একটি বাজারের গল্প (অ-রাজনৈতিক)


এই ছবিটার কুনোই ক্যাপশান নেহি আছে, তবে ই পিকচার ইজ ডেফনিটলি নট ওয়র্থ মোর দ্যান ১৮,০০০ ওয়ার্ডস। আর এক দাদার বলায় এইবারে নাম সই করেছি। ঠাহর করে দেখুন, পুরুষ্টু ছাগলের গায়ে ইনিশিয়ালস আঁকা, JD.

এবং এই ছাগলের প্রসঙ্গে একটা গল্প-ও করার লোভ সামলাতে পারছি না।
আমাদের ছোটোবেলায়, অন্ততঃ উত্তর কলকাতায়, শীতকাল এলেই প্রত্যেক শনিরবি কোথাও না কোথাও পাড়ার ক্লাবের উদ্যোগে "বসে আঁকো" প্রতিযোগিতা হতো। আমি আর আমার দিদিভাই-ও দিব্যি সেজেগুজে রং-তুলি-পেন্সিল নিয়ে আজ এই মাঠে, কাল সেই মাঠে 'আঁকো আলপনা, আঁকো লতাপাতা' করে আসতাম।
সব জায়গাতেই প্রথম তিন কি পাঁচ জনকে প্রাইজ দিতো, আর বাকি সবাইকে স্বান্তনা পুরস্কার - একটি চকচকে চাকতি, তেরঙ্গা ফিতেয় বাঁধা। দিনের শেষে সেই চাকতি গলায় ঝুলিয়ে আনন্দে নাচতে নাচতে বাড়ি ফিরতো গোটা পাড়ার বাচ্চাকাচ্চারা।
তো এইরকম-ই এক রোববার পৌঁছে গেছি নবজাতক স্কুলের মাঠে। হুলিয়ে আঁকা চলছে। কিন্তু আমি প্র্যাক্টিশ করে গেছি 'সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি' আর 'একটি গাছ, একটি প্রাণ' জাতীয় ভাবগম্ভীর টপিক, আর অপদার্থ আয়োজক-রা দিয়েছে কী? না 'একটি বাজারের দৃশ্য' ... ভাবুন ব্যাপারটা! কচিমনের উপর কাপিতালের খাঁড়া।
তা যাই হোক, আমি পাশের জনের খাতা দেখে মোটামুটি একটা বাজারের ছবি টুকে টুকে বেশ নামালাম, যদিও মানুষের অবয়ব ঠিক আঁকতে পারিনা, তাও যাহোক ধড়-মুন্ডুর-কিস্যা করে একটা সুররিয়েল বাজারদৃশ্য এঁকেই ফেললাম। তারপরেই না একটা গভীর অপরাধবোধ স্ট্রাইক করলো একেবারে মরমের মর্মস্থলে, এরকম আগাপাশতলা টুকলাম? ছিঃ ... এদিকে সময়-ও শেষের দিকে। হঠাৎ বাইরে তাকিয়ে দেখলাম, সেই বসে-আঁকার মাঠের প্রান্তরে একটি নধর ছাগল। সে এই জগতের আনন্দযজ্ঞের দিকে ভুরুক্ষেপ না করে মন দিয়ে ঘাস খেয়েই যাচ্ছে। ভাবলাম এই তো ... একেই জুড়ে দি, একটু হলেও আমার কম্পোজিশন পালটে যাবে - তখন-ই জানতাম 'টোকা + এপসাইলন = অরিজিন্যাল'।
তারপর আঁকলাম, বুঝলেন তো? লোকে মানুষ-মডেল স্কেচ করে হাত মকশো করে, আমি হাত মকশো করলাম একটি ছাগল, বড়োসড়ো নধর একটি ছাগল এঁকে। সে-ও হেঁট্মুন্ডু ও বলিপ্রদত্ত, আমার-ই মতো। তবে, তখন-ও 'পারস্পেকটিভ' (পরিপ্রেক্ষিত) কাকে বলে জানিনা, কাজেই ছাগলের আয়তন একটু বড়োই হলো আর কি - ধরে নিন বাজারু মানুষের-ই হাইটে। একটু সাই-ফাই ব্যাপার-ও ফুটে উঠলোঃ দানবিক ছাগল বাজারের ধারে ঘাস খাচ্ছে, কিন্তু বাজারুরাও স্টোয়িক সাইলেন্সে বেগুন-পটল দর করছেন, আসন্ন ছাগলনোডো-র ভয় না পেয়েই। (টীকাঃ শুনেছি প্রাচীন ঈজিপ্টের ছবি-আঁকিয়েরাও পারস্পেক্টিভ মানতেন না, যার যেমন গুরুত্ব, ছবিতে তার তেমনি সাইজ। আমার-ও সেই-ই ব্যাপার আর কি।)
সেদিন-ই সন্ধ্যেবেলা। প্রাইজ ঘোষণা হয়েছে। নবজাতক কেলাবের ছেলেরা বাঁশের উপর কাপড় লাগিয়ে সবার, মানে সব্বার আঁকা ছবি টাঙিয়ে দিয়েছে মাঠের একদিকে। যারা প্রাইজ পেয়েছে, তাঁদেরটা আলাদা, তাঁরা আলোর বৃত্তে দাঁড়িয়ে হাসি-হাসি মুখে, গার্জেন-রা আরো হাসি-হাসি মুখে পাশে দাঁড়িয়ে মাঠে আলো ছড়াচ্ছেন।
যথারীতি আমি কিছুই পাইনি। কিন্তু তাতে পরোয়া নেই। আমরা, যাঁরা হ্যাভ-নটস, তারা নিজেদের নিঃসঙ্গ ছবিটার আশে-পাশে দাঁড়িয়ে আছি আশায় আশায়, কেউ যদি ঘুরতে ঘুরতে এসে দাঁড়ায়, বাঃ-টাঃ কিছু বলে ফ্যালে। বলা তো যায় না, প্রেমের ফাঁদ হয়তো পাতা পেয়ারাবাগানেই। দেখলাম, বাচ্চারা দল বেঁধে আসছে, ঠিক আমার আঁকাটার সামনেই দাঁড়াচ্ছে - আর হেসে গড়িয়ে পড়তে পড়তে এ ওকে ডেকে ডেকে বলছে, 'দ্যাখ দ্যাখ, কত্তবড়ো ছাগল!!'
সেই থেকে ছাগল আঁকলেই একটু ভয়ে ভয়ে থাকি, হয়তো কেউ বাজারের অপরূপ শোভা কিছুই দেখবে না, খালি একটি বিষণ্ণ, বিমূর্ত ছবির সামনে দাঁড়িয়ে দাঁত কেলিয়ে বলবে, 'দ্যাখ দ্যাখ কত্তবড়ো ছাগল!"
-------------------
পুনশ্চ ১ঃ ছাগল ছাড়া সবকিছুই কাল্পনিক। আমাকে কেস দেবেন না।

পুনশ্চ ২ঃ আমার সব ক্যারেকটার আর-কে-লক্ষ্মণের থেকে 'ইন্সপায়ার্ড', মানে ওনার সেই টাইমস-এর কার্টুন দেখে শেখা। খুব মনে হয়, ইশ যদি বেঁচে থাকতেন আর-কে-এল, কী করতো তাঁর কমন-ম্যান?

Comments

Popular posts from this blog

কামাই

যে ভাষায় আমের নাম ...