"স্বার্থপরতাই আমাদের সমষ্টিগত দুর্দশার দিকে নিয়ে যেতে পারে"

কেউ দুইডোকু খেলেছেন? খেলে দেখতে পারেন, মন্দ না। সুডোকু-ই কিন্তু খেলতে হবে দুইজনে। যে শেষ "ভ্যালিড" চাল দেবে সে জিতবে। সঙ্গে একজন খেলার সঙ্গী থাকলে তো কথাই নেই, না থাকলেও https://www.duidoku.com/ সাইটে এখন এ্যাই-এর সাথে খ্যালা যাচ্ছে। আমি আবার হেব্বি আনতাবড়ি খেলে প্রথম রাউন্ডে এ্যাই-কে হারিয়ে দিলাম। মনে হচ্ছে ভালো কোম্পানির এ্যাই না। হয়তো শীর্ণ নিউরাল নেট। কে জানে!

এই খেলাটার কথা জানতে পারলাম একটি খ্যাতনামা অর্থনীতিবিদ কৌশিক বসুর উপরেই অমিতাভ গুপ্ত-র লেখা একটি ফিচার থেকে। কৌশিকবাবু ট্রাভেলার্স ডিলেমা নিয়ে গতবছর শারদীয়া উদ্বোধনে একটা প্রবন্ধ লিখেছিলেন। সেটা আতিপাতি করে খুঁজতে গিয়ে অমিতাভ গুপ্তর লেখাটা পেলাম। বলাই বাহুল্য, ট্রাভেলার্স ডিলেমা, দুইডোকু দুটোই কৌশিকবাবুর মস্তিষ্কপ্রসূত।

যাই হোক, উদ্বোধনের প্রবন্ধটা যখন পাই-ই নি, ট্রাভেলার্স ডিলেমা কী সেটাও ছোটো করে নিজের ভাষায় বলে দিই। আমি একদম অজ্জিনাল থেকেই চোথা করে দিচ্ছি। তাও, আমার বন্ধুদের মধ্যে প্রচুর প্রচুর দারুণ অর্থনীতির ছাত্রছাত্রী আছে, ভুলভাল বললে কেউ ঠিক করে দেবে আশা করছি।

ধরা যাক দুজন লোক - রামবাবু আর শ্যামবাবু ফরেন ট্যুর সেরে দেশে ফিরছেন। দুজনের লাগেজে দুটি আইডেন্টিকাল অ্যান্টিক দ্রব্য। ফিরে দেখছেন এয়ারলাইন্সের বদান্যতায় ওদের দুজনের-ই অ্যান্টিক চোট পেয়েছে। এয়ারলাইনের ম্যানেজার ক্ষতিপূরণ দিতে চান, কিন্তু তাঁর আবার ঐ বস্তুটির দাম কত সেই নিয়ে কোনো ধারণা-ই নেই আর দুজনকে দাম জিজ্ঞেস করতে মোট্টে চান না, কারণ জিজ্ঞেস করলে নির্ঘাত বাড়িয়ে-চাড়িয়েই বলবে দুজন।

এই অবস্থায় ম্যানেজার বাবু একটা জটিল স্কিম বা খেলা মাথা থেকে বের করলেন। খেলাটা এই রকম : রাম আর শ্যাম দুজনকেই একটা চিরকুটে ২ থেকে ১০০-র মধ্যে একটা পূর্ণসংখ্যা লিখতে হবে। কিন্তু নিজেদের মধ্যে আলোচনা করা বারণ। যদি দুজনেই এক-ই সংখ্যা লেখেন, ম্যানেজার ধরে নেবেন ঐটিই সঠিক দাম, আর সেটাই হাতে ধরে দেবেন। যদি দুজনে আলাদা আলাদা সংখ্যা লেখেন, তাহলে, ম্যানেজার ধরে নেবেন যে কম লিখেছে সে-ই সত্যি বলেছে, অর্থাৎ সে যেটা লিখেছে সেটাই, মানে সেই লোয়ার ভ্যালুটাই আসল দাম, আর অন্যজন ঠকানোর চেষ্টা করছে। এবার ঐ ম্যানেজার রাম-শ্যাম দুজনকেই ঐ দামটা (লোয়ার ভ্যালু) তো দেবেন-ই, কিন্তু একজনকে অল্প পুরস্কার আর অন্যজনকে শাস্তি। যিনি কম লিখেছেন তাকে দেবেন ঐ লোয়ার ভ্যালুর থেকে ২টাকা বেশি, আর যে বেশি লিখেছেন তাকে দেবেন ঐ লোয়ার ভ্যালুর থেকে দুটাকা কম। অর্থাৎ, যদি রাম চিরকুটে লেখে ৪৬, আর শ্যাম লেখে ১০০। তাহলে ম্যানেজার রামকে দেবেন.৪৬ + ২ = ৪৮, আর শ্যামকে দেবেন ৪৬ - ২ = ৪৪।

এবার গপ্পো হচ্ছে যে সত্যিকারের খেলা-টা খেলা হলে রাম আর শ্যাম কী লিখতো? আপনি-ই যদি এইরকম সিচুয়েশনে পড়েন, আপনি-ই বা চিরকুটে কী লিখবেন?

