Tuesday, June 16, 2020

ছাদের গান



এই অঞ্চলের গ্রীষ্মকালের রাতগুলি বাষ্পহীন, মেঘহীন এবং নিঃশব্দ। সামনের একটা মাঠ ছাড়া চোখের সীমানায় কোথাও আলোর কোনো উৎস নেই, খালি দূরে হাইওয়ে যেন জ্বলন্ত আংরার শেষ আভাটুকু হয়ে ফুটে থাকে। এই রাত্রের অন্ধকারের মধ্যে মিশে বসে থাকি রোজ, মাথার উপরে তাকিয়ে খুঁজতে থাকি বাল্যবন্ধুর মতো চেনা তারামন্ডল - লুব্ধক চিনতে পারি, চিনতে পারি কালপুরুষের কোমরবন্ধনী, জিজ্ঞাসাচিহ্নের মত হাতড়ে হাতড়ে খুঁজি সপ্তর্ষিদের -- পুলহ, পুলস্ত্য, অত্রি, অঙ্গিরা ... আর? নামগুলো মনে পড়ে না আর, শুধু মনে পড়ে আগের জন্মের শহরে ফেলে আসা একটা অলৌকিক ছাদ আর সে ছাদের কোণায় কোণায় জমে থাকা ধুলোর মত ময়লা একটুকরো ছেলেবেলার গল্প ... 

এই ছাদটা কিন্তু আসলে আমাদের নয় ... সত্যি বলতে আমাদের কোনোদিন-ই ছাদ ছিলো না, মাথার উপরে তাও যা ছিলো নাম-কা-ওয়াস্তে, পায়ের তলায় সর্ষে বই আর কিচ্ছু ছিলো না... কিন্তু তাতে কী? জীবনে যা কিছু আমাদের অধিগত নয়, শুধু তাই নিয়েই তো গল্প লিখি আমরা, তাই না? এও, তাই একরকমের আনরিক্যুইটেড লাভস্টোরি ... আর সেই প্রেমের গল্পের মুখ্য চরিত্র আমাদের ভাড়াটে বাড়ির মাথার উপরের এক চিলতে একটুখানি ছাদ। 


***

একটা লম্বা-চওড়া-ত্যাড়াব্যাঁকা দোতলা বসতবাড়ির মধ্যে দরমার বেড়া, টিনের চাল বসিয়ে ভাগ করে করে এক-এক ঘর ভাড়াটে। একতলার ভেতরের দিকে আমরা, একপাশে ব্যানার্জীদের ঘর, একপাশে বাড়িওয়ালারা দুইভাই, আর ঠিক মাথার উপরের ঘরটায় ভাড়া থাকতো বাবুদা-রা। ছাদটা ছিলো ওদের অংশেই - বাবুদা, সাধনাদি, আর বাবুদার বাবা-মা ... মাঝেমাঝে এসে উঠতেন বিভিন্ন দেশগায়েঁর আত্মীয়-স্বজন, আর অল্পদিনের জন্য এক ঠাকুমা। বাবুদার মাকে আমি ডাকতাম "মাঈ" - ছোটবেলায় তাদের কোলে-পিঠে চড়েছি বলে নয়, মাঈ যে মাতৃসমা, আর বাবুদাও যে ছিলো অনেক বড়ো এক দাদার মতো একথা বললে একবিন্দু অত্যুক্তি হয় না। 

তা স্নেহের কারণেই হোক, বা অভ্যেসে ... ওই বাড়িটার ছাদে আমার যাতায়াত ছিলো অবারিত, আক্ষরিক অর্থে অন-অর্গল ... বন্ধুহীন বিকেলে বা অসহ্য রাত্রে ওই ছাদটাই ছিলো আমার একার রাজ্য, ওইটাই আমার জাহাজের ডেক, ওইটাই শিকারীর মাচা, আর ক্রিকেটের সময় এলে ওইটাই আমার ইডেন গার্ডেন্স ... 

***

ছাদের মেঝেটা ছিলো রুক্ষ, কর্কশ - খালি পায়ে গেলে বকুনি খেতে হতো বড়োদের কাছে, আর দৈবাৎ চলে গেলে দেখতাম পায়ের পাতা কুষ্টি কালো হয়ে গেছে দীর্ঘদিনের জমা ময়লায়। তবু সেই ছাদের একটা অপূর্ব গন্ধ ছিলো, যা আমি ছাড়া আর কেউ পেতো না ... রোদে তেতেপুড়ে থাকা ছাদের উপর বৃষ্টি শুরু হলেই সেই ছাদের গা বেয়ে উঠতো আশ্চর্য সোঁদা গন্ধ, মনে হতো যেন জ্যান্ত হয়ে উঠছে পায়ের তলার পরিত্যক্ত ইঁট-পাথরের রাক্ষস ! 

