৩১শে অক্টোবর, ১৯৮৪
--- ১
----
আজ থেকে ঠিক চল্লিশ বছর আগের কথা। ১৯৮৪! নাইনটিন এইট্টি ফোর। অরওয়েলের
ডিস্টোপিয়ান উপন্যাস সার্থকনামা মনে হতে পারে পরপর ঘটনার দিকে তাকালে। এই এক বছরের
ইতিহাসে খোদাই করা থাকবে একের পর এক জ্বলন্ত অঙ্গারের দাগ।
চট করে ঝালিয়ে নেওয়া যাক। এই চুরাশিতেই, একদিকে প্রথম ও একমাত্র
ভারতীয় মহাকাশচারী রাকেশ শর্মা সয়ূজ টি-ইলেভেনে চেপে পাড়ি দিচ্ছেন অনন্ত শূন্যের দিকে,
গ্রীষ্ম অলিম্পিকসে ১/১০০ সেকেন্ডের জন্য পদক হাতছাড়া হচ্ছে সোনার মেয়ে পিটি ঊষার,
প্রথম ভারতীয় পর্বতারোহী হিসেবে বাচেন্দ্রী পাল স্পর্শ করছেন এভারেস্ট, আর অক্টোবর
মাসে যাত্রা শুরু করছে কলকাতার পাতাল রেল।
আবার এই ১৯৮৪-তেই পাঞ্জাবে
বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনের হিংসাত্মক কার্যকলাপের জেরে জুন মাসে শুরু হচ্ছে অপারেশন
ব্লু-স্টার - অমৃতসরের স্বর্ণমন্দিরে সামরিক
অভিযান। উগ্রপন্থীদের সাথে সেনাবাহিনীর দীর্ঘ যুদ্ধ, সামরিক সাফল্যের বলি কিছু নিষ্পাপ
নাগরিক, কিছু সাধারণ মানুষ। ব্লু-স্টারের পাঁচ মাসের মধ্যেই, অক্টোবরের ৩১শে, ভারতের
একমাত্র মহিলা প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর অ্যাসাসিনেশন - যেদিন সকালে দুই দেহরক্ষী
- কনস্টেবল সৎবন্ত সিং, সাব-ইন্সপেক্টর বিয়ন্ত
সিং-এর গুলিতে ঝাঁঝরা হয়ে যাবেন প্রিয়দর্শিনী। ফলশ্রুতিতে পরের ৩ দিন ধরে দিল্লী ও
পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে ভয়াবহ শিখ-বিদ্বেষী দাঙ্গা, লুঠতরাজ, গুরুদ্বারায় অগ্নিসংযোগ,
হানাহানি। যার ক্ষত এখনও পুরোপুরি নিরাময় হয়েছে এমন বলা শক্ত। কিন্তু এতেও যেন চুরাশির
দুর্ভাগ্যের দিনলিপির শেষ নেই। তেসরা ডিসেম্বর, ১৯৮৪ ভোপালের ইউনিয়ন কার্বাইড প্ল্যান্টের
দুর্ঘটনা। হাজার-হাজার মানুষের ঘুম ভাঙবে না পরের দিন সকালে। আরও বহু হাজার মানুষ আহত
নিহত হবেন, পদপিষ্ট হয়ে অথবা বিক্রিয়ার অন্যান্য বিষক্রিয়ায়। ইতিহাসের নিকৃষ্টতম শিল্প
বিপর্যয়।
এই নিবন্ধের মূল লক্ষ্য কিন্তু চুরাশির ইতিহাস নয়। আমাদের বিষয়
ইন্দিরা গান্ধীর হত্যাকাণ্ড, এবং তার ঠিক পরের কয়েকটি অন্ধকার দিন। অতএব, ফিরে যাচ্ছি
সেই চল্লিশ বছর আগেকার একদিন, ৩১শে অক্টোবর। ঠিকানা, ১ সফদরজং রোড। সময় সকাল ৯টা ২০।
একটি তথ্যচিত্রের জন্য সাক্ষাৎকার নেবেন বলে ১, আকবর রোডে অপেক্ষা করছেন পিটার ইউস্টিনভ।
সেই দিন প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গী তিনজন - কনস্টেবল নারায়ণ সিং, পার্সোন্যাল সিকিওরিটি
অফিসার রামেশ্বর দয়াল, আর গান্ধীর ব্যক্তিগত সচিব - রাজিন্দর কুমার ধাওয়ান। সেই রক্তাক্ত
সকালের যে বর্ণনা সুপ্রিম কোর্টের আর্কাইভ থেকে আজ পড়তে পাচ্ছি, তা এই তিনজনের সাক্ষ্যর
