Tuesday, May 21, 2024

সামাজিক সমঝোতা

 "সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়ের ডায়রি" বইটি শুরুই হচ্ছে এই ছোট্ট এন্ট্রি-টি দিয়ে। মাঝে মাঝেই হন্টিং সুরের মত, পুরোনো বকেয়া কাজের অপরাধবোধের মত এই একটা লাইন ফিরে ফিরে আসে। মাঝে মাঝেই চারদিকে তাকিয়ে মনে হয় যেন আর মানুষের বিবেক, চেতনা, ভালো-খারাপ বোধ কিচ্ছু নেই, অন্যায়ের দিকে ওঠা আঙ্গুল নেই, সামনে কোনো আয়না নেই। আছে শুধু অনন্ত "সামাজিক সমঝোতা"।

এইসব ভাবনা এলেই মনে মনে দাঁত চিপে ভাবি (আসলে প্রার্থনা করি অন্ধকার ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে) যেন এমন একদিন আমার-ও না আসে যে সমস্ত সামাজিক ও অন্যান্য সমঝোতা-ই আমার বধ্যভূমি হয়, আমার জেলখানা হয়ে যায়। তাতে যদি জীবন বন্ধুহীন ও অসামাজিক হয়ে যায়, যাক।
আমাকে এই বিস্ফোরক জিনিষটি পড়িয়েছিল অনির্বাণ। একদিন মেসেঞ্জারে ঠিক এই ছবিটাই পাঠিয়েছিল। সঙ্গে আর কিছু টেক্সট নেই। এইটাই।
না সন্দীপন লোক বড়ো ভালো ছিলেন এমন কথা আমি আদৌ ভাবি না। কিন্তু আমি ওঁর লেখার মধ্যে আটকে গেছি। আর 'বেরুনোর দরজা ক্রমশই ভারি হয়ে আসছে' আমি জানি।



গুরুচণ্ডা৯-র তিনটি বই

 বাংলা ভাষায় প্রথম রান্নার বই সম্ভবত ‘পাক রাজেশ্বর’ – সেই উনিশ শতকের কথা। তার কিছু পরেই বিপ্রদাস মুখোপাধ্যায়ের ‘পাক প্রণালী’। তবে খাদ্যাখাদ্যের গল্পের পাকাপোক্ত শেকড় তার-ও অনেক আগে। পুঁথির ভাষায় বললে, সেই চতুর্থ শতকের চন্দ্রকেতুগড়ের ফলকে, অষ্টম শতাব্দীর পাহাড়পুর কিংবা ময়নামতির পোড়ামাটিতে জলশস্য মৎস্যরূপে আকীর্ণ হয়েছেন। মৎস্যমুখী বাঙালি সেই মাটির আঁচড়ে ধরে রেখেছিল তার রোজকার জীবনের একটুকরো মাছ কোটার স্মৃতি। ঐটুকু যেন সে ধরে রাখতে চেয়েছিলো অনাগত প্রজন্মের কাছে একটি শান্ত দুপুরের চিহ্নের মত। জানেন তো নিশ্চয়ই, ঈশ্বরী পাটনীর যাঞ্চা কিন্তু আসলে ‘দুধেভাতে’ নয়, জোড়হাতে চেয়েছিলেন ওনার সন্তান ‘যেন থাকে মাছেভাতে’।

