এই লেখাটি "অপদার্থের আদ্যক্ষর" পত্রিকায় প্রকাশিত। সম্ভব হলে সেই সংখ্যাটি কিনে ফেলুন।
কাফকার “হাঙ্গার আর্টিস্ট” নিয়ে একটি গরুর রচনা
(১)
“It
was impossible to fight this incomprehension, this world of incomprehension.”
আশা করছি এই লেখাটা যখন পড়ছেন-ই, বইটা আপনি
কিনেই ফেলেছেন বা কিনতে চলেছেন, অর্থাৎ আপনার কোমরের ব্যথা, মর্টগেজের বোঝা ও তামাম
ছোটোবেলার ক্ষতের মত এইটাও আপনার অস্থাবর অস্তিত্বের এক কোণে থেকেই যাবে, অর্থাৎ আপনার
সেই অর্থে এখন কোনো তাড়া নেই। তা তাড়া যখন নেই-ই, তাহলে অনুরোধটুকু রাখুন, ফ্রানৎজ
কাফকার ‘হাঙ্গার আর্টিস্ট’ (কোনো কোনো ইংরেজি অনুবাদে স্টার্ভেশন আর্টিস্ট) গল্পটা
ইন্টারনেটে সার্চ করলেই পাবেন, বস্তুতঃ না পাওয়ার উপায় নেই। পড়ে নিন। তাই বলে আবার
নেটের বাংলা অনুবাদগুলো পড়ে বসবেন না। সেগুলো মানুষে করেছে না রোবোটে জানি না, কিন্তু
যেই করুক, সে এক জঘন্য উদরাময় হয়েছে। পড়ে আসুন যাইহোক, তারপর আমরা না হয় একটা চেয়ার
টেনে বসে দুটো-চারটে কথা বলবো এই নিয়ে? কারণ সত্যি বলতে কি, ভালো এক পাত্তর মদ খেতে
কেমন, বা সফল অর্গ্যাজ়মের আনন্দ কেমন, সে যেমন আপনি হাজার লাইন লিখলেও বোঝাতে পারবেন
না, কাফকা-ও তেমনি, নিজে না করলে ফক্কা। আর কে না জানে, টেক্সটের বাইরে আর কিছুই নেই,
যা লেখা আছে তাই একমাত্র নিটোল ও নিখাদ সত্যি, তার সামনে আপনার-আমার অনুভূতির দাম সামান্য।
(২)
"The
prospect of those visiting hours, for which the starvation artist naturally
yearned, since they were the meaning of his life, also made him shudder."
এবার ধরা যাক, আপনি বাধ্য ছাত্রের মতো হোমটাস্ক করে এসেছেন, কাজেই এর পরের
পরিচ্ছেদেই হাঙ্গার আর্টিস্টের গল্পের পিণ্ডি চটকাতে খুব বেশি দোষ হবে না। তাছাড়া,
এ ত আর হাউজফুল সিনেমা কি প্রাইমটাইমের সিরিয়াল নয়, কাফকার গদ্যর আসল মজা তো ঐ পেরেকের
মত সযত্নে সাজানো লাইনগুলো। যে পেরেকে পর্দা ছিঁড়ে যায়, নেপথ্য থেকে হঠাৎ বেরিয়ে এসে
গল্পের প্লট মিশে যায় আপনার জীবনের সাথে, একবার হলেও মাথায় আসে, ‘আচ্ছা, আমিও কি হাঙ্গার
আর্টিস্ট নই?”
