচেন ... তারপর সেই পাতালঘরের বিভিন্ন বাক্স-উপবাক্সের মধ্যে কি করে কে জানে, মিনিট পনেরো ধুলো ঝেড়েই আমার নাম লেখা একটা বাক্স উদ্ধার করে আনলেন ... বাক্স দেখে তো আমার বাক্যিহারা দশা, ব্রাউন পেপারে মোড়া একটা শক্ত বাক্স, বাক্সের গায়ে আধার-আধার গন্ধ, দেখেই মনে হচ্ছে রাষ্ট্রযন্ত্রের যাবতীয় ইস্ক্রুপ ওতে পাওয়া যাবে ...

বাক্স হাতে নিতে যাবো, ডাক-কবি-বাবু বললেন, "আইডেন্টিটি আছে?" ... বলতে চাইছিলাম সে কি কারুর-ই থাকে... বললাম আজ্ঞে হ্যাঁ, রেশন কার্ড, ভোটার আইডি, ড্রাইভিং লাইসেন্স, প্যান কার্ড - কি চাই বলুন? কবি বললেন, "আধার?" ... বাধ্য হয়ে বললাম, আজ্ঞে ওই বাক্সটাতেই আমার আধার আছে, আধার দেখিয়ে বাক্স নেবো কী করে? কবি একগাল হেসে বললেন, 'তাই তো, ডিম আগে, না মুরগী আগে?"

তারপর উনি একটা খাতা খুলে কিসব পড়তে বসলেন, আরো মিনিট দশেক গেলো, শেষমেশ মুখে হাসি ফুটিয়ে বললেন, আচ্ছা ডি-এল দিন ... বের করে দিলাম - বললেন না না জেরক্স দিন - আমি বললাম, জেরক্স তো আনিনি দাদা, কাছেপিঠে দোকান আছে? দাদা বললেন, হ্যাঁ সেই চিড়িয়ামোড় ... তখন আমার কেঁদে ফেলার অবস্থা ... ডাক-বাবুর বোধহয় মায়া হলো ! একটা ফোল্ডার থেকে একটা ফুলস্ক্যাপ কাগজ বের করলেন, তার উপরের কোণার দিকে একটা চৌকো বাকশ আঁকলেন, "ধরুন এইটে আপনার ছবি, এবার লাইসেন্সে যা যা লেখা আছে, ঠিক ঠিক জায়গায় কাগজে সেইসব লিখে দিন, ওইটাই জেরক্সের জায়গায় দিয়ে দেবো" ...

শুনেছিলাম প্রবল আন্দোলনের দিনে নিষিদ্ধ বই দেশ থেকে দেশে চলে যেতো, হাতে কপি করা নিষিদ্ধ ইস্তেহার ... ভাবিনি একদিন কোনো এক ডাকঘরের গর্ভগৃহে বসে আমিও হাতে কপি করবো আমার আইডেন্টিটি ...

এইসব করতে করতে কখন যে আলাপ জমিয়ে ফেলেছি ভদ্রলোকের সাথে বুঝতেই পারিনি ... বেরোনোর সময় ডাক-বাবু একগাল হেসে বললেন, "সব হারানো চিঠি-ই এইখানে আসে, খালি কেউ খুঁজতে আসে না, আবার কোনো চিঠি হারিয়ে গেলে আসবেন!"
---------------
আমার আধার অভিযান এই অব্দি-ই ... তবে দুটো-একটা ফুটনোট না লিখলেই নয় ...
১ঃ উদ্ধার করা সেই বাক্সে আধার ছিলো না, ছিলো স্টেট ব্যাঙ্কের
পাঠানো নতুন একটা চেক-বই, আর একটা চিঠি, আধার চেয়ে ...
২ঃ আধার শেষমেশ পেয়েছিলাম, তবে আমি চলে আসার অনেক পরে ... কথায় আছে, আশা ছেড়ে দেওয়ার ঠিক পরেপরেই ঈশ্বর প্রকট হন, সেটা সরকারী চিঠির জন্যেও সত্যি ...
৩ঃ নাঃ, এতো বছরেও আধার লিঙ্ক হয়নি, এস বি আই আজ-ও আমাকে চিনতে চেয়ে বাড়িতে চিঠি পাঠায়, কালকেই একগাদা জেরক্স অর্ধেক পৃথিবী দূর থেকে পোস্ট করেছি ... যদিও আমাকে তারা এই নব ফাল্গুনের দিনে চিনে নেবে সে আশা রাখি না আর ...
৪ঃ আমি প্রায়-ই গল্পের প্রয়োজনে একটু-আধটু অতিরঞ্জন করি, কিন্তু এই আষাঢ়ে গপ্পো-টার প্রত্যেকটা ঘটনা, মানুষ এবং ছাগল একশো পার্সেন্ট নির্জলা সত্যি !
৫ঃ রমেশ কুহাড়ের ঘটনাঃ https://i.imgur.com/NiSrMs6.jpg

