ঋতেন্দ্রনাথ


ঋতেনদা (ছবিটি তোলা অনিরুদ্ধ নিয়োগী, ওরফে নিও-দা'র)

'আমাদের দিনগুলিও অপূর্ণ, অপূর্ণ আমাদের রাত্রি, তবুও হাত ফস্কে জীবন চলে যায় যেন অকম্পিত ঘাসের মধ্যে একটি মেঠো ইঁদুর।' লিখেছিলেন এজরা পাউন্ড। জীবনের দিকে, এবং বারবার এই সন্ধেবেলায় নিজেদের দিকে তাকিয়ে মনে হয়েছে সত্যিই অদ্ভুত ঘটনাহীন জীবন যেন নিস্তরঙ্গ দুপুরের উঠোন। পুকুরের বুক চিরে ব্যাঙাচি খেলার মত একটা করে ঢিল ছুটে যায় মাঝেমাঝে - সত্যিই কি জলের স্তর চিরে যায়? চেরে না। মাঝে মাঝে মনে হয় জীবন যেন ঐরকম, কত কিছু হয়ে যায় দাগ পড়ে না।


তবু সেইসব নিস্তরঙ্গ দিনগুলোর মধ্যে একদিন একটা বিপর্যয় ঘটে যায়। আমরা বোঝার আগেই একটা অন্য পৃথিবীতে গিয়ে পৌঁছুই। আর জেনে যাই - সময় দুইরকম হয়। বিপর্যয়ের আগে, আর বিপর্যয়ের পরে। 'যেমন অসত্য ছিল দীর্ঘ গতকাল, যেমন অসত্য হবে অনন্ত আগামী'। 

আগামী তবুও আসবেই। আমরা তো আসলে মনে মনে জানি যে সেকেণ্ড ল' অফ থার্মোডায়নামিক্স বলেছে, যে টোটাল এন্ট্রপি কমতে পারে না, সময়ও শুধু সামনের দিকেই চলতে পারে। যেভাবেই সে যাক না কেন। তাই সেই ঘন্টা, মিনিট, সেকেণ্ড একদিন নরম করে দেবে এইসব যন্ত্রণা। তবে, কোথাও একটা ছোট্ট গর্ত থেকে যাবে বুকের ঠিক বাঁদিকে। 

গর্ত, অথবা নিঝুম ডাকবাক্স। জানি না। তবে আমার সেই নিঝুম ডাকবাক্সে ঋতেনদার জন্য একটা চিঠি থাকবেই। ঋতেনদাকে লিখবো, যে না তুমি তো শালা কিছুই জানো না হে, আসলে নিউট্রন স্টার নয়, এক চামচ শোকের ওজন আসলেই পৃথিবীর সমস্ত জীবজগতের সমান-সমান পাল্লায়। এক রত্তিও কম-বেশি নয়। 

---

ঋতেনদার সাথে আমার আলাপ ২০০৩ সালের আগস্ট মাসের কোনো এক পড়ন্ত বিকেলে। আমাদের বিস্ট্যাটের ক্লাস শুরু হয়েছে সেদিন, লাঞ্চব্রেকের আগেই অমর্ত্য দত্তর ক্লাসে গ্যালোয়ার টাওয়ার অফ ফিল্ড-টিল্ড শুনে তখন কান দিয়ে ধোঁয়া-টোঁয়া বেরোচ্ছে, এই অবস্থায় ক্যান্টিনের রাস্তায় আকর্ণবিস্তৃত নিষ্পাপ হাসি মেখে একজন ভালোমানুষ গোছের দাদা এগিয়ে এলেন। ঋতেনদা। 

ঋতেনদার তখন থার্ড ইয়ার। আমাদের ফার্স্ট। তো সেই অর্থে আমরা ক্লাসমেট নই, বরং গ্লাসমেট বললে খুব অত্যুক্তি হয় না। যারা জানে তারা জানে, আমাদের সেই পাপবিদ্ধ আঠেরো-কুড়ির অলৌকিক ছাদপার্টিতে নান্দীপাঠ অর্থাৎ প্রেসিডেন্ট'স স্পিচ দিতেন ঋতেন মিত্র। 