আপনি কি লেখক? আমার ধারণা ৯০% সম্ভাবনা আপনিও লেখক। আপনি কি সোশ্যাল-মিডিয়ায়
লেখেন? অথবা, একটু ঘুরিয়ে জিজ্ঞেস করলে, সেই দুরারোগ্য নেশা আপনাকেও ছাড় দেয়নি? লেখার
পর কি প্রত্যেক মিনিট কি ঘন্টায় এসে উঁকি দিয়ে দেখেন কজন পড়লো, কজন আদরবাসা জানিয়ে
গেলো, রাত দুটোর সময় ফোনের আলো জ্বেলে দেখে নেন কটা লাইক পড়লো? যে প্রকৃত পাঠকের (বা
সদ্যোজাত পাঠিকার) ভালোবাসার জন্য আপনি হেদিয়ে যান (অবশ্যই গোপনে, কারণ প্রকাশ্যে আপনি
থোড়াই-কেয়ার), সেই তারা মুখ ফিরিয়ে নেবে বলে লেখাটি পোস্ট করার ঠিক আগে একটু ভয় করে
ওঠে, যেন ইংরেজির নিশীথমাস্টারের কাছে খাতা জমা দিচ্ছেন? তাহলে হ্যাঁ, আপনি একজন
একটি হাঙ্গার আর্টিস্ট।
তারপর? তারপর কি আপনার অজান্তে বোধ করেন,
লেখক কাছে এলে প্রকৃত পাঠক সারসের মত উড়ে যায়? আপনার কি মনে হয় না চাকুরিতে ও কর্তব্যে
ঢিলে দিয়ে দিনের পর দিন বিদ্যুতগর্ভ যে সব গদ্যপদ্যপ্রবন্ধ গিলে গিলে চোক করে নিজেকে
পিটিয়ে বানিয়েছেন, সে তাবৎ লেখা ও টেখা তার পাঠকদের কোলে নিয়ে অন্তর্জলি যাত্রায় ভ্যানিশ?
অতএব, আপনার ঐ কষ্ট করে লেখা কেউ না পড়লে ধরেই নেন, আপনার লেখা আসলে উচ্চকোটির, কিন্তু
পাঠকের বাঁড়া আর রুচির ঠিক নেই? (আর তা ছাড়া আপনি তো মাসের নন, ক্লাসের?)। আমি-আপনি
একমত যে আপনি কিন্তু লিখে রাখছেন আগমার্কা খাঁটি অনুভূতির কথা আর লোকে গিলছে আগমবাগীশ,
আপনি একেবারে নিজেকে নিংড়ে নিঃশেষ করে দিলেন, আর লোকে চাইছে একেবারেই হাল্কা-পেলব-পুতুপুতু-ক্যাতকেতে
পাতাঝরা প্রেমের গপ্পো, না হলে অই আনন্দবাজারী গোছের বৃদ্ধাশ্রমের বৃত্তান্ত। আপনি
এসব দেখে রাত্রির প্রথম যামে একটা বিড়ি ধরিয়ে বলেই ফেললেন “ধুর শালা”, কিন্তু সেই মধ্যযামে
(নাকি মদ্যযামে) গুটিগুটি ফিরে গেলেন লেখার কাছে, যেমন হাজার বার অপমানের পরেও যৌনতার
আশায় পুরুষ ফিরে যায় দমবন্ধ সম্পর্কের কাছে? তাহলে হ্যাঁ, আপনি একজন একটি হাঙ্গার
আর্টিস্ট।
(৩)
“Try
to explain the art of fasting to anyone! If someone doesn’t feel it, then he
cannot be made to understand it.”
শুরুতেই গল্পটা বলে দিতে নেই, দিইনি। মাঝে একটু গুঁজে দিই। গল্পের শুরুতেই
তৃতীয় পুরুষ, বলা হচ্ছে শেষ কয়েক দশকে অনশনশিল্পীদের উপর লোকের আগ্রহ কমে গেছে, আগে
এই লাইনে কিছু পয়সা-টয়সা ছেল, আর নাই। এরপর কাফকার গল্প ফোকাস করে একজন অনশনশিল্পীর
উপর। সেই নামহীন অনশনশিল্পীকে রাখা হয় একটা খাঁচায়, কিছু খড়বিচালি আর একটি ঘড়ির সাথে,