Monday, June 24, 2019

আশায় আশায়



শহরের বাইরে দাঁড়িয়ে শহরের দিকে তাকালে একটা অদ্ভুত আভা দেখা যায় রাত্রের দিকে, সেটা গাঢ় হয় ক্রমশঃ তারপর একসময় কেউ যেন ফুঁ দিয়ে নিভিয়ে দেয় একটা বিশাল মোমবাতি ...যাদের ঘুম নেই তারা বোঝে রাত গভীর হলো, এবং এই বিশাল অন্ধকারের নীচে তারা এই মুহুর্তে বোধহয় সম্পূর্ণ একা ...  অথচ এক একটা রাত্রে জেগে থাকে একটা দূরের বারান্দা, আর এক এক রাত্রে কেউ জিগ্যেস করে ফেলে, "জেগে আছিস? একটা ফোন কর না !"


আশায় আশায় 

৫২-৮১১৩ - এটা আমাদের পাশের বাড়ির অলোক জেঠুর নম্বর, এখনকার নয়, সেই সময়ের যখন ফোন নম্বর-ও ছিলো আমাদের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের মতন সহজ এবং অল্প কিছু লোকের করায়ত্ত ! আমার স্কুল ইউনিফর্মের বুক-পকেটে একটা ছোট্ট চিরকুটে এই ছ-খানা নম্বর থাকতো, কোনোদিন-ই কাজে লেগেছে মনে পড়ে না, তবুও মা নিশ্চয়ই শান্তি পেতেন, কিছু অঘটন ঘটলে বা দরকার পড়লে কেউ হয়তো খবর দেবে ...

দরকার পড়েনি, যদিও অঘটন যে ঘটতো না এমন নয় ! তা-ও ... আমার জন্যে মা-কে গ্যাসের আঁচ কমিয়ে আঁচলে হাত মুছতে মুছতে দৌড়তে হয়েছে এমন মনে পড়ে না ...

বাবার দুঃখ ছিলো, একটা ফোন না হলে লোকে ডাক্তারবাবুকে খবর দেবে কি করে? সত্যি কথা ! ক্লাস নাইনে উঠতে একদিন একটা লাল টুকটুকে ফোন এলো বাড়িতে ... উফ কি উত্তেজনা তখন ! ফোনের সাথে এলো পাতার পাশে পাশে অক্ষর দেওয়া ফোনের ডায়রি, পদবী মিলিয়ে মিলিয়ে সবার নম্বর সেখানে থাকবে ... সব পেশেন্ট, আত্মীয়, কিছু কোচিং-ক্লাসের স্যার, যেসব বন্ধুর মায়েরা মায়ের বন্ধু, তাদের নাম ... আর এইসব নম্বরের মাঝে জ্বলজ্বল করবে নিষিদ্ধ ইস্তেহারের মতন দু-একজন বান্ধবীর নাম ... সেসব নম্বরে ফোন করা হয়ে উঠলো না আর কোনোদিন-ই, তবু দু-একটা রাংতায় মোড়া ইচ্ছে আমরা জমিয়ে রাখতাম হাতের কাছে, দৃষ্টির সামনেই ...

একদিন তা-ও একটা ফোন এসেছিলো ! একটি মেয়ে, যে আকাশী রঙের একটা ওড়না মাথায় দিয়ে কোচিং-এ এসেছিলো বৃষ্টির দিন, সে শুধু জিগ্যেস করেছিলো, 'কাল ক্লাস হবে?' ... উত্তর দেওয়া হয়নি তাকে ... তবে তার জন্য ব্যাকগ্রাউণ্ডে বাবার বজ্রনির্ঘোষ না শুধুই আমার ক্যাবলামি, কে দায়ী তা ঠাহর করতে পারি না ...

