Thursday, August 22, 2019

প্রথমতঃ



বাবার কথা মনে পড়লেই একটা গন্ধ নাকে আসে অবিকল ... সদ্য জ্বালানো উইলস ফ্লেকের গন্ধ, আমি চিনি  ... আবছা একটা ছবি ভেসে ওঠে - বাইরের পেশেন্ট দেখার ঘরের কাঠের চেয়ার, জানলার ঠিক ধারেই, বাবা মুখের সামনে লাইব্রেরী থেকে আনা একটা বই ধরে আছেন ... মুখ দেখা যাচ্ছে না, শুধু রেক্সিনের বাঁধাইয়ের আড়াল থেকে এক-একটা রিং উড়ে উড়ে জানলা দিয়ে বেরিয়ে মেঘ হয়ে যাচ্ছে ...

বাবা প্রায় সারা-জীবন চেন-স্মোকার ছিলেন ! মানে সত্যিকারের চেন, একটা নেভার আগে সেইটার আগুনে আরেকটা জ্বালানো চেন ... দিনে বোধহয় দেড় কি দু-প্যাকেট আরামসে উড়ে যেতো ! আমাদের বাড়ির প্রত্যেকটা ক্ষয়ে যাওয়া কড়ি-বরগা এমন কি পুরোনো পর্দার ভাঁজে ভাঁজে শুঁকলে হয়তো এখনো হাল্কা সুবাস পাওয়া দুষ্কর নয় ... ন্যাপথালিনের গন্ধঅলা পুরোনো শার্ট আর আমাদের সবকটা মশারি-র অগুন্তি ফুটো-ও তার সাক্ষী ... সেই যেমন হেনরি ফন্ডা লিখেছিলেন, 'I have been close to Bette Davis for thirty eight years, ... and I have the cigarette burns to prove it" ...

অনেক ভেবে মনে হচ্ছে খুব ছোটোবেলায় ক্যাপস্ট্যান খেতে দেখেছি, আর চার্মস ... আর ইস্কুলের শেষদিক থেকে উইলস ... মাসের শুরুতে এক-দু প্যাকেট নেভি কাট, বাকিটা ফ্লেক না হয় গোল্ড ফ্লেক ... মাঝে এদিক-ওদিক যে যাননি এমন নয়, এই যেমন আমি যখন থার্ড ইয়ারে পড়ি, হঠাৎ একদিন দেখি বাইরের ঘরের টেবিলে একটা স্পেশালের প্যাকেট ... খুব ধন্ধে পড়ে গেলাম ... জিগ্যেস-ও করতে পারছি না, "এটা তোমার?" ... আবার বিনা বাক্যব্যায়ে একটা আস্ত প্যাকেট হাত-ছাড়া হবে এ-ও মানা যাচ্ছে না! বোধহয় এইসব সাত-পাঁচ ভাবতে ভাবতে হাঁ করে প্যাকেট-টার দিকেই তাকিয়ে ছিলাম ... বাবা মুখ থেকে বই-টা সরিয়ে বললেন, "স্পেশাল কিন্তু তামাকে কাঠ-কয়লা মেশায়, বরং ফ্লেক ভালো ... " ... বলাই বাহুল্য, আমি সে সদুপদেশ শিরোধার্য করে টুক করে কেটে পড়া ছাড়া সেই মুহূর্তে আর কিছু ভেবে পাইনি ...

এইখানে বলে রাখা ভালো, আমি কিন্তু এই মুহূর্তে নন-স্মোকার, অন্ততঃ এই লেখাটা শেষ করা অব্দি তো বটেই ...

আর সত্যি বলতে কে যে ধরিয়েছিলো, সেইটা একটু আবছা ... তবে দিব্যি মনে আছে, যোগেশ-দার কোচিং ক্লাসের পাশেই ছিলো "আবার বৈঠক" মাঠ ... ক্লাস শুরুর আগে এক দল যেতো (তাঁদের আর নাম করে লজ্জা দিচ্ছি না), আমিও যেতাম সঙ্গে সঙ্গে ... তা সে বয়সে বন্ধুরা ঝাঁপ মারতে বললেও মেরে দিতাম, একটা নেশা আর এমন কি?

আর ভালো-ও কি কিছু শিখিনি? যেমন ত্যাগ ও তিতিক্ষা ... স্পষ্ট মনে আছে ক্লাস এইটে যখন পড়ি, ফ্লেকের একটা সিগারেটের দাম ছিলো এক টাকা ... মানে সিঁথির মোড় থেকে ইস্কুলের অটো-ভাড়ার একের তিন ... সেই যে হেঁটে হেঁটে অভ্যেস করে ফেললাম, পরে কতো হেঁটেছি কলকাতার রাস্তায়, কখনো ভালোবাসার হাত ধরে, কখন-ও ঘেন্নার কলার চেপে ... একটুও কষ্ট হয়নি কিন্তু ...