স্মৃতিই ক্রমশ বদলে যায় পদচিহ্নে। আমরা সেইসব ইতিহাস অথবা সাহিত্যের হাত ধরেই চলে যাই পূর্বপুরুষদের রসুইঘরে। সেই চর্যাপদের পাতায় ডালের গন্ধ নেই, কিন্তু চন্ডীমঙ্গলের কালকেতু পেট ভরায় জাউ আর ডাল খেয়ে, মঙ্গলকাব্যের কবি বিস্তারে বর্ণনা দেন খুল্লনাকে বাড়িতে আনার পর মাছের বিভিন্ন পদের। মোগল শাসনের সময় “রিয়াজ-উস-সালাতীন” থেকে জানি “ঘিয়ের রান্না খাসি এবং মোরগের মাংস তাদের মোটেই সহ্য হয় না”। আবার ষোড়শ শতকের সেবাস্তিয়ান মানরিক জানিয়েছেন গরীব মানুষের থালায় শুধু নুন আর শাক জুটতো, ঝোলের ভাগ তাতে সামান্য।
এসব অবশ্য বহু পুরোনো দিনের কথা। তবু, তার কিছু কিছু চিহ্ন কীভাবে যেন রয়ে গেছে আমাদের দৈনন্দিন যাপনে, শাড়ির আঁচলে, জামার হাতায় লেগে থাকা হলুদের ফিকে দাগের মত। বাঙালি ছড়িয়ে পড়েছে অক্ষাংশ-দ্রাঘিমাংশের সমস্ত সীমায়, তার বহুদূরে ফেলে আসা দেশের আবছা স্মৃতি রয়ে গেছে মশলার কৌটোয়, অথবা অচেনা দেশে হঠাৎ খুঁজে পাওয়া চেনা সব্জিতে অথবা মাছে, বার্মাদেশে যেমন শ্রীকান্ত বাঙালি খুঁজে পেয়েছিলেন বাজারের থলির ফাঁকে পুরুষ্টু মাছের ল্যাজপতাকা দেখে।
কিছু স্মৃতি যেন সব্বার চেনা ছোটোবেলা, সেইসব গল্প জমে ওঠে ঠিক কাঠফাটা গরমের দুপুরে, পা ছড়িয়ে আমের শাঁস ছাড়ানোর উপাচারে, চটের নিচে কাঁসিতে যেমন আদরে আহ্লাদে জমে ওঠে আমসত্ত্ব। সেই দৃশ্যের নেপথ্যে মিহিসুরে বেজে চলেছে পুরোনো একটা রেডিও, অনুরোধের আসরের মাঝেই থেমে থেমে বয়ে চলেছে তালপাতার পাখার হাওয়া, গুমোট দুপুরের মধ্যে। ভেসে আসছে মাগরিবের আজান আর অষ্টকের সুর, ছেঁড়া-ছেঁড়া তুলোট পাতার মত।
সেই দৃশ্য ক্রমাগত পিছনে ফেলে আমরা এগিয়ে এসেছি অনেক দূর, রসুইঘর থেকে পাকশালা হয়ে কিচেনের কিচাইনে। মোরব্বা আর বরফি থেকে কী ভাবে যেন পৌঁছে গেছি মলিকিউলার গ্যাস্ট্রোনমিতে। তবুও সেই পাহাড়পুর কিংবা ময়নামতির মানুষের মত আমরাও আমাদের-ই ফলকে নিজের মত এঁকে রেখেছি সেই সব আশ্চর্য রান্নার ছবি – কখনো সামান্য স্মৃতিভারাতুর, কখনো নিচু হয়ে আসা আকাশের মত বিষাদবিলাসী, আর কখনো কাপ্তান ছোকরার মত প্রগলভ ও ফাজিল (যে কোনো অর্থেই)। সেইসব ছবি ও সেইসব গল্পের আয়োজন এইবার গুরুর বইয়ের পাতায়। ভিয়েন বসানো হয়েছে এই আপনাদের আশেপাশেই। সদ্য সদ্য জ্বাল দিয়ে উঠে আসবে তিনটি সুস্বাদু বইঃ
শারদা মণ্ডলের পাকশালার গুরুচণ্ডালি (প্রথম খণ্ড),
স্মৃতি ভদ্রের রসুইঘরের রোয়াক (দ্বিতীয় খণ্ড)
আর অবশ্যই ডিডির কিচাইন।
এগুলো ঠিক খাবার বই নয়। আমাদের ঐতিহ্যকে মুছে যাবার হাত থেকে বাঁচানোর সামান্য প্রচেষ্টা মাত্র। পেটুক কিংবা হন বা না হন, ঐতিহ্যের সঙ্গে থাকুন।
আর হ্যাঁ, গুরুর এই বইপ্রকাশের পদ্ধতিটা আপনারা এতোদিনে নিশ্চয়ই জানেন। গুরুর সব বই-ই বেরোয় সমবায় পদ্ধতিতে। যাঁরা কোনো বই পছন্দ করেন, চান যে বইটি প্রকাশিত হোক, টিকে থাকুক কিছু পরম্পরা, তাঁরা বইয়ের আংশিক অথবা সম্পূর্ণ অর্থভার গ্রহণ করেন। আমরা যাকে বলি দত্তক। এই বইটি যদি কেউ দত্তক নিতে চান, আংশিক বা সম্পূর্ণ, জানাবেন guruchandali@gmail.com এ মেল করে।
সঙ্গের ছবিতে:
পাকশালার গুরুচণ্ডালি-র প্রচ্ছদশিল্পী রমিত চট্টোপাধ্যায়,
রসুইঘরের রোয়াক এর প্রচ্ছদ করেছেন রাজীব দত্ত।
তবে
ডিডির কিচাইন-এর ছবিটি প্রচ্ছদ নয়, প্রচ্ছদের কাজ চলছে।



পুরোনো খবর

একটা বাচ্চা ছেলের ইন্টারভিউ দেখে কুড়ি একুশ বছর আগের একটা খবর মনে পড়ল। মানে ওই কিশোরের জন্মের আগের ঘটনা আর কি, যাকে বলে এনসিয়েন্ট হিস্ট্রি।

ভাগ্যিস তখন সোশ্যাল মিডিয়া ছিল না। হুপহাপ করে কিছুই ভাইরাল হতো না। ভাগ্যিস!!
আবার বাংলা মিডিয়াম, তাই seduce শুনে কিঞ্চিৎ উত্তেজিত হয়েছিলাম মনে আছে। এখন দেখে মনে হলো, seduction শুধু না, একটু ভালবাসাও ছিল, আবার একুশ বছর ফিরে গেলে, আবারও এইই ছাইপাঁশ নিয়েই পড়তাম! এত বছর পরেও সেই কৈশোরের প্রেম রয়ে গেছে দেখি।
আর ওই শার্প ব্রিলিয়ান্ট ছেলেটি, যার নাম সৌম্যদীপ, যাকে আমি চিনি না কিন্তু চিনি — তাকে জানালাম অজস্র শুভেচ্ছা। বড়ো হও বাবা। দেখেও ভালো লাগে।



ব্রেশট

ব্রেশটের একটি দুটি লাইন আমরা বারংবার বলতাম, নাটকের দিনগুলোতে। হেঁকে বলতাম, "আমাদের অন্ধকার দিনগুলিতে গান হবে?"। জানতাম একজন বন্ধু ঠিক উত্তর দেবে, "হ্যাঁ, আমাদের অন্ধকার দিনগুলি নিয়ে গান হবে।" আর এই কবিতাটা কোথাও যেন টুকে রেখেছিলাম। ভাবতাম এই ক্রাইসিসটুকু কারুর কেন নেই?