ছাদেই প্রথম শিখেছিলাম ঘুড়ি ওড়ানো ! দুহাত শূন্যে তুলে ছুঁড়ে যে ফার্স্ট-ক্লাস ওড়ানো সে নয়, মাঞ্জা ধরে ছাদ থেকে ঝুলিয়ে দিয়ে হ্যাঁচকা টানে শূন্যে তুলে ওড়ানো ... কিন্তু বিধি বাম, চারদিকে ঘেরা সে দোতলা বাড়ির ছাদে হাওয়া-ও আসতো নিষিদ্ধ প্রেমের মতন লুকিয়ে-চুরিয়ে, তাতে টান থাকে না শুন্যে উড়িয়ে নিয়ে যাবার, তবুও বেপরোয়া টানাটানির মাঝে কখন যেন হঠাৎ আকাশে ল্যাগব্যাগ করে উঠে পড়তো কুড়িয়ে পাওয়া ঘুড়ি। ভয়েভয়ে একটু আকাশ-বিহার করে, নিপুণ মাঞ্জার লড়াই এড়িয়ে আবার সে নেমেও আসতো অন্ধকারের আগে, সাতটার খবরের আগে  ...

ঘুড়ির সিজন না হলে খেলতাম একাই-একশো-ক্রিকেট, ছাদের এই প্রান্ত থেকে ছুটে আসতাম আমি-ই যেন আক্রম, দেওয়ালে বল লাগলেই তারস্বরে অ্যাপিল, এবং আম্পায়ারের তোয়াক্কা না করে সারা ছাদ জুড়ে ভিক্ট্রি ল্যাপ ... বোলিং হয়ে গেলে ব্যাটিং-ও আমি, দেওয়ালে বল মেরে ফিরতি বলে আনতাবড়ি হুক-পুল-স্কোয়্যার-কাট, সেসব রোমহর্ষক ম্যাচের কাছে কোথায় লাগে আই-পি-এল ... সত্যি বলছি, পরে অনেক বড়ো মাঠে খেলেও সেই ছাদ-ক্রিকেটের মজা আর পাইনি ! 

আর শিখেছিলাম সূর্যগ্রহণ - ভাঙা হাড়ের এক্স-রে প্লেটের পাত নিয়ে ঠায় দাঁড়িয়ে দেখেছি সূর্য ঢাকা পড়ে যাচ্ছে চাঁদের অন্ধকার বৃত্তে। মনে আছে ঝাঁকে-ঝাঁকে পাখি বাসায় ফিরছে সন্ধ্যে নেমে গেছে ভেবে ... এতোকাল পরেও মনে পড়ে সেই ফিরতি পাখির ডাক শুনে আশ্চর্য হওয়া, ওরা তাহলে সময় বোঝে আলো দেখে, ভয় পায় অন্ধকারে? (ঘালিব বলেছিলেন না, সন্ধ্যের অন্ধকার কত ভয়ানক হতে পারে, গৃহহীন পাখিদের থেকে কে-ই বা ভালো বোঝে?)

সবথেকে মজা হতো লোডশেডিং হলে, একটা হ্যারিকেন বা লম্ফ জ্বালিয়ে চলে যেতাম ছাদে, গল্প শুনতাম দিদির মুখে, আর এক-একদিন নতুন আনা লাইব্রেরীর বইয়ের পাতা থেকে এক-এক করে রুদ্ধশ্বাসে শেষ করতাম গল্প, আর মনে মনে চাইতাম যেন রাত্রে শোওয়ার আগে আর কারেন্ট-টা না আসে ... ভূতের গল্প পড়তে পড়তে এক-একদিন দূরের হাওয়ায় দোলা গাছের পাতা দেখে শিউরে উঠতাম, সেই রাত্রে আর ঘুম আসতো না সহজে ... আর যেদিন পড়া হতো না, দুই ভাইবোনে গলা ছেড়ে গান ধরতাম, "আলো আমার আলো ওগো" ... যতো জোরে গান ততো তাড়াতাড়ি ফিরে আসবে কারেন্ট, আর সত্যি বলছি আসতোও ফিরে ... (এ কিন্তু আমার নিজের চোখে দেখা ম্যাজিক, বিশ্বাস না হয় পরের বার লোডশেডিং হলে গেয়ে দেখতে পারেন, যদিও শুনি খুচরো লোডশেডিং এখন চড়াই পাখির থেকেও বিরল কলকাতা শহরে)

আর সে ছাদে ছিলো আশ্চর্য একটা অ্যান্টেনা - খেলার মাঝে লাইন চলে গেলে আমার কাজ ছিলো ছাদে উঠে সেইটাকে ঝুলঝাড়ু দিয়ে আলতো আলতো টোকা দেওয়া। ভক্ত ধ্রুবের কাতর ডাকে বিষ্ণু-টিষ্ণু নেমে আসেন, ডিডি-ওয়ান-টু আর এমন কী? আর অ্যান্টেনার পাশেই ছিলো পায়রা বসার একটা উঁচু জায়গা, সকাল-বিকেলে পায়রার দল সেই সিংহাসনে বসে বকম-বকম করতে করতে বিশ্ব-জগতের মুখে নির্বিকারে, নির্বিচারে পটি করে চলতো ... সে অ্যান্টেনাও বেশীদিন টেঁকেনি, সেই পায়রাসন-ও নয়। এখন অবশ্য ভেবে দেখলে মনে হয় দুটো পাশাপাশি না রাখলেই মঙ্গল হতো, উচ্চাসনে বসে বাহ্য করার কাজটা যে অ্যান্টেনা বেয়েই একদিন টিভির পর্দায় ঢুকে যাবে, এ কথা কবির কিংবা বাড়িওয়ালার কল্পনায় আসেনি ! 

