Sunday, May 8, 2022

পঁচিশে


বসে বসে গ্রেডিং করছি আর মাঝে মাঝে ফেসবুক খুললেই দাদুকবি আছড়ে পড়ছেন, এই বিষম অবস্থায় একটা গল্প মনে পড়ে গেলো ...

তখন বয়েস ছয় কি সাত ! সে সময় পাড়ায় পাড়ায় পূণ্য পঁচিশের আশেপাশে ঢালাও রবীন্দ্র-নজরুল সন্ধ্যা হতো, তাতে পাড়ার যাবতীয় কুচোবাচ্চা ঘন্টার পর ঘন্টা ইস্কুলে শেখানো কবিতা আবৃত্তি করতো আর তাদের মা-বোনেরা দল বেঁধে প্রেম পর্যায়ের গান গাইতেন, কিংবা পূজা। যদিও দাদু বলে গ্যাচেন দুটোই সেম, সময় মতো নকুলদানা না দিলে কিংবা ধূপটুপ না দেখালে প্রাণদেবতা ও প্রাণাধিকা দুয়েই রুষ্ট হন। তো সে যাই হোক, আমার বাবার গুচ্ছ গুচ্ছ ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানো অর্থাৎ সামাজিক কাজের মধ্যে একটা ছিলো পাড়ায়-বেপাড়ায় এই সব সন্ধ্যার সংগঠনের দায়িত্ব নেওয়া। ব্যাপারটা খুবি সোজা, বাঙালি হৃদয়ের কথা বলিতে, আঁকিতে, গাহিতে এবং পাকা স্টেজ পেলে নাচিতেও ব্যাকুল, তাকে কেহ একবার শুধাইলেই সে চালু করে দেবে। 
তা এইটা যে বছরের কথা, সেইবারে শীলস গার্ডেন লেনে অনুষ্ঠান, বাবার সেখানে আবার দাতব্য ক্লিনিক, অঞ্চলে সবাই ডাক্তারবাবুকে শ্রদ্ধা-ভক্তি করে, ভালো-ও বাসে। বাবা বললেন এইবারে আমাকে একটা ভালো কবিতা আবৃত্তি করতেই হবে, আর দিদিকে একটা গান ! তখন যা বয়েস রবিঠাকুর-কে ভালো বাসি না বাসি, বাবার থাবা কে নিয্যস ভয় পাই, তাই রাজি হয়ে গেলাম! আবৃত্তির অবশ্য অপশন বলতে গোটা দুয়েকঃ হয় "বীরপুরুষ" নয় "লুকোচুরি" ... বীরপুরুষ তো সবাই জানে, সেই যে বাচ্চাটা জ্যামে আটকে গিয়ে এসেমেস করছে "মনে করো যেন অনেক ঘুরে, উবার নিয়ে যাচ্ছি সোনারপুরে" - সেই বীরত্বের গল্প। আর লুকোচুরি-ই বা কে না জানে? যার বিষয় হচ্ছে একটি বদমাইশ বেড়েপাকা বাচ্চা সারাদিন চাঁপাগাছে চাঁপা হয়ে ফুটে থেকে মা-কে হয়রান করে, রাত্রে ফিরে আদৌ জবাবদিহি করবে না যে সে সারাদিন কোথায় ছিলো, এবং মা-ও কী আশ্চর্য তাকে কিছুই বললেন না, দু-ঘা ও দিলেন না, 'আজ থেকে তোর বাইরে যাওয়া বন্ধ' কিংবা "আসুক তোর বাবা" এসব বাস্তবসম্মত কিছুই হলো না ... বলাই বাহুল্য, এরকম ফ্যান্টাসি সে বয়সে দারুণ লাগার-ই কথা, তো মোটামুটি চাপ নিয়ে কবিতাটা গাঁতিয়ে ফেললাম, রিহার্সাল-ও দিলাম - বাবা খবরের কাগজ পড়তে পড়তে দুবার শুনে বলে দিলেন কোথায় কোথায় ক'ছটাক ইমোশন দিতে হবে ( বাবা নিজে ছোটবেলায় দুরন্ত আবৃত্তি করতেন, প্রুফ আছে) ... মোটামুটি এবার নামলেই হয়। 



ও মা, এতো কান্ড করে পাঞ্জাবি পরে গলায় পাউডার লাগিয়ে গিয়ে দেখি আমি একাই এতো বড়ো কবিতা গাঁতিয়ে এসেছি, বাকি সব দামড়া দামড়া খোকাখুকু "আতা গাছে তোতা পাখি" বলেই কেটে পড়ছে (যেটা মাইরি দাদুর লেখাও নয়), একজন তাও "আমাদের ছোট নদী" বললো কয়েক লাইন ! বুঝলাম এ কেরি প্যাকারের ওয়ান-ডে পৃথিবী, এখানে গাভাস্কর হওয়া বৃথা ... আমিও নির্ভীক চিত্তে স্টেজে উঠলাম, বললাম "নমস্কার, আজ আমি আপনাদের ...", তারপর আর্ধেক কবিতা গড়গড় করে বলে বাবার দিকে ফিরে মাইকেই জিগ্যেস করলাম "বাবা, বাকিটা বলবো?" ... বাবা হাত দিয়ে মুখ ঢাকছিলেন না কান বোঝা গেলো না, কিন্তু "মৌনং সম্মতিলক্ষণং" ... অতএব, আমি দর্শকদের দিকে ফিরে বললাম, "আচ্ছা বাবা বোধহয় চাইছেন আমি বাকিটাও বলি, তাহলে শুনুন বাকিটা !"