উপর ভিত্তি করেই তৈরি। এই সাক্ষ্যের ভিত্তিতেই বিচার হবে হত্যাকারী ও ষড়যন্ত্রকারীদের,
কিন্তু সে কথায় পরে আসছি। আপাতত, দেহরক্ষীদের সাক্ষ্য থেকে যে চলচ্ছবিটি ফুটে উঠছে
সেইটুকু রাখা যাক।
হেড-কনস্টেবল নারায়ণ সিং-এর বয়ান অনুযায়ী, তিনি ঘটনার দিন সকাল
সাড়ে সাতটা থেকেই ডিউটিতে ছিলেন। পৌনে নটা নাগাদ জানতে পারেন প্রধানমন্ত্রীকে ১, আকবর
রোডে যেতে হবে একজন বিদেশী টিভির প্রতিনিধির সাথে কথা বলতে। নারায়ণ সিং একটি ছাতা হাতে
অপেক্ষা করতে থাকেন প্রধানমন্ত্রীর জন্য। ঠিক নটা বেজে দশ মিনিটে শ্রীমতী গান্ধীর দেখা
পাওয়া যায়, সঙ্গে সচিব আর কে ধাওয়ান ও নাথুরাম। দিল্লির সূর্য তখন-ও মধ্যগগনে যেতে
কিঞ্চিত দেরি। ছাতা হাতে নারায়ণ সিং শ্রীমতী গান্ধীর ডানদিকে চলে আসেন যাতে সরাসরি
রোদ্দুর এসে ওঁর গায়ে না পড়ে। দুই বাংলোর মাঝের করিডর পেরিয়ে হাঁটছেন ওঁরা। ১, আকবর
রোডের লনে ক্যামেরার দল যন্ত্রপাতি নিয়ে তৈরী, প্রধানমন্ত্রীর মিডিয়া অ্যাডভাইজর শারদা
প্রসাদ সেখানে পৌঁছে গেছেন শেষ মূহুর্তের খুঁটিনাটি দেখে নিতে। সুরক্ষার দায়িত্বে থাকা
আরও একজন - রামেশ্বর দয়াল, ততোক্ষণে প্রধানমন্ত্রীর বাসগৃহ থেকে জলের থার্মোস, চশমা,
হাত-মুখ মোছার ন্যাপকিন নিয়ে, বাংলোর মালিকে বলছেন একটি "গুলদস্তা" বানিয়ে
রাখতে বলে, যোগ দিচ্ছেন শ্রীমতী গান্ধীর সঙ্গে। বাতাসে শীতের অল্প কামড়, রাস্তার ওপারে
শিমূল গাছ ভরে উঠেছে ফুলে। আসন্ন বিপদের কথা মাথায় নেই কারুর-ই। হয়তো সেই জন্যেই সতর্কতাবাণী
অবজ্ঞা করেই বুলেট প্রুফ ভেস্ট পরেননি শ্রীমতী গান্ধী সেদিন?
টিএমসি গেটের কাছে তখন অপেক্ষা করছেন সৎবন্ত সিং ও বিয়ন্ত সিং।
ঠিক ১০-১১ ফুট দূরে যখন পৌঁছলেন ইন্দিরা, বিয়ন্ত সিং নিজের ০.৩৮ সার্ভিস রিভলভারের
চেম্বার নিঃশেষ করে দিলেন, পর পর পাঁচবার গুলি পয়েন্ট ব্ল্যাঙ্ক রেঞ্জ থেকে। শ্রীমতী
গান্ধী মাটিতে পড়ে যেতেই দ্বিতীয় আততায়ী সৎবন্ত সিং স্টেনগান থেকে মুহুর্মুহু গুলিবর্ষণ
করতে শুরু করলেন - পরপর তিরিশ রাউণ্ড। গুলিবৃষ্টি চলতে সময় লাগলো হয়তো বড়জোর দুই মিনিট।
বয়ান অনুযায়ী, এই সময়ের মধ্যেই একটি গুলি কোথাও ধাক্কা খেয়ে ছিটকে
এসে লাগে রামেশ্বর দয়ালের পায়ে। সেই অবস্থাতেও দয়াল দৌড়ে যান শ্রীমতী গান্ধীর দিকে।
নারায়ণ সিং হাতের ছাতা ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে, রিভলভার নিয়ে ছুটে যান বিয়ন্তের দিকে। দুই
আততায়ী ততক্ষণে আত্মসমর্পণের ভঙ্গিতে হাত তুলে দিয়েছেন। নিজের ওয়াকি-টকিটিকে একটি বেড়ায়
ঝুলিয়ে দিয়ে বিয়ন্ত বলেছেন, 'I have done what I had to do. Now you do what you
like.' ... ততক্ষণে ইন্দো-তিবেতান বর্ডার পুলিশ (আইটিবিপি)-এর দুই জওয়ান-ও ছুটে এসেছেন
