লেখা – জ্যোতিষ্ক দত্ত
নাট্যরূপ - জ্যোতিষ্ক দত্ত, শিঞ্জিনী সেনগুপ্ত, অনির্বাণ গুহ
|
কি? |
কোথায়? |
১ |
গান – প্রিয় গান |
শুরুতেই |
২ |
গান - একটা চিঠি |
২ ও ৩ |
৩ |
আমার এ ঘর বহু যতন করে, ধুতে হবে মুছতে হবে মোরে |
৩ ও ৪ |
৪ |
আজীব দাঁস্তা হ্যায় ইয়ে |
৫ ও ৬ |
৫ |
আমি বৃষ্টি দেখেছি |
৬ ও ৭ |
৫ |
গানঃ জ্যামাইকান ফেয়ারোয়েল / পথের প্রান্তে কোন সুদূর গায়ঁ |
৭ ও ৮ |
৬ |
গানঃ আমি গাই ঘরে ফেরার গান |
৮ ও ৯ |
৮ |
বিকেলের গান |
১০ নং চিঠির মধ্যে ও শেষে |
৯ |
গানঃ
এখন সকাল, এখানে সকাল |
১১ ও ১২ |
১০ |
পাখি বিষয়ক একটি কবিতা |
১১ ও ১২ |
১১ |
আজি ঝড়ের রাতে |
১৪ নং চিঠির শেষে |
১২ |
আবহ |
-- |
গান – প্রিয় গান (দেবদীপ)
চিঠি ১- মৃত্তিকার, উৎসব-কে
ডিয়ার ডঃ মুখার্জি,
আপনি নিশ্চয়ই জানেন, কদিন আগে
আপনার
একটি
ইন্টারভিউ সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হয়েছিলো। সেই ভিডিওটির প্রসঙ্গেই এই
চিঠি,
বর্তমান পরিস্থিতিতে আপনারা
যেভাবে
একদম সামনের সারিতে দাঁড়িয়ে আমাদের
জন্য লড়ছেন, তার জন্য
আমরা
আপনাদের কাছে
কৃতজ্ঞ। আপনি
বলেছেন
সরকারী
ব্যবস্থা খুবই অপ্রতুল, এবং রাজনীতির মারপ্যাঁচ দূরে সরিয়ে রেখে, সবাই একসাথে
ঝাঁপিয়ে না পড়লে এই অতিমারী ঠেকানো অসম্ভব। এও বলেছেন, অযথা আতঙ্ক না করা, নিজেদের সাবধানতা, প্রিয়জনের সঙ্গে
থাকা, তাদের খেয়াল
রাখা,
খুব
জরুরী। এই দরকারী কথাগুলো স্পষ্ট করে বলার জন্য, অনেক ধন্যবাদ !
আমি নিজে একজন অধ্যাপিকা। একটি কলেজ ক্যাম্পাসে থাকি। লকডাউনের ফলে আমরা শিক্ষক, শিক্ষিকা, ছাত্রছাত্রী আর ক্যাম্পাসের বহু মানুষ এই ক্যাম্পাসেই বন্দী - প্রিয়জনের থেকে বহুদূরে। তাদের খেয়াল পড়লেও, তাদের খেয়াল রাখা একটি খুব গুরুতর সমস্যা। আপনি যদি আপনার পরের কোন লেখা বা ইন্টারভিউতে এইসব দূরে থাকা মানুষেরা কিভাবে একে অপরের "খেয়াল রাখতে" পারবে, সে ব্যাপারে কিছু বলেন - আমাদের মতো সাধারণ মানুষের খুব উপকার হয়।
আপনার ভিডিওটায় উল্লেখ
করা হেল্পলাইনের ই-মেল আইডিটিতেই আপনাকে লিখলাম। আশা করি আপনার
কাছে পৌঁছবে …
ভাল থাকবেন। সুস্থ থাকবেন। নিজের খেয়াল
রাখবেন।
ইতি,
মৃত্তিকা চক্রবর্তী
চিঠি ২- উৎসবের চিঠি মৃত্তিকাকে
Dear Professor চক্রবর্তী,
আপনার শুভেচ্ছার জন্য ধন্যবাদ। আপনার যে আমার বক্তব্য ভালো লেগেছে তা জেনে ভাল লাগল। নানান কাজের মাঝে আমি হয়তো আরেকটা প্রতিবেদন লেখার সময় করে উঠতে পারব না। তবে আপনার যদি আপত্তি না থাকে ই-মেল এ উত্তর দিয়ে সাহায্য করতে পারি।
আপনার কাছে আমার একটি প্রশ্ন - প্রশ্ন না বলে কৌতূহল বলাই ভাল। আজ থেকে প্রায় ১৫ বছর আগে আমি একজন মৃত্তিকা মৈত্রকে চিনতাম। আমার ভাল বন্ধু ছিলেন। আমরা এক পাড়ায় বড়ো হয়েছি, একসঙ্গে এক কোচিং ক্লাসে পড়তে যেতাম । ওর বাবা ডাক্তার ছিলেন, মা প্রাইমারী স্কুল শিক্ষিকা। এক দাদা ছিল – যদ্দূর মনে পড়ছে ২ কি ৩ বছরের বড়।
আপনি যদি জানান আপনি-ই সেই মৃত্তিকা কি না, এই বেয়াড়া কৌতূহল-টার নিরসন হয়!
ইতি,
উৎসব
গানঃ একটা চিঠি (দেবদূত)
(1.51
seconds into https://www.youtube.com/watch?v=Yf72ZXSiFoY)
চিঠি ৩- মৃত্তিকার চিঠি মালবিকাদি-কে
মালবিকা দি,
হঠাৎ তোমাকে ডাক দিতে ইচ্ছে হোলো ! কেমন আছো? ইস্কুল নিশ্চয়ই এখন বন্ধ? আমি ভাবছি বাচ্চাগুলোর খুব কষ্ট, না? ওরা তো বেচারা বুঝবেও না কেন বাড়িতে আটকে ... ভাইরাস-ই বা কী? লকডাউন-ই বা কী?
আমাদের কলেজ গত সপ্তাহ থেকে পুরো ছুটি দিয়ে দিলো, এখন-ও ক্যাম্পাসে দু-একজন ইতিউতি ঘুরছে, তবে ক্লাস নেই বলে বেশীর ভাগ লোক যে যার বাড়ি ... অনেকে আবার বাড়ির বাইরে বাড়ি খুঁজে নিয়েছে,
কাল-ই
দেখলাম একজোড়া মানুষ ফাঁকা ফুটবল মাঠটার ঠিক মাঝখানে বসে, সাথে ছোট্টো-ছোট্টো
দুটো বাচ্চা
কিন্তু বেচারা নিতাইদার চায়ের দোকানটা শুনশান, আমি বললাম কদিন ঝাঁপ ফেলে দাও, আমরা কিছু টাকাপয়সা জোগাড় করে দিয়ে যাবো, নিতাইদা বললো এমনিও মরবো, অম্নিও মরবো ... তার থেকে দোকান খুলে রাখি, মরতে হলে এখানেই মরবো !
