বাংলা ভাষায় প্রথম রান্নার বই সম্ভবত ‘পাক রাজেশ্বর’ – সেই উনিশ শতকের কথা। তার কিছু পরেই বিপ্রদাস মুখোপাধ্যায়ের ‘পাক প্রণালী’। তবে খাদ্যাখাদ্যের গল্পের পাকাপোক্ত শেকড় তার-ও অনেক আগে। পুঁথির ভাষায় বললে, সেই চতুর্থ শতকের চন্দ্রকেতুগড়ের ফলকে, অষ্টম শতাব্দীর পাহাড়পুর কিংবা ময়নামতির পোড়ামাটিতে জলশস্য মৎস্যরূপে আকীর্ণ হয়েছেন। মৎস্যমুখী বাঙালি সেই মাটির আঁচড়ে ধরে রেখেছিল তার রোজকার জীবনের একটুকরো মাছ কোটার স্মৃতি। ঐটুকু যেন সে ধরে রাখতে চেয়েছিলো অনাগত প্রজন্মের কাছে একটি শান্ত দুপুরের চিহ্নের মত। জানেন তো নিশ্চয়ই, ঈশ্বরী পাটনীর যাঞ্চা কিন্তু আসলে ‘দুধেভাতে’ নয়, জোড়হাতে চেয়েছিলেন ওনার সন্তান ‘যেন থাকে মাছেভাতে’।
এ পাড়ায় আমার নাম-ডাক নেই, এককালে যাও একটা ডাক-নাম ছিলো তাও হারিয়ে গেছে। আমি এখানেই একটা কলেজে পড়াই, আর কেউ না দেখলেই রাশি-রাশি কাগজ-পত্রে দুর্বোধ্য আঁক কাটি। একটা আঁকে কঠিন রোগ সেরে যায়, একটা আঁকে চোর ধরা পড়ে, আবার একটা আঁক কষলেই বাড়ির অ্যান্টেনায় একটা পাখি এসে দোল খায় ! তবু এই বয়সেও মাঝে-মাঝেই অঙ্ক আটকে যায়, তখন এই গ্রহান্তরের একটা নির্জন গুহায় বসে ছাদের দিকে চেয়ে কল্পনা করে নি একটা ছোট্ট ঘুলঘুলি, আর একটা চড়ুই এসে তাতে বসছে, আবার উড়ে যাচ্ছে ... এই যে দু-একটা গল্প, সেই চড়ুইটার কাছেই শুনেছিলাম !
Tuesday, May 21, 2024
গুরুচণ্ডা৯-র তিনটি বই
স্মৃতিই ক্রমশ বদলে যায় পদচিহ্নে। আমরা সেইসব ইতিহাস অথবা সাহিত্যের হাত ধরেই চলে যাই পূর্বপুরুষদের রসুইঘরে। সেই চর্যাপদের পাতায় ডালের গন্ধ নেই, কিন্তু চন্ডীমঙ্গলের কালকেতু পেট ভরায় জাউ আর ডাল খেয়ে, মঙ্গলকাব্যের কবি বিস্তারে বর্ণনা দেন খুল্লনাকে বাড়িতে আনার পর মাছের বিভিন্ন পদের। মোগল শাসনের সময় “রিয়াজ-উস-সালাতীন” থেকে জানি “ঘিয়ের রান্না খাসি এবং মোরগের মাংস তাদের মোটেই সহ্য হয় না”। আবার ষোড়শ শতকের সেবাস্তিয়ান মানরিক জানিয়েছেন গরীব মানুষের থালায় শুধু নুন আর শাক জুটতো, ঝোলের ভাগ তাতে সামান্য।