ঘটনাস্থলে। আততায়ীদের নিয়ে একটি 'গার্ড রুমে'র দিকে নিয়ে গেলেন ইন্সপেকটর টি-এস জামওয়াল ও কনস্টেবল রাম শরণ।
ওদিকে কর্তব্যরত ডাক্তারবাবু, ডঃ ওপাই, ততক্ষণে ছুটে এসেছেন অকুস্থলে।
ছুটে এসেছেন পুত্রবধূ সোনিয়া গান্ধী। শ্রীমতী গান্ধীর বুলেটবিদ্ধ দেহ নিয়ে এইমসের দিকে
ছুটলো গাড়ি। পিছনের আসনে সোনিয়া। সামনে মিঃ ধাওয়ান, মিঃ ভট্ট আর মিঃ ফোটেদার। সেইখানেই
অল্পক্ষণ পরে পৌঁছবেন নারায়ণ সিং, তার সাক্ষ্যটিও সেইখানেই নেওয়া।
সাক্ষীদের বয়ানে এইমসের চিকিৎসকদের যুদ্ধের কথা নেই। সেই ইতিহাস
পুনরাবৃত্তি করে লাভ নেই। একটি সূত্র অনুযায়ী, এইমসে পৌঁছতে পৌঁছতেই তিনি বস্তুত মৃত-ই,
তবু, হার্ট-লাং বাই-পাসের সাহায্য নিয়ে মরণপণ যুদ্ধ চলে প্রায় চার ঘন্টা। খরচ হয় ৮৮
বোতল রক্ত। শেষমেশ ২.৩০টের সময় "ক্লিনিক্যালি" ডেড ঘোষণা করা হয় ভারতবর্ষের
প্রথম মহিলা প্রধানমন্ত্রীকে।
দিল্লি শহরে ততোক্ষণে একটু একটু করে ছড়িয়ে পড়ছে এই সাঙ্ঘাতিক খবর
- সঙ্গে সাম্প্রদায়িক উস্কানি, যেন দাঙ্গার প্রস্তুতি নিচ্ছে বহু রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের
সাক্ষী এই শহর। পুরোনো খবর ঘাঁটতে গিয়ে দেখছি, সেইদিন বিদেশ সফর তাড়াতাড়ি শেষ করে রাষ্ট্রপতির
কনভয় যখন অরবিন্দ মার্গে ইন্সটিটিউটের রাস্তায় বাঁক নিচ্ছে, রাস্তায় তখনই জ্বলছে একটি
মোটরবাইক। গোটা দেশে আগুন ছড়িয়ে পড়ার ফোরশ্যাডো?
আততায়ীদের মধ্যে যিনি প্রথম গুলি চালিয়েছিলেন, বিয়ন্ত সিং সেইদিন-ই
মারা যান আইটিপিবির কম্যান্ডোদের গুলিতে। বিয়ন্ত ন' বছর চিনতেন শ্রীমতী গান্ধীকে। আর
অন্যজন? আইটিপিবির লোকের বক্তব্য অনুযায়ী, গার্ড রুমের ভেতরেই আততায়ীরা হাতিয়ার কেড়ে
নেওয়ার চেষ্টা করায় গুলি চালাতে বাধ্য হন ওঁরা, যদিও সত্যিই কী ঘটেছিল তা জানার উপায়
নেই। বিয়ন্ত মারা গেলেও সৎবন্ত সিং প্রাণে বেঁচে যান আশ্চর্যজনকভাবেই। ১৭ রাউণ্ড গুলির
পরেও। দুই সহ-ষড়যন্ত্রকারী বলবীর সিং ও কেহার সিং-কে গ্রেফতার করা হয় অবিলম্বেই। হাই
কোর্টের বিচারে তিনজনেই দোষী সাব্যস্ত হলেও, শেষ অব্দি সুপ্রিম কোর্টের রায়ে মৃত্যুদণ্ড
থেকে অব্যাহতি পান বলবীর।
ভবিষ্যতদ্রষ্টা ছিলেন ইন্দিরা এমন দাবী কেউ-ই হয়তো করবেন না, হ'লে
হয়তো আরেকটু সাবধান হতেন। হয়তো ... তবুও একটি ছোট্ট ঘটনা উল্লেখ না করে পারা যায় না।
অ্যাসাসিনেশনের কিছুদিন আগে গান্ধীর সুরক্ষা উপদেষ্টা রামজি নাথ কাও প্রধানমন্ত্রীকে
উপদেশ দেন সুরক্ষা বাড়াতে। কাও চেয়েছিলেন বাসগৃহ আর পাঁচিলের মধ্যের লনে কিছু মাটির
স্তূপ বানাতে - যাতে বাইরে থেকে বিস্ফোরক কিছু ছুঁড়ে দিলেও অভিঘাত কম হয় কিছুটা। ইন্দিরা
নাকি সেই সব উপদেশ হেসে উড়িয়ে দিয়ে বলেছিলেন, 'When they come to kill me nothing
would help. Those supposed to save me will be the first to run away.'
