ওর্যাকল, জ্যোতিষবিদ্যা ও প্রাচীন রোমের এক জাদুকর
"এই যে লুকিয়ে লুকিয়ে অবৈধ একখানা সম্পর্কে মজেছি, ধরা পড়বো কি?", অথবা, "কোনোদিন কি স্বচক্ষে দেখবো মৃত্যুকে?", "যাকে মনে মনে চাই তাকে পাবো কী এ জীবনে?", "সফল হতে পারবো?", কিংবা ধরুন, "একদিন কী জাঁদরেল একজন নেতা হতে পারবো আমি?"
ধরুন এই বেয়াড়া প্রশ্নগুলো মনে এলো, যার উত্তর না মেলা অব্দি শান্তি নেই - কী করবেন? হয় ভালো একটি বাবা দেখে হাত মেলে বসে পড়বেন, অথবা খবরের কাগজের দুয়ের পাতার ভেতরে খুঁজে দেখবেন 'ভাগ্য+চেষ্টা = ফল', জ্যোতিষী শ্রীভৃগু (আসল) বলে দিয়েছেন, 'প্রেমে আছে, কিছু কথা কিছু ব্যথা'।
প্রাচীন রোমান সাম্রাজ্যে অবশ্য সংবাদ প্রতিদিন বেরোতো না, 'সব জ্যোতিষী বারবার অমৃতলাল একবার'-এর বিজ্ঞাপন-ও পড়তো না কলেসিয়ামের প্রাচীরগাত্রে - তবে উপায়? উপায় ছিলো আশ্চর্য একটি ভাগ্যগণনার বই - নাম 'Oracles of Astrampsychus' (ওর্যাকল অব অ্যাস্ট্রামসাইকাস)। আজকের গল্প সেই বইটি নিয়ে, এবং আরও খুচরো দু-পয়সা যা পড়তে গিয়ে কুড়িয়ে পেয়েছি, তাই ...
সত্যি বলতে ভবিষ্যত জানতে ইচ্ছে হয়নি এমন মানুষ খুঁজলে মেলা দায়, আর এই বোধহয় এমন একটি জিনিষ যা সেই সুদূর অতীত থেকে আজ অব্দি পাল্টায়নি। অদৃষ্ট-অস্পষ্ট ভবিষ্যত জানা সম্ভব নয় জেনেও মানুষ বারেবারে দ্বারস্থ হয়েছে জ্যোতিষীদের, ফরচুন-টেলারদের, এবং সেই ট্র্যাডিশন সমানে চলিতেছে। (যদিও এই লেখাটা লেখার সময়েই কাকতালীয়ভাবে চোখে পড়েছে এক জ্যোতিষীর বিজ্ঞাপনের সদর্প স্লোগান - "জটিল কেসে আকাশে রকেট পাঠিয়ে গ্রহ-নক্ষত্রের পজিশন ঠিক করা হয়"!!)
সেইসব বুজ্রুকির ইতিহাসে আমার আগ্রহ নেই, এবং অ্যাস্ট্রামসাইকাসের বইটি যেন ভাগ্যগণনার বাইরেও অনেক কিছু। কারণ এই বইয়ের রহস্যময় প্রশ্নোত্তরের ধাঁচ আমাদের শুধুই স্বান্তনা দেয় না, বলে দেয় কেমন প্রশ্ন রাত্রে জাগিয়ে রাখতো সেই অন্ধকার অতীতের সাধারণ রোমের বাসিন্দাদের? কিসের উত্তর খুঁজতে তারা শরণাপন্ন হতেন ওর্যাকলের, আর কোন প্রশ্নের উত্তর জানতে চাননি কেউ?
পেশায় জাদুকর অ্যাস্ট্রামসাইকাসের জন্ম-কর্ম খ্রীষ্টপূর্ব চতুর্থ শতাব্দীতে, অর্থাৎ আলেকজান্ডারের-ও অন্ততঃ বছর চল্লিশেক আগে, তবুও সেই প্রাচীন প্যাপিরাসের পুঁথির কিছু কিছু পাতা এখনো রয়ে গেছে - ব্রিটিশ লাইব্রেরীর মিউজিয়মে। তার কিছু মণিমুক্তো দেখা যাক?
অ্যাস্ট্রামসাইকাসের ওর্যাকলে মোট বিরানব্বুইটি প্রশ্ন, নম্বর দেওয়া বারো থেকে একশো তিন, আর তার একশো তিন সেট উত্তর, বা বলা ভালো দশটা করে অপশন প্রত্যেকটি উত্তরের, এক-একটি ভাগের নাম একটি 'ডিকেড'। এবার এক থেকে দশের মধ্যে একটা সংখ্যা ভাবুন চট করে ... তার পর যে প্রশ্নটা মনে ধরবে তার নম্বরের সাথে যোগ করে একটা টেবিল থেকে পেয়ে যাবেন আরেকটি সংখ্যা - যেটি বলে দেবে সেই নির্দিষ্ট ডিকেডের কোন উত্তরটি আপনার কপালে নাচছে ...
