Posts

Showing posts from 2019

প্রথমতঃ

বাবার কথা মনে পড়লেই একটা গন্ধ নাকে আসে অবিকল ... সদ্য জ্বালানো উইলস ফ্লেকের গন্ধ, আমি চিনি  ... আবছা একটা ছবি ভেসে ওঠে - বাইরের পেশেন্ট দেখার ঘরের কাঠের চেয়ার, জানলার ঠিক ধারেই, বাবা মুখের সামনে লাইব্রেরী থেকে আনা একটা বই ধরে আছেন ... মুখ দেখা যাচ্ছে না, শুধু রেক্সিনের বাঁধাইয়ের আড়াল থেকে এক-একটা রিং উড়ে উড়ে জানলা দিয়ে বেরিয়ে মেঘ হয়ে যাচ্ছে ... বাবা প্রায় সারা-জীবন চেন-স্মোকার ছিলেন ! মানে সত্যিকারের চেন, একটা নেভার আগে সেইটার আগুনে আরেকটা জ্বালানো চেন ... দিনে বোধহয় দেড় কি দু-প্যাকেট আরামসে উড়ে যেতো ! আমাদের বাড়ির প্রত্যেকটা ক্ষয়ে যাওয়া কড়ি-বরগা এমন কি পুরোনো পর্দার ভাঁজে ভাঁজে শুঁকলে হয়তো এখনো হাল্কা সুবাস পাওয়া দুষ্কর নয় ... ন্যাপথালিনের গন্ধঅলা পুরোনো শার্ট আর আমাদের সবকটা মশারি-র অগুন্তি ফুটো-ও তার সাক্ষী ... সেই যেমন হেনরি ফন্ডা লিখেছিলেন, ' I have been close to Bette Davis for thirty eight years, ... and I have the cigarette burns to prove it " ... অনেক ভেবে মনে হচ্ছে খুব ছোটোবেলায় ক্যাপস্ট্যান খেতে দেখেছি, আর চার্মস ... আর ইস্কুলের শেষদিক থেকে উইলস ... মাসের শুর...

আধার রাতের বন্দী

আজকের বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডে একটি খবর বেরিয়েছেঃ মুম্বই পোর্ট ট্রাস্টের জনৈক কর্মী, রমেশ কুহাড়, তার স্যালারি অ্যাকাউন্টের সাথে আধার লিঙ্ক করতে অস্বীকার করেন ... এবং দীর্ঘ আইনি যুদ্ধের পরে এবং তিরিশ মাস বেতন না পাওয়ার পরে, শেষমেশ কোর্ট তার পক্ষে রায় দিয়েছেন ... এবং একটি ঐতিহাসিক উক্তি-ও করেছেন, বলেছেন, "Even one dissenter has a right to oppose a government order" ... হয়তো এইটাও বলে রাখা ভালো যে, রমেশ কুহাড়, পোর্ট ট্রাস্টের ৮০০ কর্মীর মধ্যে একমাত্র ব্যতিক্রম ... বলাই বাহুল্য, তিরিশ তো দূরস্থান, তিন মাস বেতন না পেলেই আমার মতন লোকের ঘটি-বাটি বেচে রাস্তায় দাঁড়ানোর কথা ... কাজেই এই ধরনের সাহস দূর থেকে দেখে স্যালুট করা ছাড়া উপায় দেখছি না ... তবে এই ঘটনা থেকে নিজের আধার-অভিযানের দু-টুকরো গল্প মনে পড়ে গেলো, আদৌ একরকম নয়, তাও বলার লোভ সামলাতে পারছি না ... ছোটবেলায় দেখতাম পুজোর ঠিক পরেপরেই বাড়িতে বাবার বন্ধু আর আত্মীয়-দের হাতে লেখা ছোটো ছোটো চিঠি আসতো, কখনো পোস্টকার্ড, কখনো ইনল্যান্ড লেটার ... আমরাও সোৎসাহে সেসব চিঠি পড়ে উত্তর দিতাম ... 'আমরা সকলে কুশল, তোমরা?" ... তা এই ফে...