আর পাহারায় থাকে তিনজন কসাই, চোট্টামি করে কিছু খেয়ে ফেলছে কি না দেখার জন্য। দলে-দলে
লোকে টিকিট কেটে তার অনশন দেখতে আসে, কেউ কেউ আসে রাতের শোয়ে, টর্চের আলোয় জমে ওঠে
ব্যাপারখানা, কেউ তবু সন্দেহ করে সত্যিই কি না খেয়ে অ্যাত্তোগুলো দিন … বাচ্চারা সেই
কঙ্কালসার চেহারা দেখে হাঁ করে, মুগ্ধ হয়ে, কখনো খাঁচার ভেতর থেকে একটা শীর্ণ হাড়জিরজিরে
হাত বেরিয়ে আসে, লোকে ছুয়েঁ দেখে দীর্ঘ অভুক্ত সেই দেহ। মাঝে মাঝে দুর্বলতা একটু কমের
দিকে হলে তিনি গুনগুন করে ওঠেন, কখনও হয়তো দর্শকদের সাথে গল্প-টল্প করে নিজের জীবনের,
শোনেও কিছু-কিছু।
আর আছেন একজন দালাল-গোছের লোক, যাকে বলে ইম্প্রেসারিও, ইম্প্রেসারিও সময়
বেঁধে দেন অনশনের, ঠিক চল্লিশ দিনের মাথায় হৈহৈ করে বিশাল আড়ম্বরে ভাঙা হবে অনশন, এলাহি
খাবারদাবারের সাথে। এই চল্লিশ দিনের নিয়ম মোটেই পছন্দ নয় অনশনশিল্পীর, কারণ তার বিশ্বাস
আরও অনেকদিন না খেয়ে দিব্যি থাকতে পারেন তিনি। মনে হয় যেন শিল্পের প্রতি সৎ থাকা হচ্ছে
না এই চল্লিশ দিনের নিগড়ে। আর যা তাকে কুরে কুরে খায়, তা এই সম্যক ধারণা - যে আর কেউ,
কেউ-ই সত্যিই বুঝবে না তার শিল্প, এই হাঙ্গার আর্টের একমাত্র সমঝদার তিনিই, অথচ তাঁর
কাছে ব্যাপারখানা খুব-ই সহজ, লোকের যাই মনে হোক। তার ঘুমের বালাই নেই, অতএব রাতভর ফ্ল্যাশলাইটের
আলোয় বিরক্তি নেই, আর সবথেকে মজা - যখন রাত-জাগা দর্শকের দল খাঁচার সামনে বসেই খাবার-দাবার
আনিয়ে গাণ্ডেপিণ্ডে গেলে ভোরবেলায়। কিন্তু উলটো হলে? কেউ সহানুভূতি দেখিয়ে দুটো অনুকম্পার
কথা বলতে এলে? রাগে অন্ধ হয়ে খাঁচা ধরে ঝাঁকান তিনি, অনশনশিল্পী। ইম্প্রেসারিও তখন
এসে কড়জোরে ক্ষমা চান, বোঝান, না খেয়ে-খেয়ে ওইমত খিঁচড়ে আছেন শিল্পী।
তারপর রাতারাতি দর্শকের রুচি, অর্থাৎ বাজার বদলে যায়, অনশনশিল্পীকে আর কেউ
দেখতে আসে না ভিড় করে, তার জায়গা হয় সার্কাসে, তাও মূল আকর্ষণ না, বাঘসিঙ্গির পাশে
এক-কোণে একটা খাঁচায়, ইন্টারমিশনের সময় যদি কেউ দেখতে চায়। সেই অনশন-শিল্পী এবে কৃতজ্ঞ
বোধ করেন বাঘসিঙ্গিদের প্রতি, ঐ তো ওদের দেখতে এসেও যদি দর্শক এদিক পানে মাড়ান। কিন্তু
আসলে তিনি এখন বিনোদনের সোজা ও আনন্দময় রাস্তায় একটি বিরক্তিকর বাধা। “A small obstacle, at any rate, a constantly
diminishing obstacle.” … “কনস্ট্যান্টলি ডিমিনিশিং”, অনশন শিল্প অলক্ষ্যে জারি
আছে, কিন্তু কতদিন ধরে চলছে সে যুদ্ধ তাও সবাই ভুলেই যায় আস্তে আস্তে। খাঁচা পড়ে থাকে
এক কোণে, শেষে যখন একদিন খড়ের গাদায় খুঁজে পাওয়া যায় প্রায়ন্মৃত শিল্পীটিকে, তিনি মরার