তো সেই গ্যালাখ্যালার রাত্রিদিন থেকে এই দুঃস্বপ্নের গত সপ্তাহ অব্দি আমাদের চেনাচিনির দৈর্ঘ্য নয়-নয় করেও প্রায় বাইশটি বছর। আমিও পাশ-টাশ দিয়ে এদিক-ওদিক ঘুরে এই অবক্ষয়ী পশ্চিম দিগন্তে এসে ছাত্র চরানো আর পেপার ছড়ানোকেই জীবনের ব্রত জ্ঞান করেছিনু, ঋতেনদাও তাই। আমাদের দুজনের-ই রিসার্চ এরিয়া বেইজিয়ান মেথোডোলজি, তার মধ্যেও খুব-ই কাছাকাছি জিনিষের কাজ। তাই কনফারেন্সে আমরা একসাথে সেশন করেছি - একসাথে কাজ করবো বলে বিভিন্ন পেপার চালাচালি করে ঠিক করেছি যে আগে ভালো করে, মানে সত্যিকারের ভালো করে সবক
টা পেপার পড়ে ফেলা যাক। তারপর একটা জম্পেশ কাজ নামানো যাবে। সে অবশ্য আর করা হয়ে ওঠেনি। 

আমি, ঋতেনদা, ঈপ্সিতাদি, অর্পিতাদি, আর শান্তনুদা। কোনো এক চায়ের আড্ডায়। 

সিয়াটলের কনফারেন্সে আমি, সাদাগু, অর্ণব-দা আর ঋতেনদা। এই ছবি দেখে মামু জিজ্ঞেস করেছিলো, "তোমাদের কী খাঁচায় ভরে রেখেছিল?"

এই কনভেয়ার-বেল্টে মাস-প্রোডিউসড পেপারের বাজারে একদিন ঋতেনদাই আমাকে দুম করে বলেছিল, একটা সাব-সাব-সাব টপিক খুব ভালো করে পড়ে ইমবাইব করাটাও একটা কন্ট্রিবিউশন। আর বলেছিল যে একটা বিস্তৃত ফিলোজফিক্যাল ফ্রেমওয়ার্ক তয়ের করতে হবে প্রথমে, চিন্তাভাবনার একটা বড়ো পরিসর, সেখান থেকে আস্তে আস্তে ডিটেইলসে যেতে হবে। সব-ই হাঁ করে শুনেছি, তারপর বেমালুম ভুলে ছাপাখানার ভূতের মত গাদা পেপার লেখায় মন দিয়েছি। 

তবে, একাডেমিক এটাসেটা আসলে এপসাইলন। ঋতেনদার সাথে আমার একটি গুরুতর পরিচয় আছে। আছেই লিখি কারণ ছিলো-তে অভ্যস্ত হতে এখনো বহু-বহুদিন সময় লেগে যাবে। গুরুচণ্ডা৯-তে আমাকে নিয়ে এসেছিল ঋতেনদাই। গুরুর থেকেই বই বেরুলো যখন, তার অসামান্য ভূমিকাটাও লেখা ঋতেনদার-ই। 'আমরা একত্রে আছি বইয়ের পাতায়।' 

প্রায়ই গুরুর-ই ১০৮-টা বিভিন্ন হোয়া-গ্রুপে আমরা খিল্লি করতাম, কখনো মৃদু পিএনপিসি, গোপন কেচ্ছা। আমি ঠাট্টা করে বলতাম ঋতেনদার নিশ্চয়ই একটা এ্যাই ফিল্টার লাগানো আছে, কোথাও কুচ্ছো কীওয়ার্ড দেখলে একটা বৈদ্যুতিক শকওয়েভ ছুটে যায় লুইভিলের আইভরি টাওয়ারের চূড়ায়। শেষদিন অব্দি সেইসব খিল্লি করে গেছি - ঋতেনদা বলেছে জ্যোতিষ্ক আর সুনন্দ ভালো ছেলে, আর আমি বলেছি না না আমরা তো সিক্রেটলি গাছহারামি। 