একটা কাজের উদাহরণ দেওয়া যাক, ধরা যাক আপনার প্রশ্ন, আপনি কি অ্যাডাল্টারি করতে গিয়ে ধরা পড়বেন? এইটি হচ্ছে ১০০ নম্বর প্রশ্ন। আর ধরা যাক আপনার মনে মনে ভাবা সংখ্যাটি ৬, তাহলে টেবল অফ করেস্পন্ডেন্স বলে দেবে ২৮ নং ডিকেডে উত্তর পাওয়া যাবে। আঠাশে পৌঁছে ৬ নম্বরে গিয়ে দেখলেন লেখা আছে, 'এক্ষুণি ধরা পড়ছেন না, (চালিয়ে যান)'। যদি দৈবাৎ মনে ভেবে থাকেন ৫, ওর্যাকল বলে দেবে, 'ডোন্ট ওয়রি, ধরা পড়ার চান্স-ই নেই'। আবার যদি সংখ্যাটি হয় ৭, ওর্যাকলের ভবিষ্যদবাণীঃ 'আপনি অ্যাডাল্টারার নন, তবে আপনার বৌ অন্যের প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছে' ...
বইটির কিছু প্রশ্ন, যেমন প্রেমে কত সাজা আর কত মজা, সেসব চিরন্তন ব্যাপারস্যাপার, বঙ্গজীবনে বোরোলীনের মত, কিন্তু বাদবাকি থেকে ফুটে ওঠে সেইসময়ের রোমের একটি খন্ডচিত্র। কেমন সে ছবি?
জেরি টোনার দেখিয়েছেন কেমন করে অ্যাস্ট্রামসাইকাসের ওর্যাকল শুধুই জ্যোতিষীদের হ্যান্ডবুক নয় - একদিক থেকে দৈনন্দিন জীবনের বিভিন্ন ঘটনার, বিশেষ করে লাইফ-চেঞ্জিং ইভেন্টের, রিস্ক ক্যালকুলেটর-ও বটে।
যেমন বিভিন্নভাবে ঘুরিয়েফিরিয়ে করা প্রশ্ন, 'আমার ব্যবসাটা কি দাঁড়াবে?' - ওর্যাকলের যত উত্তর তার মধ্যে ইতিবাচকের সম্ভাবনা ১৮% - টোনার দেখিয়েছেন, এইটা আকাশ থেকে পড়েনি, বরং সেই সময়ের রোমে নতুন ব্যবসা শুরুর আগে ধারকর্জ্জ করলে যা সুদ দিতে হতো প্রায় তার কাছাকাছি, অর্থাৎ অ্যাস্ট্রাম-বাবু আন্দাজে ঢিল মারেননি নেহাৎ।
শুধু ব্যবসা-ই নয়, জনস্বাস্থ্য-ও, 'আমার শিশুটি কি বাঁচবে?' - উত্তরে দশের মধ্যে দুটো বলবে, এমনিও বাঁচবে না, অমনিও না, আর একটি বলছে, 'প্রতিপালিত হবে না'। সেযুগে শিশুমৃত্যু, এবং শিশুহত্যা, দুই-ই যে বেশ বেশী-ই ছিলো তার-ই প্রতিফলন।
তবে অন্ধকারের মধ্যেও ঐতিহাসিক-রা কখনো কখনো আলোকবিন্দু দেখতে পান, যেমন দেখেছেন টোনার। আশর্য ঘটনা, প্রায় পুরো বইটিতে কোত্থাও হিংসাত্মক অপরাধের বলি হওয়ার প্রশ্ন নেই, এক বিষে মৃত্যুর ভয় ছাড়া, অথচ প্রাচীন রোমান সাম্রাজ্য বলতে যে ছবিটি ভেসে ওঠে মনে তাতে রাস্তায় খুনী, ডাকাত, তস্কর-দের দৌরাত্ম্য এবং থেকে থেকেই যুদ্ধ অথবা খুনোখুনি সাধারণ ঘটনা বলে মনে হওয়াই স্বাভাবিক। তাহলে কেউ জিগ্যেস করেননি কেন? টোনার-সাহেব এ কথা স্পষ্ট করে লিখে যাননি, তবে এই দুর্দিনে দাঁড়িয়ে আমি একটু-একটু বুঝতে পারি কেন।
তবে মৃত্যুভয় অথবা কিভাবে জীবনপাখি খাঁচাটি ছেড়ে পালাবে সে কৌতূহল তো ভাগ্যগণনার ব্রেড-অ্যান্ড-বাটার - 'আমি কি দেখবো মৃত্যুকে, স্বচক্ষে'? দশের মধ্যে সাতটি উত্তর 'হ্যাঁ', কেউ বিষ খাইয়েছে? ৫০% চান্স, আমাদের জুনিয়রের ভাষায়, 'ডোন্ট টেক চাপ, টেক পি ইক্যুয়ালটু হাফ' !
