Wednesday, September 6, 2017

“ফসল কাটা মাঠে এখন সদ্যকৃত বধ্যভূমি”

আমি লোরকা-র কথা প্রথম পড়ি শুভঙ্করকে লেখা নন্দিনীর চিঠি-তে, “নতুন কবিতা কিছু লিখেছো কি?
লোরকা পড়ছো খুব? বেশি পড়ো, কম সিগারেট খাও” ... (কথোপকথন ৩)

দিন-কয়েক পরে একটা বাংলায় অনুবাদ করা বই পেয়ে যাই কলেজ স্ট্রীটে, পড়তে পড়তে প্রেমে পড়ে যাই নিজের অজান্তে – কি অদ্ভুত ম্যাজিকে লোরকার কবিতার প্রাগৈতিহাসিক আন্দালুশিয়া হয়ে যায় আমার-ই ভিটেমাটি - তার বইয়ের পাতায় কান পাতলে শুনতে পাই ফ্ল্যামেঙ্কো-র ছন্দ, টের পাই অবিকল শরীরের উত্তাপ আর মরা বাতাসে ফিসফাস করে বয়ে চলে ‘সনেটস অফ ডার্ক লভ’-এর অস্ফুট গোঙানি আর জমে-থাকা চিৎকার ... অনন্ত কুয়োর তলা থেকে উঠে আসা শব্দের মতো।

মাত্র আটত্রিশ বছর বয়সে, ১৯শে আগস্ট, ১৯৩৬, খুন করা হয় লোরকা-কে, গ্রানাডা-র তখতে তখন উগ্র-জাতীয়তাবাদী ফ্যালাঞ্জিস্ট গুন্ডাবাহিনী, আর লোরকা? সোশ্যালিস্ট, স্পষ্টবক্তা, মুক্তচিন্তক, তায় সমকামী, ফ্যাসিস্ত রাষ্ট্রযন্ত্রের সাক্ষাৎ জুজু [১]

তিরিশ-তিরিশটা বছর লেগেছিলো (১৯৭০ অব্দি [২]) শুধু এই কথাটুকু প্রকাশ্যে স্বীকার করতে যে লোরকার খুন ব্যক্তিগত দ্বন্দ্বে-ঈর্ষায় নয়, হয়েছিলো একটি রাষ্ট্রশক্তির হাতে – তাঁর বধ্যভূমি আজ-ও নিশানাহীন ...

লোরকা জানতেন, লোরকা-রা যেমন জানেন, মৃত্যুর অনেক আগেই আর তিনি যেন মিশে যান মার্কেসের সান্তিয়াগো নাসারের সাথে, হত্যার আগেই ঘাতকের ছুরি থেকে ঝরতে থাকে রক্ত, ‘Fable and round of three friends’ এ ভেসে আসে –

“Then I realized I had been murdered.
They looked for me in cafes, cemeteries and churches
.... but they did not find me.
They never found me?
No. They never found me.”

১৯৩৬-এ হত্যা, ১৯৫৩ অব্দি সমস্ত লেখার উপর নিষেধাজ্ঞা, ১৯৭৩-এ ফ্রানিসিস্কো ফ্র্যাঙ্কো মারা না যাওয়া অব্দি লোরকার মৃত্যু (অথবা জীবন) নিয়ে আলোচনা-ও ছিলো অবৈধ, ১৯৮৪-র আগে অব্দি পাওয়াই যায়নি তার ‘ডার্ক লভ’-এর সনেটগুচ্ছ, এখনো কেউ জানেনা শেষ খসড়া কোথায় – তবু লোরকা বেঁচে আছেন, থাকবেন, স্পেনের ফ্যাসিস্ত ফ্যলাঞ্জিস্ট গুন্ডার দল নেই ...

সত্যি বলতে, প্রথমবার পড়ে বিশ্বাস হয়নি, ভাবতে পারিনি একজন দুর্বল, রোম্যান্টিক, প্রেমের কবিকে জল্লাদবাহিনী টেনে দাঁড় করাচ্ছে ফায়ারিং স্কোয়াডের সামনে? একজন কবি-কে? কিসের ভয়?

আর আজ?


পুনশ্চঃ  একটু আগে এক বন্ধুর (অনির্বাণ) দেওয়ালে দেখলাম, আজ সুনীল-বাবুর জন্মদিন, তাই লোরকার স্মরণে তাঁর কবিতার একটু আর না দিয়ে থাকা গেলো না একেবারেই ..[৩]



কবি অত মানুষের মুখের দিকে চেয়ে খুঁজলেন একটি মানুষ
নারীদের মুখের দিকে চেয়ে খুঁজলেন একটি নারী
তিনি দু’জনকেই পেয়ে গেলেন
কবি আবার তাদের উদ্দেশ্যে মনে মনে বললেন,
বিপ্লব দীর্ঘজীবী হোক! মিলিত মানুষ ও
প্রত্যেক মানুষের নিজস্ব বিপ্লব!
প্রথম গুলিটি তাঁর কানের পাশ দিয়ে বেরিয়ে গেল-
যেমন যায়,
কবি নিঃশব্দে হাসলেন
দ্বিতীয় গুলিতেই তাঁর বুক ফুটো হয়ে গেল
কবি তবু অপরাজিতের মতন হাসলেন হা-হা শব্দে
তৃতীয় গুলি ভেদ করে গেল তাঁর কন্ঠ
কবি শান্ত ভাবে বললেন,
আমি মরবো না!
মিথ্যে কথা, কবিরা সব সময় সত্যদ্রষ্টা হয় না।
চতুর্থ গুলিতে বিদীর্ণ হয়ে গেল তাঁর কপাল
পঞ্চম গুলিতে মড় মড় করে উঠলো কাঠের খুঁটি
ষষ্ঠ গুলিতে কবির বুকের ওপর রাখা ডান হাত
ছিন্নভিন্ন হয়ে উড়ে গেল
কবি হুমড়ি খেয়ে পড়তে লাগলেন মাটিতে
জনতা ছুটে এলো কবির রক্ত গায়ে মাথায় মাখতে-
কবি কোনো উল্লাস-ধ্বনি বা হাহাকার কিছুই শুনতে পেলেন না
কবির রক্ত ঘিলু মজ্জা মাটিতে ছিট্‌কে পড়া মাত্রই
আকাশ থেকে বৃষ্টি নামলো দারুণ তোড়ে
শেষে নিশ্বাস পড়ার আগে কবির ঠোঁট একবার
নড়ে উঠলো কি উঠলো না
কেউ সেদিকে ভ্রূক্ষেপ করেনি।
আসলে, কবির শেষ মুহূর্তটি মোটামুটি আনন্দেই কাটলো
মাটিতে পড়ে থাকা ছিন্ন হাতের দিকে তাকিয়ে তিনি বলতে চাইলেন,
বলেছিলুম কিনা, আমার হাত শিকলে বাঁধা থাকবে না!

[১] Documents confirm fascists murdered Spanish poet Federico Garcia Lorca:  http://www.wsws.org/en/articles/2015/04/30/lorc-a30.html
[২] “Lorca and the Gay world”

No comments:

Post a Comment