আধার রাতের বন্দী

আজকের বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডে একটি খবর বেরিয়েছেঃ মুম্বই পোর্ট ট্রাস্টের জনৈক কর্মী, রমেশ কুহাড়, তার স্যালারি অ্যাকাউন্টের সাথে আধার লিঙ্ক করতে অস্বীকার করেন ... এবং দীর্ঘ আইনি যুদ্ধের পরে এবং তিরিশ মাস বেতন না পাওয়ার পরে, শেষমেশ কোর্ট তার পক্ষে রায় দিয়েছেন ... এবং একটি ঐতিহাসিক উক্তি-ও করেছেন, বলেছেন, "Even one dissenter has a right to oppose a government order" ... হয়তো এইটাও বলে রাখা ভালো যে, রমেশ কুহাড়, পোর্ট ট্রাস্টের ৮০০ কর্মীর মধ্যে একমাত্র ব্যতিক্রম ...
বলাই বাহুল্য, তিরিশ তো দূরস্থান, তিন মাস বেতন না পেলেই আমার মতন লোকের ঘটি-বাটি বেচে রাস্তায় দাঁড়ানোর কথা ... কাজেই এই ধরনের সাহস দূর থেকে দেখে স্যালুট করা ছাড়া উপায় দেখছি না ... তবে এই ঘটনা থেকে নিজের আধার-অভিযানের দু-টুকরো গল্প মনে পড়ে গেলো, আদৌ একরকম নয়, তাও বলার লোভ সামলাতে পারছি না ...
ছোটবেলায় দেখতাম পুজোর ঠিক পরেপরেই বাড়িতে বাবার বন্ধু আর আত্মীয়-দের হাতে লেখা ছোটো ছোটো চিঠি আসতো, কখনো পোস্টকার্ড, কখনো ইনল্যান্ড লেটার ... আমরাও সোৎসাহে সেসব চিঠি পড়ে উত্তর দিতাম ... 'আমরা সকলে কুশল, তোমরা?" ... তা এই ফেসবুকের যুগে সেসবের পাট তো চুকেছে, তবুও প্রত্যেক বছর একটি চিঠি আমরা পাই, স্টেট ব্যাঙ্ক গরম-কালের মাঝামাঝি একটি চিঠি দেয়, প্রথমে মিষ্টি করে বলে তারা গ্রাহকদের চিনতে চায়, শেষে বলে "কই হে, আধার কই?"
আমি রমেশ কুহাড় নই এবং খুব-ই ভীরুপ্রকৃতি, কাজেই প্রথমে গিয়ে বললাম, আজ্ঞে আমার উপায়-ও নেই এবং সত্যি বলতে এতোখানি না চিনলেও চলে যাবে, সেসব তারা কানে তুললেন না ... এবং মায়ের শঙ্কাকূল মুখখানা দেখে ভাবলাম নিয়ম চুলোয় যাক, গোরু-ছাগলের কার্ড আছে, আমি আর কি দোষ করলাম ...
