চতুরঙ্গ

 শক্তির এই কবিতাটি বহুপঠিত, অন্তত আমার বা আমার আগের প্রজন্মের। একাধিক বন্ধুকে বিভিন্ন সময় ঐ যে অমোঘ শেষ লাইনটি, ঐটি আওড়াতে শুনেছি। অথবা, প্রথমটি, অনেক সময় প্রথমের পরেই এক লাফে শেষ, দুটি "চাই না" মিলিয়ে দিয়ে। আমিও কি বলিনি? কোনো একদিন কোনো এক আড্ডার পরে সিগারেট ধরিয়ে বাঁচতে চাই না বলেছি তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে, স্পষ্ট মনে পড়ে।

অবশ্য তখন বয়স ব্যাপারটা ছিল সেই বাঘের মত যার পিঠে দিব্যি উঠে পড়া যেতো, নেমেও পড়া যেত ইচ্ছে করলে। আর এখন যখন মাঝে-মাঝেই বয়স-বয়স করে একটা তীব্র হা-হুতাশ ওঠে বন্ধুদের আড্ডার ঠেকে, তখন মাঝে মাঝে বিরক্ত হয়ে জানলা দিয়ে আকাশের দিকে তাকালে মনে হয় মেঘের মধ্যে দিয়ে যেন কেউ এই লাইনটি লিখে দিয়ে যাচ্ছেন, দৈববাণীর মত নয়, দৈবাদেশের মত। মনে হয়, এই যে মানুষের কী তীব্র আকুতি দীর্ঘ জীবনের, দীর্ঘ-নীরোগ জীবনের, জীবন প্রকৃত অর্থেই যন্ত্রণাময় এবং পরাহত জেনেও, এই এক অদ্ভুত রহস্য। একেই হয়ত বিভূতিবাবু বলতেন রোমান্স। পথের পাঁচালির সেই লাইনগুলি মনে পড়ে বারংবার।
"আজ একথা বুঝি ভাই যে, সুখ ও দুঃখ দুই-ই অপূর্ব। জীবন খুব বড় একটা রোমান্স — বেঁচে থেকে একে ভোগ করাই রোমান্স — অতি তুচ্ছতম হীনতম, একঘেয়ে জীবনও রোমান্স। এ বিশ্বাসটা এতদিন আমার ছিল না। ভাবতুম লাফালাফি ক’রে বেড়ালেই বুঝি, জীবন সার্থক হয়ে গেল—তা নয়, দেখলুম ভাই।
এর সুখ, দুঃখ, আশা, নিরাশা আত্মার যে কি বিচিত্র, অমূল্য য়্যাডভেঞ্চার, তা বুঝে দেখতে ধ্যানদৃষ্টির প্রয়োজনীয়তা আছে, তা আসে এই রহস্যমাখা যাত্রাপথের অমানবীয় সৌন্দর্যের ধারণা থেকে।"
শেষমেশ কী ভাবি আমি? জানি না। এক একদিন এই সকালে উঠে জানলার কাচে বৃষ্টির ফোঁটার উপর দেখি আলো পড়ে যেন গয়না বানিয়ে দিয়েছে কেউ। মনে হয় রোম্যান্স। তারপর দিন শুরু হয়, ফোন খুলি, ল্যাপটপ খুলি, ইমেল করি, হোয়াটস-অ্যাপে তরজায় মাতি, ফেসবুক খুলি, খুলেই বন্ধ করে দিই, তারপর আবার খুলি। দুর্ঘটনার সাঙ্ঘাতিক সব খবর ভেসে ওঠে, বা ঘৃণারাক্ষসের নতুন কোনো শিকার - তার ভিডিও আসে, দেখি। বা দুঃসংবাদ আসে বন্ধুদের কাছ থেকে, মৃত্যু অথবা দীর্ঘ দাম্পত্যের বিচ্ছেদ, আমাদের আপততঃ এইই প্রথম পাতার খবর। "সর্বম দুঃখম দুঃখম"। জন্ম দুঃখ, জরা দুঃখ, মৃত্যু দুঃখ, অপ্রিয় সংযোগ দুঃখ, প্রিয় বিচ্ছেদ দুঃখ, ঈপ্সিতের অপ্রাপ্তি দুঃখ। আড়াই হাজার বছর আগে সারনাথে বুদ্ধদেব বলেছিলেন।
মনে পড়লো, নিল গাইম্যানের বইয়ের শুরুতে লেখা ছিল, 'এভরি আওয়ার উণ্ডস, দ্য লাস্ট ওয়ান কিলস।' নিল গাইম্যান যে ভেতরে এক রাক্ষস সেটা জেনেও ঐ লাইনটা মুছে ফেলতে পারলাম আর কৈ? কেন উনি রাক্ষস হলেন? আমাদের কথা একটিবার ভাবলেন না?
যাইহোক, আর দুঃখ-দুঃখ করে লাভ নেই। একশো আটটা ইমেল করতে হবে। তারপর কাজ করতে হবে। তারপর বইপড়া।

Comments

Popular posts from this blog

কামাই

যে ভাষায় আমের নাম ...