একটু উঁচু ক্লাসের অঙ্ক পড়তে গেলেই এক-ই লোকের নাম (অথবা পদবী) বার বার ফিরে আসে, বিভিন্ন উপপাদ্য, বা সমীকরণ বা অন্যান্যা গাণিতিক বিষয়ের নামে। যেমন গাউস, লেজান্ড্র, কশি, রীম্যান, লাপ্লাস ... ইত্যাদি প্রভৃতি। কয়েকক্ষেত্রে অবশ্য এক-ই পরিবারের একাধিক লোকের নামে নানান কিছু, যার সবথেকে ভালো উদাহরণ বার্নৌলি - জ্যাকব, যোহান, ড্যানিয়েল, নিকোলাস ... কোন বার্নৌলির নামে কোন প্রিন্সিপল আর কার নামে সম্ভাবনার সূত্র - এই এক দারুণ ধাঁধার প্রশ্ন।
এই জিনিয়াসদের মধ্যে গাউস বা গস-কেই ধরুন না কেন। অ্যালজেব্রা, জ্যামিতি, নাম্বার থিওরি, রাশিবিজ্ঞান, কার্টোগ্রাফি, নট (গিঁট) থিওরি - আরও কিসে না কিসে ১০০-র উপরের অঙ্কের জিনিষের নামে Gauss উঁকি মারছেন। একটা আস্ত উইকি পেজ বরাদ্দ আছে শুধু "List of things named after Carl Friedrich Gauss"-এর নামে। পড়তে পড়তে আশ্চর্য লাগে যে এই একজন-ই লোকের নামে এতো কিছু? এরা কী এক-ই লোক? তাও গস এমন খুঁতখুঁতে পারফেকশনিস্ট মানুষ ছিলেন যিনি বিশ্বাস করতেন একদম নির্ভুল, সমালোচনার উর্ধ্বে থাকবে এমন জিনিষ নামানো না গেলে পাবলিশ করার-ই দরকার নেই। তার মোটো ছিল, Pauca sed Matura ("Few, but Ripe")। তাতেই এই। এখনকার মত "পাব্লিশ অর পেরিশ" কালচার ভাগ্যে তিনি দেখেননি।
তবে, আমার গপ্পের নায়ক গস নন। বরং এমন একজন লোক যার সাথে গস দীর্ঘদিন "কে প্রথম কাছে এসেছি?", অর্থাৎ প্রায়োরিটি ডিস্পিউটে জড়িয়েছিলেন লিস্ট স্কোয়ারের আবিষ্কার নিয়ে। সেই নিয়ে বিস্তর চিঠিচাপাটি, মান-অভিমান, একশো বছর পরেও রাশিবিজ্ঞানের ইতিহাসের আগ্রহের ব্যাপার। তিনি আদ্রিয়ান-মারি লেজান্ড্র (নাকি লেজঁদ্র?)। ১৭৫২ থেকে ১৮৩৩। অঙ্কের ইতিহাসে তার-ও কীর্তি কম নয়। চট করে ভাবলেই মনে পড়ছে - লেজান্ড্র পলিনমিয়াল, লেজাণ্ড্র ট্রান্সফর্মেশন, লেজাণ্ড্র ডিফারেনশিয়াল ইকোয়েশন, লেজান্ড্র সিম্বল, লেজান্ড্র কণ্ডিশন ফর ক্যালকুলাস অফ ভেরিয়েশন, লেজান্ড্র রিলেশন ইত্যাদি ইত্যাদি আরও কত কিছু। ভদ্রলোক এর-ই পাশাপাশি নাম্বার থিওরি, এলিপটিকাল ইন্টিগ্রাল, ক্যালকুলাসের উপর বই লিখেছিলেন বেশ কিছু, আর ইউক্লিডের জিওমেট্রির মালমশলা নিয়ে লিখেছিলেন বেশ জনপ্রিয় পাঠ্যবই, একাধিক ভাষায় অনূদিত হয়েছিল সেটি। তাও লেজান্ড্র জীবদ্দশায় প্রচুর খ্যাতি পেয়েছিলেন এ কথা লিখলে মিথ্যা বলা হবে। অন্যান্য সমমানে বিখ্যাত গাণিতিকদের মত তার 'সমগ্র' বেরোয়নি। এমন কি, ব্যক্তি লেজান্ড্র কেমন ছিলেন সে বিষয়ে আমাদের জানা আজ-ও অতি অল্প। ছাত্র অথবা বন্ধুদের দু-একটি চিঠির ভেতর যেটুকু যা ধরা যায় তাইই।