আগে ফিসফিস করে বলে যাচ্ছেন, দর্শকদের প্রকৃত অর্থে মুগ্ধতাবোধের কোনো কারণ নেই, কারণ
সত্যিই অনশন ছাড়া আর কিছুই করার উপায় ছিলো না তাঁর। স্বীকারোক্তি (?) করে যাচ্ছেন যে তিনি আসলে খেতেন না, কারণ বিশ্বের কোনো খাদ্যই তার
মুখে রুচতো না, রুচলেই তিনি আর পাঁচজনের মত সবাইকে দেখিয়ে আনন্দ করে খেতেন। গল্পের
শেষে দেখা যায়, সেই খাঁচা সাফসুতরো করে সেখানে রাখা হয়েছে একটি স্বাস্থ্যবান সুন্দর
চিতাবাঘ। তাকে দেখতে উপচে পড়ছে দর্শকের ভিড়, আর কেউ নড়তেই চায় না যেন খাঁচার সামনে
থেকে।
(৪)
এই হচ্ছে মোটের উপর গল্প। তবে, হাঙ্গার-আর্টিস্ট বা অনশন-শিল্প কিন্তু গাঁজাখুঁরি
গপ্পো না। সত্যিই ইওরোপ-আমেরিকায় আঠেরো, উনিশ শতকে অনশন-শিল্প খুব জনপ্রিয় পারফর্মেন্স
আর্ট ছিলো, এবং ঐ চল্লিশ দিন-ই ছিলো উর্ধ্বসীমা, আর শিল্পীরাও যে এদিক-ওদিক কিছু গুপি
করতেন না এমন না। অবশ্য এমন সব সিদ্ধাই যে এ দেশের কেউ করেন নি এমন জোর দিয়ে বলতে পারি
না। ছোটোবেলায় আমাদের সাদাকালো অ্যালবামে সে কোন যেন এক উলঙ্গস্বামী বাবাজির ছবি দেখেছি
মনে পড়ে – যার দিকে থরথর তর্জনী তুলে প্রবীণ আত্মীয়া বলতেন ওঁর বয়স-ই তিনশো বছর, যার
মধ্যে শ-দুয়েক শুধু হাওয়া খেয়ে অজগরবৃত্তি ধারণ করে, অর্থাৎ স্রেফ এক জায়গায় পড়ে আছেন,
তবুও ওজন তিনশো পাউণ্ড। তবে কি না সেই ভারতীয় বাবাজি মহারাজ আধুনিক কমোডিফিকেশন বা
পণ্যায়নের উর্ধ্বে ছিলেন বলেই বোধ হয় – অর্থাৎ, উলঙ্গস্বামীর শোয়ের টিকিট কাটার জো
ছিলো না। ভক্তের দল এমনি পাহাড়-টাহাড় টপকে গিয়ে বাবার মাথায় জল-টল ঢেলে আসতো। কাজেই
সেই বাবাজিকে ঠিক হাঙ্গার আর্টিস্ট বলতে পারছি না। পারফর্মেন্স ছাড়া, স্পেক্ট্যাকল
ছাড়া, শিল্পীর মনে নিজের সম্বন্ধে মহত্ব্বের ধারণা (দর্শক কি কিস্যু বোঝে?) কিসের আর্ট?
এবং অন্যান্য ফর্মেও। ১৯০৭ সালের ঘটনা – হ্যামারস্টাইন থিয়েটার ন্যু-ইয়র্কে
– সোবার স্যু-এর এইরকম এক শো হতো। থিয়েটারের চ্যালেঞ্জ, যে হাসাতে পারবে গম্ভীর, বিষণ্ণ
স্যু-কে, নগদ দেওয়া হবে একশো (পরে বেড়ে-বেড়ে হাজার) ডলার। ভিড় করে লোকে জোক শোনাতে
আসতো স্যু-কে, আসতেন পেশাদার কমেডিয়ান-রা (বিদূষক মানে কি কমেডিয়ান?)। আর-ও বড় ভিড়
জমতো সেই সব ব্যর্থ চেষ্টা দেখতে, কেউ কি পারলো? পারলো কেউ হাসি ফোটাতে? পারলো না।
কমেডিয়ানদের অ্যাক্টোয় দর্শক কুটিপাটি, স্যু তবু গম্ভীর। পরে জানা গেছিলো স্যুকে হাসি
চাপতে হতো না, ওঁর জন্মগত পক্ষাঘাত ছিলো মুখের মাংসপেশীর, আমরা যাকে “হাসি” ভাবি, ভেবে