ব্রেশটের সেই বিখ্যাত, বহুব্যবহৃত ও বিপর্যস্ত দুটো লাইন পড়েছিলাম সন্দীপনের কোনো একটি চটি বইয়ের পুস্তানিতে, এখন বিস্মৃত। যে সন্দীপন লিখেছিলেন, তাঁর কাছে শ্রেষ্ঠ কবিতা যেন একটি জ্যামুক্ত তির। যা ক্রমাগত লক্ষ্যের দিকে যেতে যেতে, বারংবার লক্ষ্যভ্রষ্ট হবে, অথচ, কি আশ্চর্য, তবুও সে লক্ষ্যের দিকে যেতেই থাকবে, সে লক্ষ্যের দিকেই যেতে থাকবে। (ঠিক এইটাই বলেননি, কিন্তু এর কাছাকাছিই কিছু একটা।)
ব্রেশটের কবিতা সেই তিরের মত। রাজনৈতিক ক্ষমতার পিছু পিছু অতর্কিত আততায়ীর মত সে ধাওয়া করেই যাবে। যতদিন আকাশে সূর্য তারা আছে।
আজকে ১০, ওঁর জন্মদিন গেল। আর কদিন পরে ২৭ ফেব্রুয়ারি, রাইখস্ত্যাগে বই পোড়ানোর দিন। তার ঠিক পরের দিন, ২৮, ব্রেশট জার্মানি ত্যাগ করেন। ১৯৩৩ সালে। আশা করি সেই ইতিহাস আর কোনোদিনই ফিরে আসবে না। অবশ্য আশা আর প্রেম ছাড়া, অন্তিম মূল্য আর কিসে?

The Burning Of The Books

When the Regime commanded the unlawful books to be burned, teams of dull oxen hauled huge cartloads to the bonfires. Then a banished writer, one of the best, scanning the list of excommunicated texts, became enraged: he'd been excluded! He rushed to his desk, full of contemptuous wrath, to write fierce letters to the morons in power — Burn me! he wrote with his blazing pen — Haven't I always reported the truth? Now here you are, treating me like a liar! Burn me! Translated by Michael R. Burch




হাঙ্গার আর্টিস্ট

 

এই লেখাটি "অপদার্থের আদ্যক্ষর" পত্রিকায় প্রকাশিত। সম্ভব হলে সেই সংখ্যাটি কিনে ফেলুন।  

কাফকার “হাঙ্গার আর্টিস্ট” নিয়ে একটি গরুর রচনা

(১)

“It was impossible to fight this incomprehension, this world of incomprehension.”

আশা করছি এই লেখাটা যখন পড়ছেন-ই, বইটা আপনি কিনেই ফেলেছেন বা কিনতে চলেছেন, অর্থাৎ আপনার কোমরের ব্যথা, মর্টগেজের বোঝা ও তামাম ছোটোবেলার ক্ষতের মত এইটাও আপনার অস্থাবর অস্তিত্বের এক কোণে থেকেই যাবে, অর্থাৎ আপনার সেই অর্থে এখন কোনো তাড়া নেই। তা তাড়া যখন নেই-ই, তাহলে অনুরোধটুকু রাখুন, ফ্রানৎজ কাফকার ‘হাঙ্গার আর্টিস্ট’ (কোনো কোনো ইংরেজি অনুবাদে স্টার্ভেশন আর্টিস্ট) গল্পটা ইন্টারনেটে সার্চ করলেই পাবেন, বস্তুতঃ না পাওয়ার উপায় নেই। পড়ে নিন। তাই বলে আবার নেটের বাংলা অনুবাদগুলো পড়ে বসবেন না। সেগুলো মানুষে করেছে না রোবোটে জানি না, কিন্তু যেই করুক, সে এক জঘন্য উদরাময় হয়েছে। পড়ে আসুন যাইহোক, তারপর আমরা না হয় একটা চেয়ার টেনে বসে দুটো-চারটে কথা বলবো এই নিয়ে? কারণ সত্যি বলতে কি, ভালো এক পাত্তর মদ খেতে কেমন, বা সফল অর্গ্যাজ়মের আনন্দ কেমন, সে যেমন আপনি হাজার লাইন লিখলেও বোঝাতে পারবেন না, কাফকা-ও তেমনি, নিজে না করলে ফক্কা। আর কে না জানে, টেক্সটের বাইরে আর কিছুই নেই, যা লেখা আছে তাই একমাত্র নিটোল ও নিখাদ সত্যি, তার সামনে আপনার-আমার অনুভূতির দাম সামান্য।

 

(২)

"The prospect of those visiting hours, for which the starvation artist naturally yearned, since they were the meaning of his life, also made him shudder."

এবার ধরা যাক, আপনি বাধ্য ছাত্রের মতো হোমটাস্ক করে এসেছেন, কাজেই এর পরের পরিচ্ছেদেই হাঙ্গার আর্টিস্টের গল্পের পিণ্ডি চটকাতে খুব বেশি দোষ হবে না। তাছাড়া, এ ত আর হাউজফুল সিনেমা কি প্রাইমটাইমের সিরিয়াল নয়, কাফকার গদ্যর আসল মজা তো ঐ পেরেকের মত সযত্নে সাজানো লাইনগুলো। যে পেরেকে পর্দা ছিঁড়ে যায়, নেপথ্য থেকে হঠাৎ বেরিয়ে এসে গল্পের প্লট মিশে যায় আপনার জীবনের সাথে, একবার হলেও মাথায় আসে, ‘আচ্ছা, আমিও কি হাঙ্গার আর্টিস্ট নই?”

