সিজারের মৃত্যু – যে দু-একটা কথা আমি জানতাম না।

 শুরুতেই তাহলে একটা ভারি আশ্চর্যের কথা বলি?

‘veni, vidi, vici'-র যে ‘v’ – ঐটা কিন্তু আসলে ‘ভ’ উচ্চারণ নয়, আবার ‘c’-এর উচ্চারণ ‘স’ বা ‘শ’ নয়, তার কারণ ক্লাসিকাল লাতিনের ‘v’ এর উচ্চারণ ছিলো এখনকার ‘w’-র মতো। যার মানে দাঁড়ায় এই যে ‘veni, vidi, vici'-র উচ্চারণ আসলে 'wainy weedy weeky' ! 

(আরেকটু স্পষ্ট করে বললে, ecclesiastical অর্থাৎ ক্যাথোলিক লাতিনে ‘v’ তাঁর নিজের আলাদা উচ্চারণ পেয়েছে যা ক্লাসিকাল লাতিনের অনেক পরের, কিন্তু সিজার যে সময়ের মানুষ ছিলেন তাতে তাঁর অন্তত ক্লাসিকাল লাতিন-ই বলা উচিত, যদি আদৌ বলে থাকেন!!)

'Julius Caesar', Act III, Scene_2, the Murder Scene George Clint (1770–1854) Royal Shakespeare Theatre


মানে ধরুন রোববার বাজারে গিয়ে ঠিক মনের মতো পাঁঠাটাই পেলেন, কিংবা হঠাৎ একদিন টালিগঞ্জ যেতে গিয়ে ভুল করে বরানগরে গিয়ে মিনিস্টার সিনিস্টার হয়ে গেলেন, সেই উত্তুঙ্গ আনন্দের মুহুর্তে লাফিয়ে উঠে চিৎকার করার সময়ে মাথায় রাখবেন, ‘ভেনি ভিডি ভিসি’ নয়, প্রকৃত আঁতেল বলবেন ‘ওয়েনি, উয়িডি, উইকি’!

এইবারে দ্বিতীয় আশ্চর্যের কথাটাও বলি? ৪৪ খ্রীষ্টপূর্বাব্দের ১৫-ই মার্চ সেনেটে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ার ঠিক আগে সিজারের শেষ বলা কথাটি ‘এত তু ব্রুত’ নয়! ওইটি শেক্সপীয়রের মনের মাধুরী। আসলে কি বলেছিলেন সে সত্যি করে কেউ-ই জানেনা, তবে সবথেকে বিশ্বাসযোগ্য যে বর্ণনাটি পাওয়া যায় – তাতে লেখা আছে, “kai su teknon” (“and, you my son?”)!

শেক্সপীয়রের অবশ্য এইটুকু স্বাধীনতা নেওয়ায় দোষের কিচ্ছু নেই !! উনি প্লুটার্কের বর্ণিত ইতিহাস থেকে নাটকের উপাদান নিয়েছেন, আর নাটকেও যদি স্বাধীনতা না থাকে, তাহলে আর কিসেই বা থাকবে!

আর প্লুটার্ক নিজে এই বর্ণনা যখন লিখছেন, সিজারের হত্যার দেড়শো বছর অতিক্রান্ত। সিজারের সমসাময়িক না হলেও তার সময়ের সবথেকে কাছাকাছি যে ঐতিহাসিকের বর্ণনা পাওয়া যায়, তার নাম নিকোলাস অফ দামাস্কাস – যিনি সিজারের পালিত পুত্র, রোমের প্রথম সম্রাট অগাস্তাস সিজারের জীবনীকার। অগাস্তাসের জীবনীকার ছিলেন বলেই বোধহয় একসময় তার লেখাকে পক্ষপাতদুষ্ট ধরা হতো, কিন্তু ইতিহাসের মতোই, নিকোলাসের লেখাও আবার পুনরাবিষ্কৃত হয়েছে, জেগে উঠেছে ধ্বংসস্তূপে চারার মত।

সেই ‘নতুন’ ইতিহাস বলছে, ব্রুটাস, ক্যাসিয়াস নয়, সিজারের যে প্রিয়ভাজনের ভূমিকা (হয়তো) সবার থেকে বেশী, তাঁর নাম ডেসিমাস, Decimus Junius Brutus Albinus (খেয়াল করুন নামের মধ্যে ব্রুটাস থাকলেও ইনি অন্য ব্রুটাস – যে ব্রুটাস নিন্দিত বিশ্বাসঘাতক, তিনি এঁর তুতো ভাই, নাম মার্কাস জুনিয়াস ব্রুটাস)।