উদ্বেল ও আবেগপ্রবণ হই, সেই একান্ত শারীরবৃত্তীয় প্রক্রিয়াটি ওর পক্ষে অসম্ভব কাজ ছিলো।
অর্থাৎ থিয়েটার-বাবুরা বিলকুল মুফতে টিকিট-ও বেচেছেন দেদার, আর কমেডিয়ানদের টুপি পরিয়ে
ফ্রিতেই খাটিয়ে নিয়েছেন সেই সঙ্গে। ঠিক যেমন, কাফকার অনশন-শিল্পী খেতেন না, কারণ তিনি
খেতে চাইতেন-ই না, কিছুই খেতে ভালোবাসতেন না তিনি।
একজন সমালোচক (বহুদিনের পুরোনো স্মৃতি থেকে লেখা, তাই অ্যাট্রিবিউশন সম্ভব
হলো না, আশা করি সেই সমালোচক বাংলা লিটল ম্যাগাজিন পড়েন না) সেক্সপিয়রের নাটকের সিনেমা-ভার্শন
নিয়ে একটা লম্বা রচনার গোড়ায় লিখেছিলেন যে শেক্ষপীরকে ওঁর মনে হয় একটি স্বচ্ছ জলাশয়ের
মত, অথবা ইনফাইনাইট মিরর (অজস্র-সারিবদ্ধ আয়না)-র মত। যে কোনো ভাবেই ঝুঁকে পড়লে বহুদূর
অব্দি, বহু গভীরতায় নিজের ছায়াই উঠে আসে। আমার মনে হয়, ঐ লাইনটি হু-ব-হু টুকে কাফকার
বেলায় চালিয়ে দেওয়া যায়। হাঙ্গার আর্টিস্ট পড়ে আপনার যা মনে হবে, তা আসলে আপনিই। কাফকা
সেসব ছেঁদো ইমোশনের জন্য দায়ী নন।
তাই, আমার পড়ে যা মনে হয়েছে, স্পষ্ট করে প্রথম পুরুষে লিখে রাখি, যদিও পৌরাণিক
গল্পের থিসিয়াসের মত আমি রুটির টুকরো ছড়াতে ছড়াতে এসেছি অনেকক্ষণ।
আর্টিস্ট, অর্থাৎ শিল্পী, শিল্প সৃষ্টির প্রতি একটি দায়বদ্ধতা এবং আবেগ
দুইই নিয়ে আসেন, কম-বেশি সবাই। তার কপাল ভালো হলে আগ্রহী শ্রোতা, বা দর্শক, বা পাঠক
জুটে যায় ভাগ্যে, এক কথায় আমরা বলবো অডিয়েন্স, যদিও তিনি এ কথা মৃত্যুতক মাথায় বয়ে
নিয়ে চলেন যে সেই ভাগ্য, অর্থাৎ সেই সমঝদার অডিয়েন্স বড়ো চঞ্চলা। আজ মাথায় তুলেছে,
কাল একঘেয়ে বলে নাক ঝেড়ে ফেলে দেবে। আর যাদের কপাল খারাপ, তাদের জোটে শুধু প্রত্যাখ্যান,
বা ঔদাসীন্য। “Full many a flower is born to blush unseen”। সেসব খেয়াল পড়লে শীতের
পাজামার তলায় আমাদের বিবেক দাঁড়িয়ে যায়, অবয়বহীন আমাদের দিকে লক্ষ্য করেই আমরা কিছু
গালাগালি করে ফেলি, অখ্যাত-কিন্তু-অনন্যোসাধারণ শিল্পীর মৃত্যুতে সমাজের পেন্টুল টেনে
খুলে দিয়ে আত্মশ্লাঘা বোধ করি। ‘সমাজের ওঁকে চিনতে এখনো দেরি আছে’ অথবা ‘ঐ পাঠকের ভালোবাসা
লয়্যা কিই বা করিতাম?’ কিন্তু অস্বীকার করতে পারি না এই সহজ সত্যিটা যে শিল্পীর সৃষ্টিমাত্রই
একজন অবগাহক খুঁজে বেড়ায় – দর্শক, শ্রোতা, পাঠিকা – একজন কেউ যে অন্ততঃ স্বীকৃতি দেবে
শিল্পসৃষ্টির এই একান্ত ব্যক্তিগত, প্রায়শঃ উদ্দেশ্যহীন ও উপায়হীন উদ্যোগকে। কিন্তু
কতটা, ঠিক কতখানি স্বীকৃতি সন্তুষ্ট করতে পারে একজন শিল্পীকে? কতটুকুতে তার মন ভরবে,