তবে, সে এমন কিছু আশ্চর্য হয়তো না। কত বিখ্যাত বৈজ্ঞানিক কি অঙ্কবিদ সারাজীবন নিভৃতচারী হয়ে কাটান। অন্য এক আশ্চর্যতর জগতের বাসিন্দা হয়ে। তাদের রোজনামচা না-ই জানা থাকতে পারে। কিন্তু লেজাণ্ড্রের গল্পের সবথেকে আশ্চর্য বিষয় এই যে এক শতাব্দীর-ও বেশি সময় ধরে মানুষ অন্য এক লেজান্ড্র-র ছবি দেখে ভেবেছে এই সেই আদ্রিয়ান-মারি। প্রজন্মের পর প্রজন্ম যেখানে যেখানে যে বইতে লেজান্ড্রর কথা পড়েছে, যে ওয়েবসাইটে অঙ্কের ইতিহাসে লেজান্ড্রর কীর্তি পড়েছে, সেই কীর্তির পাশে যাঁর ছবি দেখেছে তিনি আদৌ গণিতজ্ঞ লেজান্ড্র নন। আদ্রিয়েন-মারির সাথে তাঁর যে কোনোরকম বাহ্যিক সাদৃশ্য ছিলো এমন-ও না। তবে, মিল ছিল পদবীতে। যে ভদ্রলোকের রাজপুরুষোচিত চেহারা দেখে আমরা গড় করেছি তাঁর নাম লুয়ি লেজান্ড্র। লুয়ি বাবু অঙ্কের লোক ছিলেন না, ছিলেন ফরাসী বিপ্লবের সময়কার এক বিপ্লবী। আদ্রিয়ান-মারির সমসাময়িক লুয়ি (১৭৫৫-১৭৯৭) প্রথম জীবনে ছিলেন একজন কসাই, ফরাসী বিপ্লব যখন শুরু হচ্ছে, অর্থাৎ ১৭৮৯ নাগাদ অতি-বাম Montagne দলে যোগ দেন, বাস্তিল দুর্গ আক্রমণে অংশ নেন, এবং পরে রাজার মৃত্যুদণ্ডে সায় দিয়ে ভোট দেন। এই Montagne দলের লোকদের, অর্থাৎ Montagnards-দের মধ্যেই ছিলেন ইতিহাসের পাতায় কলঙ্কিত নায়ক রেইন-অফ-টেররের রোবস্পিয়ের। তবে, বিখ্যাত বা কুখ্যাত যাই হোন, লুই ছিলেন আগাগোড়া রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব - তার সাথে আদ্রিয়ান-মারির প্রায় কোনো সম্পর্কই নেই, শুধু ঐ পদবী বাদ দিয়ে।
https://i.imgur.com/IVKblVW.png
এবং এইখানেই আরও আশ্চর্যের কথা। দুইজনেই কমবেশি বিখ্যাত নাহক ঐতিহাসিক চরিত্র, আমাদের কাছে না হলেও সেই দেশে তো বটেই, হয়তো ভিন্ন ক্ষেত্রে, তা-ও। অথচ, বছরের পর বছর ধরে এই দুই লেজান্ড্রর নামের পাশে এক-ই লোকের ছবি বসেছে বইতে ও অন্যত্র (যে ছবিটি দেখা যাচ্ছে উপরে), কিন্তু কারুর-ই এই অদ্ভুত ডাবল-রোল চোখেও পড়েনি। এর একটা কারণ হতে পারে এই যে যারা মন দিয়ে অঙ্ক পড়েছে তারা আর ইতিহাস পড়েননি, আর ভাইসি ভার্সা। আর দ্বিতীয় কারণ এই যে এতোসব শক্তিশালী সার্চ ইঞ্জিন তো এই কয়েকদিন আগেও ছিলো না আর পাশাপাশি রেখে দেখার কাজ-ও এতো সোজা ছিল না।