--- ২
---
সরকারি হিসেবমতে ইন্দিরা গান্ধীর হত্যাকাণ্ডের পরেই যে শিখ-নিধন
যজ্ঞ চলে গোটা দেশ জুড়ে, তার জেরে শুধু দিল্লিতেই নিহত হন প্রায় ২,৮০০ শিখ ধর্মাবলম্বী
মানুষ, আর গোটা দেশে ৩,৩৫০। বেসরকারি হিসেবে সংখ্যাটা আরও অনেক বেশি ৮-১৭ হাজারের কাছাকাছি।
কংগ্রেস এম-পি সজ্জন কুমারের যাবজ্জীবন কারাবাসের দণ্ডাদেশ দেওয়ার সময় দিল্লি হাইকোর্টের
রায়ে বলা হয় '৮৪-র নভেম্বরের শুরুর সেই গণহত্যা, হ্যাঁ গণহত্যা-ই, মানবিকতার বিরুদ্ধে
অপরাধ, ক্রাইম এগেইন্সট হিউম্যানিটি। আর এও বলা হয় সেই রায়ে, যে দাঙ্গার, পোগ্রোমের
খবর জেনেও তৎকালীন দিল্লীর সরকার কার্যত কিছুই করেন নি রুখতে। আসলে হয়তো আরও বেশিই
কিছু। দাঙ্গাবাজদের, হত্যাকারীদের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ মদতের কথা সবাই জানে আজ চল্লিশ
বছর পরে। দিল্লি হাইকোর্টের রায়ে স্পষ্ট লেখা, “the criminals responsible for the
mass crimes have enjoyed political patronage and managed to evade prosecution
and punishment.”
সেই দিনের প্রত্যক্ষদর্শী, অথবা তাদের উত্তর-প্রজন্মের কাছে '৮৪-র
সেই দিনের ক্ষত এই চল্লিশ বছর পরেও স্পষ্ট, আতঙ্কের স্মৃতি হয়তো কোনোদিন-ই তামাদি হয়
না, কে জানে।
আমার নিজের পড়া দুজন মানুষের লেখায় সেই সময়ের স্মৃতি তুলে আনি
সামান্য। প্রথমজন বিখ্যাত লেখক অমিতাভ ঘোষ। ইন্দিরা-হত্যার সময় তিনি আঠাশ বছর বয়সী
নবীন লেখক। ডিফেন্স কলোনির একটি ছোট্ট বাড়ির টঙে বসে লিখে চলেছেন প্রথম নভেল। সদ্য
অক্সফোর্ড থেকে ফিরে দিল্লী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপনার কাজে যোগ দিয়েছেন। ৩১শে অক্টোবরের
সকালে, যখন বিয়ন্ত-সতবন্তের গুলিতে ভূপতিত হচ্ছেন শ্রীমতী গান্ধী, তখনই বাসে চড়ে ভার্সিটি
যাচ্ছেন অমিতাভ। রাস্তায়, ক্যাম্পাসে অল্প গুঞ্জন, ছাত্রদের সামান্য চাঞ্চল্য - ছাড়া
তেমন কিছুই নেই সেই সকালে।
খবর ছড়াতে ছড়াতে দুপুর, করাচি রেডিও ১.৩০টায় প্রথম খবর দিচ্ছে
মৃত্যুর সম্ভাবনার, এইমসের ঘোষণা তখনো দেরি, কিন্তু লোক-ক্ষ্যাপানো শুরু হয়ে গেছে ততোক্ষণে,
এইমস-চত্ত্বর এর মধ্যেই উত্তপ্ত, জ্ঞানী জৈল সিং-এর মোটোরকেড আক্রান্ত রাস্তায়। আক্রান্ত,
কারণ রাষ্ট্রপতি হলেও তিনি শিখ।
অমিতাভ সেদিন যাচ্ছেন সফদরজং অনক্লেভে, বন্ধু হরি সেন-এর বাড়ি,
কনট প্লেস থেকে বাস চলেছে রিং রোড ধরে। দাঙ্গার
মেঘ ঘনাচ্ছে আকাশে, একে-একে দোকান বন্ধ হচ্ছে, 'নিবিছে দেউটি'। সেই বাসেই আচমকা দৌড়ে
উঠে পড়লেন একজন সাদামাটা পোষাকের মানুষ। উঠেই খেয়াল হ'ল, ভিড় বাসে তিনি একাই শিখ, এবং
সেই বাসের রাস্তায় পড়বে এইমসের চত্ত্বর। বাস সেইদিকে যেতে যেতেই রাস্তায় চোখে পড়ছে
উন্মত্ত রক্তচক্ষু জনতার ভিড়, তাদের পরনে বোতাম-খোলা সিন্থেটিক শার্ট, হাতে রড, সাইকেলের