সহ্যশক্তি-ও ... বাবা তখন কাশি সেরে উঠেছেন, আমিও এদিকে একে নতুন বিড়িখোর তায় আবার পাড়ার ভালো ছেলে ... প্রকাশ্যে তাম্বাকু-হাতে ধরা পড়ার ভয় দুইজনার-ই ... আমি একদিন সেন্টার সিঁথির একটা গলির-গলি তস্য গলিতে লুকিয়ে মনের আনন্দে সুখটান দিচ্ছি ... হঠাৎ দেখি বাবা-ও সেই গলিতেই মাছের বাজারের থলে হাতে গুটিগুটি আসছেন ... সেই যে ঘাবড়ে গিয়ে বিড়িসুদ্ধু হাত পকেটে পুরে দৌড় দিয়েছিলাম, একটি ছোট্ট ফোস্কাচিহ্ন এখনো সেই ইতিহাস জানে ...

তারপর থেকে যে কতোশতবার কেস খেয়েছি, সে লিখতে বসলে ট্র্যাজিক একটি মহাকাব্য হয়ে যাবে ... তা-ও দু-তিনটে ছড়ানোর গল্প না বলে পারছি না ...

এক, কোচিং-ফেরতা বন্ধুকে বললাম ক্লোর-মিন্ট খাবি? সে আঁতকে উঠে বললো ওরে বাবা, ক্লোর মিন্ট খেয়ে বাড়ি ঢুকলেই ভাববে নিশ্চয়ই বিড়ির গন্ধ ঢাকার জন্য মেন্থল খেয়ে এসেছি ... সিগারেট খেয়ে ক্যালানি খেলে না হয় সহ্য করা যায় - মিন্ট খেয়ে এই দামড়া বয়সে মায়ের প্যাঁদানি পোষায় না ...

দুই-টা আমার-ই ... আপাদমস্তক ক্লিন ইমেজ মেইন্টেন করে চলেছি বাড়িতে, সে যেন সাক্ষাৎ  ডেটল জলে ধোয়া বিবেকানন্দ ... হঠাৎ মা একদিন জামা কাচতে দিতে গিয়ে বললেন, তুই যে বলিস স্মোক করিস না, তা জামার পকেটে এতো তামাকের গুঁড়ো কেন? ... আমি অম্লানবদনে জবাব দিয়েছিলাম, হোস্টেল বড়ো নিষ্ঠুর জায়গা, সিনিয়র-দাদার আমাকে দিয়েই সিগারেট কিনতে পাঠায়, আমি পকেটে করে নিয়ে আসি ... আসা-যাওয়ার রাস্তায় অল্প খসে খসে পড়েছে ...

এই ঘটনার কদিন পরের কথা, আমি আর রাজা আই-এস-আইএর পেছনের একটা বাস্কেটবল কোর্টে বসে গ্যাঁজাচ্ছি ... (এইখানে বলা উচিৎ, এই প্রলেতারিয়াত কোর্টে কোনোদিন-ও বড়োলোকী বাস্কেটবল বা অন্য কিছুই খেলা হয়নি, খালি আমি ভালোবেসে একটি গাঁজার চারা পুঁতেছিলেম কোর্টের এক কোণে আর একটা ছাগল সেটা এক পড়ন্ত বিকেলে খেয়ে খুব আনন্দ পেয়েছিলো) ... তো গ্যাঁজাতে গ্যাঁজাতে হঠাৎ গুণ্ডার ফোন, আব্বে তোর বাবা-মা তোর রুমে ঢুকে পড়েছে ...

ঘরে ফিরে দেখেছিলাম, মা সব গুছিয়ে রেখেছেন ... এমনকি সিগারেটের প্যাকেটগুলো পর্যন্ত একজায়গায় জড়ো করে রাখা ... বাবা গম্ভীর হয়ে বললেন, খাবে খাও, আমাকে দেখে তো শিখবে না, দরজা বন্ধ করে খেয়ো না, কার্বন মনোক্সাইড ইজ আ ডেডলি সাবস্ট্যান্স ... (সেই থেকে, সুধী পাঠক, এখন-ও বন্ধ ঘরে খাই না, অন্ততঃ বারান্দায় যাই) ...

ভেবেছিলাম মার খাবো, কিন্তু খাইনি ... খাইনি বলেই হয়তো গভীর অনুশোচনা হয়েছিলো সেদিন ... হয়তো ছেড়েই দিতাম, কিন্তু কি করবো, একে তো প্রেমের ফাঁদ পাতা ভুবনে, তার উপর অসৎসঙ্গে রোজরোজ স্বর্গবাস ... মার্ক টোয়েন না কে যেন সেই বলে গেছিলেন না, সিগারেট ছেড়ে দেওয়া খুব সোজা, আমি নিজেই কয়েকশো বার ছেড়েছি ...

