Sunday, October 11, 2020

ইতি ও পুনশ্চ


 

বছর দুই হলো একতলার বাসা ছেড়ে দোতলায় উঠেছি, সামনে এখন কোনো উঁচু বাড়ি নেই, তাই দৃষ্টি অনেকদূর যায় বাধাহীন। তবে সেই দৃশ্যে শুধুই রুক্ষ, অযত্নে লালিত অনেকখানি জংলা জায়গা, যার একদিক থেকে আস্তে আস্তে এগিয়ে আসছে ছোট্ট, ছোট্ট নতুন দেশলাই বাক্সের মতন বাড়িঘর। আজ থেকে আর সপ্তাহ তিনেক পরেই যদি এসে ব্যালকনিতে বসেন একটা চেয়ার টেনে, হেমন্তের শেষ পাতার ফাঁক দিয়ে হুই দূরের একটা হাইওয়ের একটু আলো দেখা যাবে রাতে, আর ক্রমে ক্রমে কমে আসা জঙ্গলের যেদিকটায় আলো পড়ে না, সেইখান থেকে শোনা যাবে পাখির ডাক, ক্কচিৎ দুই-একটা খরগোশ কিংবা হরিণের আওয়াজ। কোত্থাও কোনো হর্ণ নেই, কোনো সাইরেন নেই, চারিদিকে তাকিয়ে দেখি, আর কোথাও কেউ ব্যালকনিতে শীতের রাতে একা-একা দাঁড়িয়ে নেই। 

মনে হয় এই নিস্তব্ধতা এতোই গাঢ়, এতোই তরল, যেন চোখ বুজে কান পাতলেই বহু দূর থেকে চেনা স্বর এসে পৌঁছবে কানে। যেন এই ডানা-ঝটপটানো রাতে একদিন হঠাৎ-ই ফোন আসবে সেই ইচ্ছে করে সেভ না করা নম্বরটা থেকে, এবং সে জিগ্যেস করবে, 'জেগে আছিস?' 

***** 

বাবার কাছে চিঠি আসতো প্রচুর। পুজোর ঠিক আগে আগে আমাদের ছোট্ট কাঠের ডাকবাক্স ভরে যেতো প্রায় প্রায়। কতোরকমের সে সব চিঠি ! মালদা থেকে শিবুকাকুদের চিঠি আসতো, দাদুর বয়ানে, 'কল্যাণীয়েষু জগন্নাথ'আর বিজয়ার ঠিক পরে প্রত্যেক বছর নিয়ম করে অশ্বিনীকুমার কাকুর চিঠি, একটা গোটা ইনল্যান্ড লেটারের ভেতরে এক প্যারা খুদি খুদি করে লেখা, 'হোপ দিস লেটার ...'উত্তর লিখে দিতাম আমি-ই, সুন্দর হাতের লেখায় যতোটা সম্ভব ছোটো করে একটা পোস্টকার্ডে এক মহাভারত ধরিয়ে ফেলতাম ডিকটেশন নিতে নিতে ... অবশ্য ডাক-ব্যবস্থাও ছিলো আরেক পরাবাস্তব দুনিয়া, মহালয়ার শুভেচ্ছা পেতে পেতে পেরিয়ে যেতো কালিপুজো, কালিপুজোর উত্তর যেতো নিউ ইয়ারের পরে।  

তবে সব চিঠি-ই কি কেজো ছিলো? বাবা বলতেন বাবার নাকি অল্প বয়সে দারুণ দারুণ সব পেন-ফ্রেন্ড ছিলো - একজন ছিলেন নাকি ইজরায়েলের এক মহিলা, যাঁর সাথে আলাপ পাহাড় চড়তে গিয়ে। সুখিয়া-পোকরিতে পোস্টিং ছিলো বাবার, মাইনাস দশ ডিগ্রি, ওরে বাবা। তার মধ্যে বরফ কেটে পাহাড় চড়তে যেতেন বন্ধু জুটিয়ে। সেইখানেই আলাপ। 

আর ছিলো বিখ্যাত সব লোকের উত্তর, তারাশঙ্করের চিঠি, উত্তমকুমারের নিজের হাতে সই করা ফটো। সব-ই, বাবা বলতেন, আছে আমাদের আলমারির ভেতরে দস্তাবেজের ভেতর চেপ্টে, কিংবা ট্রাঙ্কে হারিয়ে যাওয়া জমির দলিলের সাথে মারামারি করতে করতে। অ্যাশট্রে-তে ছাই ঝেড়ে ফেলে দিয়ে বাবা বলতেন, 'সব-ই ছিলো, বুঝলি, আসলে গুছিয়ে রাখার কেউ নেই।'

(এখানে বলে রাখা ভালো, পরে সেই তোরঙ্গ খুলে আমি প্রচুর হাঁটকেছি। দাদুর আমলের গাদা কাগজ আর ফালতু, রদ্দি জিনিষের মাঝে কোনো চিঠি-ই দেখিনি, খালি পেয়েছি একজোড়া কাঁসার ভারী বাসন, যার উপরে খোদাই করে লেখা ঠাকুমার নাম, 'চাঁপারাণী দত্ত')