কার্ড করাতে কষ্ট হয়েছে বলবো না, লাইনে দাঁড়িয়ে মশার কামড় খেয়ে ঘন্টা তিনেকের মধ্যে গালি আর ধাক্কা খেতে খেতে কোথায় সময় কেটে গেলো বুঝতেই পারলাম না... দন্ডমুন্ডের কর্তারা বলে দিলেন, চিঠি পাবেন বাড়ির ঠিকানায় ... তা চিঠি দেবো বলে দেয়নি এমন লোকের সংখ্যা জীবনে কিছু কম নেই আমার, তবু, বিশ্বাস করুন, যে উৎকন্ঠা নিয়ে আধারের চিঠির পথ চেয়ে রোজ বসে থেকেছি সেই দিনগুলোয়, তার এক শতাংশ আগ্রহ থাকলেও বাজারে যদুবাবুর এই বদনাম থাকতো না ...
সে চিঠি শেষমেশ আর এলো না (কোনো চিঠি-ই কি আর ঠিক ঠিকানায় পৌঁছয়?), তবে একদিন জানা গেলো, চিঠি নাকি হারিয়ে গেছে, তবে চিৎপুরের পোস্টাপিসে গেলে পাওয়া গেলেও যেতে পারে!
চিড়িয়ামোড় থেকে চিৎপুর ডাকঘর অল্প একটু হাঁটা, শীতকালে পনেরো মিনিট, বর্ষায় আধঘন্টা, আর অটোয় ইনফিনিটি ... কাজেই হাঁটা লাগালাম প্রাণ হাতে করে, যারা সে রাস্তা দেখেননি তাঁদের বলে রাখি, এই রাস্তায় ডাকঘর অব্দি গেলেই মরুতীর্থ হিংলাজের অভিজ্ঞতা হয়ে যায় - অটো-ছাগল-বালিভরা ট্রাক এবং কিছু সদ্যোজাত উন্নয়নের চিহ্ন পেরোলেই ডাকঘর দেখা যায় দিগন্তে ...
ডাকঘর-টি ভারী বিচিত্র, কিছুটা পরাবাস্তব বললেও ভুল হবে না - ঢুকে দেখা যায়, অনেকগুলো কাউণ্টার, সব-কটাই প্রায় বন্ধ, একটি টিমটিম করে খোলা, তার সামনে নোটিশ ঝুলছে, "এখানে গঙ্গাজল পাওয়া যায়" ... যে ভদ্রলোক বসে আছেন, তিনি এক্কেবারে মুজতবা আলীর গল্পের পাতা থেকে উঠে এসেছেন ... জিগ্যেস করলাম "দাদা চিঠি ফেরত গেছে, কোথায় পাবো?" দাদা বললেন, "ক'লিটার দেবো? একদম ফ্রেশ জল..." ...বুঝলাম আশা নেই ... তারপর দেখলাম একটি ছাগল আমার ঠিক পাশটাতে দাঁড়িয়ে আমার ঝোঝুল্যমান পাঞ্জাবীর পকেটের দিকে বিপজ্জনক ভাবে তাকিয়ে ... তাঁকেই জিগ্যেস করবো কিনা ভাবছি, ছাগলের মালিক ঘরের এক কোণ থেকে ছুটে এসে বললেন, তাঁর-ও এক-ই দশা, চিঠি খুঁজতে এয়েচেন আর পোস্টাপিসের বাইরে সাইকেল স্ট্যান্ড থাকলেও ছাগল রাখার জায়গা নেই, তাই ছাগল-কে গঙ্গাজলের কাউন্টারে দাঁড় করিয়ে তিনি ভেতরে চলে গেছেন, এবং হারানো চিঠির ব্ল্যাক-হোল-টিও আবিষ্কার করেছেন ...