এই ক্যাম্পাসে অনেকগুলো ছোট্ট ছোট্ট বেড়াল আর কুকুর আমার খুব ন্যাওটা, বেচারাগুলোর মুখ দেখতেও আজকাল কষ্ট হচ্ছে, ফাঁকা গাছতলায় ঘুরছে এক-পেট খিদে নিয়ে, আর এদিক-ওদিক মাটি শুঁকছে... আমি রোজ ওদের জন্য একটা মালসা করে একটু জল আর খাবার রাখছি ... তাতে আর কি-ই বা হয় বলো? কিন্তু তা-ও ...
কী যে হবে কে জানে ! কদিন চিন্তায় ঘুম হয়নি, জানো?
এখন তাই ঠিক করেছি যতো পারি টিভি আর ইন্টারনেট থেকে দূরে থাকবো, বরং কদিন বই-টই পড়ি ... ভালো কিছু পড়লে এর মধ্যে? জানিও। এই মূহুর্তে আশা-র উপরেও ভরসা নেই, কিন্তু আর কি-ই বা আছে আমাদের?
মাঝে মাঝে তোমার বলা সেই বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের কবিতাটা মনে পড়ছে - নিজেই ঘুরে ঘুরে জোর গলায় নিজেকে শোনাচ্ছি,
"তার ঘর পুড়ে গেছে,
অকাল অনলে,
তার মন ভেসে গেছে,
প্রলয়ের জলে
তবু সে এখনও
মুখ দেখে চমকায়
এখনও সে মাটি পেলে
প্রতিমা বানায়"
একটা কথা বলা হয়নি তোমায় (বকবে না, প্রমিস?)
উৎসব-কে একটা ইমেল করেছিলাম ! উত্তর দিয়েছে। আমাকে চিনতে পারেনি, ভাবো? জানতে চেয়েছে আমি সেই মৃত্তিকা কি না! মালবিকাদি, জবাব দেওয়ার দায় তো আমার নেই বলো? প্রতিমা সাজার শখ-ও আমার কোনোদিনi ছিলো না ... তবু, কেন যে খুব জবাব দিতে ইচ্ছে করছে, জানিনা ! আমার দিদুন বলতো, অলস মস্তিষ্ক শয়তানের বাসা, কিছু করছি না বলে এইসব বোকা কাজ করে বেড়াচ্ছি হয়তো, কে জানে? কি করি বলতো? দেবো, জবাব?
ইতি,
তোমার মৃত্তিকা
গানঃ
আমার এ ঘর বহু যতন
করে, ধুতে হবে মুছতে হবে মোরে ...(অন্তরা থেকে শুরু হবে)
আমার এ ঘর বহু যতন ক'রে
ধুতে হবে মুছতে হবে মোরে।
আমারে যে জাগতে হবে, কী
জানি সে আসবে কবে
যদি আমায় পড়ে তাহার মনে
বসন্তের এই মাতাল সমীরণে ॥
আজ জ্যোৎস্নারাতে সবাই গেছে বনে
বসন্তের এই মাতাল সমীরণে ॥
চিঠি ৪- মালবিকাদির চিঠি মৃত্তিকাকে
আদরের মৃত্তিকা,
কেমন আছ? তোমার চিঠি পেয়ে খুব খুব ভাল লাগল। আর তার সঙ্গে একটু মজাও। তোমরা কবে সেই স্কুল কলেজ ছেড়ে দিয়েছ। কিন্তু তোমাদের মন গুলো এখনও ওরকমই রয়ে গেছে। ভাগ্যিস। নইলে কি আর এতদিন পড়ে মালবিকাদিকে মনে পড়ত?
তোমার চিঠি পড়ে আমিও কেমন যেন আমার সেই হারিয়ে যাওয়া দিনগুলোয় চলে গেলাম। আমাদের সময় তো আর তোমাদের মত সোশ্যাল মিডিয়া ছিলো না, তবুও
কয়েকজন দূরদেশের বন্ধু-বান্ধবী ছিলো আমার। পেন-ফ্রেন্ড – ভালো বাঙলায় যাকে বলে
পত্রমিতালী। কত অপেক্ষা করতাম এক-একটা চিঠির জন্য, তারপর সে চিঠি এলে জমিয়ে রাখতাম
অনেকদিন – পড়লেই তো ফুরিয়ে যাবে, তাই না?
সেই বন্ধুরা আর চিঠি লেখেন না।
তবুও চিঠিগুলো জমিয়ে রাখতাম, এখন-ও রাখি ... মাঝে মাঝে সে চিঠিগুলো নিজে নিজেই জ্বলে উঠে ছাই হয়ে যায়, আবার মাঝে মাঝে দেখি সেই ছাই থেকে ফিনিক্সের মতন নতুন একটা কবিতা হয়তো জন্ম নিলো ... যদিও এখন দেখছি ছাই-ই বেশী, কবিতা কম ...
জয় গোস্বামীর একটা কবিতার বই আছে আমার বইয়ের তাকে, তার ব্যাক কভারে লেখক-পরিচিত-র তলায় লেখা - "শখ - পুরোনো চিঠি পড়া" ...
ছোটোবেলায় পড়তে পড়তে ভাবতাম, কবে সেই বয়সে পৌঁছবো যখন আমার-ও পুরোনো চিঠি থাকবে !
তুমি যা জানতে চেয়েছ তার উত্তর দিতে পারলাম কি? আমার কুশল জেনো, মাকে আমার প্রণাম দিও !
ভালবাসা নিও,
মালবিকাদি
পুনশ্চঃ পৃথিবীটা কতো ছোট্ট হয়ে
গেছে ভাবো, এই ইমেল পাওয়ার আগেই উৎসবের সেই ভিডিও-র ক্লিপ টিভির প্রতিবেদনে আমি
দেখে ফেলেছি … আমাকে পারলে ওর ইমেল আইডি টা পাঠিও তো। সেদিন ওর ওই অস্থির চেহারাটা দেখার পর থেকে বড়ো অস্বস্তিতে আছি …
চিঠি -৫ মৃত্তিকার চিঠি উৎসবকে -
ডিয়ার ডঃ মুখার্জি,
আশ্চর্য ব্যাপার !পনের বছর আগে,
আমিও এক উৎসব মুখার্জিকে চিনতাম। বরানগরের ছেলে। কোচিং ক্লাস হতো ওদের-ই বাড়ির বসার ঘরে। ওর বাবাও ডাক্তার ছিলেন, আমার বাবার মতোই। আর কাকিমা ভারী সুন্দর গান গাইতেন – সত্যদার মাইটোসিস-মিয়োসিস-এর
নোট টোকার ফাঁকে শুনতে পেতাম পাশের ঘর থেকে ভেসে আসা গানের কলি। ছেলেটি ভাল কবিতা লিখত।
আর পাঁচজন বন্ধুর থেকে একটু বেশীই
সেন্সিটিভ ছিলো, নিজের মনে থাকতো, একা-একা, আলাদা ! বন্ধুরা খ্যাপাতো, পেছনে লাগতো
সুযোগ পেলেই … স্পষ্ট মনে পড়ে, তার কবিতার খাতা কেড়ে নিয়ে কোচিং ক্লাস-এ সবার
সামনে বিকৃত করে পড়া হচ্ছে তার লেখা কবিতা, হাসির হুল্লোড় উঠছে থেকে থেকে, আর এক কোণে লজ্জায় মুখ লুকিয়ে, মাটিতে মিশে যাচ্ছে সেই
ছেলেটি !