এইখানে বলে রাখা যায়, অ্যাস্ট্রামসাইকাসের থেকেও এক কাঠি সরেস Homeromanteion, 'হোমারের ওর্যাকল'। তার নির্দেশমালায় বলা আছে,
'প্রথমতঃ, জানতে হবে কোন দিন ব্যবহার করতে হয় ওর্যাকল। দ্বিতীয়ত, প্রার্থনা করতে হবে ঈশ্বরের, মন্ত্রোচ্চারণ করে, নিজের মনে মনে চাইতে হবে অভীষ্ট ফল। তারও পরে, একটি ছক্কা (dice) নিয়ে তিন-তিনবার রোল করতে হবে ভাগ্যফল জানতে'।
এতো কান্ড করে যে সংখ্যাটি পাবেন আপনি, হোমারের কাব্যের সেই পংক্তিটি বলে দেবে কপাললিখন। এই যেমন, আমি ছক্কা চাললাম, নাম্বার তিনটি এলো ৪, ১, ৩ - ইলিয়াডের পাতা থেকে জানা যাবে ভবিষ্যদবাণী 'λάϊνον ἕσσο χιτῶνα κακῶν ἕνεχ' ὅσσα ἔοργας.'
পড়তে পারলেন না? আচ্ছা, ইংরেজিতে দাঁড়ায়, "You would have worn a cloak of rocks for all the wrongs you have done." (বলাই বাহুল্য, আমার অপকর্মের কথা বলা হচ্ছে, আশ্চর্যের কিছু নেই)
আপনিও করে দেখতে পারেন, ইলিয়াড-ওডিসি হাতের কাছে না থাকলে কুছুই পরোয়া নেই, অনলাইন সিমুলেটর আছে কী করতে? চলে যান এই ঠিকানায় - http://www.homeromanteion.com/ !
চেষ্টা করে দেখুন, কপালে তিলক কাটা বাবাজির থেকে হোমারের এই এপিকদুটি যদি ভাগ্য বলে দেয়, মন্দ কী?
ইলিয়াড, ওডিসি পড়েছি, আবার-ও পড়বো সময় পেলেই, তবে, অ্যাস্ট্রামসাইকাসের ওর্যাকলের যে নমুনাগুলি ব্রিটিশ লাইব্রেরীতে আছে, সেগুলোর শহরে গিয়েও দেখা হয়ে ওঠেনি আমার। যা বললাম সব-ই অন্যান্য পত্র-পত্রিকায় পড়া। আক্ষেপ হয়। পরেরবার ইচ্ছে আছে স্বচক্ষে এই আশ্চর্য বইটি দেখে আসা।
তবুও মনে একটা প্রশ্ন খচখচ করেই যায়, এই যে প্রোবাবিলিটির ছাত্রদের ক্লাসে গিয়ে বলি সাধারণ মানুষের randomness, risk নিয়ে ধারণা এত অকাজের ও কাঁচা হওয়ার একটি কারণ, বাকি অনেক কিছুর থেকে অনেক পরে সদ্য অষ্টাদশ শতকের কাছাকাছি প্রোবাবিলিটির শাখাটির জন্ম হওয়া ... হয়তো সেটা সত্যি হলেও, পুরোপুরি সত্যি না।
হয়তো Fermat বা Pascal-এর অনেক অনেক আগে, প্রাচীন রোমের সেই জাদুকর অ্যাস্ট্রামসাইকাস শুধুই জ্যোতিষী ছিলেন না, ছিলেন একজন পাক্কা প্রোবাবিলিস্ট?
আর সত্যিই কী ভবিষ্যত কেউ জানে? সে তো অজ্ঞেয় ... তবু, একবার সেই জাদুকর-জ্যোতিষীকে ধরতে পেলে জিগাতাম, এই অন্ধ রাত্রি কবে শেষ হবে? অ্যাস্ট্রামসাইকাসের ওর্যাকলে হদিশ আছে তার?
রেফারেন্সঃ
১> Fortune Telling, Bad Breath and Stress / Confronting the Classics / Mary Beard. Liveright Publishing Corporation. (এইসব বই পড়লে আরেকবার ষোলোয় ফিরে গিয়ে শুরু করতে ইচ্ছে হয়, অঙ্কের জায়গায় ক্লাসিকস)
২> https://blogs.bl.uk/digitisedmanuscripts/2019/04/fortune-telling-the-ancient-way.html (ব্লগটির নাম Medieval manuscripts blog, অলমিতি বিস্তারেণ)
৩> http://www.homeromanteion.com/ (অনলাইন সিমুলেটর)
Comments
Post a Comment