আপনি কি লেখক? আমার ধারণা ৯০% সম্ভাবনা আপনিও লেখক। আপনি কি সোশ্যাল-মিডিয়ায় লেখেন? অথবা, একটু ঘুরিয়ে জিজ্ঞেস করলে, সেই দুরারোগ্য নেশা আপনাকেও ছাড় দেয়নি? লেখার পর কি প্রত্যেক মিনিট কি ঘন্টায় এসে উঁকি দিয়ে দেখেন কজন পড়লো, কজন আদরবাসা জানিয়ে গেলো, রাত দুটোর সময় ফোনের আলো জ্বেলে দেখে নেন কটা লাইক পড়লো? যে প্রকৃত পাঠকের (বা সদ্যোজাত পাঠিকার) ভালোবাসার জন্য আপনি হেদিয়ে যান (অবশ্যই গোপনে, কারণ প্রকাশ্যে আপনি থোড়াই-কেয়ার), সেই তারা মুখ ফিরিয়ে নেবে বলে লেখাটি পোস্ট করার ঠিক আগে একটু ভয় করে ওঠে, যেন ইংরেজির নিশীথমাস্টারের কাছে খাতা জমা দিচ্ছেন? তাহলে হ্যাঁ, আপনি একজন একটি হাঙ্গার আর্টিস্ট।

তারপর? তারপর কি আপনার অজান্তে বোধ করেন, লেখক কাছে এলে প্রকৃত পাঠক সারসের মত উড়ে যায়? আপনার কি মনে হয় না চাকুরিতে ও কর্তব্যে ঢিলে দিয়ে দিনের পর দিন বিদ্যুতগর্ভ যে সব গদ্যপদ্যপ্রবন্ধ গিলে গিলে চোক করে নিজেকে পিটিয়ে বানিয়েছেন, সে তাবৎ লেখা ও টেখা তার পাঠকদের কোলে নিয়ে অন্তর্জলি যাত্রায় ভ্যানিশ? অতএব, আপনার ঐ কষ্ট করে লেখা কেউ না পড়লে ধরেই নেন, আপনার লেখা আসলে উচ্চকোটির, কিন্তু পাঠকের বাঁড়া আর রুচির ঠিক নেই? (আর তা ছাড়া আপনি তো মাসের নন, ক্লাসের?)। আমি-আপনি একমত যে আপনি কিন্তু লিখে রাখছেন আগমার্কা খাঁটি অনুভূতির কথা আর লোকে গিলছে আগমবাগীশ, আপনি একেবারে নিজেকে নিংড়ে নিঃশেষ করে দিলেন, আর লোকে চাইছে একেবারেই হাল্কা-পেলব-পুতুপুতু-ক্যাতকেতে পাতাঝরা প্রেমের গপ্পো, না হলে অই আনন্দবাজারী গোছের বৃদ্ধাশ্রমের বৃত্তান্ত। আপনি এসব দেখে রাত্রির প্রথম যামে একটা বিড়ি ধরিয়ে বলেই ফেললেন “ধুর শালা”, কিন্তু সেই মধ্যযামে (নাকি মদ্যযামে) গুটিগুটি ফিরে গেলেন লেখার কাছে, যেমন হাজার বার অপমানের পরেও যৌনতার আশায় পুরুষ ফিরে যায় দমবন্ধ সম্পর্কের কাছে? তাহলে হ্যাঁ, আপনি একজন একটি হাঙ্গার আর্টিস্ট।

 

(৩)

“Try to explain the art of fasting to anyone! If someone doesn’t feel it, then he cannot be made to understand it.”

শুরুতেই গল্পটা বলে দিতে নেই, দিইনি। মাঝে একটু গুঁজে দিই। গল্পের শুরুতেই তৃতীয় পুরুষ, বলা হচ্ছে শেষ কয়েক দশকে অনশনশিল্পীদের উপর লোকের আগ্রহ কমে গেছে, আগে এই লাইনে কিছু পয়সা-টয়সা ছেল, আর নাই। এরপর কাফকার গল্প ফোকাস করে একজন অনশনশিল্পীর উপর। সেই নামহীন অনশনশিল্পীকে রাখা হয় একটা খাঁচায়, কিছু খড়বিচালি আর একটি ঘড়ির সাথে, আর পাহারায় থাকে তিনজন কসাই, চোট্টামি করে কিছু খেয়ে ফেলছে কি না দেখার জন্য। দলে-দলে লোকে টিকিট কেটে তার অনশন দেখতে আসে, কেউ কেউ আসে রাতের শোয়ে, টর্চের আলোয় জমে ওঠে ব্যাপারখানা, কেউ তবু সন্দেহ করে সত্যিই কি না খেয়ে অ্যাত্তোগুলো দিন … বাচ্চারা সেই কঙ্কালসার চেহারা দেখে হাঁ করে, মুগ্ধ হয়ে, কখনো খাঁচার ভেতর থেকে একটা শীর্ণ হাড়জিরজিরে হাত বেরিয়ে আসে, লোকে ছুয়েঁ দেখে দীর্ঘ অভুক্ত সেই দেহ। মাঝে মাঝে দুর্বলতা একটু কমের দিকে হলে তিনি গুনগুন করে ওঠেন, কখনও হয়তো দর্শকদের সাথে গল্প-টল্প করে নিজের জীবনের, শোনেও কিছু-কিছু।