আমার বিশ্বাস ছিল, তার হাতে-গোনা
কয়েকজন বন্ধুর মধ্যে আমিও একজন ছিলাম - স্পষ্ট মনে আছে, শেষ দেখা| ওর মায়ের কাজের
দিন, ভাড়া করা শ্রাদ্ধবাড়ির ব্যালকনিতে সিগারেট খাচ্ছিলো বন্ধুর সাথে, কারুর মুখে
কোনো কথা নেই। ওর মাথা কামানো, পরণে সাদা থানের উত্তরীয়, আমি বলেছিলাম সন্ন্যাসীর
মতো দীপ্ত লাগছে তোকে। অনেকক্ষণ, অনেকক্ষণ পরে সে বলেছিলো, ‘জানিস, মা-কে একটা এসি
লাগিয়ে দেবো বলেছিলাম শোওয়ার ঘরটায়,করা হলো না – যাক শান্তিতে ঘুমোবে এখন’ …
একদিন সে চলে গেছিলো, হঠাৎ করে।
ব্যাস, ওইটুকুই, ওই পর্যন্ত-ই তারপর ১৫টা
বছর কেটে গেছে, যোগাযোগ সে রাখেনি.
আপনি
যদি
সেই
উৎসব
হন।
তাহলে
হয়তো
আমিও সেই মৃত্তিকা।
ভাল
থাকবেন।
চিঠি ৬ – উৎসবের চিঠি অনির্বাণ-কে
অনি,
একটা আশ্চর্য ঘটনা ঘটলো জানিস ... মৃত্তিকার কাছ থেকে একটা ইমেল পেলাম ! এত বছর বাদে ... মনে মনে নিজেকে বললাম ইট টুক আ প্যানডেমিক? আ প্যানডেমিক? .. উত্তর দিতে পারিনি এখনো ! সত্যিকারের চিঠি হলে জানলা দিয়ে উড়িয়ে দিতাম হাওয়ায় ... ইমেল, তাই রয়ে গেছে!
খুব অভিমান হ'লো, রাগ হ'লো, জানিস তো? দিনের পর দিন এই যে এই অন্ধকার, একা ঘরের কোণায় কুঁকড়ে থেকে একটু একটু করে মরেছি, চিৎকার করতে চেয়েছি গলায় রক্ত তুলে, লোকের পায়ের আওয়াজ পেয়ে লুকিয়ে পড়েছি আলমারির পেছনের বুড়ো টিকটিকিটার মতো, কই একবার-ও তো সে খোঁজ নেয়নি ...
যাই হোক, ভাস্কর লিখেছিলেন, 'আমাদের স্বর্গ নেই, স্যারিডন আছে'? স্বর্গ না হোক, স্যারিডন-ই সই ...
সরি, আমি বড্ডো সেলফ-সেন্টারড, নিজের কথা বলেই কাটিয়ে দিচ্ছি ! তুই সেদিন আমার পাশে না দাঁড়ালে, আমার আজ এই ডাক্তার হয়ে ওঠা হত না । তোর হয়তো আমার প্রতিদানের কোন প্রয়োজন নেই, কিন্তু আমার তোকে আজও দরকার অনি।
তুই কেমন আছিস? খবরে শুনলাম নিউ ইয়র্কে নাকি অলরেডি প্রায় পঁচিশ হাজার জন মারাই গেছে? রোজ রোজ একটা খবর পাই আর কেঁপে কেঁপে উঠি ...
আমাদের এদিকে যা হওয়ার তা-ই হয়েছে, আসলে এই খেলনানগরে মানুষের জীবনের কোনো দাম নেই রে, ব্যাটারি শেষ হয়ে গেলে ফেলে দেবে আস্তাকুঁড়ে ... বড়ো বড়ো নেতা আর নেতাদের গামছায় হাত মোছা পাবলিক আসবে, ভাষণ দেবে টেলিভিসনে, তারপর অশ্লীল তর্ক জুড়ে দেবে ... কদ্দিন না খেলে বাঁচবে লোকে? আর পাঁচদিন, আর এক মাস, আর এক জীবন ... ?
তুই কাজ করিস না পাবলিক হেলথে? ওখানে করছিস? একদিন শুনবো কী করিস !
(যাই করিস অনি, প্লীজ ... প্রত্যেক-টা রেশিও-র দিকে তাকিয়ে ভাবিস নিউম্যারেটর-ডিনমিনেটর সব-ই মানুষ, প্রত্যেকটা টাইম-পয়েন্ট বাড়ার সাথে ভুলের মার্জিন যতো কমে তার ঢের বেশী মানুষ টপকে যাচ্ছে অনাহারের বিপদসীমা, আর আমরা সবাই এই মুহূর্তে যে একটা বিশাল খাদের সামনে দাঁড়িয়ে আছি, আর মাটি কাঁপছে পায়ের তলায় সেইটা বোঝাতে মডেল লাগে না ...)
কাকিমা কেমন আছেন জিগ্যেস করতে চাই, লজ্জা করছে করতে ... কাছের মানুষদের নিয়ে খুব ভয় করছে রে, পেটের মধ্যে হাত-পা সেঁধিয়ে আসা ভয় ! বিশাল বড়ো মেলায় গেলে যে ভয়-টা করে, এই বুঝি কোথাও একটা দুম করে আওয়াজ হলো, অমনি শয়ে শয়ে বুটজুতোপরা পা আমার ঠিক ওপর দিয়ে চলে যাবে ... সেই, একদম অবিকল সেই ভয়-টাই !
যাই হোক, আবোল-তাবোল বকা বন্ধ করি ! যাই একটা সিগারেট ধরাই ... সব শেষ হোক, একদিন আমরা গোটা রাত ছাদে বসে শুধু চিৎকার করে বেসুরো গান গাইবো আর প্রচুর প্রচুর সিগারেট খাবো আর দেদার আড্ডা ... শুধু সেই আশাতেই এই অন্ধকার টানেল-টা পেরিয়ে যাবো, বল?