এই আশ্চর্য ভ্রান্তি বা অ্যানোম্যালি প্রথম ধরা পড়লো ২০০৫ সালে। ইউনিভার্সিটি অফ স্ট্রাবুর্গের দুই ছাত্রের চোখে ধরা পড়ল যে দুইজন সম্পূর্ণ ভিন্ন লোকের - প্রতিকৃতি এক-ই। ফরাসী ব্লগেও লেখালিখি শুরু হলো। অঙ্কের দুনিয়ায় শোরগোল পড়লো, "ছবি তুমি কার?" - আদ্রিয়ান-মারি না লুই না অন্য কেউ? সেই অনুসন্ধানে মুখ্য ভূমিকা নিলেন জাঁ বার্নার্ড ফ্রাসোয়াঁ, তার ওয়েবসাইটে রীতিমত গোয়েন্দা-তদন্তের মত পরপর সূত্রসহ ছবি দিয়ে। অচিরেই জানা গেলো যে হ্যাঁ ঐ ছবিটি লুই লেজান্ড্রর-ই। যে ছবিটি সবাই দেখে অভ্যস্ত সেটি একটি লিথোগ্রাফ প্রতিকৃতি। সমসাময়িক আরও অনেক ফরাসী ব্যক্তিত্বের সাথে এক-ই বইতে সেই ছবি। তাতে তৎকালীন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, বৈজ্ঞানিক, শিল্পী, সেনানায়ক, এমন কি সেই ভাগ্যহত রাজা ষোড়শ লুইয়ের ছবি যেমন ছিল, ঠাঁই পেয়েছিলেন বেশ কিছু গণিতজ্ঞ-ও - লাগ্রাঞ্জ, কার্নট, কনডর্সেট (এই কনডর্সেটের কথা আগের পর্বে লিখেছিলাম, যার জুরি থিওরেম দিয়ে বোঝা যায় সংখ্যাগরিষ্ঠ মতের গতিপ্রকৃতি।) এরা সবাই রীতিমত বিখ্যাত ব্যক্তিত্ব, যাদের খ্যাতি পড়াশুনোর জগত ছাড়িয়েও বেশ কিছুদূর যায়। কনডর্সেটের খ্যাতির কথা আগেই বলেছি, বাকিরাও হয় রাজনীতি না হলে সরকারি কাজের ভার পেয়ে স্বনামধন্য ছিলেন। যেমন ছিলেন, আমাদের লেজান্ড্র-ও, বিশেষতঃ ইউক্লিডের পাঠ্যরূপের জন্য। কাজেই ঐ তারকাখচিত বইয়ের প্রতিকৃতি দেখে ভুল হওয়া আশ্চর্য হলেও একেবারে অসম্ভব নয়। যদিও বইয়ের শেষের সূচিতে জ্বলজ্বল করছে, "LEGENDRE (Louis), né à Paris, en 1756, mort à Paris, le 13 décembre 1797"। আরও খুঁটিয়ে দেখলে বোঝা যায় ছবির তলায় যে সই, সেটি "Legendre", আর আমাদের অঙ্কের স্যার সই করতেন "Le Gendre"। এ যেন সেই দুলাল চন্দ্র ভড়ের তালমিছরি। ছবি ও সই না মিলিয়ে নিলে নকল দুলালের মিছরি খেয়ে ঠাণ্ডা লেগে যাবে। লিথোগ্রাফের ছবিই যে লুইয়ের ছবি তার আরও অকাট্য প্রমাণ - ঐ মন্তানার্দদের সাথে লুইয়ের একসাথে গ্রুপ ছবি। তাতে যার ছবি দেখা যাচ্ছে তিনিই যে লিথোগ্রাফের মানুষ বুঝতে অসুবিধে হওয়ার কথা নয়।
https://i.imgur.com/dfiyFeG.png
তবে ইনি না হয় লুই, তাহলে আসল আদ্রিয়ান মারি কোনজন? এই ধাঁধার জট ছাড়াতে লেগে গেলো আরও দুই বছর। ২০০৭ সালে জেরার্ড মিশঁ নামে আরেক গণিতজ্ঞ ঐ জাঁ বার্নার্ড ফ্রাসোয়াঁর ওয়েবসাইট থেকে এই প্রতিকৃতি-বিতর্কের কথা জানতে পেরে নিজের ওয়েবসাইটে একটি নোটিশ ঝোলান, আর একটি রীতিমত দুষ্প্রাপ্য ওয়েবসাইটের গহ্বরে খুঁজে পান একটি ক্যারিকেচারের অ্যালবাম। তাতে পাশাপাশি পেন্সিল স্কেচে দুই বিখ্যাত লোকের ছবি - বাঁদিকে লেজান্ড্র আর ডানদিকে ফ্যুরিয়ের।
https://i.imgur.com/aAatsXn.jpeg--
No comments:
Post a Comment