চেন। রাস্তায় দাঁড়িয়ে সেই মব এক এক করে থামাচ্ছে সব গাড়ি, বাস। চিৎকার করে জিজ্ঞেস
করছে প্যাসেঞ্জারদের কেউ শিখ কি না। উপস্থিত বুদ্ধি দেখালেন বাসের-ই এক সহযাত্রিনী
মহিলা। ইশারায় সেই শিখ ভদ্রলোক-কে বললেন চুপ করে দুই সিটের মাঝে বসে পড়ে লুকিয়ে থাকতে,
যেন বাইরে থেকে নজরে না পড়ে। যথারীতি মব এসে ঘিরে ধরলো বাসটিকে, ড্রাইভার বললো নাঃ
বাসে কোনো শিখ ওঠেননি সেদিন, বাকিরাও চিৎকার করে সায় দিলেন না না কেউ নেই, যেতে দিন,
বাড়ি ফেরার তাড়া। বাইরে থেকে লম্ফ-ঝম্প করেও কাউকে দেখতে না পেয়ে একটু পরেই রিং রোড
দিয়ে দিল্লীর মফস্বলের দিকে দৌড় লাগালো বাস। দুই সিটের মধ্যে কোনোরকমে জড়সড়ো হয়ে বসা
সেই শিখ ভদ্রলোক তখন নিশ্চুপ, নিস্পন্দ, যেমন নিস্পন্দ হয়ে গেছেন বাসের বাকি সবাই।
পরের দিন সকাল হতে দেখা গেলো কাছে-দূরে-বহুদূরে যতদূর চোখ যায়, আগুন জ্বলছে বিভিন্ন শিখ এলাকায়, কারুর বাড়ি, কারুর দোকান, কোথাও কোনো গুরুদ্বারা। সেইসব আগুনের ধোয়াঁর স্তম্ভ দিল্লির আকাশে মিশে যেন তৈরী হচ্ছে বীভৎস কোনো কুনাট্যরঙ্গের স্তম্ভসজ্জা। বেলা বাড়তে বাড়তে শোনা যেতে লাগলো হত্যাকারীদের গাড়ির আওয়াজ। অস্ত্র হাতে, কেরোসিন মশাল কিংবা পেট্রোল ক্যান হাতে দাঙ্গাবাজদের দল শহরে টহল দিতে শুরু করেছে তখন, কেউ টেম্পো, কেউ বাইক, কেউ ট্রাক। অভিযোগ, দাঙ্গার অভিমুখ সেদিন এলোমেলো, বিচ্ছিন্ন না হয়ে যাতে ধাবিত হয় একটি নির্দিষ্ট সম্প্রদায়ের দিকেই, তাই এই গোটা হত্যাকাণ্ড-ই ছিল অভাবনীয় রকমের গোছানো, পরিকল্পিত, অর্গানাইজড। সেই অর্গানাইজার-রা শহর ঘুরে ঘুরে দাঙ্গাবাজদের মবদের দেখিয়ে দিচ্ছিলেন কোথায় কোথায় যেতে হবে, পৌঁছেও দিচ্ছিলেন সেখানে। বিনামূল্যেই। দাঙ্গাবাজদের মূল লক্ষ ছিল যুবক শিখ সম্প্রদায়, তাদের টেনে-হিঁচড়ে রাস্তায় ফেলে পিটিয়ে আগুনে জ্বালিয়ে দিয়ে প্রতিশোধ মেটাচ্ছিল সেই উন্মত্ত হিংস্র জনতা। এই সময়ের জ্বলন্ত দলিল লিখেছিলেন একদল সমাজবিজ্ঞানী - বীণা দাস, রাধা কুমার, ললিতা রামদাস, মিতা বোস - নাম "হু আর দ্য গিলটি?" (দোষী কে?)। সেই বইয়ের শুরুতেই লেখা - কর্তৃপক্ষ যে হত্যাকান্ডকে মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত রাগের, উন্মাদনার বহিঃপ্রকাশ বলে চালাতে চাইছেন, আসলে তা মোটেও স্বতঃস্ফূর্ত নয়, পুরোপুরি অর্গানাইজড হলোকস্ট - "handiwork of a determined group"। এখানে এটা বলে রাখা দরকার যে ভারতবর্ষের কোথাও কখনোই সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বাধলে বা সংখ্যালঘুদের নিশানা করে হিংসাত্মক ঘটনা ঘটলে তার মোকাবিলা করার নির্দিষ্ট উপায় আছে - কার্ফিউ ঘোষণা, প্যারামিলিটারি ট্রুপ নামানো, এবং তাতেও কাজ না হলে আর্মি ডিপ্লয় করা। দিল্লিতে সেই অভিশপ্ত দিনটিতে এর কোনোটাই হয়নি সময়মত। কোনো কোনো রাজ্যে, যেমন আমাদের বাংলায়, সরকারের দ্রুত হস্তক্ষেপে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে যেতে পারেনি।