এখানে ক্লাস সেভেনের ইতিহাস আরেকবার ঝালিয়ে নিই? ৪৪ খ্রীঃপূঃ-র সিজার রোমের নন্দিত একনায়ক। গল, অর্থাৎ ফ্রান্স ও বেলজিয়ামে, যুদ্ধ জিতেছেন, মাঝে একবার তখনকার জর্মনি আর ব্রিটেন-কেও আক্রমণ করে এসেছেন, আর সেনেটের রিপাবলিকান-রা তাকে শাসন থেকে সরাতে চাইলে দীর্ঘ গৃহযুদ্ধে জয়ী হয়ে ক্ষমতায় এসেছেন। তাঁর লক্ষ্য ‘ঘরে-বাহিরের সামঞ্জস্য সাধন’ – সেনেটকে মেনে নিতে বাধ্য করা তাঁর একনায়কতন্ত্র।

রোমে তখন-ও প্রজাতন্ত্র বহাল, তবে তা নামমাত্র, রাজনৈতিক সমস্ত ক্ষমতা আস্তে আস্তে চলে গেছে সিজারের হাতে। রাজা না হয়েও সিজারের নিয়ন্ত্রণ দৈবাদিষ্ট রাজার-ই সমান। চাটুকার-রা তার বন্দনা করেন ‘ঈশ্বর’ বলে, পরিকল্পনা চলে মন্দিরের, যজ্ঞের, শুধু সিজারপুজোর জন্য নির্দিষ্ট ঋত্বিকের। এর-ই মধ্যে সিজারের পালিত-পুত্র অক্টাভিয়াস ৪৪ খ্রীষ্টপূর্বাব্দে হয়ে বসেন সিজারের ডানহাত, সেকেণ্ড-ইন-কম্যাণ্ড। ডাইন্যাস্টির সিঁদুরে মেঘ বুঝি ঘনিয়ে এলো রিপাবলিকের মুক্ত আকাশে।

রিপাবলিকের বাকিরা ঠিক করলেন সিজার-কে থামাতেই হবে যে কোনো মূল্যে, শুরু হলো সামরিক সূক্ষতায় হত্যার ষড়যন্ত্র। এটাও অবশ্যই এখানে স্বীকার করতেই হয় যে শুধুই গণতন্ত্র রক্ষার মহান আদর্শ নয়, নিজেদের প্রভাব-প্রতিপত্তি হারিয়ে ফেলার ভয়-ও তাড়িত করেছিলো ক্যাসিয়াস, ব্রুটাস-দের, বলাই বাহুল্য।



La morte di Cesare, Vincenzo Camuccini (1771–1844) 


কি হয়েছিলো তাহলে ১৫-ই মার্চ অর্থাৎ ‘আইডস অফ মার্চে’র দিন? এইখানে বলে উচিত যে, রোমান-রা মাসের মোটামুটি মাঝের দিনটিকে আইডস বলতেন। কাজেই সব মাসেই আইডস থাকে, তবে বাকি আইডস-দের কেউ পোঁছে না।

কল্পনা, ইতিহাস, জনশ্রুতি – সব-ই মিলেমিশে যে ছবিটি দাঁড়ায় সেটি এইরকম।

পনেরোই মার্চের সকালে সিজারের ইচ্ছে ছিলো না সেনেটে যাওয়ার। একটা কারণ তাঁর মন্দস্বাস্থ্য, কিন্তু তার থেকেও বড়ো সিজার-পত্নী ক্যালপূর্ণিয়া-র আপত্তি। সেক্সপীয়রের নাটকে এই অংশটি বারবার পড়ার মত, ক্যালপূর্ণিয়া দুঃস্বপ্নে দেখছেন বজ্রবিদ্যুত, দেখছেন এক সিংহী রাস্তায় জন্ম দিচ্ছে এক সিংহশাবকের আর কবর ভেদ করে উঠে আসছে মৃতমানুষের চিৎকার। আর দেখছেন সিজারের বিশাল মূর্তি থেকে উদ্গত হচ্ছে রক্তের স্রোত আর সারা রোমের মানুষ আসছেন সেই শোণিতে তাঁদের কবজি ডুবিয়ে নিতে।

“What do you say, Caesar? Will someone of your stature pay attention to the dreams of a woman and the omens of foolish men?”

বলেছিলেন ডেসিমাস জুনিয়াস ব্রুটাস আলবিনাস, তাঁর থেকে প্রায় এককুড়ি বছর বয়স্ক পিতৃব্যসম সিজার-কে। সিজার মত পাল্টান, ঠিক করেন গিয়ে না হয় শুধুই অধিবেশন স্থগিত করার কাজটুকুই করবেন। আর সত্যি-ই তো, পন্টিফেক্স ম্যাক্সিমা (উচ্চতম পুরোহিত) সিজার, ঈশ্বরের সাক্ষাৎ প্রতিমূর্তি সিজার, সামান্য দুঃস্বপ্নে ভয় পেতে পারেন?