সেই দাদার পেছন ব্ল্যাক হোলে গিয়ে দেখি এক মাঝবয়েসী কবিমানুষ উদাস হয়ে একঘর চিঠির বাক্সের মধ্যে নিজের মনে মান্না দের গান গাইছেন, আমাকে দেখে যারপরনাই আহ্লাদিত হলেন, বললেন আসে না তো আসে না, আজ দুজন এয়েচেন ... তারপর সেই পাতালঘরের বিভিন্ন বাক্স-উপবাক্সের মধ্যে কি করে কে জানে, মিনিট পনেরো ধুলো ঝেড়েই আমার নাম লেখা একটা বাক্স উদ্ধার করে আনলেন ... বাক্স দেখে তো আমার বাক্যিহারা দশা, ব্রাউন পেপারে মোড়া একটা শক্ত বাক্স, বাক্সের গায়ে আধার-আধার গন্ধ, দেখেই মনে হচ্ছে রাষ্ট্রযন্ত্রের যাবতীয় ইস্ক্রুপ ওতে পাওয়া যাবে ...

বাক্স হাতে নিতে যাবো, ডাক-কবি-বাবু বললেন, "আইডেন্টিটি আছে?" ... বলতে চাইছিলাম সে কি কারুর-ই থাকে... বললাম আজ্ঞে হ্যাঁ, রেশন কার্ড, ভোটার আইডি, ড্রাইভিং লাইসেন্স, প্যান কার্ড - কি চাই বলুন? কবি বললেন, "আধার?" ... বাধ্য হয়ে বললাম, আজ্ঞে ওই বাক্সটাতেই আমার আধার আছে, আধার দেখিয়ে বাক্স নেবো কী করে? কবি একগাল হেসে বললেন, 'তাই তো, ডিম আগে, না মুরগী আগে?"

তারপর উনি একটা খাতা খুলে কিসব পড়তে বসলেন, আরো মিনিট দশেক গেলো, শেষমেশ মুখে হাসি ফুটিয়ে বললেন, আচ্ছা ডি-এল দিন ... বের করে দিলাম - বললেন না না জেরক্স দিন - আমি বললাম, জেরক্স তো আনিনি দাদা, কাছেপিঠে দোকান আছে? দাদা বললেন, হ্যাঁ সেই চিড়িয়ামোড় ... তখন আমার কেঁদে ফেলার অবস্থা ... ডাক-বাবুর বোধহয় মায়া হলো ! একটা ফোল্ডার থেকে একটা ফুলস্ক্যাপ কাগজ বের করলেন, তার উপরের কোণার দিকে একটা চৌকো বাকশ আঁকলেন, "ধরুন এইটে আপনার ছবি, এবার লাইসেন্সে যা যা লেখা আছে, ঠিক ঠিক জায়গায় কাগজে সেইসব লিখে দিন, ওইটাই জেরক্সের জায়গায় দিয়ে দেবো" ...

শুনেছিলাম প্রবল আন্দোলনের দিনে নিষিদ্ধ বই দেশ থেকে দেশে চলে যেতো, হাতে কপি করা নিষিদ্ধ ইস্তেহার ... ভাবিনি একদিন কোনো এক ডাকঘরের গর্ভগৃহে বসে আমিও হাতে কপি করবো আমার আইডেন্টিটি ...

এইসব করতে করতে কখন যে আলাপ জমিয়ে ফেলেছি ভদ্রলোকের সাথে বুঝতেই পারিনি ... বেরোনোর সময় ডাক-বাবু একগাল হেসে বললেন, "সব হারানো চিঠি-ই এইখানে আসে, খালি কেউ খুঁজতে আসে না, আবার কোনো চিঠি হারিয়ে গেলে আসবেন!"
---------------
আমার আধার অভিযান এই অব্দি-ই ... তবে দুটো-একটা ফুটনোট না লিখলেই নয় ...
১ঃ উদ্ধার করা সেই বাক্সে আধার ছিলো না, ছিলো স্টেট ব্যাঙ্কের
পাঠানো নতুন একটা চেক-বই, আর একটা চিঠি, আধার চেয়ে ...
২ঃ আধার শেষমেশ পেয়েছিলাম, তবে আমি চলে আসার অনেক পরে ... কথায় আছে, আশা ছেড়ে দেওয়ার ঠিক পরেপরেই ঈশ্বর প্রকট হন, সেটা সরকারী চিঠির জন্যেও সত্যি ...
৩ঃ নাঃ, এতো বছরেও আধার লিঙ্ক হয়নি, এস বি আই আজ-ও আমাকে চিনতে চেয়ে বাড়িতে চিঠি পাঠায়, কালকেই একগাদা জেরক্স অর্ধেক পৃথিবী দূর থেকে পোস্ট করেছি ... যদিও আমাকে তারা এই নব ফাল্গুনের দিনে চিনে নেবে সে আশা রাখি না আর ...
৪ঃ আমি প্রায়-ই গল্পের প্রয়োজনে একটু-আধটু অতিরঞ্জন করি, কিন্তু এই আষাঢ়ে গপ্পো-টার প্রত্যেকটা ঘটনা, মানুষ এবং ছাগল একশো পার্সেন্ট নির্জলা সত্যি !
৫ঃ রমেশ কুহাড়ের ঘটনাঃ https://i.imgur.com/NiSrMs6.jpg

Comments

Popular posts from this blog

কামাই

যে ভাষায় আমের নাম ...