ইতি,
উৎসব
"হারিয়ে গেছে তরতাজা সময়
হারিয়ে যেতে করেনি আমার ভয়
কখন কিসের টানে মানুষ
পায় যে খুঁজে বাঁচার মানে
ঝাপসা চোখে দেখা এই শহর
আমি অনেক স্রোতে
বয়ে গিয়ে
অনেক ঠকেছি
আমি আগুন থেকে
ঠেকে শিখে
অনেক পুড়েছি
আমি অনেক কষ্টে
অনেক কিছুই
দিতে শিখেছি
শুধু তোমায় বিদায় দিতে হবে
স্বপ্নেও ভাবিনি"
চিঠি ৭ অনির্বাণের চিঠি উৎসব-কে
"হে প্রিয় শহর, তুমি কেন চিঠি লেখো না প্রত্যহ?
একা, একা, একা, একা, কেঁপে উঠি মানুষের দেশে"
ভাস্করের কথা বললি তুই, ওনার লাইন দিয়েই বললাম কেমন আছি :) তবে, আজ একটু বেটার থাকবো জানি, ঘুম থেকে উঠেই তোর ইমেল-টা পেলাম। সকাল-টা ভালো হয়ে গেলো ... আত্মীয়-স্বজন, প্রিয় বন্ধুদের চিঠি আসছে রোজ-ই, ফোন আসছে মাঝে মাঝে, একদিন একটা জুম কল হ'লো কলেজের বন্ধুদের কয়েকজনের সাথে ... সবাই জিগ্যেস করছে, ভালো আছিস? ঠিক আছিস? তোদের ওদিকে তো ... আমার না কোথাও একটা লজ্জা হচ্ছে, অপরাধবোধ হচ্ছে বারবার, বারবার বলতে, হ্যাঁ ভালো আছি, সেফ আছি ... এই মৃত্যু মিছিলের থেকে অনেক দূরে, আরামে বসে নিশ্চিন্তে তত্ত্ব করছি কী হলে কী হতো, আর প্রত্যেকটা দিন আমরা একটু-একটু করে এগিয়ে যাচ্ছি আরো গভীর খাদের দিকে ... হয়তো ঝাঁপ মেরেই দিয়েছি, কে জানে?
এই মারণরোগ এসে একটা গভীর প্রশ্নের সামনে দাঁড় করিয়ে দিয়ে গেলো আমাদের ... এই যে বাড়িতে আটকে আছি এতোদিন, বাড়িতেই তো আছি, তাহলে এতো গৃহহীন লাগছে কেন নিজেকে? ভালো বাসাটা তাহলে কোথায়? (জানি, জানি, তুই বলবি প্রিভিলেজড লোকের প্রবলেম, তাও ... এই দেশ সত্যি আমাদের unaccustomed earth !
রিলকে পড়েছিস? দুইনো এলেজিস?
'Ah who can we turn to, then?
Neither Angels nor men,
and the animals already know by instinct,
we're not comfortably at home in our translated world''
সেই ইন্সটিংক্ট-টাই বোধহয় কাজ করছে ভেতরে?
তবে কী জানিস তো উতু, জীবনের গভীর শোকের দিনগুলিতে কোনো কবিতা নয়, উক্তি নয় ... কাজ, কাজ, কাজ, পাগলের মত কাজই আমাকে বারবার টেনে তুলেছে ... গত দুই সপ্তাহ, এই শহরের একদল রিসার্চার মিলে দিন-রাত এক করে একটা দরকারী কাজ করার চেষ্টা করছি!
কতো লোকে যে এগিয়ে এসেছেন, কাঁধে-কাঁধ লাগিয়ে লড়ছেন, সেটা ভাবলে এই মৃত্যু উপত্যকার দাঁড়িয়েও ইচ্ছে করে একটা বড়ো শ্বাস নিতে ... )
খুব ভয় করে বাড়ির লোকেদের জন্য, পাগলের মতো ভয়, ভবিষ্যত ভয়ানক অনিশ্চিত মনে হয়। এই বিশাল মৃত্যুর মিছিলের বোঝা চেপে ধরে দশদিক থেকে... আর ধুলোর মধ্যে, খিদের মধ্যে নিশ্চিত মৃত্যুর দিকে হেঁটে যেতে যেতে সেই মিছিলের শিশুরা জিগ্যেস করে, লগ-স্কেলে আঁকবো, না লিনিয়ার? ...
কিন্তু এই যে মোমবাতিটুকু কাঁপছে ঝোড়ো হাওয়ায়, এইটুকু দুই হাত দিয়ে আগলে রাখা দরকার ... যদ্দিন হাত দুখানা আছে ...
'আমাদের অন্ধকার দিনগুলিতে গান হবে, উৎসব?’
ইতি, অনির্বাণ
পুনশ্চঃ ভাগ্যিস ইমেল আছে, তুই মৃত্তিকার চিঠি পাচ্ছিস,আর জানলা খুলে উড়িয়ে দিচ্ছিস
বাইরের
রাস্তার নোংরা ধুলোয়, ভাবলেই তোকে ঠাস করে চড়াতে ইচ্ছে করছে ... আমাকে ভুল বুঝিস না
কিন্তু, ভুল শুধরে নেওয়ার সুযোগ বারবার আসে না উৎসব !
গানঃ Jamaican
farewell / পথের প্রান্তে
Down the way where the
nights are gay
And the sun shines daily on the mountain top
I took a trip on a sailing ship
And when I reached Jamaica I made a stop
But I'm sad to say I'm
on my way
Won't be back for many a day
My heart is down, my head is turning around
I had to leave a little girl in Kingston town
পথের প্রান্তে ওই সুদূর গাঁয়ে
যেথা সময় থমকে থামে বটের ছায়ে
আহা সন্ধ্যা দ্বীপ জ্বালে তারার টিপ
কত ফুলের গন্ধে মোর মন মাতায়
হায় কোন সুদুর সেই স্বপ্নপুর
মোর মন যে গায় ঘরে ফেরার সুর
মোর পথ চেয়ে আজ ও সেই মেয়ে
বুঝি স্বপ্ন যায় বনে গান গেয়ে
চিঠি ৮ - উৎসবের চিঠি অনির্বাণ-কে
অনি,
আমার
মাঝে মাঝেই মনে হয় যতো ভুল বোঝার ভিকটিম হয়েছি আমি, ততো বোধহয় আর কেউ নয়। তবে তুই
আমাকে বুঝিস এইটুকু আমি সত্যি বলে ধরে না নিলে বেঁচে থাকার মানে চলে যায় ...