দুর্লক্ষণ আরো ছিলো, হয়তো দৈববাণীর মতই।

এক দৈবজ্ঞ সাধু (?) সিজার-কে আগেই বলেছিলেন, আইডস অফ মার্চ পেরোনোর আগেই ক্ষতি হবে সিজারের। সেইদিন পম্পেই-এর থিয়েটারের রাস্তায় সিজার আবার দেখেন সেই সাধুটিকে, ঠাট্টা করে বলেন, ‘The ides of March has come’, সাধু উত্তর দেন, ‘Aye Caesar, but not gone’!

The Ides of March, 1894, Artist Carl von Piloty

সেনেটে তখন ষাটজন ষড়যন্ত্রী অপেক্ষা করছেন পোষাকে লুকোনো ছোরা নিয়ে।

সেই ষাটজনের বেশীর ভাগের-ই নাম ইতিহাসের কোথাও লেখা নেই। বড়োজোর গোটা কুড়ি ঐতিহাসিক-রা যাও খুঁজে বের করেছেন, তাঁদের-ও অধিকাংশের নামের বেশী কিছুই প্রায় জানা নেই আমাদের। কিন্তু এইটুকু জানা গেছে, ঐতিহাসিক সেনেকা্র বিবরণে, যে সেই ষাটের কেউ-ই সিজারের শত্রুপক্ষের ছিলেন না, ঘাতকেরা সকলেই তাঁর পরিচিত এবং কাছের মানুষ।

যেমন বিশ্বাসঘাতক ব্রুটাস। ব্রুটাসের মা ছিলেন সিজারের একসময়ের ‘মিসট্রেস’, হয়তো অপত্যস্নেহের একটা কারণ সেটাও? তবুও পম্পেই-এর পতনের আগে অব্দি ব্রুটাস ছিলেন সিজারের বিরোধীপক্ষের লোক, পতনের পর পতাকা পাল্টাতে অবশ্যই সময় লাগেনি তাঁর, এমনকি পম্পেই পালিয়ে লুকিয়ে আছেন কোথায় সেই গোপন তথ্য-ও সিজার-কে এনে দেন এই ব্রুটাস-ই।

গোলটা বাঁধলো যখন ৪৫-এর শুরুতেই। একদিকে, সিজারের প্রতিপক্ষ সেনেটর-রা ব্রুটাসের কানে মন্ত্রণা দিলেন, মনে করিয়ে দিলেন তাঁর-ই পূর্বপুরুষ লুসিয়াস জুনিয়াস ব্রুটাসের কথা – বহু বছর আগে রাজাকে তাড়িয়ে রোম প্রজাতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা করেন যিনি।

আর তার-ই কিছু আগে ব্রুটাস প্রথম স্ত্রীকে ত্যাগ করে প্রেমে পড়েছেন পর্শিয়ার – যিনি সিজারের-ই এক প্রাক্তন শত্রু ক্যাটো মাইনরের সন্তান। ক্যাটো মাইনর – যে স্তোইক দার্শনিক সম্রাট, দুর্নীতির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেন সারাজীবন, এবং সিজার-শাসিত পৃথিবীর বায়ুতে শ্বাস নিতে চাননি বলে আত্মঘাতী হন মাত্র ঊনপঞ্চাশ বছর বয়সে, ৪৬ খ্রীষ্টপূর্বাব্দে।

 

Portia, wife of Brutus, Artist/author: John William Wright (?)

ক্ষমতার লোভ, না অন্ধ প্রেম না পূর্বপুরুষের হৃতগৌরব পুন্রুদ্ধারের অলীক স্বপ্ন – ব্রুটাস কিসের দ্বারা সবথেকে বেশী প্রভাবিত হয়েছিলেন, এ কথা যদিও কোথাও লেখা নেই, তবে কল্পনা করতে অসুবিধে হয় না।

এইখানে এক মুহূর্ত দাঁড়ান, পাঠক ! রাজরক্তে হাত রাঙানো আরেক ট্র্যাজেডির নায়কের কথা কি মনে পড়ছে আপনার?  তিনিও উচ্চবংশজাত, তিনিও ‘রাজা’র ঘনিষ্ঠ অনুচর, তিনিও অবজ্ঞা করেন অতিপ্রাকৃত অশুভ সংকেত, এবং সিংহাসনের হাতছানিতে করে ফেলেন অকল্পনীয় নিষ্ঠুর হত্যা।