তবে কি জানেন ... ছেড়ে দেওয়ার পরেপরেই বড্ডো মিস করি  ... মনে হয় যেন আমাদের পোকায় কাটা জীবনের ছোট্ট-ছোট্ট ফাঁক-ফোঁকর গুলো কি সুন্দর ভরে যেতো সিগারেটের ধোঁয়ায় ... সেই ফাঁকগুলো বিশাল বড়ো মনে হয় ...

মনে পড়ে ফিফথ ইয়ারের কথা, রাত্রে খাওয়ার পর একটা নেভি কাট ধরাতাম এক বান্ধবীর সাথে, কাউন্টারে খেতাম   ... খানিকক্ষণ যে সেই অছিলায় বসে থাকতাম অন্নপূর্ণা কেবিনের ছোট্ট টেবিল-টায় ... সেই মুহূর্ত-টা, সেই একটা নির্জন, নিস্তব্ধ মিনিট ... আমি কিন্তু সত্যি বিশ্বাস করতাম, চা, কফি আর ব্যর্থ প্রেমের প্রকৃত স্বাদ স্মোকার ছাড়া আর কেউ-ই জানেন না ...

এখন মাঝে মাঝে মনে হয় আমাদের সেই প্যারেন্থেটিক্যাল স্পেসগুলো দখল করে নিয়েছে কেউ... যেন পাহাড়ে উঠছি তো উঠছি, সামনে অনেকটা আঁকা-বাঁকা পথ ... এক-একটা ওভারলুকিং পয়েন্ট এলে তিন বন্ধু দাঁড়াবো সেই বিশালত্বের সামনে ... কিন্তু কতোক্ষণ লম্বা সে মুহূর্ত? একটা সিগারেট তিনজনের ঠোঁটে ঘুরে ঘুরে শেষ হতে যতক্ষণ লাগে ঠিক ততোক্ষণ ... বছর কয়েক আগে একদিন হঠাৎ বুঝতে পারলাম, আমাদের সেই সময়ের ইউনিট এখন অচল, সৌন্দর্যের সামনে মুগ্ধ হওয়ার সময় বাঁধা এখন সেলফি-তে ...

কতো বন্ধু ছিলো জীবনে ... সিগারেটের বন্ধু ... অফিস-চত্ত্বরে এক কোণায় একটা ঘুপচি জায়গা বরাদ্দ বিড়িখোরদের জন্য, সেইখানে গিয়ে রোজ দেখা হতো কয়েকটা লোকের সঙ্গে ... মুখ লুকিয়ে চুপিচুপি এসেছে কাজের ফাঁকে ... তাদের সাথে যে কত সন্ধ্যে কেটে গেলো মেরিন ড্রাইভে, লাস্ট লোকালে আর কাফে মন্ডেগায় সে কথা-ও কি আর বলে শেষ করা যাবে?


যাই হোক, কি যে লিখবো বলে শুরু করেছিলাম আর কি লিখলাম কে জানে ... বিশ্বাস করুন এইটা কোনোভাবেই তামাকু সেবনের উপকারিতা প্রবন্ধ নয় ... একচুল-ও নয় ... বিশ্বাস না হলে বলুন, আমার সামনেই একটা দেশ থেকে আনা প্যাকেট ... তার উপরের পচা-গলা মাড়ি আর বুকের টিউবের ছবি দেখলে আঁতকে উঠবেন না এমন বীর পেড্রো ভূভারতে নেই ...

পড়েছিলাম সমরেশ মজুমদারের একসময় সিগারেট খাওয়া বারণ হয়ে যায় - কিন্তু ঐটি ছাড়া লেখা কিছুতেই আসতো না ... ভদ্রলোক তার ছোট্ট বন্ধ ঘরে বাঁ হাতে ধরে থাকতেন একটি জ্বলন্ত সিগারেট, ডান হাতে লিখে চলতেন একের পর এক গল্প, উপন্যাস ...

সেই অবস্থা আমার যে হয়েছে তা নয়, তবে হ্যাঁ, মাঝে মাঝে সেই বন্ধুগুলোর সাথে দেখা হয়, আড্ডা মারতে মারতে আমরা ঠিক করি, একদিন আশি পেরোবো আমরা একসাথে, সেইদিন সব তল্পি-তল্পা নিয়ে একটা সমুদ্রের ধারে ছোট্ট কুঁড়েঘরে গিয়ে উঠবো সবাই মিলে, আমাদের সঙ্গে থাকবে শুধু দারুণ কয়েকটা বই, দু-একটা পুরোনো ডায়রি ... আর অনেক অনেক আনফিল্টারড চারমিনার ...