যাই
হোক যা লিখছি, তোর কাছে কৈফিয়ত মনে হতে পারে মৃত্তিকাকে উত্তর না দেওয়ার, কিন্তু
বিশ্বাস কর, কৈফিয়ত নয়,শুধু এই জবাব-টা না দিতে পারলে রাত্রে ঘুম আসবে না, তাই
দিচ্ছি
বাড়ি ছেড়েছি আজ ১৫ বছর হলো - মাঝেমাঝে ভীষণ মার কথা মনে পড়ে। তখনকার দিনের এম-এ পাশ, তাও বাবা চাকরিটা শেষমেশ ছাড়িয়েই দিলো একদিন। সারাটাদিন নিজেকে হাজার রকম বাড়ির কাজে
বেঁধে ফেলেছিলো মানুষটা, আমরাও যেন তাকিয়েও তাকাইনি তার দিকে …
আমার এই বই পড়ার নেশা মায়ের হাত ধরে,
রাত্রে খাওয়ার সময় নতুন, নতুন গল্প না বললে খেতে চাইতাম না নাকি … গান-ও, রান্নাঘরে মায়ের গুনগুন শুনে-শুনেই সুর শিখেছি। অথচ বাবা
যেন ঠিক উলটো, বাড়ি ফিরলেই সারা বাড়িতে কিরকম একটা কার্ফু – কেউ জোরে হাসে না,
কথা বলে না - শুধু চাপা গলায় ফিসফিসানি। আর যেদিন
নম্বর কম নিয়ে বাড়ি ফিরতাম – না রে অনি, ছোটোবেলার সেই ভয়ের মুখটা আর মনে করতে চাই
না !
অনেকদিন মাকে বলেছি চলো বেরিয়ে যাই, কিছু একটা জুটিয়ে নেবো, আমি টিউশনি করবো, মা ডে-কেয়ার। মা শোনেনি। বলতো, তোদের মুখের দিকে তাকিয়ে …
মা যে মনেপ্রাণে নিজেকে সবকিছু থেকে সরিয়ে নিয়েছিল সেটা বুঝতে পারি যখন শেষ মুহূর্তে এসে ডাক্তার বলেন, মার দীর্ঘ দিনের টিবি ছিল। কাউকে বুঝতে দেননি। আমার মেডিক্যাল এ চান্স পাওয়া নিয়ে ভীষণ আনন্দে ছিল। আর কটা বছর পেরোলেই নিজেই পারতাম মার চিকিৎসা করতে। নিজের ওপর ভীষণ রাগ হয়, এত কাছে থেকেও কিকরে একবারের জন্য বুঝতে পারলাম না? হয়তো আমিও বাবার মতোই, ভীষণ স্বার্থপর। কে জানে?
মাকে চুল্লি তে দিয়ে যখন গঙ্গার ধারে একা বসে আছি। জলের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে কিরকম মনে হল এই জীবন, মৃত্যু, ভালবাসা, বন্ধুত্ব, সমস্ত সম্পর্ক সব - সব কিরকম ভাসমান, ক্ষণিক, অনিশ্চিত, অকিঞ্চিৎ।
আসলে ছোট্টবেলা থেকেই আমার মনে হয় সব
সম্পর্ক-ই আসলে ভিতরে ভিতরে এক-ই রকম পোকায়-কাটা, এক-ই রকম তিক্ত, এই যে ছেলেমেয়েরা
সন্ধ্যের আলোয় উড়ে বেড়াচ্ছে, ঘুরে বেড়াচ্ছে, এরাই কিছু বছর পরে একে অন্যর দিকে ছুঁড়ে
দেবে অভিশাপ, থালা-বাসন … অথবা আলাদা হয়ে যাবে দুটো দ্বীপের মতো, যাদের মধ্যে কোনো
সেতু নেই …
আসলে কি জানিস তো অনি, আমি ছোটোবেলা
থেকেই কোনরকম সম্পর্ক বুঝিনা, বিশ্বাস করিনা
দুজন মানুষের পরিণতি ঘৃণা বা উদাসীনতা ছাড়াও অন্য কিছুও হয়। এমনিতেও, মা ছাড়া পরিবারের বাকিদের সাথে সুতোর টান অনুভব করিনি কোনোদিন। মা চলে যাবার পর দিনগুলো কিরকম একটা ঘোরের মধ্যে কেটে যাচ্ছিল। তুই বোধহয় কিছুটা আন্দাজ করেছিলি। মৃত্তিকাও করেছিল। বাবা বোধহয় ওকেও কিছু বলেছিল। মার কাজের দিনটা বাদ দিয়ে ও তাই আর আসেনি।
আমিও অর্ধেক পৃথিবী দূরে স্বেচ্ছায়
চলে এলাম একদিন, পড়তে না পালাতে জানি না ... হয়তো সেই অবুঝ বয়স বুঝতো না এসব জটিল হিসেব
!
অবশ্য দোষ আমার-ও কম নয়, দিল্লীর
এই চাকরিটা ছেড়ে আজ মেদিনীপুরের গ্রামে-গ্রামে ঘুরে বেড়াই সেও তো বছর তিনেক হলো … মৃত্তিকার মায়ের শরীর খারাপের খবর পেয়েছিলাম, জানতাম হাতে দিন গোনাগুন্তি, নিজের ইনারশিয়া কাটিয়ে একটা সামাজিকতার খাতিরেও একবারও যোগাযোগ করে উঠতে পারিনি ... সত্যি ! আসলে, আসলে আমরা দুজনেই একে অপরকে বলে উঠতে পারিনি, কিন্তু কিছু না বলা কথা যে অনেক কথার থেকে অনেক বেশী। সেদিন শহর ছেড়ে চলে যাবার আগে ওর বাড়ির সামনে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়েছিলাম। কিন্তু ভেতরে যাবার জন্য পা সরেনি। কি হয়েছিল সেদিন? হয়তো ভয়, হয়তো অবসাদ, হয়তো কাপুরুষতা, হয়তো সেই স্বার্থপরতা -
এখনো এক-একদিন স্বপ্নে দেখি সেই গভীর অসুখের মতন আগুনগুলো ফিরে এসেছে আমার গাছ-ঢাকা বারান্দায়, আর তাদের আমি ছোট্ট চিঠিতে লিখে দিচ্ছি, “যতটুকু দেখে গেলে ততটুকু নয়, ভালোবাসা থেমে আছে, আমার-ও আমূল অন্ধকারে” ...
‘হ্যাঁ, অনি, আমাদের অন্ধকার দিনগুলি নিয়ে গান হবে'
গানঃ আমি গাই ঘরে ফেরার গান
চিঠি ৯- মালবিকাদির চিঠি উৎসবকে
স্নেহের উৎসব,
কেমন আছো? তোমাকে সেদিন দেখলাম টিভিতে, খোঁচা খোঁচা দাড়িওয়ালা রাগী যুবক, এই ছেলেটাই আমার ক্লাসে নোট না লিখে কবিতা লিখতো আর ছবি আঁকতো খাতায়?