তবু হতোদ্যম হইনি, ছোটোবেলার কাগজে দেখতাম শ্রেনীবদ্ধ বিজ্ঞাপনের পাতা জুড়ে প্রেমে ব্যর্থ/বশীকরণ, জয়েন্টে সাফল্য আর নাম-বদলের এফিডেভিটের মাঝে একটা-দুটো টিমটিম করছে পত্রমিতালীর ডাক। কখনো নিঃসঙ্গ প্রৌঢ়, অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক সঙ্গ চাইছেন সমমনস্ক মানুষের, অথবা মাঝবয়েসী ব্যবসায়ী বা শিক্ষক চাইছেন নি-ছক বন্ধুতা। 

আমিও প্রায়-ই পনেরো পয়সার পোস্টকার্ড নিয়ে গুছিয়ে চিঠি লিখতাম সেইসব বিজ্ঞাপনের উত্তরে, বলাই বাহুল্য তারা আর যাই চেয়ে থাকুন, আমার চিঠি চান নি। দু-একবার ভেবেছি জ্যোতিষ্ক-র জায়গায় জেসমিন নামে দু-এক পিস পাঠিয়ে দেখি কেমন উত্তর আসে, তারপর বাবার থাবার কথা ভেবে সে আশালতার মূলোচ্ছেদ স্বহস্তেই করেছি।

নিজের চিঠি পাওয়ার আশায় তখন প্রায় জল ঢেলেই দিয়েছি, এই সময় বুঝলাম চিঠি লেখার সবথেকে ভালো উপায় দুমদাম প্রেমে পড়া - সত্যি বলতে তখন মনে হতো মানুষে প্রেমে পড়ে কেবলমাত্র চিঠি লেখার অজুহাত পাবে বলে। অতএব, উর্ধ্বমুখ মুগ্ধচোখে গর্তে দিলেম পা, শুরু হলো অভাগীর স্বর্গ কিংবা ককলিয়ার ২-৩/৪ প্যাঁচের নোটের মাঝে পাচার করা নিষিদ্ধ-গন্ধমাখা চিঠি। 

কিন্তু বিধি বাম ! 

অনেক ভেবেচিন্তে একজন, এবং তার অনতিকাল পরেই আরেকজনকেও চিঠি ধরালাম (কাজটা মোটেও ভালো করিনি, এরা দুইজন বুজুম ফেরেন্ড ছিলেন)। সেসব চিঠির মধ্যে বাছাই-করা কোটেশন, শুধু বাংলা তেমন স্মার্ট না লাগার রিস্ক নেবো না বলে জয়বাবু ও জন ডান একত্রে হাঁটু গেড়ে বসেছেন নীল রঙের খামে। তবুও, তবুও ... কথোপকথন আর হলো না ... প্রেম সেই কৈশোরে নিঃশব্দ চরণে এসেছিলো কিনা জানা নেই, তবে এসেই যে সে সশব্দ চরণে পালিয়েছিলো সে বিষয়ে আমি দৃঢ় নিশ্চিত। 

অগত্যা আউটসোর্সিং ! বন্ধুরা বরাত দিতো, লম্বা চিঠির পারিশ্রমিক একটা আস্ত নেভি-কাট, বিফলে মূল্য ফেরত নাই, তবে সফল হলে আরো কিছু এগরোল-চাউমিন উপরি। লিখেওছি দেদার, যে যেমন চায় ঠিক তেমন - কারুর চিঠি সামান্য ভীতু, বেনামি, 'বুক-ফাটে-তাও-মুখ-ফোটে-না', তলায় সই করা - স্বশিক্ষিত প্রেমিক হলে 'অমিত রায়', অশিক্ষিত ড্যাকরা হলে রাহুল/রাজ। কারুর চিঠিতে শাহ্রুখীয় সেন্টু কিংবা অঞ্জনের গান, আবার কারুর নচিদার স্টাইল, 'এই! তুমি কি আমায় ভালোবাসো?' 

জীবনে কোনো আনন্দ-ই চিরস্থায়ী নয়, হলে জানবেন সেটা জীবন নয়, জি-বাংলা, অতএব এই কেরিয়ারের ইতিও অচিরে। দুই বন্ধুই যে লাবণ্যকে লিখতে বলেছে, সে যে একমেবাদ্বিতীয়ম একজনা-ই, এবং সে যে দুইটি চিঠির স্যাম্পল দেখেই বুঝে যাবেন নিবারণ চক্কোত্তি আর অমিত সব-ই আসলে দাদু ঠাকুর, সে কি আর আমি জানতাম? 