দাঙ্গার পরপর-ই সমাজবিজ্ঞানীর দল সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন পাঁচটি
ভিন্ন গোষ্ঠীর লোকের - (১) দাঙ্গায় ক্ষতিগ্রস্ত মানুষ, হতাহত অথবা সর্বস্বান্ত (২)
পুলিশ অফিসার যাঁদের কথা ছিল দাঙ্গা থামাতে চেষ্টা করার (৩) দাঙ্গায় ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের
প্রতিবেশী যাঁরা আড়াল করতে চেয়েছিলেন শিখ প্রতিবেশীদের, (৪) রাজনৈতিক নেতা ও (৫) সেনাবাহিনীর
মানুষজন। দক্ষিণের মুনির্কা থেকে পশ্চিমের মঙ্গলপুরী কিংবা পূর্ব দিল্লীর ত্রিলোকপুরী
- দূরদূরান্তেও আক্রমণের অবিকল এক ধরণ, এক-ই ভাবে পরপর বিন্যস্ত ঘটনার ক্রম তুলে ধরেন
তারা। চটি বইটি এখনো আন্তর্জালে সহজলভ্য - পড়ে নিতে পারেন যে কেউ। তবে পড়তে পড়তে কেঁপে
উঠবেন, সন্দেহ নেই। সেই রিপোর্টের এক টুকরো নিচে দিলাম।
"In a large hall of the Shakurpur Camp housing the Sultanpuri victims of the carnage sit a row of women and children huddled together with shock and grief inscribed on every part of their beings. There is not a single boy of over ten years in the group and boys are rare. Each group consists of a woman of the older generation, three or four young widows, a few adolescent girls and the rest are children, ranging from ten years to nursing infants. One such household consists of 18 people rendered absolutely destitute with not a single earning member left; all four adult males have been murdered. Two of the younger women have new born babies, one six day old (it was born a day before the killings) and another 10 days old. They stared blankly into space holding the babies in their arms too dazed to speak or even mourn. But the older woman who had lost her husband and three sons gave vent to her grief bitterly "ab to sabse accha yeh hoga ki aap ham sab ko jahar dila dain; ab ham ji nahin sakte; kaise jiyenge, kis ke liye jiyenge?" (It would be best to give us all poison, how will we live and for whom?).
She was
voicing the sentiment of many of the women present, all of whom had watched
their men folk being attacked and cut down, then doused with kerosene and set
ablaze. Not one of these were willing to consider returning to their original
homes after the brutal massacre they had lived through. How can they even think
of it unless the guilty are identified and punished?"