অবাধ্যতা করতে বলে কতো বকেছি তোমাকে ছোটোবেলায়, এখন ভাবি সব ছেলেই যেন অবাধ্য হয়ে জন্মায় ! এখন ভাবি সবার খাতার শেষ পাতায় লিখে দেবো, "জল নয়, আগুন" ... তোমাদের মতো ছাত্র কে পড়াতে পেরেছি নিশ্চয়ই আগের জন্মের সঞ্চিত পূণ্য
চিঠিটা তোমাকে লিখবো কিনা ভেবে ভেবে লিখেই ফেললাম, সন্তানসম ছাত্রের কাছে মায়ের আর লজ্জা কী বলো?
কত চিঠি-ই অবশ্য পাঠাবো বলে আর পাঠাই নি কাউকে, সেইসব ঠিকানায় না পৌঁছনো চিঠিগুলোর জন্য এখনো একটু আফশোস রয়ে গেছে মনে মনে, অবশ্য এ-ও ঠিক যে নিজে পাওয়া যে কতো চিঠি হারিয়ে গেছে তার ইয়ত্তা নেই.. যদিও সেসব উদ্ধার হলে যে সমূহ বিপদ একথা অস্বীকার করার উপায় নেই..
আর কি জানো, এককালে প্রেমের চিঠি লিখতে দারুণ লাগতো, মনে হতো মানুষে প্রেমে পড়ে কেবলমাত্র চিঠি লেখার অজুহাত পাবে বলে, তাই আমি নিজের লেখার সুযোগ না পেলে বন্ধুদের লিখে দিতাম ... পুরো অর্ডার-দেওয়া কাস্টমাইজড চিঠি সেসব ... এখন আর কেউ বলে না !
আমি আবার গান শিখছি, জানো? সারা জীবন দুঃখ রয়ে গেছিলো গানটা কোনোদিন-ই ঠিক মতো গাইতে পারিনা বলে, এই বুড়ো বয়সে পৌঁছে আবার শিং ভেঙে বাছুরের দলে, এখন তো গৃহবন্দী, গানের দিদিমণি-ও ছুটি দিয়েছেন ... ইউটিউব-ই ভরসা, তোমার এক বন্ধুর গান সেদিন শুনলাম, কী ভালো, কী ভালো !
আমরা যারা পারিনি গানের ঝরনাতলায় স্নান করতে, আমরা যারা চিৎকার করে গেছি মেহফিলের বাইরে দাঁড়িয়ে, অন্ধকারের চোখে চোখ রেখে ... দেখো একদিন আমরা-ও ঠিক গেয়ে উঠবো ...
আসলে উৎসব, এই প্যানডেমিক আমাকেও কান ধরে বুঝিয়ে দিয়ে গেলো, জীবন বড়ো ক্ষণস্থায়ী, ভঙ্গুর, তবুও এই ভঙ্গুর, তুচ্ছ, জীবন ... full of sound and fury জীবন, tale told by an idiot জীবন ... এই জীবনটুকু বেঁচে থাকার মধ্যেও একরকমের রোম্যান্স আছে, সেইটা - সেইটাই এই সময়ের সব থেকে বড়ো
শিক্ষা হয়ে থাকুক
চিঠি ১০ - উৎসবের চিঠি মৃত্তিকাকে
মৃত্তিকা,
দুদিন হল তোর ইমেল পেয়েছি ... রিপ্লাই করবো ভেবে ভেবেও করা হয়নি, সরি !
আসলে খুব ডিট্যাচড লাগছে সবকিছু থেকে -আবার যা কিছু থেকে ডিট্যাচড হতে চেয়েছিলাম, সবকিছু মনে পড়ে যাচ্ছে। চোখের সামনে সিনেমা চলছে কিন্তু একটা সিন-ও মাথায় রেজিস্টার করছে না, কবিতার বই খুলে তাকিয়ে আছি অথচ অক্ষরগুলোর অর্থহীন নকশা মনে হচ্ছে - কালকে একটা পাতা খুলে অনেকক্ষণ ড্যাবড্যাব করে চেয়েছিলাম, কিছু যেন একটা প্যাটার্ণ আছে জানিনা ...
(পড়া ফেড হতে হতে এই গানটা শুরু হবে ব্যাকগ্রাউন্ডে)
যখনই বিকেল আসে, ভাবি আমি মরে যাব
পাখি হয়ে নেব ঠোঁটে নীহারিকা নীহারিকা...
যখনই বিকেল আসে শহরে
বাড়ে মনখারাপেরা, ছায়াদের বাড়ি ফেরা
বুকে কিছু কাটাকুটি, ধুলো জমে ধুলো জমে...
বাড়ে মনখারাপেরা বহরে
এখানে সবাই একা, ভীষণ ভীষণ একা
মরা সেতু ঝুলে আছে বাতাসে
কত কী লিখব ভেবে, কিছুই লিখিনি
খালি এপিটাফে এপিটাফে খাতা শেষ...
তাই চোখের আয়না পুড়ে ছাই
নাও, তুমি মাখবে কথা দাও...
https://www.youtube.com/watch?v=rGVESufLCqk
চিঠি ১১- মৃত্তিকার চিঠি, উৎসব-কে
উৎসব,
তোকে উত্তর দেবো কি দেবো না বুঝতে পারছিলাম না। তারপর মনে হলো নৈঃশব্দ্যের আঘাত শব্দের থেকে বোধহয় কিছু বেশী, আর সে আঘাত তোকে আমি অজান্তে হলেও হয়তো দিয়েছি গত পনেরো বছর ... একদিন ঠিক ঠিক করে সব কথা বুঝিয়ে লিখবো বলে আর লেখাই হয়ে ওঠেনি কোনোদিন, সেই বিনয় মজুমদার গায়ত্রীকে লিখেছিলেন না, ‘যখন দুজনে যুবক ও যুবতী ছিলাম, তখন কি জানতাম বুড়ো হয়ে যাবো?’... লিখেছিলেন,
‘আমার ঠিকানা আছে তোমার বাড়িতে,
তোমার ঠিকানা আছে আমার বাড়িতে,
চিঠি লিখবো না,
আমরা একত্রে আছি বইয়ের পাতায়’
জানিনা কেন, সেইটাই ভবিতব্য মেনে নিয়ে জীবন-টা কাটিয়ে দেবো ঠিক করেছিলাম! ভেবেছিলাম ‘আমার বিশ্বাস আমি ন্যস্ত রেখেছিলাম পাথরে, এক অনমনীয় পাথরে’ ... কিন্তু এই হঠাৎ করে ধেয়ে আসা অন্ধকার, এই otimari সেই নিপুণ খেলার ছক সব ওলোট-পালোট করে দিলো জানিস?