আশায় আশায়

শহরের বাইরে দাঁড়িয়ে শহরের দিকে তাকালে একটা অদ্ভুত আভা দেখা যায় রাত্রের দিকে, সেটা গাঢ় হয় ক্রমশঃ তারপর একসময় কেউ যেন ফুঁ দিয়ে নিভিয়ে দেয় একটা বিশাল মোমবাতি ...যাদের ঘুম নেই তারা বোঝে রাত গভীর হলো, এবং এই বিশাল অন্ধকারের নীচে তারা এই মুহুর্তে বোধহয় সম্পূর্ণ একা ...  অথচ এক একটা রাত্রে জেগে থাকে একটা দূরের বারান্দা, আর এক এক রাত্রে কেউ জিগ্যেস করে ফেলে, "জেগে আছিস? একটা ফোন কর না !" আশায় আশায়  ৫২-৮১১৩ - এটা আমাদের পাশের বাড়ির অলোক জেঠুর নম্বর, এখনকার নয়, সেই সময়ের যখন ফোন নম্বর-ও ছিলো আমাদের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের মতন সহজ এবং অল্প কিছু লোকের করায়ত্ত ! আমার স্কুল ইউনিফর্মের বুক-পকেটে একটা ছোট্ট চিরকুটে এই ছ-খানা নম্বর থাকতো, কোনোদিন-ই কাজে লেগেছে মনে পড়ে না, তবুও মা নিশ্চয়ই শান্তি পেতেন, কিছু অঘটন ঘটলে বা দরকার পড়লে কেউ হয়তো খবর দেবে ... দরকার পড়েনি, যদিও অঘটন যে ঘটতো না এমন নয় ! তা-ও ... আমার জন্যে মা-কে গ্যাসের আঁচ কমিয়ে আঁচলে হাত মুছতে মুছতে দৌড়তে হয়েছে এমন মনে পড়ে না ... বাবার দুঃখ ছিলো, একটা ফোন না হলে লোকে ডাক্তারবাবুকে খবর দেবে কি করে? সত্যি কথা ! ক্লাস নাইনে উঠতে ...

আমার কথা

আমার সব লেখাই আত্মজৈবনিক - যেন হঠাৎ হঠাৎ মনে পড়ে যাওয়া এক-একটা ছোট্ট চিরকুট, সাদা শার্টে একটা ছোট্ট পুরোনো দাগ যেটা ধুয়ে ধুয়েও কি করে যেন রয়ে গেছে, তাই আলাদা করে আমার কথা লিখতে বসে বড্ড গোলমাল লাগছে! আসলে কিসের পরে কি ছিলো জানিনা, শুরুতে কি ছিলো? জল না আগুন? না অন্ধকার? শেষে কি আলো থাকবে? এসব বোধহয় আমাদের সিলেবাসে ছিলো না ! সিলেবাসে কী ছিলো তবে? ছিলো একটা রঙচটা নাইলনের বাজারের থলে – আজ-ও সেটা উল্টোলেই একটা দুটো পেয়াঁজের খোসা কোত্থেকে ঠিক বেরিয়ে পড়বে, সেইরকম কতগুলো জিনিষ কেমন করে যেন আলগা হয়ে লেগে থাকে আমাদের সাথে, কবে এসেছিলো জানিনা, আবার কোনদিন ঝাড়তে গিয়ে বেরিয়েও যাবে, এই দু-একটা স্মৃতি সেই দু-একটা উড়ে যাওয়া কুটো ! ছোটবেলার কথা ভাবলেই মনে পড়ে লোডশেডিং – বিষ্যুদবার সাতটা পয়ঁতাল্লিশে শুরু হতো চিত্রহার,ঠিক আট-টায় কারেন্ট চলে যেতো ! অন্ধকার বারান্দায় দুই ভাই-বোন বসে গলা ছেড়ে গাইতাম, “আলো আমার আলো ওগো, আলো জীবন ভরা” ... লন্ঠণ জ্বালিয়ে দিয়ে যেতেন মা, আর আমাদের আকুল আলোর ডাকে কুপির শিস উঠতো উপর দিকে কেঁপে-কেঁপে, সে ডাক শুনে আলো-ও কি ক্রমে আসতো সে ছোট্ট ঘরে? মনে নেই, তবে জল আসতো খুব...