নরেন্দ্রপুরে যখন পড়তাম গৌরাঙ্গ ভবনের পাশে ছিলো রবীন-দার দোকান ... একটা ছোটো ফোনের বুথ আর নাইলনের দড়ি থেকে ঝুলতো হজমোলা, সার্ফ এক্সেল, পার্লে জি ... হাত খরচা পেতাম সপ্তাহে তিরিশ টাকা, যাতায়াত আর এটা-সেটা ... আর এগরোল না খেয়ে, গেট টপকে গড়িয়ায় সিনেমা না দেখে সেইটুকু জমিয়ে ফোন করতাম বান্ধবীদের ... রবীন-দা বুঝতেন, জানি! মাঝে মাঝে একদিন বেরিয়ে দেখতাম প্রাণপণে গম্ভীর মুখ করে বসে আছেন ...

তো এই ভালো মানুষ রবীন-দার দোকানে একদিন একটা ঘটনা ঘটে গ্যালো ... আমি যথারীতি এক বান্ধবী-কে ফোন করছিলাম, তো তার করালমূর্তি মা ফোন ধরায় টুক করে কেটে দি, তারপর রবীন-দাকে পয়সা দিয়ে বেরিয়ে আসছি হঠাৎ দেখি বুথের মধ্যেই ফোনটা তারস্বরে বাজছে - তা রবীন-দা-ই গিয়ে ধরলেন - তারপর টানা দু মিনিট খিস্তি খাওয়ার পর আমার দিকে ফিরে খুব বেচারা মুখ করে বলেছিলেন "উনি মনে হয় আমাকে নয় তোমাকে খুঁজছেন"

আমার প্রথম উপার্জন এবং প্রথম প্রেম এর না হোক তিন বছর পরে ... কলেজে স্টাইপেন্ড পেতাম, আর কোচিং করতাম চুটিয়ে ... কাজেই শুভদিন দেখে একদিন কোচিং থেকে ফেরার পথে "উর্দ্ধমুখে মুগ্ধচোখে গর্তে দিলাম পা" ...

পা দিয়েই বুঝলাম, প্রথম (এবং দ্বিতীয় এবং তৃতীয় এবং প্রায় প্রত্যেকবারেই) প্রেমের অবশ্য কর্তব্য রাত-বিরেতে ফোন করে কুশল জিগ্যেস করা এবং খুব গভীর রাজনৈতিক সমস্যার আশু সমাধান করা ... এই যেমন অর্কুট-এ প্রোফাইল তো খোলা হলো, এবার রাজস্থানে বিমর্ষ উটের পিঠে ছবি ভালো না নিক্কো পার্কে ইউরিনালের পাশে ছবি? হৃদয় তো চিরকাল-ই অবাধ্য মেয়ে, তাকে কি আর বলতে পারি, প্রেমের মাশুল মিনিটে এক টাকা আটষট্টি পয়সা?

আশার আলো দেখা দিলো ... হোস্টেলে এসে দেখলাম আই-এস-আই-এর মেস-এ একটা বহু-ব্যবহৃত ফোন রাখা, তার রঙ উঠে গেছে, ফিতে জায়গায় জায়গায় দীর্ণ আর নম্বরগুলোও প্রায় পড়া যায় না বললেও চলে ... তবে সে অলৌকিক ফোনের ডায়ালে '৯' টিপলেই গোটা পৃথিবী এবং তার তাবৎ রোম্যান্স আপনার হাতের মুঠোয় ... তবে সাপ্লাই আর ডিম্যান্ড এ পৃথিবীতে কোনোদিন-ই মেলেনি ... এক হোস্টেল প্রেমিক-পুরুষ, একটি মাত্র টেলিফোন ... এক এক রাত্রে ভালো একটা কবিতা গাঁতিয়ে নিয়ে মেসে গিয়ে দেখতাম সিনিয়র ব্যাচের দাদা পাশের হোস্টেলের দিদিকে ফোনে রিগ্রেশন বোঝাচ্ছেন ... সেসব রাত্রে যা দীর্ঘশ্বাস ফেলেছি, জয় গোস্বামী-ও ঘুমোতে পেরেছেন কিনা সন্দেহ !

সেসব সন্ধ্যে গুলোয় হোস্টেল থেকে বেরিয়ে হেঁটে হেঁটে চলে যেতাম বনহুগলীর রাস্তাটায়, লেকের দিকে যেটা গেছে ... বাপ্পাদার দোকানের পাশেই ছিলো একটা ছোট্ট এস-টি-ডি, আই এস ডি, পি সি ও ... দাদুর দোকান, দাদু একটা মোটা কাঁচের চশমা পরতেন, আর সাদা পাঞ্জাবী-পাজামা ... আমি ফোন করতাম বেশ খানিকক্ষণ, হয়ে গেলে দাদু খবরের কাগজ-টা পাশে রেখে হিসেব করে পয়সা ফেরত দিতেন অনেকক্ষণ ধরে ... কোনো-কোনোদিন যাকে ফোন করতাম সে বারবার কেটে দিতো রাগে ... বেরিয়ে দাদুকে বলতাম, অনেকগুলো এক-দু সেকেন্ডের কল আছে, পুরোটা দেখে নিন ...