আর আছেন একজন দালাল-গোছের লোক, যাকে বলে ইম্প্রেসারিও, ইম্প্রেসারিও সময় বেঁধে দেন অনশনের, ঠিক চল্লিশ দিনের মাথায় হৈহৈ করে বিশাল আড়ম্বরে ভাঙা হবে অনশন, এলাহি খাবারদাবারের সাথে। এই চল্লিশ দিনের নিয়ম মোটেই পছন্দ নয় অনশনশিল্পীর, কারণ তার বিশ্বাস আরও অনেকদিন না খেয়ে দিব্যি থাকতে পারেন তিনি। মনে হয় যেন শিল্পের প্রতি সৎ থাকা হচ্ছে না এই চল্লিশ দিনের নিগড়ে। আর যা তাকে কুরে কুরে খায়, তা এই সম্যক ধারণা - যে আর কেউ, কেউ-ই সত্যিই বুঝবে না তার শিল্প, এই হাঙ্গার আর্টের একমাত্র সমঝদার তিনিই, অথচ তাঁর কাছে ব্যাপারখানা খুব-ই সহজ, লোকের যাই মনে হোক। তার ঘুমের বালাই নেই, অতএব রাতভর ফ্ল্যাশলাইটের আলোয় বিরক্তি নেই, আর সবথেকে মজা - যখন রাত-জাগা দর্শকের দল খাঁচার সামনে বসেই খাবার-দাবার আনিয়ে গাণ্ডেপিণ্ডে গেলে ভোরবেলায়। কিন্তু উলটো হলে? কেউ সহানুভূতি দেখিয়ে দুটো অনুকম্পার কথা বলতে এলে? রাগে অন্ধ হয়ে খাঁচা ধরে ঝাঁকান তিনি, অনশনশিল্পী। ইম্প্রেসারিও তখন এসে কড়জোরে ক্ষমা চান, বোঝান, না খেয়ে-খেয়ে ওইমত খিঁচড়ে আছেন শিল্পী।

তারপর রাতারাতি দর্শকের রুচি, অর্থাৎ বাজার বদলে যায়, অনশনশিল্পীকে আর কেউ দেখতে আসে না ভিড় করে, তার জায়গা হয় সার্কাসে, তাও মূল আকর্ষণ না, বাঘসিঙ্গির পাশে এক-কোণে একটা খাঁচায়, ইন্টারমিশনের সময় যদি কেউ দেখতে চায়। সেই অনশন-শিল্পী এবে কৃতজ্ঞ বোধ করেন বাঘসিঙ্গিদের প্রতি, ঐ তো ওদের দেখতে এসেও যদি দর্শক এদিক পানে মাড়ান। কিন্তু আসলে তিনি এখন বিনোদনের সোজা ও আনন্দময় রাস্তায় একটি বিরক্তিকর বাধা। “A small obstacle, at any rate, a constantly diminishing obstacle.” … “কনস্ট্যান্টলি ডিমিনিশিং”, অনশন শিল্প অলক্ষ্যে জারি আছে, কিন্তু কতদিন ধরে চলছে সে যুদ্ধ তাও সবাই ভুলেই যায় আস্তে আস্তে। খাঁচা পড়ে থাকে এক কোণে, শেষে যখন একদিন খড়ের গাদায় খুঁজে পাওয়া যায় প্রায়ন্মৃত শিল্পীটিকে, তিনি মরার আগে ফিসফিস করে বলে যাচ্ছেন, দর্শকদের প্রকৃত অর্থে মুগ্ধতাবোধের কোনো কারণ নেই, কারণ সত্যিই অনশন ছাড়া আর কিছুই করার উপায় ছিলো না তাঁর। স্বীকারোক্তি (?) করে যাচ্ছেন যে তিনি আসলে খেতেন না, কারণ বিশ্বের কোনো খাদ্যই তার মুখে রুচতো না, রুচলেই তিনি আর পাঁচজনের মত সবাইকে দেখিয়ে আনন্দ করে খেতেন। গল্পের শেষে দেখা যায়, সেই খাঁচা সাফসুতরো করে সেখানে রাখা হয়েছে একটি স্বাস্থ্যবান সুন্দর চিতাবাঘ। তাকে দেখতে উপচে পড়ছে দর্শকের ভিড়, আর কেউ নড়তেই চায় না যেন খাঁচার সামনে থেকে।

 

 

(৪)

এই হচ্ছে মোটের উপর গল্প। তবে, হাঙ্গার-আর্টিস্ট বা অনশন-শিল্প কিন্তু গাঁজাখুঁরি গপ্পো না। সত্যিই ইওরোপ-আমেরিকায় আঠেরো, উনিশ শতকে অনশন-শিল্প খুব জনপ্রিয় পারফর্মেন্স আর্ট ছিলো, এবং ঐ চল্লিশ দিন-ই ছিলো উর্ধ্বসীমা, আর শিল্পীরাও যে এদিক-ওদিক কিছু গুপি করতেন না এমন না। অবশ্য এমন সব সিদ্ধাই যে এ দেশের কেউ করেন নি এমন জোর দিয়ে বলতে পারি না। ছোটোবেলায় আমাদের সাদাকালো অ্যালবামে সে কোন যেন এক উলঙ্গস্বামী বাবাজির ছবি দেখেছি মনে পড়ে – যার দিকে থরথর তর্জনী তুলে প্রবীণ আত্মীয়া বলতেন ওঁর বয়স-ই তিনশো বছর, যার মধ্যে শ-দুয়েক শুধু হাওয়া খেয়ে অজগরবৃত্তি ধারণ করে, অর্থাৎ স্রেফ এক জায়গায় পড়ে আছেন, তবুও ওজন তিনশো পাউণ্ড। তবে কি না সেই ভারতীয় বাবাজি মহারাজ আধুনিক কমোডিফিকেশন বা পণ্যায়নের উর্ধ্বে ছিলেন বলেই বোধ হয় – অর্থাৎ, উলঙ্গস্বামীর শোয়ের টিকিট কাটার জো ছিলো না। ভক্তের দল এমনি পাহাড়-টাহাড় টপকে গিয়ে বাবার মাথায় জল-টল ঢেলে আসতো। কাজেই সেই বাবাজিকে ঠিক হাঙ্গার আর্টিস্ট বলতে পারছি না। পারফর্মেন্স ছাড়া, স্পেক্ট্যাকল ছাড়া, শিল্পীর মনে নিজের সম্বন্ধে মহত্ব্বের ধারণা (দর্শক কি কিস্যু বোঝে?) কিসের আর্ট?