ম্যাকবেথ-ও অবশ্যই ইতিহাসের একজন চরিত্র, এবং বিশ্বাসঘাতকতার গ্লানি তাকেও তাড়া করে বেড়াবে তার বাকি জীবন, ম্যাকবেথের জন্যে যা ব্যাঙ্কোর প্রেতাত্মা, ব্রুটাসের তা-ই সিজারের।

আমার এই দীর্ঘ গল্পের শেষ করবো এইখানেই, তবে রোমের ইতিহাসের গল্পের শেষ নেই। এইটুকু না বললে অবশ্য অন্যায় হবে যে রিপাবলিকান সেনেটর-দের ইচ্ছের কিছুই চরিতার্থ হয়নি। সিজারের মৃত্যুর পরে গৃহযুদ্ধ শুরু হয় অচিরেই, যাঁর অন্তিম পরিণতি গাইয়াস অক্টাভিয়াস, অর্থাৎ, অগাস্তাস সিজারের মাথায় রোমের প্রথম সম্রাটের মুকুট। ষড়যন্ত্রীদের কেউ-ই রক্ষে পাননি শেষমেশ, নিষ্ঠুরভাবে হত্যা শুধু নয়, অগাস্তাসের সাম্রাজ্যে ষড়যন্ত্রীদের সম্বন্ধে একটিও শংসাসূচক বাক্য উচ্চারণ ছিলো রাজদ্রোহের শামিল।

যাইহোক, সে গল্প আজ নয়। এতোটা টাইপ করে আঙুলে এমনিই ব্যথা। শেষপাতে কয়েকটা নীতিবাক্য বলে যাই, কারণ স্পষ্টতই ইতিহাস থেকে মানুষ কিছু শেখেনা।

এক, সকালে উঠে যদি বৌ (বা বর বা পার্মানেন্ট-রুমমেট) বলেন আজকে আপিস যেও না, মনটা কুডাক ডাকছে, তাহলে জানবেন ঘুমের ব্যাঘাত মোটে ভালো কথা নয়, 'আলজোলাম খাওয়াও তাহারে', এবং এ-ও জানবেন যে এরপরেও বেরিয়ে বেঘোরে প্রাণটা খুইয়ে এলে ‘ইউ আর ইন গুড কোম্পানি’।

দেড়, বন্ধুরা বাড় খাওয়ালে খাবেন্না, খাবেন্না। বরং তাঁদের শেক্সপীয়রের অ্যাব্রিজড এডিশন ছুঁড়ে মারুন। 

এবং তিন, যেটা এই ২০২১-এ মনে রাখা বোধহয় সবচাইতে দরকারী। ব্রুটাস-ই হোক, আর ক্যাসিয়াস বা ডেসিমাস, দলে থেকে এয়াঁরা কোনোদিন-ই কাজ করতে পারবেন না। তবে কি না ইতিহাস নীরব সাক্ষী, সিজারের নাম একনায়কতন্ত্রের সাথে জড়াক বা না জড়াক, বিশ্বাসঘাতকতা ও ব্রুটাস – ইতিহাস ও শিল্পের পাতায় সমার্থক শব্দ।

 

সূত্র –

১) What Latin Sounded Like - and how we know https://www.youtube.com/watch?v=_enn7NIo-S0 **আর কিছু না দেখলেও, এইটে চট করে দেখে ফেলুন**

২) https://www.historyextra.com/period/roman/death-julius-caesar-what-we-know-ides-of-march-brutus-cassius-et-tu/  **যেখান থেকে মনের আনন্দে চোতানুবাদ করেছি**

৩) “Security Gives Way to Conspiracy”: Brutus’s and Macbeth’s Control and Overconfidence Stamile, Gabrielle. State University of New York at Stony Brook, ProQuest Dissertations Publishing, 2020. 28263176. https://search.proquest.com/openview/3fa36c44ded8e44ae5af39b3db9a8cca/ **আমি অ্যাকাডেমিক, আমি বার্তা দিলা, কঠিন থিসীস এক পড়তে দিলাম। জোকস অ্যাপার্ট, থিসীস লেখাও যে এতো প্রাণবন্ত হয় সেটা দেখার জন্যেই এটা পড়া উচিত।**

৪) https://en.wikipedia.org/wiki/Cato_the_Younger **উইকি দেখে নাক সিঁতকোবেন না**

৫) https://en.wikipedia.org/wiki/Decimus_Junius_Brutus_Albinus **ডিটো**

) https://en.wikipedia.org/wiki/Ides_of_March **ডাবল ডিটোর মামলেট**


Comments

Post a Comment

Popular posts from this blog

কামাই

যে ভাষায় আমের নাম ...