আমি এই বছর তিনেক আগে, ভারতীয় দলের যাবতীয় ক্রিকেটারদের সমস্বরে ট্যুইট করতে দেখে সবার উপর হেব্বি খচে গিয়ে ক্রিকেট দেখাই বন্ধ করে দিয়েছিলাম। তার আগে একদিন ঐরকম কিসে একটা রেগে গিয়ে বলিউডি ব্লকবাস্টার দেখা ছেড়ে দিয়েছিলাম। এখনো দেখি না।
তখন নিজেকে এই বুঝিয়েছিলাম যে আমার পকেট থেকে যে এপসাইলন বাই টু পরিমাণে রেভিনিউ ঐসব যজ্ঞে যাচ্ছে, সেটা আর না-ই বা গেল। তাতে মহাবিশ্বে কারুর কিস্যু যাবে-আসবে না, সে অবশ্য কিসেই বা যায় আসে? আর এগুলো এমন কিছু জিনিষ নয় যে ছেড়ে দিলাম মানে বিশাল কিছু
আত্মত্যাগ হ'ল।
অবশ্য, দু-একজন বন্ধু জিজ্ঞেস করেছিল যে কেন এই ক্রিকেটার বা লেখক বা সেলিব্রিটিদের হায়ার মোরাল বা এথিক্যাল স্ট্যাণ্ডার্ডে ধরা হবে, একজন সাধারণ মানুষের চাইতে? গাঙ্গুলির কাজ ক্রিকেট খেলা, তার কভার ড্রাইভ দেখে হাততালি দিলাম হয়ে গেলো। বা শাহরুখ-খানের কাজ দু-হাত ছড়িয়ে পর্দায় প্যারাবোলা এঁকে দেওয়া, এঁকে দিলেন, হয়ে গেল। আবার তারা কোন ইস্যুতে কী বললেন, বা বললেন না, এই নিয়ে মাথা ঘামানো কেন, মুণ্ডপাত-ই বা করা কেন? এও তো সেই 'ক্যান্সেল কালচার'-এর ই সামান্য মিউটেটেড ভ্যারিয়েন্ট, নয়? অথবা হোয়াটাব্যাউটারি?
আবার এও ঠিক যে একজন সেলিব্রিটির - বা সেলিব্রিটি ছাড়ুন, একটু বেশি ফলোয়ার-ওয়ালা লোকের, একটা টুইট কি একটা ভুলভাল পোস্ট কত ক্ষতি করে দিতে পারে, তার-ও কি কোনো ঠিকঠাক মেজ়ার আছে? নেই। আর আমাদের দেশে সেলিব্রিটিদের নিয়মিত দ্বিতীয় ইনিংস রাজনীতির মাঠে, সেখান থেকে সো-ও-জা ক্যাবিনেট। তারপর শিক্ষা-স্বাস্থ্য-আইন সবেতেই আপনার প্রতিনিধি, অর্থাৎ, আপনার গলার স্বর তিনিই। কাজেই সমালোচনার উর্ধ্বে তিনি নন। পাবলিক ফিগার হওয়ার, জনগণের নয়নের মণি হওয়ার বিনিময় মূল্য ঐটেই। বল্ডুইন বলেছিলেন, you can't risk love, without risking humiliation.
তার উপর আরও জটিলতা, একজন ঠিক কতোটা বড় শিল্পী - সেও একটা বিশাল ফ্যাক্টর। একজন খুব-ই সাদামাটা শিল্পী উনিজির সাথে সেলফি তুললে কি অযোধ্যায় গিয়ে নাচলে যে কারণে রেগে যাই, সেই এক-ই কারণে লতা মঙ্গেশকরের আজীবন সংঘ-যোগাযোগের জন্য রেগেও থাকি, কিন্তু ভুলে যাই। ভাবি এই এতো গান যে মাথায় ঘুরছে সব ফর্ম্যাট করে বের করি কী করে? আরও হাতের কাছেই আছেন কবীর সুমন। রক্তে এমন মিশে গেছেন, যে অতি বদ লোক জেনেও, আর্ট-ভার্সেস-আর্টিস্ট এইসব ভেবেটেবেও - ওঁর গান অবচেতনে বেজেই চলে। অতএব, ঠিক কোন থ্রেশহোল্ড পেরিয়ে আমরা সেলিব্রিটি বা শিল্পীকে ক্ষমাসুন্দর চোখে দেখবো, সেও জানি না।
তো এই সব প্রশ্নের মীমাংসা আমার কাছে নেই, তবে, একটা নিজের মত নিয়ম বানিয়ে নিয়েছি। সেটাও খুব পাকাপোক্ত কিছু নয়। আমি ভাবি যে, যে কোনো ইস্যুতে যা আমাকে খুব-ই আহত বা বিচলিত করে বা নাড়িয়ে দিয়ে যায়, সেই নিয়ে আমার যা বলার আমিই বলবো, কোনো সেলিব্রিটি কিছু বললেন কি না, কী ভাবে বললেন, ক'ছটাক নান্দনিকতা ঢেলে দিলেন তাই দিয়ে তাদের জাজ় করে সময় নষ্ট করবো না। আমার স্ট্যাণ্ড আমাকেই নিতে হবে, ওঁরা নেবেন আর আমি চোখ বুজে শেয়ার করে দেবো ঐটি হচ্ছে না। হ্যাঁ, ভাঁড়ামো চোখে পড়লে খ্যাকখ্যাক করতে পারি এই অব্দি। আবার তারা বা তাদের পি-আর টিম দুম করে ভালো কিছু বলে ফেললেও শিরদাঁড়াফাঁড়া বলে মাথায় তুলে নেত্য করবো না।
কিন্তু, এর উল্টোটা যখন হবে, মানে যখন দেখবো, একজন বিখ্যাত লোক তার সেলেব-স্ট্যাটাস ভাঙিয়ে ঘৃণার চাষে জৈবসার দিচ্ছেন, বা "যতক্ষণ দেহে আছে প্রাণ, প্রাণপণে ছড়াবো জঞ্জাল" বলে ফেক নিউজ় ছড়িয়ে ফ্যাসিজ়মের ছাতার তলায় দাঁড়িয়ে পড়েছেন, তাদের আর এনডোর্স করবো না। এবং তাদের বোকামি ও বজ্জাতি মনে রাখবো।
আর অবশ্যই, বন্ধুদের কাউকে সহসা কোনো সেলিব্রিটিকে নিয়ে গদগদ হতে দেখলে কিঞ্চিৎ বেসুরে বেজে উঠে বলবো ভাই এই সেলেবদের পোঁছা একটু বন্ধ কর ক'দিন। ওদের রাজনৈতিক বোধবুদ্ধি তোর থেকে বেশি এমন কেউ দিব্যি দেয় নি, আর বিখ্যাত লোকের বিবেকবুদ্ধি অদৃশ্য সুতোয় ক্ষমতার সাথে, আদিম পুঁজির স্বার্থের সাথে বাঁধা থাকে। সেইসব সুতোর টান সাংঘাতিক।
সেই এনডেভর সিরিজের কাল্পনিক দুষমণ সেবাস্তিয়ান ফেনিক্স যেমন ডায়লগ ঝেড়েছিলেন,
"Conscience is a negotiable commodity. There are no heroes. There's no white hat. There's no black hat. Only shades of green. Money."