এবং অন্যান্য ফর্মেও। ১৯০৭ সালের ঘটনা – হ্যামারস্টাইন থিয়েটার ন্যু-ইয়র্কে – সোবার স্যু-এর এইরকম এক শো হতো। থিয়েটারের চ্যালেঞ্জ, যে হাসাতে পারবে গম্ভীর, বিষণ্ণ স্যু-কে, নগদ দেওয়া হবে একশো (পরে বেড়ে-বেড়ে হাজার) ডলার। ভিড় করে লোকে জোক শোনাতে আসতো স্যু-কে, আসতেন পেশাদার কমেডিয়ান-রা (বিদূষক মানে কি কমেডিয়ান?)। আর-ও বড় ভিড় জমতো সেই সব ব্যর্থ চেষ্টা দেখতে, কেউ কি পারলো? পারলো কেউ হাসি ফোটাতে? পারলো না। কমেডিয়ানদের অ্যাক্টোয় দর্শক কুটিপাটি, স্যু তবু গম্ভীর। পরে জানা গেছিলো স্যুকে হাসি চাপতে হতো না, ওঁর জন্মগত পক্ষাঘাত ছিলো মুখের মাংসপেশীর, আমরা যাকে “হাসি” ভাবি, ভেবে উদ্বেল ও আবেগপ্রবণ হই, সেই একান্ত শারীরবৃত্তীয় প্রক্রিয়াটি ওর পক্ষে অসম্ভব কাজ ছিলো। অর্থাৎ থিয়েটার-বাবুরা বিলকুল মুফতে টিকিট-ও বেচেছেন দেদার, আর কমেডিয়ানদের টুপি পরিয়ে ফ্রিতেই খাটিয়ে নিয়েছেন সেই সঙ্গে। ঠিক যেমন, কাফকার অনশন-শিল্পী খেতেন না, কারণ তিনি খেতে চাইতেন-ই না, কিছুই খেতে ভালোবাসতেন না তিনি।

একজন সমালোচক (বহুদিনের পুরোনো স্মৃতি থেকে লেখা, তাই অ্যাট্রিবিউশন সম্ভব হলো না, আশা করি সেই সমালোচক বাংলা লিটল ম্যাগাজিন পড়েন না) সেক্সপিয়রের নাটকের সিনেমা-ভার্শন নিয়ে একটা লম্বা রচনার গোড়ায় লিখেছিলেন যে শেক্ষপীরকে ওঁর মনে হয় একটি স্বচ্ছ জলাশয়ের মত, অথবা ইনফাইনাইট মিরর (অজস্র-সারিবদ্ধ আয়না)-র মত। যে কোনো ভাবেই ঝুঁকে পড়লে বহুদূর অব্দি, বহু গভীরতায় নিজের ছায়াই উঠে আসে। আমার মনে হয়, ঐ লাইনটি হু-ব-হু টুকে কাফকার বেলায় চালিয়ে দেওয়া যায়। হাঙ্গার আর্টিস্ট পড়ে আপনার যা মনে হবে, তা আসলে আপনিই। কাফকা সেসব ছেঁদো ইমোশনের জন্য দায়ী নন।

তাই, আমার পড়ে যা মনে হয়েছে, স্পষ্ট করে প্রথম পুরুষে লিখে রাখি, যদিও পৌরাণিক গল্পের থিসিয়াসের মত আমি রুটির টুকরো ছড়াতে ছড়াতে এসেছি অনেকক্ষণ।