১৯৯৪ সালের পেপারে কৌশিক বাবু দেখিয়েছিলেন যে এইরকম গেমের "লজিক্যাল" সলিউশন দুজনের-ই ২ লেখা। গেম থিওরির ভাষায় বললে এই গেমের ন্যাশ ইকুইলিব্রিয়াম একটাই, এবং সেটা ঐ (২,২)। মানে রাম-ও দুই, শ্যাম-ও দুই।

কিন্তু গাদা-গাদা এম্পিরিক্যাল/প্র্যাকটিক্যাল পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখা গেছে যে লোকে সচরাচর ১০০ বা ১০০-র কাছাকাছি কিছু একটা লেখে। কৌশিকবাবুর ২০০৭ সালের সায়েন্টিফিক আমেরিকানের প্রবন্ধে সুন্দর করে সামারাইজ করা, "When playing this simple game, people consistently reject the rational choice. In fact, by acting illogically, they end up reaping a large reward - an outcome that demands a new kind of formal reasoning."

কেন (২,২)? সেইটার যুক্তি ব্যাকওয়ার্ড ইনডাকশন। ইনডাকশনের কী যেন একটা বাংলা ছিলো ভুলে গেছি। যাই হোক, গপ্পোটা এইরকম যে ধরা যাক শ্যাম ভাবলো যে সবথেকে বড় নাম্বারটাই লেখা উচিত, তাই সে ১০০ লিখবে, আর রাম-ও যদি এক-ই যুক্তি অনুসরণ করে তা'লে রাম-ও ১০০-ই লিখবে। আর আসল জিনিষটার দাম ১০০-র অনেক কম হলে তো পোয়াবারো।

কিন্তু তারপরেই শ্যাম ভেবে দেখলো, সে যদি ১০০ না লিখে ৯৯ লেখে, আর রাম ১০০ লেখে, তাহলে কিন্তু অল্প হলেও বেশি লাভ। কারণ ঐ খেলার নিয়ম অনুযায়ী সে এখন পাবে ৯৯ + ২ = ১০১, আর অন্যজন পাবে ৯৯-২ = ৯৭। কিন্তু যদি রাম-ও মাথা খাটিয়ে ৯৯ লেখে? তাহলে তো দুজনেই ৯৯? তাহলে শ্যামের লেখা উচিত ৯৮, তাতে করে রাম ৯৯ লিখে থাকলে সে পাবে ১০০ আর রাম পাবে ৯৭। কিন্তু আবার-ও এক-ই যুক্তিতে রামের উচিত ৯৯ না, ৯৮ লেখা। "অ্যান্ড সো অন অ্যান্ড সো ফোর্থ।" এই যুক্তিতে একে অন্যকে কাঠি করে নিজের লাভ করতে গেলে দেখা যাবে যে একদম সাপ-লুডোর মত সাপ দিয়ে নামতে নামতে দুজনেই নেমে পৌঁছে যাবে একদম সবথেকে ছোট্ট সংখ্যায় - সেটা ঐ "২"।

আমার স্মৃতিশক্তি জঘন্য, ফলস মডেস্টি না সত্যিই জঘন্য, কিন্তু কৌশিকবাবুর লেখার গুণেই উদ্বোধনের প্রবন্ধটা একটা লাইন আমার মাথায় গেঁথে আছে। সেটা এইরকম যে, "স্বার্থপরতাই আমাদের সমষ্টিগত দুর্দশার দিকে নিয়ে যেতে পারে"।

এর খুব কাছাকাছি আরেকটা গেম আরও বেশি পরিচিত। সেটার নাম প্রিজনার্স ডিলেমা। সেটা এইরকম যে দুজন অপরাধী, এও ধরা যাক রাম আর শ্যাম, দুটো আলাদা আলাদা কুঠুরিতে বন্দী - যোগাযোগের উপায় নেই। পুলিশের দারোগাবাবু দুজনকেই একটা ফাউস্তিয়ান বার্গেন দিলেন। যদি দুজনেই মুখে কুলুপ এঁটে থাকে, তাহলে দুজনেই এক বছর করে জেল খাটবে, আর দুজনেই মুখ খুললে, অর্থাৎ সাক্ষ্য দিলে, দুই বছর করে। কিন্তু, যদি একজন সাক্ষ্য দেয় আর অন্যজন চুপ থাকে? তাহলে যে সাক্ষ্য দিচ্ছে সে সঙ্গে-সঙ্গে ছাড়া পেয়ে যাবে, আর অন্যজন জেল খাটবে তিন-তিনটে বছর। বালাই ষাট, কেউ জেলে যান চাই না, কিন্তু ঐ এক-ই প্রশ্ন। এইরকম পরিস্থিতিতে কী করতেন? সহযোগিতা না বিশ্বাসঘাতকতা?