আস্তে আস্তে ফোন নাম্বারগুলো বদলে যেতে থাকে ... নাইন-ফোর-থ্রি-থ্রি ... নাইন-এইট-ওয়ান-জিরো ... সেই ঘুপচি ঘরে একটা ছোট্ট কাঁচের বাক্সে আমার মিথ্যেগুলোও পাল্টাতে থাকে প্রত্যেক-টা মিসড কলের পর ... খালি পাল্টান না সেই দাদু  ...

আর এক একদিন দেখতাম আমার-ই বয়েসী (বা অল্প ছোট-ও হতে পারে) একটি মেয়ে সেই বুথে বসে ... সামনে ঢাউস বই খোলা, সম্ভবতঃ বায়োলজি-র কোনো শাখা হবে ... ফোন হয়ে গেলে সে বইয়ের পাতা থেকে চোখ না তুলে বিনিময় করতো খুচরো আধুলি, এক-টাকা, দু-টাকা ... অনেকদিন ভেবেছি তাকে জিগ্যেস করবো কি নিয়ে পড়ো? ভেবেছি জিগ্যেস করবো ইনি কি তোমার দাদু-ই হন, মা-বাবা আছেন তোমার? তবু কাঁচের বাক্সের কালো একটা যন্ত্রের লাল অক্ষরে লেখা সময় আর খুচরোর বিনিময়ের মধ্যে কোথাও একটা সে সাহস আর হয়নি আমার ...

পাশ করার বছর ঘুরতে না ঘুরতেই আবার দৌড়ে গেছিলাম হোস্টেলে ... কনভোকেশন, প্রচুর হইচই, দেদার আড্ডা, বন্যা বইলো মদের ... পরের দিন সন্ধ্যেয় গিয়ে দেখলাম সেই ছোট্ট দোকানটার উপর জন্মের শোধ ঝাঁপ পরে গেছে ... বাপ্পাদা বললো সে দাদুই নাকি আর নেই ... গোটা পাড়ার বার্তা দেওয়া-নেওয়ার মাঝে কখন যে তাঁর ডাক পড়েছে কেউ জানতে পারে নি ...

আজ চব্বিশে জুন, দু হাজার উনিশ, দশ-দশটা বছর কেটে গেছে ... এস-টি-ডির মানে আর ফোন বুথ নেই এই প্রজন্মের ডিকশনারি-তে ! এখন ফোন খুললে ঝাঁপিয়ে পড়ে অর্থহীন অকারণ চিৎকার, মিথ্যে, ঘৃণা আর জঘন্য সব টিটকিরি ...

মাঝে মাঝে তখন সেই ছোট্ট ফোন বুথটায় ফিরে যাই ... একটা নতুন পাওয়া নম্বরে ফোন করি, রিং হয় ... চেনা একটা গানের রিংটোন ... পরের সুনিপুণ মিথ্যেটা সাজাতে সাজাতে আমি আড়চোখে দেখে নিই অন্য একজন-কে ...

আর তখন সেই ছোট্ট কাঁচের অ্যাকোরিয়ামে আমার না ভাঙা নেশা, আমার না লেখা কবিতা আর আমার আছড়ে পড়া যাবতীয় ইচ্ছে ভাসতে থাকে রঙীন মাছেদের মতন, যাদের সমুদ্রে মেশা হবে না আর কোনোদিন-ই ...











Monday, April 15, 2019

আমার কথা


আমার সব লেখাই আত্মজৈবনিক - যেন হঠাৎ হঠাৎ মনে পড়ে যাওয়া এক-একটা ছোট্ট চিরকুট, সাদা শার্টে একটা ছোট্ট পুরোনো দাগ যেটা ধুয়ে ধুয়েও কি করে যেন রয়ে গেছে, তাই আলাদা করে আমার কথা লিখতে বসে বড্ড গোলমাল লাগছে! আসলে কিসের পরে কি ছিলো জানিনা, শুরুতে কি ছিলো? জল না আগুন? না অন্ধকার? শেষে কি আলো থাকবে? এসব বোধহয় আমাদের সিলেবাসে ছিলো না !