আর্টিস্ট, অর্থাৎ শিল্পী, শিল্প সৃষ্টির প্রতি একটি দায়বদ্ধতা এবং আবেগ দুইই নিয়ে আসেন, কম-বেশি সবাই। তার কপাল ভালো হলে আগ্রহী শ্রোতা, বা দর্শক, বা পাঠক জুটে যায় ভাগ্যে, এক কথায় আমরা বলবো অডিয়েন্স, যদিও তিনি এ কথা মৃত্যুতক মাথায় বয়ে নিয়ে চলেন যে সেই ভাগ্য, অর্থাৎ সেই সমঝদার অডিয়েন্স বড়ো চঞ্চলা। আজ মাথায় তুলেছে, কাল একঘেয়ে বলে নাক ঝেড়ে ফেলে দেবে। আর যাদের কপাল খারাপ, তাদের জোটে শুধু প্রত্যাখ্যান, বা ঔদাসীন্য। “Full many a flower is born to blush unseen”। সেসব খেয়াল পড়লে শীতের পাজামার তলায় আমাদের বিবেক দাঁড়িয়ে যায়, অবয়বহীন আমাদের দিকে লক্ষ্য করেই আমরা কিছু গালাগালি করে ফেলি, অখ্যাত-কিন্তু-অনন্যোসাধারণ শিল্পীর মৃত্যুতে সমাজের পেন্টুল টেনে খুলে দিয়ে আত্মশ্লাঘা বোধ করি। ‘সমাজের ওঁকে চিনতে এখনো দেরি আছে’ অথবা ‘ঐ পাঠকের ভালোবাসা লয়্যা কিই বা করিতাম?’ কিন্তু অস্বীকার করতে পারি না এই সহজ সত্যিটা যে শিল্পীর সৃষ্টিমাত্রই একজন অবগাহক খুঁজে বেড়ায় – দর্শক, শ্রোতা, পাঠিকা – একজন কেউ যে অন্ততঃ স্বীকৃতি দেবে শিল্পসৃষ্টির এই একান্ত ব্যক্তিগত, প্রায়শঃ উদ্দেশ্যহীন ও উপায়হীন উদ্যোগকে। কিন্তু কতটা, ঠিক কতখানি স্বীকৃতি সন্তুষ্ট করতে পারে একজন শিল্পীকে? কতটুকুতে তার মন ভরবে, পেট না-ই বা ভরুক? আমার ব্যক্তিগত ধারণা, এর একমাত্র উত্তর - ‘অসীম’। সে যেন গ্রীক পুরাণের শাপগ্রস্ত ট্যান্টালাস, তার সামনেই টলটলে দীঘির জল, তার মাথার উপরে ফলের ভারের ঝুঁকে আসা ডাল, কিন্তু পা বাড়ালেই পিছিয়ে যাচ্ছে জলরেখা, হাত বাড়ালেই নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে ফলের থোকা। তার তেষ্টা ও খিদে এ জন্মে মেটার নয়। প্রত্যেক “প্রকৃত” শিল্পীই তাই আমার কাছে অনশন-শিল্পী – যিনি একটিই কাজ ঠিক করে করতে পারেন, সেটাই তার শিল্প, সেইটিই তাকে আলাদা করেছে জনগণের থেকে আবার সেইটিই তাকে আজীবন ভরে রেখেছে অদৃশ্য একটি খাঁচায়। সেই একটি ছোট্ট বৃত্তে, নিজের সেই একটি প্রকাশ-কেই আরও ভালো, আরো ভালো, ভালোতমের আশায় নিজেকে শেষ করেন শিল্পী। যেমন একটু একটু করে নিজেদের নষ্ট করে ফেলছি আমরা, হয়তো প্রত্যেকদিন, হয়তো সবার অজান্তে।

**

এতো কথা, কারণ কাফকার এই অসামান্য গল্পটির আজ একশো-এক বছর হয়ে গেলো। জুনো দিয়াজ না কে যেন বেশ লিখেছিলেন, ইতিহাস থেকে আমরা ঠিক ততটুকুই শিখি, যতটা একটা খরগোশ বা গিনিপিগ শেখে তার প্রজাতির উপর করা বহু বহু বছরের বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা থেকে। সেই এক-ই কথা আমার ‘প্রফেটিক’ সাহিত্য সম্পর্কেও মনে হয়েছে। কথাটা মিথ্যে নয়।

 

পুনশ্চঃ যে দুচার কথা জেনেছি অন্যদের আলোচনা পড়ে, তার অনেকটাই লিখলাম না, কারণ সেগুলো অতিরিক্ত বলে বোধ করেছি। তাও খুব অল্পে লিখি। এই যেমন ১) কাফকা আসলে নিজেই অনশন শিল্পী – খাঁচাটা নাকি ওঁর ছোট্ট অ্যাপার্টমেন্টের রূপক, ইম্প্রেসারিও সম্পাদকের বা প্রকাশকের, আর অসাফল্য তো নিত্যসঙ্গী ছিলোই। ২) এই গল্পে নাকি বোঝানো হয়েছে কারুবাসনা আসলে একটি মানসিক রোগ (সে আর কী বলবো ভাই?)। ৩) ক্যাপিটালিজ়ম – আহা, তাকে ছেড়ে কোথা যাই? এই গল্পের মূল সুর নাকি ক্যাপিটালিস্ট কমোডিফিকেশনের বিরুদ্ধে কাফকার প্রতিবাদ। হতেই পারে। শিল্পর যদিও সেসব দায় আছে বলে আমি মনে করি না। তার কাজ শুদ্ধু ‘থাকা’, এগজিস্ট করা। ৪) কেউ বলেছেন সমস্ত অন্তঃসারশূন্য ফাঁপা শিল্প-ই প্রথমে জনপ্রিয় হয়, তারপর বিরক্তির কারণ হয়ে দাঁড়ায় ও শেষে লোকে ভুলে যায়। যদিও আমার মনে হয়েছে সেটা বাজে কথা। যথেষ্ট সার-দেওয়া উর্বর শিল্প-ও লোকে পুরোই ভুলে গেছে। যাওয়ার-ই কথা। হয়তো সেটাই আনন্দের ব্যাপার। এই যে আমরা এত চেঁচামেচি করছি আর্ট-ফার্ট নিয়ে, আসলে মহাকালের সামনে তা একটি প্রজাপতির পাখার দুটি সামান্য ইড়িং-পিড়িং ছাড়া কিস্যু নয়।

মিমেটিক ডিজ়ায়ার

রেনে জিরার্দের কথা লিখি একটু আজকে। ওঁর মিমেটিক ডিজায়ারের তত্ত্ব। ব্যাপারটা এইরকম যে মানুষ কোনো কিছুই যখন "চায়", তখন সেই চাওয়ার মূল কারণ ঐ অভীষ্ট বস্তুটির অন্তর্নিহিত বা ইন্ট্রিনজ়িক ভ্যালু নয়, চাওয়ার মূল কারণ এই যে অন্য লোককেও সে দেখে ঐ এক-ই জিনিষ চাইতে।