তবে নাঃ, ছাদে প্রেমে পড়া হয়নি কোনোদিন - বয়ঃসন্ধি হওয়ার মুখে প্রাণপণে খুঁজতাম, যদি কোনো বিকেলের পড়ে-যাওয়া ম্লান আলোয় দূরের কোনো বাড়ির ছাদে কেউ আসে, যদি ... কিন্তু লুঙ্গি-শোভিত কাকুর দল আর উচ্চিংড়ে বোম্মারা মাঞ্জাকিশোর ছাড়া কাউকে কখনো দেখেছি বলে স্মরণে আসে না। 

যদিও এ কথাটা বলে রাখতেই হবে যে, এক্ষেত্রে exception proves the rule, আমার সেরার সেরা বন্ধুদের মধ্যে অন্যতম যে, তার প্রেমে পড়া ওই টবিন রোডের ছোট্ট ছাদে বাঁশির হাত ধরে - বিটিরোডের কর্কশ যন্ত্রদানবের চিৎকার সেই প্রথম প্রেমের বাঁশির ডাক যে ঢাকতে পারেনি, ম্যাজিক বলতে এখনো এইটুকুই বুঝি ... 


তবে কী, সব ম্যাজিক-ই ক্ষণস্থায়ী, একসময় শো শেষ হবেই হবে - ম্যাজিশিয়ান তাঁর টুপি, খরগোশ আর ধবধবে শাদা পায়রা নিয়ে,  রুমাল নাড়তে নাড়তে মিলিয়ে যাবেন পর্দার আড়ালে ...

আমার ছোটবেলার ছাদের ম্যাজিক-ও কিছুটা ওইরকম। বাবুদার বাবা সারা জীবনে বোধহয় ঐ একদিন-ই এসেছিলেন আমাদের বাড়িতে, হাতে মিষ্টির হাঁড়ি নিয়ে। ভাড়াবাড়ি ছেড়ে ফাইন্যালি ওঁরা পেরেছেন নিজেদের ঠিকানা বানাতে, তবে অনেক-অনেক দূর, ঠিকানা দিয়ে বলেছিলেন, মাঝে মাঝে বাপ্টুকে নিয়ে এসো, আমার স্ত্রী তো খুব ভালোবাসেন ওকে ... সে ঠিকানা খুঁজে আমার বাবা আর নিয়ে যাননি আমাকে, আমার নিজের যাওয়ার বয়স হতে হতে আস্তে আস্তে সেই সব-ই কোথায় যেন হারিয়ে গেলো পাথর চাপা কঙ্কালের মত, কখন যে তার উপর অন্যের বসতবাটী গড়ে উঠলো কেউ জানে না ... 

বাবুদা-মাঈ-দের পরে যাঁরা ওই বাড়িতে থাকতেন, তাঁরা বাড়িওলার-ই আর এক ভাই, আর তাঁর দুই বিশ্ব-বখাটে উচ্ছৃঙ্খল ছোঁড়া ... একদিন রাত্রে ঘুম ভেঙে শুনি পাশের বাড়ি থেকে তীব্র ঝগড়ার আওয়াজ, উত্তর কলকাতার রক্ষণশীল পাড়া তখনো শেখেনি ছাদে ডিজে পার্টি আর গড়িয়ে যাওয়া খালি বোতলের আওয়াজে অভ্যস্ত হয়ে যেতে ... 

কলকাতা ছাড়ার আগে আর মাত্র একবার যাওয়া হয়েছিলো সেই ছাদে, চটি খুলে খালি পায়ে উত্তপ্ত ছাদে দাঁড়িয়ে ছিলাম অনেকক্ষণ - দেখলাম পলকা অ্যান্টেনা কবেই উড়ে গিয়ে একটা কালচে খুঁটি দাঁড়িয়ে আছে এক কোণে, পায়রার দল অন্য কোনো ছাদে পাকাপাকি চলে গেছে সংসার গুটিয়ে, আকাশেও কোনো মিলেনিয়াল কিশোরের ওড়ানো দোত্তে-পেটকাটি নেই ... 

খালি চিলেকোঠার ঘরের জানলার তলায় লাল খড়ি দিয়ে আঁকা তিনটে ঢ্যাঙা উইকেট তখনো দেখলাম দিব্যি দাঁড়িয়ে আছে, হয়তো সেই শেষ-না-হওয়া খেলাটা-ই আবার একদিন খেলবে বলে, সেই ছোট্টবেলার ছাদের পিচে বাপ্টুবাবু এখনো যে নট-আউট !