পেট না-ই বা ভরুক? আমার ব্যক্তিগত ধারণা, এর একমাত্র উত্তর - ‘অসীম’। সে যেন গ্রীক
পুরাণের শাপগ্রস্ত ট্যান্টালাস, তার সামনেই টলটলে দীঘির জল, তার মাথার উপরে ফলের ভারের
ঝুঁকে আসা ডাল, কিন্তু পা বাড়ালেই পিছিয়ে যাচ্ছে জলরেখা, হাত বাড়ালেই নাগালের বাইরে
চলে যাচ্ছে ফলের থোকা। তার তেষ্টা ও খিদে এ জন্মে মেটার নয়। প্রত্যেক “প্রকৃত” শিল্পীই
তাই আমার কাছে অনশন-শিল্পী – যিনি একটিই কাজ ঠিক করে করতে পারেন, সেটাই তার শিল্প,
সেইটিই তাকে আলাদা করেছে জনগণের থেকে আবার সেইটিই তাকে আজীবন ভরে রেখেছে অদৃশ্য একটি
খাঁচায়। সেই একটি ছোট্ট বৃত্তে, নিজের সেই একটি প্রকাশ-কেই আরও ভালো, আরো ভালো, ভালোতমের
আশায় নিজেকে শেষ করেন শিল্পী। যেমন একটু একটু করে নিজেদের নষ্ট করে ফেলছি আমরা, হয়তো
প্রত্যেকদিন, হয়তো সবার অজান্তে।
**
এতো কথা, কারণ কাফকার এই অসামান্য গল্পটির আজ একশো-এক বছর হয়ে গেলো। জুনো
দিয়াজ না কে যেন বেশ লিখেছিলেন, ইতিহাস থেকে আমরা ঠিক ততটুকুই শিখি, যতটা একটা খরগোশ
বা গিনিপিগ শেখে তার প্রজাতির উপর করা বহু বহু বছরের বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা থেকে।
সেই এক-ই কথা আমার ‘প্রফেটিক’ সাহিত্য সম্পর্কেও মনে হয়েছে। কথাটা মিথ্যে নয়।
পুনশ্চঃ যে দুচার কথা জেনেছি অন্যদের আলোচনা পড়ে, তার অনেকটাই লিখলাম না,
কারণ সেগুলো অতিরিক্ত বলে বোধ করেছি। তাও খুব অল্পে লিখি। এই যেমন ১) কাফকা আসলে নিজেই
অনশন শিল্পী – খাঁচাটা নাকি ওঁর ছোট্ট অ্যাপার্টমেন্টের রূপক, ইম্প্রেসারিও সম্পাদকের
বা প্রকাশকের, আর অসাফল্য তো নিত্যসঙ্গী ছিলোই। ২) এই গল্পে নাকি বোঝানো হয়েছে কারুবাসনা
আসলে একটি মানসিক রোগ (সে আর কী বলবো ভাই?)। ৩) ক্যাপিটালিজ়ম – আহা, তাকে ছেড়ে কোথা
যাই? এই গল্পের মূল সুর নাকি ক্যাপিটালিস্ট কমোডিফিকেশনের বিরুদ্ধে কাফকার প্রতিবাদ।
হতেই পারে। শিল্পর যদিও সেসব দায় আছে বলে আমি মনে করি না। তার কাজ শুদ্ধু ‘থাকা’, এগজিস্ট
করা। ৪) কেউ বলেছেন সমস্ত অন্তঃসারশূন্য ফাঁপা শিল্প-ই প্রথমে জনপ্রিয় হয়, তারপর বিরক্তির
কারণ হয়ে দাঁড়ায় ও শেষে লোকে ভুলে যায়। যদিও আমার মনে হয়েছে সেটা বাজে কথা। যথেষ্ট
সার-দেওয়া উর্বর শিল্প-ও লোকে পুরোই ভুলে গেছে। যাওয়ার-ই কথা। হয়তো সেটাই আনন্দের ব্যাপার।
এই যে আমরা এত চেঁচামেচি করছি আর্ট-ফার্ট নিয়ে, আসলে মহাকালের সামনে তা একটি প্রজাপতির
পাখার দুটি সামান্য ইড়িং-পিড়িং ছাড়া কিস্যু নয়।
No comments:
Post a Comment