"Man is the creature who does not know what to desire, and he turns to others in order to make up his mind. We desire what others desire because we imitate their desires."
এই যেমন আমরা বাড়ি-গাড়ি-শাড়ি-স্মার্টফোন-ফ্যান্সি ভেকেশন, বা এই রক্তজল করা বালের চাকুরি যাই-ই চাই, সবের-ই মূল কারণ ঐ মিমেটিক ডিজ়ায়ার। জিরার্দের বক্তব্য "all desire is merely an imitation of another's desire!"
এই মিমেটিক ডিজ়ায়ারের ফল - দ্বন্দ্ব - দুজন মানুষ (বা দুই দেশ বা দুই দল) হয়তো এক-ই জিনিষ (বা ভূখণ্ড বা লক্ষ্য) চাইছে। এই ত্রিকোণের তিনটি অংশ - সাবজেক্ট - যে নকল করছে, মডেল - যার নকল করছে আর অবজেক্ট - অভীষ্ট।
কিন্তু দুজনে যদি শেয়ার না করতে পারে, যেমনটা প্রায় সবসময়েই হয়, তাহলে অবশ্যম্ভাবী ফল সেই নিয়ে সংঘাত। আর সংঘাতের পরের স্টেজ "স্কেপগোট" খোঁজ়া। কারণ সংঘাত তো আর চিরদিন চলতে পারে না। অতএব, শান্তি চাই, আর এই পরিস্থিতিতে শান্তির পথ দুই বিবাদী ঐকমত্য হয়ে একটি বলির পাঁঠা খুঁজে বের করা, এবং তাদের/তাকে শাস্তি দেওয়া।
এই যেমন ব্ল্যাক ডেথের দায় গিয়ে পড়ে উইচদের উপর, ইস্টবেঙ্গল হেরে গেলে জানা যায় রেফারি বাজে, প্রতিবেশী রাষ্ট্র ক্রিকেটে হেরে গেলে বলে আইসিসি চোর, জার্মান মানুষের আর্থিক অবস্থা পতনোন্মুখ মনে হলে দায়ী হন ইহুদিরা। রামায়ণের গল্পে যেমন স্কেপগোট হন শুদ্র শম্বুক। আর আধুনিক ইতিহাস দেখলে, যেখানে যা খারাপ হচ্ছে - দুম করে দেগে দেওয়া হয়, আসলে তো সংখ্যালঘুর দোষ - আমেরিকায় বলা হয় ইমিগ্রান্ট চাকরি খেয়ে নিচ্ছে, আমাদের দেশে দোষ চাপানো হয় মুসলিম জনসম্প্রদায়ের উপর। আসলে এগুলো ঢপের চপ। কিন্তু এই সময়টাই পোস্ট-ট্রুথের।
এখন এই কথাগুলো কেন লিখছি? কারণ প্রধানমন্ত্রীর একের পর এক ভাষণে সমানে এই স্কেপগোটিং করে চলেছেন ভোটের শুরু থেকে। ওদের দরকার পড়ছে - কারণ স্কেপগোটিং-এর আদর্শ সময় তো এইই, যখন সত্যিকারের ইস্যু নিয়ে মানুষ ক্ষুব্ধ - এবং তারা সেসবের পেছনে সত্যি কারণ-ও নিজেরাই খুঁজে পাচ্ছেন বা পেয়ে গেছেন। মানুষের "লয়ালটি-ফ্যাটিগ" এসে গেছে গত দশ বছরে - চাকরি না পেলে আর কিসের কি?
সেই পরিস্থিতিতে অ্যান্টি-ইনকাম্বেন্ট সেন্টিমেন্টের হাওয়ার ডুবে যাওয়ার আগে হাওয়া ঘোরানোর মরিয়া চেষ্টা ঐ স্কেপ-গোটিং। একটি আর্টিকল থেকে নিচের অংশটি টুকলাম।
"Politicians have always tried to divert the real issues people are facing and the real reasons behind an issue; instead they create a scapegoat to attract attention to less important or false issues. We have seen this time and again whenever a ruling party tries to ride against the anti-incumbent sentiments of promises not delivered. Be it politics trying to whip up communal frenzy and trying to scapegoat a community just before elections or any type of hate speech used by a political worker belonging to any political party."
কাজেই এই হেট-স্পিচ, এই রেটরিক, এই স্কেপগোটিং - আরও কিছুদিন (বা মন্দভাগ্য হলে আরও বেশ কিছুদিন) সহ্য করতেই হবে দাদা, যদ্দিন না ঐ পার্টি কেন্দ্র থেকে সরছে।
---
পুনশ্চঃ জিরার্দ কীভাবে এই তত্ত্বে উপনীত হয়েছিলেন সেও এক মজার গপ্পো। উনি অ্যাপারেন্টলি কোনো এক মহিলার প্রেমে পড়েন, এবং কিছুদিন পরেই যা হয় - প্রেম কেটে যায়, তারপর সেই মহিলা প্রেমে পড়েন ওঁর-ই এক বন্ধুর। জিরার্দ লক্ষ্য করেন, ঠিক এই ঘটনার পরে ওঁর মনে হঠাৎ আবার সেই প্রাক্তনের প্রতি প্রেম হুহু করে বেড়ে গেছে - কিন্তু সে তো মানুষ এক-ই? তার তো ইন্ট্রিনজ়িক কোয়ালিটি পালটে যায়নি? তাহলে কী কেস? না ঐ যে বন্ধু চাইছে, সেই ডিজ়ায়ারের মিমিক করছেন জিরার্ড।