উঁচু-নিচু জ্যোৎস্না

এইসব অবসন্ন, স্বপ্নতাড়িত দিনরাতগুলোয় হঠাৎ হঠাৎ মনে হয় বোবা হয়ে যাচ্ছি, তখন ইচ্ছে করে চিৎকার করতে, বা কম্বল গায়ে হুট করে বেরিয়ে যেতে খোলা মাঠে শিশিরের তলায় ... যেখানে কোনো এক পার্কের কোণে একচিলতে বারোয়ারী আগুন জ্বলছে, আর একজন লোক সেই নিশুতি রাতে শুকনো পাতার স্তুপে একটা চিঠি খুঁজছে খালি এইসব রাত্রে অবিকল শুনতে পাই, রান্নাঘর থেকে গানের কলি ভেসে আসছে (সুরটা লাগছে ঠিক-ই, কিন্তু কথাগুলো শেখা হয়নি এখনো), সেইসব হলুদ-মাখা আঁচল আর সিগারেটের গন্ধ বড্ডো দুঃসহ লাগে সেসময় ... তখন আমি ভাস্কর চক্রবর্তীর কাছে গিয়ে বসি ... মনে হয় যেন এই পরিত্যক্ত রাত্রির মতো তার কবিতা দুই বিশাল ডানা দিয়ে ঢেকে রাখছে আমাকে। যেন প্রবল বৃষ্টির রাতে ক্ষয়ে যেতে যেতে, গলে যেতে যেতে ঘরে ফেরা হবে কিনা জানিনা আমি, অথচ বহুদূরে যেন চেনা একটা মোমবাতির হলদে আলো দেখতে পাই ... “তোমাকে অজ্ঞাত দেশে দেখি প্রায় একটি নির্জন ছাতে দাঁড়িয়ে রয়েছো । সব কথা শেষ হয়ে গেছে । আর কোনো কথা নেই – স্বপ্ন নেই – শুধু কিছু দিন আর রাত্রি পড়ে আছে।“ ভাস্কর লিখেছিলেন ‘শেষ নেই এমন এক পাহাড়ে অনবরত চড়তে থাকার সঙ্গে কবিতা লেখার তুলনা করা যায় কি...

অনুত্তীর্ণ

বাইরে শনশনিয়ে হাওয়া দিচ্ছে আজ, আর ঝড়ে একটা রঙচটা পর্দা আছড়ে আছড়ে          বুঝিয়ে দিতে চাইছে ঠিক কতোটা বন্ধ           এই ছোট্ট একফালি গুহাটুকু দুটো সুন্দর মিথ্যেও পাশাপাশি বসতে পারে না এই শহরে জন্ম হয়না, মৃত্যুও খুব ধূসর              দাম্পত্যের ক্ষতচিহ্নের মতন              পদশব্দে ঢাকা পড়ে যায় সন্ধ্যের দিকে দু-একটা বাসন ভাঙ্গার আওয়াজ ছাড়া               তেমন কোনো কবিতাও শুনিনি কোনোদিন তবুও কবিজন্ম ডানার উত্তরাধিকার বয়ে আনে,              একটা আশ্চর্য বৃত্ত এঁকে দেয় বোধের চরাচরে              তার ব্যাসার্ধ ধরে ছুটতে ছুটতে আমাদের দীর্ঘ চুম্বনের স্বাদ মনে পড়ে যায়,         আর যেন গতজন্মের স্মৃতির ভেতর থেকে একটা চেনা গলা এসে বলে, 'উড়ছিস ওড়, তা পড়ে মরবি, না মরে পড়বি?'