প্রতিবেশীদের ভূমিকা কেমন ছিল সেই নিয়ে সাদাকালো উত্তর বোধহয় আজ
আর দেওয়া সম্ভব না। সাক্ষ্যপ্রমাণ বলছে কোথাও কোথাও যেমন শিখ প্রতিবেশীদের আড়াল করার
অপরাধে ঘর জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছিল হিন্দু মানুষের, তেমনিই আজাদপুরের হিন্দু মালিকের
কারখানায় আশ্রয় নিয়ে প্রাণে বেঁচে যান দুইটি পরিবার, আবার ঐ এক-ই সাক্ষ্যপ্রমাণের দস্তাবেজের
আরেক পাতায় আছে মর্মন্তুদ বর্ণনা, গুরগাঁও-এর এক ভিক্টিম দেখেন, পাড়ার মানুষ ছাদে উঠে
দেখছিল আমাদের ঘরবাড়ি কেমন জ্বলছে, যেন প্রজাতন্ত্র দিবসের প্যারেড দেখছেন। বীণা দাসের
বর্ণনায় আছে এক হতভাগ্য মায়ের কথা, যার স্বামী-পুত্র জনতার হাত থেকে বাঁচতে লুকিয়ে
ছিলেন একটি পোড়োবাড়িতে, বাইরে তালা মেরে। প্রতিবেশীরাই ফাঁস করে দেন সেই খবর উন্মত্ত
জনতার কাছে। বাবাকে টেনে বের করে সেই বাড়িতে আগুন লাগিয়ে দেয় খুনে জনতা। পরের দিন দগ্ধ
বাড়ির ভেতর থেকে উদ্ধার হয় জড়াজড়ি করে থাকা দুই ভাইয়ের মৃতদেহ। আবার তার-ই বিপ্রতীপে
দাঁড়িয়ে থাকে ময়ূর বিহারের সেই যুবকের দল যারা সারা রাত জেগে পাহারা দেন ছত্রিশটি শিখ
পরিবারের। তেমনই, তাণ্ডবের দিনরাত্রিতে জিটি-কার্নাল
রোডে দিল্লী ইউনিভার্সিটির শিক্ষক-ছাত্রদের পাহারায় বেঁচে যায় সেই অঞ্চলের কয়েক ঘর
শিখ পরিবার।
আমার মনে পড়ে ডিসি’র হলোকস্ট মিউজিয়মের ভেতরের অসংখ্য নিদর্শনের মধ্যে জেগে
থাকা, নাৎসি শাসনের ফলে উদবাস্তু ও হলোকস্ট-স্কলার রাউল হিলবার্গের সেই উক্তিটি,
“At crucial junctures, every individual makes decisions, … and every decision
is individual” …
এই অন্ধকার ইতিহাসের শেষে কোনো আলোক-বর্ত্তিকা নেই - উত্তরণের
অথবা আশাবাদের বাণীও নেই। বরং আশাবাদের চিহ্ন দেখতে পেলে ধরতে হবে সেটা মানসিক বিভ্রম।
কারণ আমরা জানি, সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষের নির্বিচার হত্যার ইতিহাস '৮৪-তে শুরু
নয়, শেষ-ও নয়। ২০১৮-র রায়ে লেখা, “The riots in early November 1984 – in which in
Delhi alone 2,733 Sikhs and nearly 3,350 all over the country were brutally
murdered [official figures], was neither the first instance of a mass crime
nor, tragically, the last […] there has been a familiar pattern of mass
killings in Mumbai in 1993, in Gujarat in 2002, in Kandhamযal, Odisha in 2008,
in Muzaffarnagar in UP in 2013 to name a few. Common to these mass crimes were
the targeting of minorities and the attacks spearheaded by the dominant
political actors being facilitated by the law enforcement agencies.”
আর কী জানি? জানি যে ইতিহাস বারংবার নিজেকে রিপিট করে। প্রথমে
ট্র্যাজেডি, তারপর পুনরাবৃত্ত ফার্স হিসেবে। তাই মনে করিয়ে দেওয়া যাক একটা সাঙ্ঘাতিক
আশঙ্কার কথা। সেই অভিশপ্ত দিনগুলোতে দাঙ্গার আগুন ছড়িয়ে পড়েছিল শাসকের প্রত্যক্ষ মদতে,
সন্দেহ নেই। এবং সেই আগুনে বাতাস ও অক্সিজেন সরবরাহ করেছিল একের পর এক ভুয়ো খবর - ফেক
নিউজ। মাস-কিলিং শুরু হওয়ার আগেই সুপরিকল্পিত ভাবে ছড়ানো হয়েছিল সেইসব ফেক নিউজ, কোথাও