বলাই বাহুল্য, আমার বাড়বাড়ন্ত রবীন্দ্র-প্রেম সত্ত্বেও সেই আমার প্রথম এবং শেষ স্টেজে উঠে দাদু-কবিতা আবৃত্তি! বাবা আর কোনোদিন-ও আবৃত্তি করতে বলেন নি, আমিও সে পথ মাড়াইনি। আজ তিরিশ বছর বাদে হঠাৎ মনে পড়লো, কিন্তু কোথায় সে শীলস গার্ডেন, কোথায় সে থাবা, কোথায়-ই বা সে বাবা, এখানে পঁচিশ তারিখ সন্ধ্যা-ও হয় না। 
যদুবাবুকে ডাকাডাকি করবে এমন লোক-ও আর বেশী নেই পিতিবি-তে, তবে এখন কেউ ডাকলে পুরোটাই এক্কেবারে আউড়ে দিয়ে আসবো, প্রমিস !


Friday, March 25, 2022

ব্যক্তিগত অথবা নৈতিক

"Those who choose the lesser evil forget very quickly that they chose evil."

জতুগৃহের সামনে দাঁড়িয়ে তত্ত্বকথা অশ্লীল মনে হয়, তাও ... অর্ধশতাব্দী আগে Hannah Arendt এই চমৎকার কথাটা বলেছিলেন, যা (দুর্ভাগ্যবশতঃ) পুরোনো হওয়ার নয় কোনোদিন-ইঃ 

বলেছিলেন, সাংঘাতিক গণহত্যার পরেপরেই গোটা মানবসভ্যতাকেই কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে ইচ্ছে করে, যেমনটি হয়েছিলো জর্মনিতে, কিন্তু সেই collective guilt আসলে একটা ফ্যালাসি বই কিছু না, "There is no such thing as collective guilt or collective innocence; guilt and innocence make sense only if applied to individuals"! 

অকল্পনীয় বাস্তবের সামনে দাঁড়িয়ে আমরা বুঝতে পারি না, কোথা থেকে কী হয়ে গেলো, বুঝতে পারি না একটু একটু করে আমাদের-ই প্রত্যেক দিনের আপোষ, এক-একটা সামান্য নৈতিক বিচ্যুতি জমতে জমতে একদিন এমন জায়গায় পৌঁছে যায় যে অপরাধের যথেষ্ট শাস্তি নেই আমাদের অভিধানে, আর ক্ষমা তো প্রশ্নাতীত। 

কিন্তু তবুও ব্যক্তিগত দায়িত্ববোধ তো একেবারেই এড়ানো যায় না, তাই না? আমি-আপনি কেউ তার ব্যতিক্রম নন। সে দায়িত্ববোধ শুধু হাওয়া মেপে দিকে-দিগন্তরে জাজমেন্টের বাণী ছড়িয়ে আর নিজেকে ছাড়া বাকি সবাইকেই কাঠগড়ায় তুলে শেষ হয় না। সেই দায়িত্ববোধের একটুখানি বোধ করি খানিকটা অকৃত্রিম ঘৃণা আর রাগ মনের মধ্যে পুষে রাখা, কারণ এখনো অনেক দীর্ঘ রাত্রি বাকী। 

অ্যারেন্ট বলেছিলেন যে নিতান্ত সাধারণ মানুষ যারা পিষে যাবেন জেনেও ঐ বিশাল চাকার সামনে দাঁড়িয়ে পড়েছিলেন, আর প্রতিবাদ করতে সাহস করেছিলেন, তাদের আর কিছু ছিলো না নৈতিক বিশ্বাসটুকু ছাড়া। সক্রেটিসের মতো তারাও ভাবতে পেরেছিলেন, "it is better to suffer an injustice than to commit one!” 

সেইটুকুও কি আমার/আমাদের আর অবশিষ্ট আছে? জানি না। তবে নিজের সাথে একান্তে একটু অপ্রিয় কথা বলাই যায়, নিজেকে নিজে অস্বস্তিকর প্রশ্ন-ও করাই যায়, অথবা সব কিছু শেষ হয়ে গেলেও নিজের হাতের দিকে তাকিয়ে আবছা অথবা স্পষ্ট দাগ-ও খোঁজাই যায়। প্রকাশ্যে হোক বা না হোক, যদ্দিন বেঁচে আছি, সেই নিজের সাথেই তো বাঁচতে হবে, তাই না? 

--- 

Excerpts from “Personal Responsibility Under Dictatorship,” Hannah Arendt’, available here: https://grattoncourses.files.wordpress.com/2016/08/responsibility-under-a-dictatorship-arendt.pdf  


Hannah Arendt,
Image credit: Barbara Niggl Radloff, CC BY-SA 4.0 via Wikimedia Commons