খিল্লিই ঋতেন্দ্রনাথের অন্য নাম। খিল্লি আর সেই ফ্যাচফ্যাচ করে হাসি। যেরকম হাসি শেষ হেসেছিলো সেই হযবরল'র বেড়াল। এই যে এখন ঋতেনদা আর নেই, আমি জানি, আমি ঠিক জানি শালা মেঘের উপরে মেঘের ওপারে কোথাও অলক্ষ্যে বসে ফ্যাচফ্যাচ করেই হাসছে। একবার ঋতেনদার বাওয়ালি-স্পৃহা দেখে পদ্য লিখেছিলাম, 

"অতর্কিতেই ফেসবুক জুড়ে কোন্দল লাগে কী বিচিত্র।
নতুন একটা বাওয়ালি করতে মাঠে নামলেন ঋতেন মিত্র।"

এই বছর দুই কি তিন আগে, আমি ব্রিগহ্যাম ইয়াং ইউনিতে যাচ্ছি একটা টক দিতে। একদম উত্তুরে উটাঃয়। চার্চ অফ জেসাস ক্রাইস্ট অফ লেটার-ডে সেন্টস অর্থাৎ মরমন-দের রাজ্য। যেতে যেতেই সার্চ করে জানতে পারলাম যে মর্মনরাজ্যে কফিটাও পাওয়া যায় না। একটু রুষ্ট হয়ে সেই কথাটা ঋতেনদাকে বলতেই, ঋতেনদা হাঁহাঁ করে উঠে বললো না না ওরা খুব উপকারী প্রাণী। ঋতেনদা টেক্সাসে পোস্টডক করার সময় একবার নাকি  বাড়িতে অনেক সুন্দরী মর্মন এসে অনেক সাহায্য-টাহায্য করে দিয়েছিল। সেই ঘটনায় আপ্লুত হয়ে ঋতেনদা সেই সন্ধ্যেতেই একটি স্বরচিত রবীন্দ্রসঙ্গীত-ও লিখেছিল, "আজি মরমন-ধ্বনি কেন বাজিল রে!" (সুর প্রচলিত।) 

তবে উইটি লোকের উইট কি শুধুই খোঁচা দেয়? মলম লাগায় না? মোট্টেই না। সেই সেকেণ্ড বা থার্ড ইয়ারের-ই গপ্পো। আমি সেমিস্টার পরীক্ষায় খুব-ই ধেড়িয়েছি। ঋতেনদা আমাদের কয়েকজনকে মদ খাওয়াতে নিয়ে গেলো। গিয়ে বলল ঐ স্যারের নামে একটা থিওরেম আছে, ডিপিএসজি থিওরেম, সেটা বলে যে পড়াশুনো, নম্বর, আর প্রশ্নের ডিফিকাল্টি - এই তিনটে মিউচুয়ালি ইন্ডিপেন্ডেন্ট। তবে হ্যাজ আর নম্বর প্রোপোর্শনাল, তাই না জানলেও কিছুটা হ্যাজ লিখলে ডিপিএসজি দয়াপরবশ হয়ে অল্প নম্বর দিয়ে দেন। চট করে স্ট্যাটিস্টিকাল ইন্ডিপেন্ডেন্স আর পরীক্ষায় সাফল্যের চাবিকাঠি - দুটোই বশ হয়ে গেলো। 

অবশ্য ইন্ডিপেন্ডেন্সের লজিক লাগিয়ে ফ্রেঞ্চ-ও শিখতে উদবুদ্ধ করেছিলো ঋতেনদা। বলেছিল সহি আঁতেল হ'তে গেলে একটু ফরাসী আবশ্যক। খালি শেখার সময় মনে রাখতে হবে, সে ভাষার বানান আর উরুশ্চারণ ইনডিপেন্ডেন্ট। 

অবশ্য আজীবন বামপন্থী (তাও আবার অসিপিএম বাম) মানুষের এইসব টোটকা একটু লাগে। ভোটের ফলের আগের দিন হেব্বি-হেব্বি সব প্রেডিকশন আসছে এবার সিপিএম গোটা দশের সিট নামাবেই নামাবে। ঋতেনদা শুনে-টুনে বললো দ্যাখ আমরাও পরীক্ষার ছড়িয়ে এলে বাড়িতে এসে বলতাম দারুণ দিয়েছি। অন্তত রেজাল্ট না বেরুনো অব্দি শান্তি! 