এই গেম থিওরির অতিপরিচিত উদাহরণগুলোর কথা আজ সন্ধ্যেবেলায় বাড়ি ফিরতে ফিরতে আবার মনে পড়লো, কারণ, দুইদেশের দুইটি বিষাক্ত মৌলবাদী দলের আস্ফালন আর সংখ্যালঘুদের উপর অত্যাচার দেখতে দেখতে মনে হয়, যে ঐ ট্রাভেলার্স ডিলেমার মতোই কিছু একটা হচ্ছে যেন, পরের যাত্রাভঙ্গ করতে গিয়ে কখন যে নাক-নরুণ সব-ই চলে যাচ্ছে তার আর ঠিক নেই। অথচ, একজন অচেনা মানুষের প্রতি সহজ স্বাভাবিক বিশ্বাসের বা একদম সামান্য, ন্যূনতম বিশ্বাসের একটুখানি খোলা জায়গায় আলোবাতাস খেলতে দিলেই হয়তো এই অন্ধকারে আমরা পৌঁছতাম না, কে জানে?

--

পুনশ্চঃ আমি যেসব জিনিষ ছেলেবেলায় সুযোগ পেয়েও মন দিয়ে পড়িনি সেগুলো বুড়ো বয়সে পড়ছি আবার করে। এই যেমন হোমস-মরিয়ার্টি প্রবলেম, সেই যে হোমস লণ্ডন থেকে ডোভারে যাচ্ছে মরিয়ার্টির থেকে পালিয়ে, ডোভার-ই শেষ স্টেশন, মাঝে ক্যাণ্টারবেরি। কিন্তু, ঠিক ট্রেনটা স্টেশন ছাড়ার সময় হোমস দেখছেন প্ল্যাটফর্মে মরিয়ার্টি দাঁড়িয়ে। এবার হোমস কোথায় নামবেন? একেবারে সোজা ডোভার চলে যেতেই পারেন, কিন্তু ধড়িবাজ মরিয়ার্টি হয়তো আরো দ্রুতগামী ট্রেন বা অন্য কিছুতে করে সেখানে আগেই পৌঁছে গেছে? তাহলে হোমস নামবে ক্যান্টারবেরি। কিন্তু মরিয়ার্টি যদি আন্দাজ করে যে হোমস মরিয়ার্টির চাল আন্দাজ করে নিয়ে ক্যান্টারবেরি নামবে, তাহলে মরিয়ার্টি-ও আর ডোভার না গিয়ে যাবে ক্যান্টারবেরি? আর এক ধাপ এগোলে, হোমস যদি আন্দাজ করে যে মরিয়ার্টি হোমসের চাল আন্দাজ করে ক্যান্টারবেরি-ই যাচ্ছে, তাহলে হোমস থোড়াই সেখানে যাবে ... এইভাবে চলবে তো চলবে, অথবা বলা ভালো, এইভাবে এগোলে দেখা যাবে যে দুজনের কারুর পক্ষেই বেস্ট স্ট্র্যাটেজি নেওয়া সম্ভব নয়, এই অর্থে যে নিতে গেলেই এইরকম একটা ইনফাইনাইট রিগ্রেসের ব্যাপার ঘটে যায়।

ফাইন্যাল প্রবলেমের সেই বিখ্যাত ডায়লগ মনে করুন -

‘All that I have to say has already crossed your mind,’ said he.
‘Then possibly my answer has crossed yours,’ I replied.
‘You stand fast?’
‘Absolutely.’

এই নিয়ে অস্কার মর্গ্যানস্টার্নের বিখ্যাত একটা পেপার আছে, যার বক্তব্য হ'ল "perfect foresight is inconsistent with economic equilibrium", এই নিয়ে মর্গ্যান্সটার্ন আর আমাদের ম্যান ফ্রম ফিউচার জন ভন নয়ম্যানের যুগ্ম কাজ আছে। আর আমাদের পার্ডুর অনির্বাণদার একটা ভারি সুন্দর কলাম আছে আই-এম-এস বুলেটিনে, নাম "Randomization, Bootstrap and Sherlock Holmes"।

কিন্তু আজকে ঘুম পেয়ে গেছে, আরেকদিন লিখবো সে সব।

সূত্রঃ


১) https://www.anandabazar.com/culture/poila-baisakh/a-special-write-up-on-kaushik-basu-by-amitabha-gupta-1.597792
২) https://imstat.org/2013/07/17/anirbans-angle-randomization-bootstrap-and-sherlock-holmes/
৩) https://www.duidoku.com/
৪) Basu K (2007) The Traveler’s Dilemma. Sci Am 296: 90–95
৫) The Traveler’s Dilemma: Paradoxes of Rationality in Game Theory. Kaushik Basu in American Economic Review, Vol. 84, No. 2, pages 391–395; May 1994.

Comments

Popular posts from this blog

কামাই

যে ভাষায় আমের নাম ...