এসব অবশ্য বহু পুরোনো দিনের কথা। তবু, তার কিছু কিছু চিহ্ন কীভাবে যেন রয়ে গেছে আমাদের দৈনন্দিন যাপনে, শাড়ির আঁচলে, জামার হাতায় লেগে থাকা হলুদের ফিকে দাগের মত। বাঙালি ছড়িয়ে পড়েছে অক্ষাংশ-দ্রাঘিমাংশের সমস্ত সীমায়, তার বহুদূরে ফেলে আসা দেশের আবছা স্মৃতি রয়ে গেছে মশলার কৌটোয়, অথবা অচেনা দেশে হঠাৎ খুঁজে পাওয়া চেনা সব্জিতে অথবা মাছে, বার্মাদেশে যেমন শ্রীকান্ত বাঙালি খুঁজে পেয়েছিলেন বাজারের থলির ফাঁকে পুরুষ্টু মাছের ল্যাজপতাকা দেখে।
কিছু স্মৃতি যেন সব্বার চেনা ছোটোবেলা, সেইসব গল্প জমে ওঠে ঠিক কাঠফাটা গরমের দুপুরে, পা ছড়িয়ে আমের শাঁস ছাড়ানোর উপাচারে, চটের নিচে কাঁসিতে যেমন আদরে আহ্লাদে জমে ওঠে আমসত্ত্ব। সেই দৃশ্যের নেপথ্যে মিহিসুরে বেজে চলেছে পুরোনো একটা রেডিও, অনুরোধের আসরের মাঝেই থেমে থেমে বয়ে চলেছে তালপাতার পাখার হাওয়া, গুমোট দুপুরের মধ্যে। ভেসে আসছে মাগরিবের আজান আর অষ্টকের সুর, ছেঁড়া-ছেঁড়া তুলোট পাতার মত।
সেই দৃশ্য ক্রমাগত পিছনে ফেলে আমরা এগিয়ে এসেছি অনেক দূর, রসুইঘর থেকে পাকশালা হয়ে কিচেনের কিচাইনে। মোরব্বা আর বরফি থেকে কী ভাবে যেন পৌঁছে গেছি মলিকিউলার গ্যাস্ট্রোনমিতে। তবুও সেই পাহাড়পুর কিংবা ময়নামতির মানুষের মত আমরাও আমাদের-ই ফলকে নিজের মত এঁকে রেখেছি সেই সব আশ্চর্য রান্নার ছবি – কখনো সামান্য স্মৃতিভারাতুর, কখনো নিচু হয়ে আসা আকাশের মত বিষাদবিলাসী, আর কখনো কাপ্তান ছোকরার মত প্রগলভ ও ফাজিল (যে কোনো অর্থেই)। সেইসব ছবি ও সেইসব গল্পের আয়োজন এইবার গুরুর বইয়ের পাতায়। ভিয়েন বসানো হয়েছে এই আপনাদের আশেপাশেই। সদ্য সদ্য জ্বাল দিয়ে উঠে আসবে তিনটি সুস্বাদু বইঃ
শারদা মণ্ডলের পাকশালার গুরুচণ্ডালি (প্রথম খণ্ড),
স্মৃতি ভদ্রের রসুইঘরের রোয়াক (দ্বিতীয় খণ্ড)
আর অবশ্যই ডিডির কিচাইন।
এগুলো ঠিক খাবার বই নয়। আমাদের ঐতিহ্যকে মুছে যাবার হাত থেকে বাঁচানোর সামান্য প্রচেষ্টা মাত্র। পেটুক কিংবা হন বা না হন, ঐতিহ্যের সঙ্গে থাকুন।
আর হ্যাঁ, গুরুর এই বইপ্রকাশের পদ্ধতিটা আপনারা এতোদিনে নিশ্চয়ই জানেন। গুরুর সব বই-ই বেরোয় সমবায় পদ্ধতিতে। যাঁরা কোনো বই পছন্দ করেন, চান যে বইটি প্রকাশিত হোক, টিকে থাকুক কিছু পরম্পরা, তাঁরা বইয়ের আংশিক অথবা সম্পূর্ণ অর্থভার গ্রহণ করেন। আমরা যাকে বলি দত্তক। এই বইটি যদি কেউ দত্তক নিতে চান, আংশিক বা সম্পূর্ণ, জানাবেন guruchandali@gmail.com এ মেল করে।
Subscribe to:
Post Comments (Atom)
No comments:
Post a Comment