---

ঠাকুমা-ঠাকুরদার গল্প শুনেছি ঋতেনদার কাছে। অথচ, সেই ঠাকুমাই যে স্বয়ং ইলা মিত্র সে কথা জেনেছি অনেক অনেক পরে। নাঃ, ঋতেনদা বলেনি, বলেছে অন্য কেউ। পড়েওছি তারপর। অসামান্য একটা ব্লগ-পোস্টে। যে ইলা মিত্রর কথা শুনেছি কোন ছোটোবেলায়, যাকে নিয়ে লেখা কবিতা, গান শুনেছি, শিউরে উঠেছি ইতিহাস পড়ে - সেই তিনিও একজনের, খুব চেনা একজনের ঠাকমা। জোর করে সক্কাল-সক্কাল ঘুম থেকে তুলে সাঁতার কাটতে নিয়ে যাওয়া, আর দৌড়ে মিনিবাসে উঠে পড়া ঠাকমা। 

ঋতেনদার সেইসব লেখা পড়তে পড়তে একাধিকবার মনে হয়েছে এই লোকটা স্ট্যাটিস্টিক্স না পড়ে শুধু মন দিয়ে বাংলা বা ইংরেজি যে কোনো একটা ভাষায় মন দিয়ে লিখলেও বিখ্যাত হয়ে যেতো। 

আর পড়েছি অজস্র খুচরো ফাজলামো করা লেখা, বেনামে, ছদ্মনামে লেখা সব ভয়ঙ্কর মজার টইপত্তর - গুরুতে। সৃজন সমাদ্দার নামে লেখা 'দোল ইন্টারন্যাশনাল' এখনো দুম করে খুলে পড়লে যে কোনো গোমড়া দিনে দিল তর হয়ে যেতে বাধ্য। আর ঋদ্ধি নামে সেই যে সব অসামান্য সিনেমালোচনা? 

বাইশে শ্রাবণের সেই বিখ্যাত টইতে রাইমা সেনের বর্ণনা, "খারাপ অভিনেত্রী নয়, মিষ্টি হাবভাব , তবে ঐ হাফ পরোটা ভর্টিকালি ইলোঙ্গেট করে সেন্টারে দুটো মুর্গির ডিমের মত চোখ ফিট করা মুখে আর কত ভিন্ন এক্সপ্রেশান আসবে? ঐ নেকু নেকু মিষ্টি কাটিং ছাড়া?" এই এতো বছর পরেও, এখনো টিভি কি বড়পর্দায় রাইমাকে দেখলেই এই একটি লাইন মনে পড়লেই আমিও ফ্যাচফ্যাচ করে হাসি - সে দৃশ্য যতোই বিয়োগান্তক হোক না কেন। 

না হাসলে অবশ্য মুশকিল। আমাদের কোথায় যেন একটা গ্রুপ ফোটো উঠেছিল গোমড়া মুখে। সবাই এদিক-ওদিক তাকিয়ে। কারুর মুখে হাসি নেই। ঋতেনদা দেখে সখেদে বলেছিল, এ যেন মৃণাল সেনের সিনেমার প্রতি পারফেক্ট ট্রিবিউট। ব্লীক, ডিপ্রেসিং, অন্ধকার, সবাই বিষণ্ণ এবং মরকুটে। এ কী বিশ্রী ব্যাপার! 

--- 

মরকুটে তাই থাকবো না ঋতেনদা। খিল্লি করবো গুছিয়ে। দুপুরবেলা গাছের তলায় বসে হারিয়ে ফেলবো চাবি আর ল্যাপটপ। আনমনে হাঁটবো পড়ন্ত বিকেলের কালভার্টে। জীবনটাকে ফুঁকে দেবো বেমালুম। 

একদিন তবে দেখা হবে ঠিক-ই। কোনো এক রাত্রির পারে অলৌকিক ভোরের ছাদে। আপাততঃ সেই দিনের উদ্দেশ্যে, 'উল্লাস কমরেড!' 



Comments

Popular posts from this blog

কামাই

যে ভাষায় আমের নাম ...