কোথাও পুলিশের সক্রিয় সহযোগিতায়। প্রথমে রটানো হয় প্রধানমন্ত্রীর মৃত্যুতে মিষ্টি বিতরণ
করে, দীপ জ্বালিয়ে আনন্দ করছেন শিখ সম্প্রদায়ের মানুষ। তারপরে রটানো হয়, ট্রেন-বোঝাই
হিন্দু মানুষের মৃতদেহ নিয়ে একটি রেলগাড়ি এসে দাঁড়িয়েছে পুরোনো দিল্লির রেলস্টেশনে।
আর তারপর শেষ ও মোক্ষম গুজব, রটানো হয় পানীয় জলে নাকি বিষ মিশিয়ে দিয়েছে শিখ সম্প্রদায়ের
মানুষ - সেই গুজব রটাতে আবার পুলিশের লোক কোনো কোনো অঞ্চলে বাড়িতে বাড়িতে ফোন করে নিষেধ
করেন জল না খেতে। বলাই বাহুল্য, মিথ্যে এবং শেষের দুটো সরকারীভাবে অস্বীকার করা হলেও
যা ক্ষতি হওয়ার তা হয়েই গেছে চিরতরে।
কিন্তু আজ যে আমরা জানি যে এই সব, সব-ই গুজব ছিলো, বা গুজবের ফলে
প্রাণ গেছে আরও কত মানুষের, কত জায়গায়, কত সময়ে, কত অবিশ্বাস্য মিথ্যায়, আমরা শিখেছি
কি কিস্যু? উত্তর একটি সশব্দে বোমা ফাটানোর মত “না”। তাই সেই ভুয়ো প্রাণঘাতী গুজবের
চারা গত চল্লিশ বছরে পরিণত হয়েছে বিষবৃক্ষে, সাম্প্রদায়িক হিংসা হানাহানি এখন এতোই
স্বাভাবিক হয়ে গেছে যে, যে খবর দেখে এক সময় মানুষ আঁতকে উঠতো, আজ সেই খবর সে রাস্তায়
বর্জ্যপদার্থের মত এড়িয়ে চলে যায়। এই নর্মালাইজড ঘৃণার দিনকালে আর কিছুই তাকে নাড়ায়
না।
তার জীবনের একমাত্র ও প্রধান ট্র্যাজেডি - সে জানেও না সে ফায়ারিং
স্কোয়াডের উদ্যত নলের সামনেই দাঁড়িয়ে জীবন কাটাচ্ছে, এবং এই ঘৃণার, এই মিথ্যার পাঁচিল টপকে সূর্যোদয়
আর কোনোদিন-ই তার ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য হবে না।
---
পুনশ্চ
এই নিবন্ধের লেখকের জন্মও এই '৮৪ সালেই। ইন্দিরা গান্ধী হতাকাণ্ডের
সময় বয়স তার মাত্র দুই মাস। তাই ব্যক্তিগত স্মৃতি থাকার সম্ভাবনা প্রায় নেই। তবু, আছে।
মনে আছে একটা ভয়ের গল্প, একজন সাধারণ মানুষ, পেশায় রেলের কর্মচারী, সেইদিন ডালহৌসি
থেকে দমদম হেঁটে ফিরেছিলেন কারণ রাস্তায় সব গাড়ি বন্ধ। দিকে দিকে অশান্তি, খুচরো দাঙ্গার
খবরে বাতাস সামান্য ভারী। তাঁর স্ত্রী একলা বাড়িতে ছোট্ট দুই শিশু নিয়ে চিন্তায় আকুল,
কারণ ঐ রেল-কর্মচারী ভদ্রলোকের মুখে চাপ-দাড়ি। চেহারাও গড়পড়তা বাঙালির থেকে দু-পোঁচ
বেশি শক্তপোক্ত, দু-পোঁচ যেন ফর্সা। যদি কেউ ভুল করে ফেলে? কোনো হিংস্র মবের মুখে পড়ে
যান ঐ যুবক? পড়েননি। তাও, সেইদিন রাত বারোটায় বাড়ি ফিরেছিলেন কোনো মতে। পড়েননি, তাই
দু-মাস বয়সে পিতৃহীন হন'নি এই লেখক।
---
সূত্র
১)
https://news.abplive.com/news/india/indira-gandhi-assassination-case-what-key-witnesses-told-mahesh-chandra-court-supreme-court-abpp-1719957
২)
https://www.theweek.in/news/india/indira-gandhi-death-anniversary-assaciation.html
৩)
https://www.indiatoday.in/mail-today/story/the-last-walk-indira-gandhis-last-morning-as-the-pm-179393-2014-02-02
৪) https://en.wikipedia.org/wiki/Assassination_of_Indira_Gandhi
৫) "Who are the Guilty?" URL: http://www.unipune.ac.in/snc/cssh/humanrights/04%20COMMUNAL%20RIOTS/B%20-%20ANTI%20-%20SIKH%20RIOTS/01%20-%20DELHI/a.pdf
৬) Ghosh, A. (2002). The ghosts of Mrs.
Gandhi. The Imam and the Indian. pp.
46-62.
Comments
Post a Comment