সিলেবাসে কী ছিলো তবে? ছিলো একটা রঙচটা নাইলনের বাজারের থলে – আজ-ও সেটা উল্টোলেই একটা দুটো পেয়াঁজের খোসা কোত্থেকে ঠিক বেরিয়ে পড়বে, সেইরকম কতগুলো জিনিষ কেমন করে যেন আলগা হয়ে লেগে থাকে আমাদের সাথে, কবে এসেছিলো জানিনা, আবার কোনদিন ঝাড়তে গিয়ে বেরিয়েও যাবে, এই দু-একটা স্মৃতি সেই দু-একটা উড়ে যাওয়া কুটো !


ছোটবেলার কথা ভাবলেই মনে পড়ে লোডশেডিং – বিষ্যুদবার সাতটা পয়ঁতাল্লিশে শুরু হতো চিত্রহার,ঠিক আট-টায় কারেন্ট চলে যেতো ! অন্ধকার বারান্দায় দুই ভাই-বোন বসে গলা ছেড়ে গাইতাম, “আলো আমার আলো ওগো, আলো জীবন ভরা” ... লন্ঠণ জ্বালিয়ে দিয়ে যেতেন মা, আর আমাদের আকুল আলোর ডাকে কুপির শিস উঠতো উপর দিকে কেঁপে-কেঁপে, সে ডাক শুনে আলো-ও কি ক্রমে আসতো সে ছোট্ট ঘরে?

মনে নেই, তবে জল আসতো খুব ! মা বলতেন যেদিন আমি জন্মেছিলাম, সেদিন নাকি ওরকম ঝমঝম করে বৃষ্টি – শম্ভুকাকু দৌড়ে ট্যাক্সি ডেকে আনতে গেছেন, আর জমা জলের মধ্যে বাবা মা-কে চ্যাংদোলা করে নিয়ে চলেছেন আমাকে আনতে ... সেই থেকে বৃষ্টিকে চিনি আমি! বৃষ্টি হলেই আগে গলি, তারপর বাথরুম-পায়খানা, আস্তে আস্তে বারান্দা দিয়ে জল আসতো হুহু করে - আমাদের মাঝের ঘরের খাটের পায়ার নীচে দুটো থান ইঁট থাকতো সম্বচ্ছর, আমি ভাবতাম আরেকটু জল ঢুকলেই নিশ্চয়ই খাটে বসে ছিপ দিয়ে মাছ ধরা যাবে ! বাবা বলতো কেমন ছোটবেলায় গামছা দিয়ে মাছ ধরেছে বন্যার জলে (অবশ্যই সেসব আমার জন্মের বহু আগে),আর মা-কে দেখতাম সেই জলের মধ্যে হাঁটুর উপর কাপড় তুলে বালতি বালতি জল ঘরে তুলে রাখছে, আর গলায় তাঁর দীর্ঘদেহী ঈশ্বরের কোনো একটা বর্ষার গান ! দুপুর পড়লে ডাকতে আসতো বুবলাই, এ-পাড়া,ও-পাড়া ঘুরে এসে বলতাম কোথায় কত জল কদ্দূর ছাড়িয়েছে ! সেই জল-গান-গীতবিতানের সংসারে অভাব ছিলো, দৈন্য ছিলো না !

মুখচোরা লোক ছিলাম, এবং ক্যাবলা-ও ! যে ইস্কুলে পড়তাম তার নাম বরাহনগর মিশন, তার নামকরণের সার্থকতা বলে রচনা এলে লিখতাম, যে আমার জলের বোতলের ঢাকনা খুলে ফুটবল খেলতো বন্ধুরা, চাইলে মার জুটতো কপালে ! এক-একদিন মেরে আবার আমার নামে নালিশ, এবং ফল, আবার মার ! ক্লাসে সবাই হাসছে, ওর-ই মধ্যে দু-একজনকে দেখতাম করুণা-অনুকম্পা নিয়ে দেখছে আমার দিকে ! যেভাবে মানুষ দূর থেকে বিচ্ছেদ দেখে, অসুখ দেখে ... আমার ডাকনাম-ও ছিলো “ভোমরা পাঁঠা” – সে-ও সার্থক, সত্যি !