সুন্দর লম্বা চিঠি লিখতো শুভ্রকান্তি, কখনো-সখনো শৌভিক, একবার-আধবার সন্দীপ । শুভ্র একদিন লিখলো ওদের দামোদরের জল শুকিয়ে চড়া পড়ে যায় গরমে, হেঁটে হেঁটে পেরোনো যায় দিব্যি। সে চিঠি যেদিন পৌঁছলো আমার বাড়িঘরময় তখন বন্যার জল থইথই, বাবা ইঁট পাতছেন গলির ভেতরে, আর মা সেই জলের মধ্যে হাঁটুর উপর কাপড় তুলে বালতি বালতি জল ঘরে তুলে রাখছে, আর গলায় তাঁর দীর্ঘদেহী ঈশ্বরের কোনো একটা বর্ষার গান।

এক বর্ষার দিনে শুধু বাড়ি ফিরতে গিয়ে দেখি সেই ইঁটগুলো আর নেই -- গলির মধ্যে জল পাড়িয়ে ঢুকতে গিয়ে কেডস ভিজে যাবে বলে এক শ্রাবণে ভিজে ভিজে বাবা যে ইঁটগুলো পেতে রেখেছিলেন আমার আজন্ম বর্ষাকালে ... সেই প্রকান্ড মহীরুহ তার ডালপালা, তার শেকড়, তার কোটরে বাস করা তক্ষক, তার বর্ষার জলে পাতা ইঁট – সব নিয়ে একদিন চলে গেছেন কোনো একটা দৃশ্যের ওপারে ... সেইখানে যেখানে আর কোনো চিঠি-ই পৌঁছয় না।

হাতে লেখা চিঠির-ও সেই শেষ বসন্ত। দিদির সাথে কাফেটেরিয়ায় গিয়ে ইমেল খুলছি, ইয়াহু আইডিতে নামধাম-জন্মসাল সব দেওয়া, বন্ধুদের সেই কাফে থেকেই ইমেল করলাম, বললাম, শোন এই হচ্ছে আমার ইউজারনেম আর এই হচ্ছে পাসওয়ার্ড, পত্রপাঠ উত্তর দিস প্লীজ। এক সপ্তাহ সে কী উত্তেজনা তারপর, ইনবক্স(১) দেখবো কি পরের বার? রোজ-ই সাইবার কাফের বাইরে চটির মেলা দেখি, পকেটে টাকা গুণে ফিরে আসি চুপচাপ, পরের দিন অফ-টাইমে যাবো, ভর দুপুর বেলা। 

কতো বড়ো হলাম তারপর, কতো হাজার-লক্ষ ইমেল পেলাম, হারিয়ে ফেললাম আস্ত আস্ত ইমেলের বাক্স, নিজের নামের আই-ডি, নিজের আর সেই প্রথম প্রেমিকার নাম জুড়ে আইডি, আর ইনবক্স ভরা কতো ঝগড়া-অভিমান-কতো তুচ্ছ রাগ, হারিয়ে ফেলেছি সব-ই। কতো ইমেল লিখতে হবে কোনোদিন ভাবিনি, কতো ইমেল পেতে চাইনি কোনোদিন, এখন ভাবলে হাসি পায়, আর কেউ দেখার না থাকলে, অন্ধকার ব্যালকনিতে মাঝে মাঝে কান্না-ও। তবু, ইমেল তো, কুটি কুটি করে ছিঁড়ে জানলা দিয়ে উড়িয়ে দেওয়া যায়না হাওয়ায়, পুড়িয়ে দেওয়া যায়না অন্ধ রাগে, লুকোনো যায়না পেঙ্গুইনের পুরোনো পেপারব্যাকটার ঠিক মাঝখানে। একটা ব্যর্থ প্রেমের আবর্জনা পোড়াতে বসলে, একটা মাত্র ডিলিট-এর বোতাম টিপে সুখ হয়, বলুন?  

জয় গোস্বামীর একটা কবিতার বই আছে আমার বইয়ের তাকে, তার ব্যাক কভারে লেখক-পরিচিত-র তলায় লেখা - "শখঃ পুরোনো চিঠি পড়া" ... ছোটোবেলায় পড়তে পড়তে ভাবতাম, কবে সেই বয়সে পৌঁছবো যখন আমার-ও পুরোনো চিঠি থাকবে ! 

তাই এখন ধুলো ঘেঁটে ঘেঁটে বের করি পুরোনো সব হাতে-লেখা চিঠি ... মাঝে মাঝে সে চিঠিগুলো নিজে নিজেই জ্বলে উঠে ছাই হয়ে যায়, আবার মাঝে মাঝে দেখি সেই ছাই থেকে ফিনিক্সের মতন নতুন একটা কবিতা হয়তো জন্ম নিলো ... যদিও এখন দেখছি ছাই-ই বেশী, কবিতা কম ...  

সেই সব হারিয়ে যাওয়া ছাইদের জন্যে এখনো একটু আফশোস রয়ে গেছে মনে মনে, অবশ্য এ-ও ঠিক যে সেসব উদ্ধার হলে যে সমূহ বিপদ একথা অস্বীকার করার উপায় নেই। তাই আশা ছেড়েই দিয়েছি। 

খালি একজন লিখেছিলো, ‘তোকে উপায়হীন ভাবে ভালোবাসি আমি’ ... শুধু সেই চিঠিটা এখনো মাঝে মাঝে খুঁজি ... 


No comments:

Post a Comment