অগুন্তি মৃত্যুর মিছিলে দাঁড়িয়ে ইলিয়ট মনে পড়ে, "A crowd flowed over London Bridge so many, I have not seen/
death hath/ undone so many?" মাঝে মাঝে টিভির পর্দায় সারি সারি শাদা চাদরে মোড়া বেডের ছবি দেখতে দেখতে আজকাল ওই লাইনটা যেন চোখের সামনে দেখতে পাই জানিস!
এই অতিমারীর সাথে যুদ্ধের
উপায়গুলো আমাদের ভারী অদ্ভুত! অস্ত্র শানানোর উপায় নেই, তাই মানুষের এবার ইগো
সমর্পণ করার পালা। কি ক্ষুদ্র আমরা, ততোধিক ক্ষুদ্র আমাদের রাগ, দুঃখ, অভিমান,
ক্ষমা না করার অঙ্গীকার। পুরোটাই যেন who
blinks first এর খেলা। আজ বোধ হয় হেরে
যাওয়ার দিন এসেছে মানুষের. তাই আমাদের মধ্যে ক্ষমাটা না হয় আমি-ই করি প্রথম?
‘Reading between the lines’ আমাদের অভ্যেস, তাই জানি তোর চিঠিতে লেখা থাক না থাক, তোর ও অভিমান জমে জমে পাহাড় হয়ে আছে, আমি নদী হতে পারবো না জানি, শুধু শীর্ণ সাঁকোটুকুর অভিমান হয়ে থাকতে পারলেই আমি খুশি ...
ভালো থাকিস,
মৃত্তিকা
“যখন পথের পাশে পেয়ে গেছি একটি বৃক্ষকে,
যখন বৃক্ষের পাশে পেয়ে গেছি পাতার কুটির
যখন কুটিরপার্শ্বে পেয়ে গেছি রাঙা নদীখানি
যখন নদীর পাশে পেয়ে গেছি একফালি ভুঁই
ভুঁই থেকে উঠে আমি যখন হয়েছি ভুঁইফোঁড়
তখন তো বৃক্ষে উঠে হবোই একটি হাওয়ায় কাঁপা ডাল
ডালে এসে বসবেই একটি পাখির মতো পাখি
এবং সে পাখি বলবেঃ ‘কুটির সাজাতে আমি জানি
ও গাছ জিগ্যেস করো, ও নদী জিগ্যেস করো ওকে
একটু কি ভালো লাগবে, একটু কি শান্তি হবে ওর
যদি সব ছেড়ে দিয়ে আজ
আমি এসে ওর সঙ্গে থাকি?’
গানঃ "এখন সকাল এখানে সকাল
মেঘলা সকাল
মাটি ভেজা ভেজা গন্ধ
তোমার আকাশে কত তারা ভাসে
তুমি দ্যাখোনা তো
তোমার জানালা বন্ধ
তোমার চিঠি কালকে পেয়েছি
ক'হাজার মাইল পেরিয়ে এসেছে
তোমার কথার ছন্দ
একা একা রাত কাটানো খবরে
কুয়াশা জড়ানো ভোরের খবরে
পাওয়া-না-পাওয়ার দ্বন্দ্ব
আমার এখানে এক-ই কাদা-জল
বর্ষাকালে দু-পায়ে মাখানো
বাড়িতে বাইরে সেই অবিকল
এক-ই রকম সময় কাটানো ...
(https://www.youtube.com/watch?v=1R28UK4Azrg&feature=youtu.be )
চিঠি ১২- উৎসবের চিঠি মৃত্তিকাকে
মৃত্তিকা,
আমার
আবার দেরি হয়ে গেলো। ‘জুতোয় পেরেক ছিলো’[1] …
আসলে বড্ড ডিস্টার্বড থাকি আজকাল, ঘুম-টুম উড়ে গেছে, যেটুকু হয় তাতেও সারি সারি শবদেহ তাড়া করে, সমুদ্র-ঢেউয়ের মাথায় হাজার হাজার মুখোশপরা মুখ আলোর উপরে প্রেতের মত জেগে দেখে আমাকে ... তবুও পাগল যে হয়ে যাইনি কেন, কে জানে !
তুই মেজপিসিকে দেখিসনি, গল্প শুনে থাকবি হয়তো ... চলে গেলেন কিছুদিন আগে, আকস্মিক সেরিব্রাল অ্যাটাক । কয়েকদিন আগেও কথা বলেছেন আত্মীয়-স্বজনদের সাথে, খবরাখবর নিয়েছেন ... বলেছেন, 'অনেকদিন দেখিনা, একদিন আসো'! পিসেমশায়
জনাইয়ের ইস্কুলের হেডমাস্টার ছিলেন, হেডমাস্টার মানুষ যেমন হয় তেমনি,
রাগী, ভারিক্কি লোক, পুরু ফ্রেমের চশমা পরা, চোখের সামনে হয় আনন্দবাজার না হলে পরীক্ষার খাতা ... আর পিসিমণি ছিলো নরম-সরম, আদরের মানুষ, ছোটোবেলায় আমি তাঁর ডাকনাম রেখেছিলাম গদীপিসি...
সেই মানুষ-টা বোধ হয় হঠাৎ একটা পছন্দের স্টেশন দেখে জীবনের ট্রেন থেকে নেমেই পড়লেন সবাইকে ফেলে ! আর এমন দুর্যোগের দিনকালে, যে আমার অশীতিপর পিসেমশাই শেষকৃত্য সেরে বাড়ি ফিরলেন যে লকডাউনের দিনগুলিতে, সেদিন তাঁর পাশে এসে বসার অনুমতি নেই কারুর ... হ্যাঁ, ভালোর জন্য-ই, জানি, কিন্তু সেই ছায়াঘেরা ছোটবেলার স্মৃতির বাড়িতে এখন 'আছে শুধু নেই'
এই বিশ্বজোড়া হাহাকারের মাঝে নিজের শোক বড়ো অকিঞ্চিৎকর মনে হয়। তা হোক, ছোটোবেলায় যে তারস্বরে চেঁচিয়েছি আমরা পাশাপাশি দাঁড়িয়ে, সকাল সাতটার প্রেয়ারে ... 'মৃত্যোর্মা অমৃতংগময়', তার কী কিছুই ফল পাবো না?
উৎসব
চিঠি ১৩- মৃত্তিকার চিঠি উৎসব-কে
উৎসব,
খুব
মনখারাপ? কী বলি বল তো?
তোর
মেজপিসিকে মনে আছে আমার, তুই ডাক্তারিতে চান্স পেয়েছিস শুনে পাড়াশুদ্দু লোককে
মিষ্টি খাইয়েছিলেন, তুই-ই বলেছিলিস আমাকে. বলেছিলেন, “আমার ভাইপো ডাক্তার, যমকে
আমার ভয় কিসের?”