একদিন দুম করে সব পালটে গেলো, কেউ হয়তো গল্পের প্লট ভুলে গিয়ে অন্য কিছু একটা লিখতে শুরু করে দিয়েছিলো কে জানে? যে ছেলেটা ভয় পেতো ইস্কুলের  বাস দেখলে, সেই গোটা দু-বছর কামাই না করে রোজ হাজিরা দিয়েছে, তার বন্ধুদের সাথে একটা দিন-ও হারাতে চায় না বলে ! হেডস্যারের বেত পিঠে ভেঙেছে তার, সে    তবুও মারের মুখে নাম বলে দেয়নি তার বন্ধুদের ...
সেই বন্ধুরাই চিনিয়েছে লুকোনো আগুন – ছুটির বৈঠকের মাঠে, একটা ফ্লেক তখন এক-টাকা, এক-একদিন সিঁথির মোড় থেকে অটো না ধরে হেঁটে চলে যেতাম, আর ফেরার পথে হাঁস-পদ্ম-আঁকা ব্যাজ-টা পকেটে লুকিয়ে ঢুকে যেতাম সরু সরু শেষ না হওয়া গলিতে ... সেইভাবেই একদিন প্রেম চিনলাম, কবিতা চিনলাম ! সদ্য বিকেলের আড় ভাঙার সময় গলিতে-গলিতে ফিসফাস, হয়তো কোচিং ক্লাসের পথ ভুল করলো একটা সাইকেল! আমার সাইকেল ছিলো না, শেষের কবিতা ছিলো ...  অবশ্য সেসব কবিতার দিন নয় !

এসব খেলনা আগুন একসময় নিভে যায়, হয়তো চাপা থাকেও বা, গভীর অসুখের মতন, কে জানে !
ইস্কুল আর কোচিং শেষ হয়ে গেলো একদিন, নতুন ঠিকানা হয়ে গেলো কলকাতা – ১০৩ ! নরেন্দ্রপুরের ভোর হয় আলো ফোটার আগে, ধড়মড়িয়ে ঘুম ভেঙে উঠে দেখতাম আমার খাট-জোড়া বই, আমি দেওয়ালে পা-তুলে কি করে যেন দিব্যি ঘুমিয়ে গেছি ! অনি ছিলো আড়াআড়ি খাট-টায়, আর পাশের খাটে সৌম্য ! চোখ মেলেই দেখি সবাই দৌড়চ্ছে – সামনে জয়েন্ট (না এই জয়েন্ট সেই প্রসাদতূল্য জয়েন্ট না, যাঁর পেছনে দৌড়লে দোষ লাগে না) ...তার মধ্যে একদিন পরীক্ষার আগে অনি এসে বললো, “বুঝলি হাবু, জীবনে যদি দুটো অপশনের মধ্যে একটা হয় ঘুম দেওয়া, তা’লে সবসময় সেইটা টিক করিস’ ... বলে দুম করে নোটস, টেক্সট্‌, ডিপিসি, এস-এন-দে, সিমপ্লার, হার্ডার, আইআইটি, অ্যাংজাইটি এই তাবৎ বিশ্বচরাচরের উপর বিদ্রোহ ঘোষণা করে ঘুমিয়ে পড়লো অনি ... এখনো এক-একদিন ঘাড়ের উপর অ্যাটলাসের বোঝাটা বড়ো ভারী লাগে, তখন সেই অনির দেওয়া উপদেশ মনে করে ঘুমে ক্লিক করে দিই ...

ওহ, আরেকটা বিশাল ক্ষতি-ও এইসময় হলো, সে-ও অনির দোষ, বাবরের প্রার্থনা পড়লাম একদিন, আর একদিন পড়লাম টিউটোরিয়াল কবিতাটাও ... এক-একদিন স্বপ্নে দেখতাম সেই গভীর অসুখের মতন আগুনগুলো ফিরে এসেছে আমার গাছ-ঢাকা বারান্দায়, আর তাদের আমি ছোট্ট চিঠিতে লিখে দিচ্ছি, “যতটুকু দেখে গেলে ততটুকু নয়, ভালোবাসা থেমে আছে, আমার-ও আমূল অন্ধকারে” ...

আমূল অন্ধকার দেখেছি দু-চোখ ভরে, আই-এস-আই-তে ! হয়তো আলো দেখেছি তার থেকেও কিছু বেশী ... একদিন রাত্রে জেগে উঠে দেখলাম দিব্যি পদ্মপানার মতো পুকুরের জলে ভাসছি, পাশে যেটা পচা নারকেল মনে হচ্ছে সেটা আরেক বন্ধুর টাক-মাথা, পাড়ে দাঁড়িয়ে দারোয়ান-রা হল্লা করছে ... সেই পুকুরের পাড়েই একরাতে একজনকে মনে হয়েছিলো দুর্বোধ্য একটা স্বপ্ন ... পরের দিন তার সাথে সারা রাত তাড়া করেও একফালি চাঁদকে ধরতে পারিনি আমরা ... সে দুম করে একদিন চলে গেলো (সবাই যেমন যায়), সেদিন জানলাম প্রেম অনেকটা ভূতের মতন ... আছে বলে বিশ্বাস হয়না, কিন্তু অন্ধকারে চেনা রাস্তায় তাও একা হাঁটতে ভয় হয় ...

তারপর?


তারপরের কথা ভাবতে গেলে স্মৃতি বিদ্রোহ করে উঠছে - হুহু করে অনেক-কিছু যেন ভূতগ্রস্ত মানুষের মতো দৌড়ে চলে যাচ্ছে, তাঁদের আমার কথা শোনার সময় নেই ! অর্ধেক পৃথিবী দূরে স্বেচ্ছায় চলে এলাম একদিন, পড়তে না পালাতে জানি না ... হয়তো সেই অবুঝ বয়স বুঝতো না এসব জটিল হিসেব !

এক বর্ষার দিনে শুধু বাড়ি ফিরতে গিয়ে দেখি সেই ইঁটগুলো আর নেই -- গলির মধ্যে জল পাড়িয়ে ঢুকতে গিয়ে কেডস ভিজে যাবে বলে এক শ্রাবণে ভিজে ভিজে বাবা যে ইঁটগুলো পেতে রেখেছিলেন আমার আজন্ম বর্ষাকালে ... সেই প্রকান্ড মহীরুহ তার ডালপালা, তার শেকড়, তার কোটরে বাস করা তক্ষক, তার বর্ষার জলে পাতা ইঁট – সব নিয়ে একদিন চলে গেছেন কোনো একটা দৃশ্যের ওপারে ...
বাবা যেদিন চলে গেলেন, সেইদিন-টা মাঝে মাঝে ফিরে আসে ... এক সপ্তাহ পরে বিয়ে, সকালে অনেক-কে নতুন খোলা ইমেল-আইডি থেকে জানিয়েছি সে খবর ! দরজায় দরজায় শিকলি টানাচ্ছি, ‘এসো সুসংবাদ এসো’ ... অসুস্থ বাবা হুইলচেয়ার থেকে পাড়ার প্রদ্যুম্ন-কাকুকে ডেকে বলছেন, “উনিশে আসিস !” এমন সময় কে যেন এসে একটা বিরাট কালো যবনিকা টেনে দিলো সেই নাটকের উপর, চুপিচুপি অডিয়েন্স-কে ডেকে বলে দিলো, সরি এটা আসলে ট্রাজেডি ... এরপরের গান গুলো অন্ধকারের গান, তবে হাততালি দিতে মানা নেই  ...

অথবা আলো, চোখ-ধাঁধানো চুল্লির শিখা, একটা কমলা রঙের আগুনের গোলা দেখেছিলাম সেদিন, বিশাল তার আকার, পাক খেতে খেতে শুন্যে উঠে যাচ্ছে মায়ের কপাল থেকে, “দিবি সূর্যসহস্রস্য ভবেদ্যুগপদুত্থিতা” ...

সেই অসহ্য আলো-সেই অবিনাশী অন্ধকারের দিনে আমার পাশে একজন ছিলো, বন্ধুর মতন ! গভীর খাদের পাশে লতাগুল্মের মতন একটা ঠিকানা, জ্বরের কপালে একটা ঠান্ডা হাত ... আগুনের চারদিকে প্রদক্ষিণ আমাদের আর হয়ে ওঠেনি, কিন্তু সে অদাহ্য-অক্লেদ্য মঙ্গলময় আগুন যে আমাদের ঘিরে থেকেছে তা বুঝেছি জীবন দিয়ে !

সেই অবুঝ, উচ্ছ্বল, জেদী মেয়েটি এখনো আছে এই ধ্বংসস্তুপের পাশে, আর আছে একটা ছোট্ট কুকুর-ছানা, সে গভীর রাত্রে আমাদের মাঝখানে এসে নাক গুঁজে শুয়ে পড়ে ...তখন চোখ বুজলে মনে হয় আমার দেশে বিকেল নামছে, আর একটা অল্প ঠান্ডা হাওয়া দিচ্ছে থেকে থেকে, কাছেই কোথাও বৃষ্টি হচ্ছে বুঝতে পারি !