তোর
পিসেমশাইয়ের কথা ভেবে মনটা খারাপ হয়ে গেলো. একা তো হয়েই গেলেন, তার উপর এই শেষ
দেখার মূল্য ধরে দিতে হবে দীর্ঘ একাকীত্ব দিয়ে । উনি ভালো থাকুন এই প্রার্থনা করি
…. আমার কেন জানিনা মনে হয়, যাঁরা চলে যান তাঁরা হয়তো সত্যিই কোনো আলোপথ ধরে আরো
সুন্দর কোথাও চলে যান, সেখানে শুধুই শান্তি আর ভালোবাসা – আর যাঁরা থেকে যান তাদের
ভাগ্যে শুধুই আফশোস আর গ্লানি। আর যাঁরা পুনর্জন্মে বিশ্বাস করেন, তাঁদের শেষপাতে
শুধু একটু স্বান্তনার প্রসাদ !
মৃত্যু
কী শুধুই মৃত্যু, বল তো? এই যে আমাদের জীবনে বারেবারে রাস্তার মোড় এসে দাঁড়ায়, সেখানেও
তো প্রতিবার যখন একটা রাস্তা বেছে নেয় মানুষ তখন অন্য রাস্তাটার মৃত্যু ঘটে সি
মুহুর্তেই? যে মৃত্তিকা হতে পারতো যদি সেদিন উৎসব না বলে চলে না যেতো, সেই
মৃত্তিকার মৃত্যু কি অস্বীকার করা যায়, বা সেই উৎসবের?
আবার
দ্যাখ, যে তারাটা আমাদের এই চেনাজানা পৃথিবীর মাত্র কুড়ি-পঁচিশটা আলোকবর্ষ দূরে, সেখান
থেকে যদি দেখতে পেতাম, দেখতাম উৎসব মৃত্তিকা আজো কফি হাউসে বসে আড্ডা মারছে
অ্যানাটমির ক্লাস কেটে, হাঁটছে কলেজ-স্ট্রীটের অলি-গলি-পাকস্থলী ধরে মাইলের পর
মাইল. সময়কে অতিক্রম করতে পারলে আর বোধহয় স্বান্তনার প্রয়োজন থাকেনা আমাদের জীবনে
… এইটুকুই তো দূরত্ব !
মল্লারপুর
পড়েছিস? সেই যে ইতু বলেছিলো বর্ষণ-কে: মনে
কর মাঝে কয়েকটা বছর বেড়াতে গেছিলাম।
খুব
শক্ত, উৎসব এভাবে বেঁচে নেওয়া?
মৃত্তিকা
চিঠি ১৪- উৎসবের চিঠি মৃত্তিকাকে
মৃত্তিকা,
আজ প্রায় চার দিন পরে ইন্টারনেট এলো আমাদের এখানে, ইলেকট্রিসিটি
প্রায় নেই বললেই চলে – কোনোরকমে জেনারেটর দিয়ে হাসপাতালের কয়েকটা যন্ত্র চলছে ...
কাল সারা রাত্তির ঘুমোতে পারিনি, জেগে জেগে দেখছি একটু-একটু করে জল বাড়ছে,একটা
একটা করে সিঁড়ি ডুবে যাচ্ছে ... চারতলার একটা জানলা থেকে একটা সোলার প্যানেল কালকে
ঝড়ে উড়িয়ে নিয়ে গেছে, কোথায় গিয়ে পড়েছে কে জানে? কত যে ক্ষতি হয়ে গেলো তার কোনো
হিসেব নেই ...
তাও তো আমরা প্রিভিলেজড ক্লাস ... সেদিক থেকে দেখলে সেফ-ই
আছি, মাথার উপরে একটা ছাদ আছে,কিন্তু এই অঞ্চলের কতশত মানুষ গৃহহীন, গতিহীন, তাদের কী হবে কে জানে?
আমাদের বাড়িতে যিনি কাজ করতেন, ক্ষমাপিসি, তাদের গ্রামে
গেছিলাম গত বছর ... মনে পড়ছে ওদের সেই ছোট্ট বাড়িটার কথা,২০০৮ সালের আয়লায় আর্ধেক
বাড়িটাই খেয়ে নিয়েছিলো ... তারপর কত কষ্ট করে তিল তিল করে এতো বছর ধরে মেরামত
করেছে সেই ভিটেমাটি... কাল শুনলাম সে বাড়িটাই নাকি আর নেই, কোনোরকমে একটা
পাকাবাড়ির একতলায় ঢুকে প্রাণ বাঁচিয়েছে, বাকি সব শেষ ...
অনেকদিন আগে যখন দিল্লীর কর্পোরেট হাসপাতাল ছেড়ে এই গ্রামে এসেছিলাম, ভেবেছিলাম জীবনের ছোট্ট ছোট্ট ফুটো গুলো ভরাট করবো এই মাটির মানুষগুলোর ভালোবাসায় ... আজ বুঝতে পারছি এইটাই আমার ডাক ... ঠিক করলাম বাকি জীবনটা যতোটুকু পারি এখানে থেকে এই অসম যুদ্ধটাই চালিয়ে যাবো ...
মালবিকাদি বলতেন, দীপেন প্রজ্জ্বালিত দীপবৎ - পারবো না বল একটা অন্ততঃ মাটির প্রদীপ হয়ে জ্বলতে বাকি কটা
বছর?
জানিনা এই শীর্ণ
সাঁকোর ওপারে কী আছে? জানিনা আমাদের সত্যি-ই কোনোদিন দেখা হবে কি না হঠাৎ একটা
রাস্তার মোড়ে, বইয়ের ব্যাগ কিংবা পেশেন্টের বাইন্ডার ফাইল হাতে। একদিন ঝড় থেমে যাবে জানি, তবু সেই সকাল কেমন হবে সে কল্পনা করতেও ভয় হয় ...
এ চিঠির জবাব দেওয়ার দায়
নেই, তবু, ‘উত্তর আসবে না, তুমি আসবেই আমি জানি’...
অপেক্ষায় থাকব।
উৎসব
আকাশ কাঁদে হতাশ-সম, নাই যে ঘুম নয়নে
মম–
দুয়ার খুলি হে প্রিয়তম, চাই যে বারে বার॥
আজি ঝড়ের রাতে তোমার অভিসার
পরানসখা বন্ধু হে আমার॥
বাহিরে কিছু দেখিতে নাহি পাই,
তোমার পথ কোথায় ভাবি তাই।
সুদূর কোন্ নদীর পারে গহন কোন্ বনের
ধারে
গভীর কোন্ অন্ধকারে হতেছ তুমি পার॥
আজি ঝড়ের রাতে তোমার অভিসার
পরানসখা বন্ধু হে আমার॥
[1] আমার খানিকটা দেরি হয়ে যায়, জুতোয় পেরেক ছিল, পথে বড় কষ্ট, তবু ছুটে
এসেও পারি না ধরতে, ততক্ষণে লুট শেষ, দাঁড়িয়ে রয়েছে সব ম্লান ওষ্ঠপুটে