আমাদের এক জোড়া দগ্ধ চোখ সেই রাত্রিনদীর অন্ধকারে তখন বৃষ্টির অপেক্ষা করতে থাকে !

উঁচু-নিচু জ্যোৎস্না


এইসব অবসন্ন, স্বপ্নতাড়িত দিনরাতগুলোয় হঠাৎ হঠাৎ মনে হয় বোবা হয়ে যাচ্ছি, তখন ইচ্ছে করে চিৎকার করতে, বা কম্বল গায়ে হুট করে বেরিয়ে যেতে খোলা মাঠে শিশিরের তলায় ... যেখানে কোনো এক পার্কের কোণে একচিলতে বারোয়ারী আগুন জ্বলছে, আর একজন লোক সেই নিশুতি রাতে শুকনো পাতার স্তুপে একটা চিঠি খুঁজছে খালি
এইসব রাত্রে অবিকল শুনতে পাই, রান্নাঘর থেকে গানের কলি ভেসে আসছে (সুরটা লাগছে ঠিক-ই, কিন্তু কথাগুলো শেখা হয়নি এখনো), সেইসব হলুদ-মাখা আঁচল আর সিগারেটের গন্ধ বড্ডো দুঃসহ লাগে সেসময় ...
তখন আমি ভাস্কর চক্রবর্তীর কাছে গিয়ে বসি ... মনে হয় যেন এই পরিত্যক্ত রাত্রির মতো তার কবিতা দুই বিশাল ডানা দিয়ে ঢেকে রাখছে আমাকে। যেন প্রবল বৃষ্টির রাতে ক্ষয়ে যেতে যেতে, গলে যেতে যেতে ঘরে ফেরা হবে কিনা জানিনা আমি, অথচ বহুদূরে যেন চেনা একটা মোমবাতির হলদে আলো দেখতে পাই ...

“তোমাকে অজ্ঞাত দেশে দেখি প্রায়
একটি নির্জন ছাতে দাঁড়িয়ে রয়েছো ।
সব কথা
শেষ হয়ে গেছে ।
আর কোনো কথা নেই – স্বপ্ন নেই –
শুধু কিছু দিন আর রাত্রি পড়ে আছে।“

ভাস্কর লিখেছিলেন ‘শেষ নেই এমন এক পাহাড়ে অনবরত চড়তে থাকার সঙ্গে কবিতা লেখার তুলনা করা যায় কিছুটা’...
সেই বোবাপাহাড়ের ঠিক তলায় দাঁড়িয়ে আমি, সিসিফাসের উত্তরাধিকার বহন করে চলেছি যেন, তবু বিশ্বাস করি এরপরের স্টপেই আলো-ভরা উপত্যকা আসছে একটা, আর অনেক চিঠি হাতে সেখানে আমার জন্য নিশ্চয়ই একটা আস্ত ডাকবাক্স বানিয়ে রেখেছেন একজন রুপোলি চুলের নিঃসঙ্গ মানুষ।

Saturday, January 19, 2019

অনুত্তীর্ণ


বাইরে শনশনিয়ে হাওয়া দিচ্ছে আজ,
আর ঝড়ে একটা রঙচটা পর্দা আছড়ে আছড়ে
         বুঝিয়ে দিতে চাইছে ঠিক কতোটা বন্ধ
          এই ছোট্ট একফালি গুহাটুকু
দুটো সুন্দর মিথ্যেও পাশাপাশি বসতে পারে না

এই শহরে জন্ম হয়না, মৃত্যুও খুব ধূসর
             দাম্পত্যের ক্ষতচিহ্নের মতন
             পদশব্দে ঢাকা পড়ে যায়
সন্ধ্যের দিকে দু-একটা বাসন ভাঙ্গার আওয়াজ ছাড়া
              তেমন কোনো কবিতাও শুনিনি কোনোদিন

তবুও কবিজন্ম ডানার উত্তরাধিকার বয়ে আনে,
             একটা আশ্চর্য বৃত্ত এঁকে দেয় বোধের চরাচরে
             তার ব্যাসার্ধ ধরে ছুটতে ছুটতে আমাদের
দীর্ঘ চুম্বনের স্বাদ মনে পড়ে যায়,
        আর যেন গতজন্মের স্মৃতির ভেতর থেকে
একটা চেনা গলা এসে বলে,

'উড়ছিস ওড়,
তা পড়ে মরবি, না মরে পড়বি?'